মহান ইমাম আবু বকর বায়হাকি রহ. (মৃত্যু: ৪৫৮ হিজরি) বলেন,
‘অবশেষে আক্রমণ এসে পৌছলো আমাদের শাইখ আবুল হাসান আশআরির দিকে। তিনি আল্লাহর দীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করেননি এবং কোনো বিদআত আনয়ন করেননি। বরং তিনি উসুলুদ দীন (দীনের মৌলিক বিধান অর্থাৎ আকিদা)-এর ক্ষেত্রে সাহাবা তাবেয়িন এবং তৎপরবর্তী ইমামগণের মতামত গ্রহণ করেছেন। তিনি আরও বিস্তর ব্যাখ্যা এবং সুস্পষ্টকরণের মাধ্যমে এগুলো পরিপুষ্ট করেছেন। উসুলুদ দীনের ব্যাপারে তিনি যা-কিছু বলেছেন এবং শরিয়াহ যে-সকল বিধান প্রদান করেছে, তা সবই আকলের বিচারে সহিহ। বিষয়টি তেমন নয়, যেমন প্রবৃত্তিপূজারীরা দাবি করে থাকে যে, তার কিছু কিছু বিষয় বিবেচনার আলোকে ঠিক নয়। তার আলোচনায় ছিলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর প্রমাণাদির সুদৃঢ়তা এবং তার পূর্বে গত হওয়া ইমামগণের বক্তব্যের সমর্থন—যেমন কুফাবাসীদের মধ্য থেকে ইমাম আবু হানিফা, সুফয়ান সাওরি; শামবাসীদের মধ্য থেকে আওযায়ি এবং অন্যান্যরা, হারামাইনাবাসীদের মধ্য থেকে ইমাম মালিক, শাফেয়ি এবং হিজায ও অন্যান্য অঞ্চলের যারা তাদের ধারায় চলেছেন, আহলুল হাদিসের মধ্য থেকে আহমাদ ইবনু হাম্বাল প্রমুখ, আহলুল আসার এবং সুন্নাহ, যার ওপর শরিয়াহর ভিত্তি, এর সংরক্ষকদের মধ্য থেকে ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম। পূর্বের যুগে এবং পরবর্তী যুগে এই উম্মাহর যে-সকল ইমাম মোকাবেলা করেছেন এবং আহলুস সুন্নাহর যারা ইলমে বিশেষ স্থান অধিকৃত করেছেন, এটা তাদেরই ধারা।’ {তাবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ আলকুবরা; তাবয়িনু কাযিবিল মুফতারি: ১০৩}
ইমাম তাজুদ-দীন সুবকি তার উস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনু মুসা আল-মায়ুরকি থেকে উদ্ধৃত করেন,
‘আহলুস সুন্নাহর ভাষায় কালামকারীদের মধ্যে আবুল হাসানই প্রথম নন। তিনি অন্যদের আদর্শের ওপর এবং পরিচিত মাযহাবের ওপরই চলেছেন। তিনি মাযহাবের বয়ান এবং প্রমাণকে বৃদ্ধি করেছেন। তিনি এমন কোনো বক্তব্য উদ্ভাবন করেননি, যা নিজের থেকে আবিষ্কার করেছেন এবং এমন কোনো মাযহাব উদ্ভাবন করেননি, যা তিনি একাই গঠন করেছেন।’
তিনি আরও বলেন,
‘তোমরা জেনে রাখো যে, ইমাম আবুল হাসান আশআরি ইলমুল কালামের শুধু সে অংশই নিয়েছেন, যা দ্বারা তিনি সুন্নাহসমূহকে স্পষ্ট করতে এবং তার ওপর স্থিরতা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। …আবুল হাসান আশআরি সত্যের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিতদেরই একজন। আমি ইনসাফকারী কাউকে দেখিনি, যিনি তাকে এই মর্যাদা থেকে পিছিয়ে দিয়েছেন এবং তার ওপর তার সমকালীন অন্য কাউকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার পরবর্তী হকপন্থীরা তার পথেই চলেছে। …ইমাম আশআরি যেদিন মৃত্যুবরণ করেছেন, সেদিন আহলুস সুন্নাহ তার মৃত্যুতে কেঁদেছে বিদআতিরা তার থেকে পরিত্রাণ পেয়ে আত্মপ্রশান্ত হয়েছে।’
শাইখ আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ইবনু আবি যায়দ রহ. বলেন,
‘আশআরি তো বিদআতি জাহমিয়া এবং কাদরিয়াদের মতবাদ-খণ্ডনকারীদের মধ্যে একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছাড়া আর কিছু নন, যিনি সুন্নাহর একজন ধারক ছিলেন। {তাবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ আল-কুবরা: ৩/৩৬৭}
এবার আসি তাবিলের ‘বিদআত’ প্রসঙ্গে
অপবাদ আরোপ করা হয়, তাবিলের সূচনা নাকি তার দ্বারাই হয়েছে। আচ্ছা, আমরা একটু পেছনের দিকে ফিরে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারি।
‘যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচন করা হবে’। {সুরা আল-কলম: ৪২} এই আয়াতের তাফসিরে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা., মুজাহিদ, সাইদ ইবনু জুবাইর, কাতাদা প্রমুখগণ প্রচণ্ডতা দ্বারা তাবিল করেছেন। অধিকাংশ মুফাসসির এক্ষেত্রে তা-ই করেছেন। ইমাম হাকিম তার মুসতাদরাকে এই বর্ণনা উল্লেখ করে এটাকে সহিহ বলেছেন। ইমাম যাহাবিও তার সঙ্গে দ্বিমত করেননি।
‘অথবা তোমার প্রতিপালক আসবেন’। {সুরা আনআম: ১৫৮} আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস, যাহহাক এবং অন্যান্যরা এই আয়াতের তাবিল করেছেন ‘ধ্বংস এবং শাস্তি আসা’র দ্বারা। ইমাম কুরতুবি এটা উল্লেখ করেছেন। {তাফসিরে কুরতুবি: ৭/১৪৪}
‘এবং তোমার প্রতিপালক এসেছেন’। {সুরা আল-ফজর: ২২} ইমাম আহমাদ এই ‘প্রতিপালক আসা’কে ‘তার কুদরত আসা’ দ্বারা তাবিল করেছেন। ইমাম বাইহাকি তার সনদে এই বর্ণনাটিকে উল্লেখ করার পর বলেন, এটি একটি সহিহ সনদ। এ ব্যাপারে কোনো অস্পষ্টতা নেই। {আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১৪/৩৮৬}
আয়াতুল কুরসির অংশ ‘তার কুরসি আকাশসমূহ এবং পৃথিবী পরিব্যাপ্ত করে রয়েছে’। {সুরা আল-বাকারা} এই আয়াতের ‘কুরসি’কে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস, সাইদ ইবনু জুবাইর, মুজাহিদ, ইবনু জারির তাবারি প্রমুখ ‘ইলম’ দ্বারা তাবিল করেছেন। এই তাবিল উল্লেখ করেছেন, ইমাম বুখারি তার সহিহ গ্রন্থে, আবদুল্লাহ ইবনু আহমাদ তার কিতাবুস সুন্নাহয়, লালকাই তার শারহু উসুলি ই‘তিকাদি আহলিস সুন্নাহয়, বাইহাকি তার আল-আসমা ওয়াস-সিফাতে। এ ছাড়াও ইমাম বাগাবি, কুরতুমি, ইবনুল জাওযি, বাইযাবি, ইবনু আতিয়্যা, আবু হাইয়ান উন্দুলুসি, আবু মুহাম্মাদ মাক্কি কায়রাওয়ানি এবং মাওয়ারদি প্রমুখ উদ্ধৃত করেছেন। তারা এর পাশাপাশি অন্যান্য মত উল্লেখ করলেও এই তাবিলের প্রতি অস্বীকৃতি জানাননি।
‘আমি আকাশকে বানিয়েছি হাত দ্বারা’। {সুরা যারিয়াত: ৪৭} ইবনু আব্বাস, মুজাহিদ, কাতাদা, সুফয়ান, তাবারি, বাগাবি প্রমুখ এর তাবিল করেছেন ‘শক্তি’ দ্বারা।
‘সে দুয়া করতে থাকবে, অনন্তর আল্লাহ তাকে দেখে হাসবেন। যখন তিনি হাসবেন, তখন তাকে বলবেন তুমি জান্নাতে প্রবেশ করো।’ {সহিহ বুখারি: ৭৪৩৭; সহিহ মুসলিম: ১৮২} ইমাম বুখারি বলেন, ‘হাসা’ অর্থ ‘রহমত’ (দয়া)। {আল-আসমা ওয়াস-সিফাত, বাইহাকি: ২/৭২}
‘আল্লাহ তাআলা এমন দুই ব্যক্তিকে দেখে হাসেন, যাদের একজন অপরজনকে হত্যা করে আর তারা উভয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। …’। ইমাম ইবনু আবদিল বার বলেন, ‘আল্লাহ তাকে দেখে হাসেন অর্থ হলো, আল্লাহ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন দয়া সন্তুষ্টি ক্ষমা এবং মার্জনার সাথে। ‘হাসা’ শব্দটি এখানে রূপকার্থে। কারণ আল্লাহর থেকে হাসি হতে পারে না, যেমনটা মানুষের থেকে হয়। কারণ তার মতো কিছুই নেই। কোনো জিনিসই তার সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে না।’ {আল-ইসতিযকার: ১৪/২১৭}
নাযর ইবনু শুমাইল ‘আল্লাহ জাহান্নামে পা রাখবেন’-এই হাদিসের তাবিল করেছেন ‘তার ইলমে পূর্ব থেকেই যাদের কথা রয়েছে’ দ্বারা। {আল-আসমা ওয়াস-সিফাত, বাইহাকি: ২/১৯০; আকাওয়িলুস সিকাত: ১/১৭৮} ইমাম ইবনু জারির তাবারি তো ‘ইসতিওয়া’কেও তাবিল করেছেন। {দেখুন—তাফসিরে তাবারি: ১/৪৩০}
সালাফের মাযহাবের নামে নব্য সালাফিয়াতকে চালিয়ে দেয়া এবং আহলুস সুন্নাহর ইমামগণের নামে বিষোদগার করা যাদের নিত্যদিনের স্বভাব, কিয়ামাতের দিন আল্লাহর সামনে তারা কী জবাব দেবে? আমরা কাউকেই ভুলের উর্ধ্বে মনে করি না। আল্লাহর কসম, আমরা ইসলামের আলিমগণকে ভালোবাসি। এটা ধ্রুব সত্য। এর পাশাপাশি এটাও সত্য যে, আমরা যে-কোনো ব্যক্তির থেকে সত্যকে বেশি ভালোবাসি। কখনও সত্য কারও বিপক্ষে গেলে স্রেফ এ কারণেই আমরা তাঁর সম্মানের ওপর আক্রমণকে বৈধ মনে করি না। আল্লাহ তাআলা সম্মানকে হারাম করেছেন, যেভাবে তিনি জান-মালকে হারাম করেছেন।
মানুষের বেয়াদবিরও তো সীমা থাকে। নিজের মতবাদ প্রচার করা এক জিনিস আর উম্মাহর ইমামগণের সঙ্গে বেয়াদবি করা ভিন্ন জিনিস। সুন্দর মোড়ক পরিয়ে নিজের ভুল মতবাদকে তো উম্মাহর ইমামগণের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা ছাড়াও প্রচার করা যায়। কারও কারও আকলে সালিম এবং ইনসাফ হয়তো মরে গেছে। আল্লাহ হিদায়াত দান করুন।