আজ আমি গল্প বলবো। একজন পপস্টারের অসাধারণ আত্মত্যগের গল্প। খোদার রাহে তুলনাহীন কোরবানির নযরানা পেশ করার গল্প। এক ক্ষণজন্মা মহান দা‘য়ী ও বিশ্বখ্যাত সফল ইসলাম সংগীতশিল্পীর অকাল নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়ার বেদনীয় অবিস্মরণীয় গল্প।
৭ই ডিসেম্বর ২০১৬। পাকিস্থানের স্থানীয় সময় ৪টা বেজে ৪০ মিনিট। চিত্রলা থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখী পিআইএ বিমানের ফ্ল্যাইট ৬৬১ তখন অ্যাবোটাবাদের আকাশে। চিত্রলায় মাসতুরাতসহ দশ দিনের তাবলিগি সফর শেষ করে এ বিমানেই ইসলামাবাদের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন ইসলামি সংগীতাঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র জুনায়েদ জামাশেদ। সাথে আছেন স্ত্রী নেহা জুনায়েদ ও পরিবারের আরো ক’জন সদস্য। ভাগ্যের পরিহাসে হঠাৎ যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বিধ্বস্ত হয় পিআইএ বিমান। ঐতিহাসিক অ্যাবোটাবাদের একটি পাহাড়ে জ¦লেপুড়ে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন সাতচল্লিশজন যাত্রীর সবাই। তৈমুর জুনায়েদ এবং আয়েশা জুনায়েদ হারায় তাদের প্রিয় বাবাকে। আর আমরা হারাই লাখো-কোটি ভক্তের মনের কাবার প্রিয় শিল্পী জুনায়েদ জামশেদকে, মাত্র ৫২ বছর বয়সে নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি না ফেরার জগতে, পরমপ্রিয় আপন প্রভুর সান্নিধ্যে। ইথারে ইথারে রেখে যান আবেগমাখা সংগীতের সুমধুর ধ্বনির হৃদয়গ্রাহী গুঞ্জরণ, ভালোবাসার অনুরণন।
১৯৬৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বাবা জামশেদ আকবর খান ও মা নাফিসা আকবরের ঘর আলোকিত করে এ পৃথিবীতে আগমন করেন জুনায়েদ জামশেদ। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। ভাইদের নাম হুমায়ুন জামশেদ ও ওমর জামশেদ। একমাত্র বোনের নাম মুনিজা জামশেদ। বিমানবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জামশেদ আকবর খান ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং নিষ্ঠাবান। জুনায়েদ জামশেদ বলেন, “আমার বাবার পুরো সম্পদে কখনো একটি হারাম টাকার মিশ্রণ ঘটেনি। চার ভাই-বোনের সংসার তাই কিছুটা সংযমের সাথেই চলতো। তবুও বাবা তার জীবনে অবৈধ পস্থায় সম্পদ উপার্জনের চিন্তা কখনো মাথায় আনেননি।” বাবার আদর্শ ও সুখ্যাতি দেখে জুনায়েদ জামশেদও স্বপ্ন দেখেছিলেন, পড়ালেখা শেষ করে তিনিও হবেন আদর্শবান এয়ারফোর্স অফিসার, হবেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের পাইলট। চোখের দৃষ্টিজনিত সমস্যার কারণে তার এ স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে তিনি একজন পেশাদার প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে লাহোর প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্বিবদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পরে কিছুদিন একটি বেসামরিক চঅঋ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে কাজও করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই জুনায়েদ জামশেদ সুললিত কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। শখের বশেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। ১৯৮৩ সালের আগে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে সংগীতানুষ্ঠান করতে। এক্ষেত্রে রাহেল হায়াত ও নুসরত হোসেন তাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেন। ১৯৮৩ সালের পরে রাহেল হায়াতের থেকে নির্দেশনা পেয়ে জুনায়েদ কাজ শুরু করেন দলীয়ভাবে, যদিও কিছুটা সংক্ষিপ্তসারে। পাশাপাশি পড়ালেখার প্রতিও পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ রাখেন। ১৯৮৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রাহেল হায়াত ও শাহজাদ হাসানের সঙ্গে দেশাত্মবোধক গান ‘দিল দিল পাকিস্তান’ গাওয়ার মাধ্যমে দেশের প্রথম পপ ব্যান্ড ‘ভাইটাল সাইন’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই ব্রডকাস্টার ও প্রযোজক শোয়েব মনসুর ব্যান্ডের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তার ‘পিটিভি সংগীত স্টুডিও’র সাথে ‘ভাইটাল সাইনে’র একটি রেকর্ড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শোয়ের মনসুরের সহযোগিতায় মুক্তি পায় জুনায়েদ ব্যান্ডের প্রথম হিট অ্যালবাম ‘ভাইটাল সাইনস-১’। অ্যালবামের ‘দিল দিল পাকিস্তান’ এবং ‘তুম মিল গায়ে’ গান দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই একটি অ্যালবামই জুনায়েদ জামশেদকে আকাশচুম্বি খ্যাতি এনে দেয়। আর এর মাধ্যমে তার জীবনের মোড়ও ঘুরে যায়। পরিণত হন তিনি শৌখিন সংগীতসেবী থেকে একজন পেশাদার শিল্পীতে। ‘ভাইটাল সাইনস-১’ বাণিজ্যিক সাফল্যে পাকিস্তানের রক-সংগীত শিল্প বিকাশে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। প্রথম ঠরঃধষ ঝরমহং গায়ক ভোকালিস্ট হিসাবে জুনায়েদ তখন দেশব্যাপী প্রাধান্য ও জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন। কয়েকটি জনপ্রিয় ও হিট অ্যালবাম বের করার পরে জুনায়েদ জামশেদ নিজেকে ভাইটাল সাইন থেকে আলাদা করে নেন। নিজের একক ক্যারিয়ার গড়ার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। এতেও তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অজন করেন, ‘পাক সার যমিনে’ নিজেকে প্রথম পপস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিত হতে থাকেন। জুনায়েদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া বিশ্বের প্রতিটি দেশে আমি সংগীত পরিবেশন করেছি। প্রতিটা গানের বিনিময়ে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করেছি। পরিবারের সংযমের দিনও তখন শেষ হয়েছে। গাড়ি-বাড়ি সবই হয়েছে। অভাব ছিলো না কিছুরই। আমার গান তখন মানুষের মুখে মুখে। যেখানেই যাই, অন্যের কণ্ঠে নিজের পরিবেশিত গান শুনি। হৃদয়রাজ্যে বয়ে যায় তখন সুখ ও প্রশান্তির সমীরণ।’
জুনায়েদ জামশেদের গানের বিখ্যাত অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘মেরা দিল’ (১৯৯৩), ‘জুনায়েদ অব ভাইটাল সাইনস’ (১৯৯৪), ‘উস রাহ পর (১৯৯৯) এবং ‘দিল কি বাত’ (২০০২)। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সংগীত ‘‘কসম উস ওয়াকত কি’’ এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনী তাদের ‘‘পালাটনা ঝাপাটনা’’-এর জন্য এই খ্যাতিমান পপস্টারকেই নির্বাচন করে।
জুনায়েদ জামশেদের জনপ্রিয়তার যখন তুঙ্গে, একের পর এক হিট অ্যালবাম বেরুচ্ছে তখন হঠাৎ করেই তিনি সংগীত ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিলেন। ২০০২ সালে এক সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন, তিনি গানবাজনা ছেড়ে দিবেন। সাথে সাথে সংগীতাঙ্গনে ওঠে এক প্রলয়ংকারী ঝড়। অগনিত ভক্ত ও ফ্যান নিজেদের প্রিয়তম শিল্পীকে হারিয়ে শোকাহত হয়ে পড়ে। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাফরুল্লাহ জামালী জুনায়েদ জামশেদের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি তাকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে টেলিভিশনে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের জন্য আহ্বান করেন। জুনায়েদ বলেন, ‘‘স্যার, আমি তো গানবাজনা ছেড়ে দিয়েছি।’’ তিনি বলেন, ‘‘এটা কেমন কথা! তুমি আমার অনুরোধ রাখবে না?’’ কিছুক্ষণ ভেবে জুনায়েদ বলেন, ‘‘আচ্ছা, আমি আপনার অনুরোধ রাখতে পারি। তবে আপনাকেও আমার একটা শর্ত মানতে হবে।’’ তিনি বলেন, ‘‘কী শর্ত?’’ প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে জুনায়েদ বলেন, ‘‘এই গাওয়াই হবে আমার শেষ গাওয়া। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পরে গোটা জাতির সামনে আমি ঘোষণা করবো, আজ থেকে গানবাজনার সাথে আমি সম্পূর্ণরূপে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম।’’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে শর্ত মেনে নিলেন। ১৪ আগস্ট ২০০৩, জুনায়েদ জামশেদ আনুষ্ঠানিকভাবে চিরবিদায় নিলেন নিষিদ্ধ এ জগত থেকে। যে ‘দিল দিল পাকিস্তানে’র মাধ্যমে তার শিল্পীজীবনের সূচনা, সেই একই গানের মাধ্যমে তিনি পরিসমাপ্তি ঘটালেন নিজের সংগীতজীবনের। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখরে থেকেও খ্যাতি ও আলোকিত ভবিষ্যতের পরিবর্তে বেছে নিলেন তিনি ঈমানকে, লীন হলেন প্রিয়নবির প্রদর্শিত পথে। খ্যাতিমান এই পপস্টারের জীবনে কীভাবে এলো এই নাটকীয় পরিবর্তন? প্রত্যয়দীপ্ত এ সিদ্ধান্তের কারণে কী অসাধারণ আত্মত্যাগ ও কোরাবানির নযরানা তাকে পেশ করতে হয়েছে? হ্যাঁ, পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সে বিষয়ের প্রতিই সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো।
পাকিস্তানের খ্যাতিমান পপস্টার জুনায়েদ জামশেদ বিষণ্ণ মনে বসে আছেন। বাড়িতে মা ভীষণ অসুস্থ। অসুস্থতার প্রচণ্ডতায় অনেক কষ্ট পাচ্ছেন, বিছানায় কাতরাচ্ছেন। অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক। কিন্তু তার যে আর সাধ্য নেই। মায়ের পথ্যেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। ছেলে হয়েও নীরবে অশ্রু ঝরানো ছাড়া তিনি আর কিছুই করতে পারছেন না। এমন সময়ে ফোনটা বেজে ওঠলো।
‘‘হ্যালো, পপস্টার জুনায়েদ জামশেদ বলছেন?’’
‘‘জী, জুনায়েদ স্পিকিং।’’
‘‘পেপসি কোম্পানির পক্ষ থেকে বলছি। আপনি আমাদের একটি সং গাইবেন। বিনিময়ে আমরা আপনাকে চার কোটি টাকা অনার করবো।’’
অসুস্থ মায়ের কাতর চিত্র হৃদয়-ক্যানভাসে ভেসে ওঠলো। কিছুটা দোদুল্যমানতায় পড়ে গেলেন জুনায়েদ জামশেদ। কিন্তু আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত যার জীবন, সে কি আর পার্থিব মোহে পড়ে বিচ্যুত হতে পারে সরল পথ থেকে! জুনায়েদ কড়া ভাষায় না করে দিলেন। ওরা অনেক পীড়াপীড়ি করলো; কিন্তু তিনি আপন সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
জুনায়েদের তখন বড় কষ্টে যাচ্ছে দিন। হাতে নগদ টাকা যা ছিলো প্রায় সব শেষ। গাড়ি বিক্রি করেছেন তো সেই কবেই। সে অর্থে চলেছে কিছুদিন। এরপর বিক্রি করতে হলো শখের বাড়িটাও। এরমধ্যে বিভিন্ন শো-কনসার্টে সংগীত পরিবেশনের জন্য অফারের ধারাবাহিকতা তো চলছেই। একেক শো’র জন্য বরাদ্দ লাখ-লাখ টাকা। কিন্তু তিনি অনড়। ফের কিছুতেই আর পা বাড়াবেন না সেই নিষিদ্ধ অঙ্গনে। যতো কষ্টই বরণ করতে হোক, ত্যাগের যে নযরানাই তাকে পেশ করতে হোক, করে যাবেন সব সহাস্য বদনে। আরে, বেলাল-সোহাইব রা.দের আত্মত্যাগের সামনে এ যে একেবারেই নস্যি। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হলেন জুনায়েদ। অর্থাভাবে কলজের টুকরো ছেলে-মেয়েদুটোকে- তৈমুর জুনায়েদ ও আয়েশা জুনায়েদকে ছাড়িয়ে আনতে হলো স্কুল থেকে। তখনও সংসার চালানোর জন্য কোনো আয়ের খাতের ব্যবস্থা হয়নি। সর্বশেষে যেদিন পকেটে ছিলো মাত্র একশ টাকার একটি নোট, স্ত্রী নেহা জুনায়েদের দিকে তা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘এই আমার নগদ অর্থ শেষ। কাল থেকে সংসার কীভাবে চলবে জানি না।’’ স্ত্রীও ছিলেন সাহাবি আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তিনিও দীক্ষিত হয়েছিলেন দীনী তালীমে। স্বামীর এই দুর্দিনে তিনি তাকে শক্তি যুগিয়েছেন, দীনের পথে অবিচল থেকেই সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। নেহা জুনায়েদ বললেন, ‘‘এ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। যে আল্লাহ এতোদিন আমাদেরকে রিযিক দিয়েছেন, সে আল্লাহই এ দুর্দিনে আমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করবেন।’’ স্ত্রীর ঈমানদীপ্ত উত্তর শুনে জুনায়েদের হৃদয়রাজ্যে প্রশান্তির ¯িœগ্ধ সমীরণ বয়ে যায়। এরপরে নেহা জুনায়েদ স্ব-উদ্যোগে পাঞ্জাবি-পা’জামা বানিয়ে বিক্রির জন্য বাজারে পাঠাতে শুরু করেন। আল্লাহ তাদের এই ত্যাগদীপ্ত উদ্যোগে এতোটাই বরকত দান করেন, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে সফরকালে জুনায়েদ বলেন, ‘‘সারা পাকিস্তানে এখন আমার ৪৫টা শোরুম আছে। কোনটা কোথায় তাও আমি জানি না। নিজে গিয়ে সেগুলোর তদারকিরও প্রয়োজন পড়ে না। মাস শেষে ব্যাংক একাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টাকা চলে আসে। দুর্দিনের পরে মহান আল্লাহ ফের এনেছেন সোনালি সুদিন। তাছাড়া আমি এখন পুরোই অবসর। প্রায় সারাবছর আল্লাহর রাস্তায় তাবলিগে সময় লাগাচ্ছি। দাওয়াতের কাজে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর লাভ করছি আল্লাহর মহব্বত ও লক্ষ-কোটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা’’
নিজের পরিবর্তন সম্পর্কে জুনায়েদ জামশেদ বলেন, ‘‘১৯৯৭ সালের অক্টোবরে আমার এক বন্ধ’র সাথে তাবলিগ জামাতে মাত্র তিনদিন সময় অতিবাহিত করি। এটা আমার জীবনের সবচে অবিস্মরণীয় ঘটনা। এরপর আল্লাহর অনুগ্রহে আমার ভেতরে বোধ ও উপলব্ধি জাগ্রত হয় যে, সারাটা জীবন আমি তো বিরাট ভুলের মধ্যে কাটাচ্ছি। অবিরল স্রষ্টার অবাধ্যতায় ডুবে আছি। আমাকে জীবনের মোড় পরিবর্তন করতেই হবে। গানবাজনা ছাড়াও জীবনের বড় কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে।’’
কিন্তু সংগীত যার পেশা, সংগীত যার নেশা, যার রক্তের কণায় কণায় মিশে আছে সংগীত তার জন্য সংগীত ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিলো অত্যন্ত কঠিন এবং অসম্ভবপ্রায়। জুনায়েদ সেই দিনকে স্মরণ করে বলেন, ‘‘আমি তখন ভীষণ বিষণ ছিলাম। তরঙ্গবিক্ষুক্ষ হৃদয়সাগর পুরো উতলে ওঠেছিলো। উথাল-পাথাল ঝড় বইছিলো হৃদয়রাজ্যে। কারণ সংগীত ছিলো আমার রক্তকনিকায়, ছিলো চামড়ার ভেতরে, ছিলো প্রতিটি লোমকুপের নিচে, যাতে আমি ছিলাম পুরোদমে অভ্যস্ত। কিন্তু আমি শুধু আল্লাহকে খুশি করতে চেয়েছি। আমি সেই ব্যক্তিটি হতে চাইনি, যাকে আল্লাহর কিতাবে মন্দ বলা হয়েছে।’’
শয়তানের অবিরাম প্ররোচনায় জুনায়েদের জন্য তখনই সংগীতাঙ্গনকে একেবারে বিদায় জানানো সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তার পরমপ্রিয় এক বন্ধুর লাগাতার তিন বছরের সাধনায় অবশেষে জুনায়েদ শত ব্যস্ততার মধ্যে সময় ফারিগ করে আরো একটি দিনের জন্য তাবলিগে সময় দেয়ার কথা মনস্থির করেন। বন্ধুর সাথে একদিনের সফরে বের হন জুনায়েদ। একদিন শেষ হলে বন্ধুর অনুরোধে আরো একদিন, এরপর আরো একদিন- এভাবে করতে করতে পুরো চল্লিশদিন আল্লাহর রাস্তায় কাটিয়ে বাড়ি ফিরেন জুনায়েদ। এ দীর্ঘ সময়ে তার মানসজগতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি দৃঢ়সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যে করেই হোক, সংগীতাঙ্গনকে বিদায় তিনি জানাবেনই। আগের পোশাক পরিবর্তন করে দেহে ধারণ করেন সুন্নতি লেবাস। দাড়ি একবার রাখেন, একবার কাটেন এভাবে চলছে। গানের পরিমাণও একেবারেই তখন কমিয়ে দিয়েছেন। এসময়ে মাওলানা তারেক জামিল সাহেব তাকে অভয় দেন। স্ত্রী নেহা জুনায়েদ সংগীতাঙ্গনের ব্যাপারে তাকে নিরৎসাহিত করেন, দীনের পথে অবিচল থাকার সাহস ও প্রেরণা যোগান। আর থাকে সেই বন্ধুটির নিরচ্ছিন্ন দাওয়াত ও মেহনত। এভাবে একপর্যায়ে জুনায়েদ জামশেদ ঈমানী বলে বলিয়ান হয়ে পুরো জাতির সামনে ঘোষণা করেন, ‘‘আজ থেকে ইসলামে নিষিদ্ধ এ অঙ্গণের সাথে আমি জুনায়েদ জামশেদ সম্পূর্ণরূপে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম।’’
এই পাহাড়সম সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তার কখনোই সে ব্যাপারে আফসোস হয়নি, পার্থিব জগতকে অম্লান বদনে লাথি মেরেও হৃদয়ে তার কোনো আক্ষেপ জাগেনি। জুনায়েদ বলেন, ‘‘আমার পূর্বের জীবনযাপনের কোনো দৃষ্টিভঙ্গিই এখন আর বাকি নেই। আমার নতুন জীবন খুব সরল, পবিত্র এবং সুন্দর। আমি অনুভব করি, আপনি যদি হিম্মত করে নিজ জীবনে আল্লাহর হুকুম এবং রাসুলের তরিকার ওপরে আমল করেন, তাহলে দুনিয়াতেই আপনার জীবন জান্নাতে পরিণত হবে।’’
এই নাটকীয় পরিবর্তন ও অসাধারণ আত্মত্যাগের পর আল্লাহ তার সুললিত কণ্ঠকেও দীনের খেদমতে কবুল করেন। শাইখুল ইসলাম মুকতি তকি উসমানী দা. বা. একদিন ফোন করে জুনায়েদ জামশেদকে দারুল উলুম করাচিতে ডেকে নেন। এরপর তিনি তার রচিত সাড়া জাগানো হামদ ‘‘এলাহি তেরি চৌকাঠ পর, ভিখারি বন কে আয়া হুঁ’’ জুনায়েদের হাতে তুলে দেন। নির্দেশ দেন, এটাকে সুন্দর করে গেয়ে রেকর্ড বাজারে ছড়িয়ে দিতে। হযরতের নির্দেশানুযায়ী জুনায়েদ হামদ রেকর্ড করে বাজারে ছাড়ার সাথে সাথেই সারাদেশে হৈ চৈ পড়ে যায়, ইসলামি অঙ্গনে তা ব্যাপক সাড়া জাগায়। এরপর হামদ-নাতের অ্যালবাম তৈরি করে বাজারে ছাড়লে ২০০৭ সালে তা সারা পৃথিবীতে উর্দু অ্যালবামের সর্বোচ্চ বিক্রির রেকর্ড ভঙ্গ করে। যে কণ্ঠে একসময় উচ্চারিত হতো ‘এইতেবার’, ‘উস রাহ পর’, ‘দিল কি বাত’, ‘সওলি সালোনি’, ‘ইয়ে শাম’, ‘তুম দূর থা’, ‘কেহ দো জো ভী’ ও ‘না তু আয়োগি’র মতো উচ্চাঙ্গের দেশ কাঁপানো সংগীত, সে কণ্ঠই খোদার প্রেমে উত্তাল হয়ে গেয়ে ওঠে ‘বদরুদ্দোজা শামসুদ্দোহা’, ‘মেহবুবে ইয়াজদান’, ‘মেরে দিল বদল দে’, ‘মুহাম্মাদ কা রওযা’ ও তকি সাহেব রচিত ‘মুঝে যিন্দেগি মে ইয়া রব, সারে বান্দেগি আতা কর’-এর মতো উচ্চাঙ্গের ইসলামি নাশিদ।
জুনায়েদ জামশেদ বলেন, ‘‘আমি আশা করি, আমার মৃত্যুর পরও আমার হামদ-নাত-গজল মানুষের মুখে জারি থাকবে। একসময় সবার মুখে ছিলো আমার গান, এখন থাকবে আমার গজল। কিছুদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার সুবিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুম যাকারিয়ায় সফর করলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, প্রতিটি ছাত্রের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে আমার গজল। আমি খুব অভিভূত হয়ে পড়লাম। দীনের খাতিরে আল্লাহ আমাকে এতো সম্মান দান করেছেন।’’
জুনায়েদ জামশেদের ইসলামি নাশিদের অ্যালবামগুলোর মধ্যে আছে- ‘জালওয়ায়ে জানান’ (২০০৫), ‘মেহবুবে ইয়াজদান’ (২০০৬), ‘বদরুদ্দোজা’ (২০০৭), ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ (২০০৯), ‘বদিউয যামান’ (২০০৯), ‘হাদিউল আনাম’ (২০১০), ‘রাব্বি যিদনি ইলমা’ (২০০১), ‘নুরুল হুদা’ (২০১৩) ও ‘উম্মতি’ (২০১৬)। তার গাওয়া নাশিদের সংখ্যা শতাধিক।
লাখো-কোটি ভক্তের মনের কাবার প্রিয় শিল্পী জুনায়েদ জামশেদের জানাযা হয় করাচিতে। ১৫ই ডিসেম্বর, রোজ বৃহস্পতিবার সকালে জানাযার নামাযে ইমামতি করেন মাওলানা তারেক জামিল। নামায শেষে অসিয়ত মোতাবেক জুনায়েদ জামশেদকে দারুল উলুম করাচির কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার জীবনের অন্যতম প্রশংসনীয় দিক ছিলো, দীনের পথে আসার পর থেকে আমরণ তিনি প্রতিটি উদ্যোগ ও পদক্ষেন গ্রহণ করছেনে মুফতি তকি উসমানি দা. বা.র পরামর্শে। একক সিদ্ধান্তে কখনো কোনো কাজ করেননি। মৃত্যুর পরও তাই পরম মমতায় জড়িয়ে থাকতে চেয়েছেন শায়খের পদধূলিধন্য দারুল উলুম করাচিকে। তাই আগেই অসিয়ত করে রেখেছিলেন আপনজনদেরকে। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন। তার একটি নাশিদের মাধ্যমেই আমার এ লেখার ইতি টানছি।
‘‘মেরা দিল বদল দে…
মেরা গাফলত মেঁ ডুবা দিল বদল দে…
হাওয়া ও হিরসওয়ালা দিল বদল দে…
খোদা ইয়া ফাযলো করমা দিল বদল দে…
গুনাহগারি মে কব তক উমর কাটো….
বদল দে মেরা রাস্তা দিল বদল দে…।’’