সম্মান পেতে হলে সম্মান দিতে হয়। মুশরিকরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে সকল উপাস্যকে আহ্বান করে, কুরআনে আল্লাহ সে সকল উপাস্যকে অযথা গালমন্দ করতে বারণ করেছেন। কারণ, যদিও বাতিল উপাস্যদের গালমন্দ করা কোনো দোষের বিষয় নয়; কিন্তু এর কারণে মুসলমানরা নিজেদের হক উপাস্যকেও মুশরিকদের মুখে গালি খাওয়ার পথ খুলে দেয়। একইভাবে এক হাদিসে নিজের বাবাকে গালি দিতে নিষেধ করা হয়েছে। সাহাবির জিজ্ঞাসার জবাবে এর সুরতও বর্ণনা করে দেওয়া হয়েছে, মানুষ যখন অন্যের বাবাকে গালি দেয় তখন সে উত্তেজিত হয়ে গালিদাতার বাবাকেও আচ্ছামতো গালমন্দ করে। এতে গালিদাতা প্রকারান্তরে নিজেই নিজের বাবাকে গালমন্দ করল।

আলিমগণ অনুসরণীয়। মানুষ তাদেরকে ভালোবাসে। তাদের ওপর আস্থা ও নির্ভরতা রাখে। সব আলিমের মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা কখনো এক হবে না। প্রত্যেক ফুলের ঘ্রাণ আলাদা। আপনি একজন আলিমের অনুসরণ করেন, তো আরেকজন অন্য কোনো আলিমের অনুসরণ করে। হ্যাঁ, বাতিলের ব্যাপারে কারও অনুসরণ করা বৈধ নয়। কিন্তু হকের মধ্যেও তো একাধিক পথ ও মত রয়েছে। শরিয়াহই এই মতভিন্নতার সুযোগ রেখে দিয়েছে। বর্ণনায়ও উম্মাহর দালিলিক মতভিন্নতাকে রহমত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং কোনো মত যতক্ষণ পর্যন্ত হকের গণ্ডির ভেতর থাকে, বাহ্যিক বিচারে তা যতই দুর্বল মনে হোক না কেন, তাকে প্রত্যাখ্যান করার এবং তার অনুসারীদেরকে তাচ্ছিল্য করার কোনো সুযোগ নেই।

আজকাল কী ঘটছে? নিজের মতানুসারী আলিমদের অনুসরণ করতে গিয়ে, তাদের স্তুতি বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য সবাইকে ডুবানো হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় যদি সেই ডুবন্তরা আবার এদের আলিমদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করছে তাহলে আবার দ্রোহের তপ্ত লাভার মতো বিস্ফোরিত হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য যে বেচারা নিজেই দায়ি, এই অনুভূতিটুকু ভেতরে জাগছে না।

আপনি সারাদিন কিতালি তানজিমগুলোর শরিয়াহ বিভাগের শাইখদের নিয়ে কটুক্তি করবেন, আপনার এই কটুক্তি দেখে তাদের কেউ যদি আপনার শাইখদের নিয়ে কটুক্তি করে তখন আবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন – এটা তো সমীচীন নয়। সম্মান পেতে হলে তো সম্মান দিতে হয়। পরমতসহিষ্ণুতা, অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ভিন্নমত পোষণ করার মানসিকতা রাখতে হয়। কারও ভালোবাসার জায়গায় আঘাত করলে সে-ও আপনাকে অবশ্যই আঘাত করবে, এই তিক্ত সত্য আমরা বারবার কেন ভুলে যাই?

বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সামগ্রিকতার রূপ দিয়ে বিধান বর্ণনা করা কখনোই সংগত নয়। পত্রপত্রিকার সুবাদে আজকাল মানুষজন জানে, দেশের অনেক হিফজ বিভাগেই কিছু সমকামী ছেলেপেলে থাকে। এখন এ কারণে কি কুরআনের সকল হাফিজকে সমকামী বলা বৈধ হবে? আবদুল্লাহ মাসউদসহ কওমির কিছু ছেলেপেলে কখনোসখনো নাস্তিক হয়েছে। বিদআতি বা বামপন্থী হয়েছে, এরকমও অভাব নেই। ব্যভিচারী, চোর, মাদকাসক্তও হয়েছে কেউ কেউ। এখন এর কারণে ঢালাওভাবে কি সবার বিরোধিতা করা যাবে? তাবলিগের মধ্যে এতাআতিরা রয়েছে বলে কি পুরো তাবলিগি জামাআতের সমালোচনা করা যুৎসই হবে? জমিয়ত, খেলাফত, নেজামে ইসলাম বা ইআবা দলগুলোর মধ্যে অনেক উচ্ছৃঙ্খল ও বেয়াদব সাথি রয়েছে বলে কি ঢালাওভাবে তাদের সবার ওপর এসব ট্যাগ আরোপ করা যাবে? এ সবগুলোর উত্তর যদি ‘না’ হয় তাহলে কিছু নিয়ন্ত্রণহীন উগ্র ছেলেপেলের কারণে সব কিতালিকে কেন সমালোচনার লক্ষ্যস্থল বানানো হবে? এমনকি ফেইসবুকে কোথাকার কোন ফেইক আইডি থেকে কোনকালে আল্লামা তাকি উসমানির ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে বলে সেই স্ক্রিনশট দেখিয়ে কুখ্যাত বাইতুন নুর-জাতীয় মাদরাসা ৫ জন ছাত্রের বহিষ্কারের ঘটনাকে বৈধতা দেবে? তবে কি এ ক্ষেত্রে এসে বিচ্ছিন্নতাকে সামগ্রিকতার রূপ দেওয়া হয়? কিন্তু কেন? কিতালিদের ওপরই কেন সব ক্ষোভ? তবে কি এটা কুরআনের সেই আয়াতের বাস্তবায়ন : ‘তোমাদের ওপর কিতালকে ফরজ করা হয়েছে। অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়।’

কিতাল যার ফার্স্ট চয়েজ না, তাকে তো লাস্টেও সুযোগ দেওয়া হয় না। কুরআনের আয়াত : ‘আল্লাহ যদি আপনাকে তাদের কোনো দলের কাছে ফেরান আর তখন তারা আপনার কাছে খুরুজের জন্য অনুমতি চায় তবে আপনি বলে দিন, তোমরা কখনোই আমার সঙ্গে বেরোবে না এবং কিছুতেই আমাদের সঙ্গে কোনো দুশমনকে কতল করবে না। তোমরা প্রথমবার বসে থাকার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছিলে। সুতরাং তোমরা পশ্চাদগামীদের সঙ্গে বসে থাকো।’

যদি বলা হয়, আরে কিতাল আমাদের ফার্স্ট চয়েজ না তোমাদেরকে কে বলেছে? আমরা বলব, তোমাদের লিসানে কাল না বললেও লিসানে হালই এ কথা বলেছে। যদি তোমাদের কিতাল পছন্দসই হয়ে থাকে তাহলে অর্ধশতাব্দী বসেও এর কোনো রূপরেখা কেন প্রণয়ন করতে পারলে না? ইতিমধ্যে এক প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে নতুন প্রজন্মের আগমন ঘটেছে। তবুও তো দেখা যাচ্ছে, তোমাদের অবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসছে না। তোমরা অতীত নিয়ে গর্ব করো; কিন্তু বর্তমানের করণীয় নিয়ে কোনো রূপরেখা প্রণয়ন করো না, এটা তো বড়ই হাস্যকর। আর শোনো আল্লাহর বাণী : ‘যদি তারা খুরুজ চাইত তবে এর জন্য কিছু প্রস্তুতি তো নিত। কিন্তু আল্লাহ তাদের উত্থানকে অপছন্দ করেছেন, তাই তিনি তাদেরকে অলস করে দিলেন আর তাদেরকে বলে দেওয়া হলো, তোমরাও উপবিষ্টদের সঙ্গে উপবেশন করে থাকো।’

কথায় বলে, খালি কলসি বাজে বেশি। অনেক কালই তো বাজনা শুনলাম। এবার না হয় ঢাকনা সরিয়ে একটু দেখানো হোক, কলসির ভেতর আসলেই কিছু আছে কি না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দীন কারও একচ্ছত্র সম্পত্তি নয়। দীনের ওপর আমল করবে সবাই। আর আমল করার জন্য পূর্বশর্ত হলো ইলম। দীনের ইলম যে অর্জন করবে, সে-ই দীনের ব্যাপারে কথা বলতে পারবে। এ ক্ষেত্রে স্তরবিন্যাস করে একদলকে গদিতে বসিয়ে বাকি সবার মুখে কুলুপ আঁটা যাবে না। কারণ, বিষয়টা যদি এমনই হতো তাহলে প্রথম তিন প্রজন্মের সালাফে সালেহিনের পর আর কারও দীন নিয়ে কোনো মন্তব্য করারই সুযোগ ছিল না। কিন্তু এরপরও যেহেতু চাকা চলেছে, সুতরাং সামনেও চলবে। কিয়ামত অবধি চলবে।

ইমাম বুখারি ইমাম আবু হানিফাকে বারবার তাচ্ছিল্য করেছেন, একজন হানাফি হয়ে এ কথা জানার পরও কিন্তু আপনি বুখারিকে আগলে রেখেছেন। ইমাম আবু হানিফাও কোনো কোনো মাসআলায় ভুল করেছেন, এ কথা জেনেও কিন্তু আপনি তাকে ইমাম মেনেছেন। আল্লামা শামি হাজার বছর পরে এসেও এমন সব মনীষীদের শত শত মতকে ভুল বা দুর্বল বলে আখ্যা দিয়েছেন, যাদের মর্যাদার সঙ্গে তার হয়তো তুলনা চলে না; এরপরও সেই ফাতওয়া শামিকেই কিন্তু আপনি আপনার ইফতার মেরুদণ্ড বানিয়েছেন। আরে, ইমাম বুখারিকে তার দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, এটাকে বাদ দিলেও খোদ আদম আ.-কেই তো ভুলের কারণে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল; এরপরও আপনি কিন্তু অপরিহার্যভাবে তাকে আদি পিতা ও মহান পয়গম্বর মেনেছেন। তবে কেন এ যুগের ব্যাপারস্যাপারে এসে আপনি দ্বিচারিতায় আক্রান্ত হচ্ছেন? এটা কি এ মাটির দোষ? কিংবা গোত্রপ্রীতির প্রভাব? নাকি আপনার মস্তিষ্কের নাটবল্টুর সমস্যা?

ইমাম খায়রুদ্দীন রামালি বড় সুন্দর বলেছেন,
‘যে সমসাময়িককে গোনায়ই ধরে না
শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচনা করে শুধু পূর্ববর্তীদের,
তাকে বলো, সেই প্রবীণও তো একদা ছিল নবীন
আর এই নবীন তো কালের আবর্তে প্রবীণ হিসেবে অমর হবে।’

মুদির সাহেব একদা বড় সুন্দর বলেছিলেন :

‘পূর্ববর্তী আলিমগণের চাইতে বর্তমানকালের আলিমগণের প্রতি সর্বদাই আমাদের আস্থা ও নির্ভরতা থাকে বেশি। যার কারণে সেই ছোটবেলা থেকে প্রতিনিয়ত শুনে আসছি, এই মাসআলায় ইমাম আবু হানিফার মত গৃহীত না হয়ে ইমাম আবু ইউসুফ বা ইমাম মুহাম্মাদের মত গৃহীত হয়েছে। এই অধ্যায়ে অমুক ইমামের তুলনায় তমুক ইমামের মত প্রণিধানযোগ্য। এমনকি ক্রয়-বিক্রয়ের আধুনিক মাসআলায় সার্বিক কল্যাণার্থে কত সময় হানাফি মাযহাবের মতকেই উপেক্ষা করে অন্য মাযহাবের মত গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব কথাবার্তা ও আলোচনা সাধারণত আমাদের দৃষ্টি কাড়ে না। আমরা অবাক হয়ে ভাবি না যে, কী ব্যাপার! ইমাম আবু হানিফা এত বিদগ্ধ জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে উনার মত প্রত্যাখ্যাত হবে! তদুপরি এসব মতভিন্নতার কারণে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধও কমে যায় না। অনাস্থা আসার তো প্রশ্নই আসে না।

কিন্তু বর্তমানকালের অনেকের ব্যাপারে আমাদের ধারণা, পৃথিবীর সবার ভুল হতে পারে; কিন্তু উনি ভুলের ঊর্ধ্বে। উদাহরণস্বরূপ, আমি যদি এখন ‘বুহুস ফি কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসিরাহ’ পড়াতে গিয়ে যদি আল্লামা তাকি উসমানি সাহেবের সঙ্গে কোনো মাসআলায় দ্বিমত করি তাহলে দেখা যাবে, কিছু ছাত্রের মনে এ কৌতূহল বা দ্বিধা জাগবে যে, উনি কীভাবে তাকি সাহেবের মত প্রত্যাখ্যান করে ভিন্নমত পোষণ করছেন! তবে কি উনি নিজেকে তাকি সাহেবের চাইতেও বড় মনে করেন! অথচ বাস্তবতা হলো, এ বইয়ে অনেক বিষয়ই এমন আছে, যেসব ক্ষেত্রে দলিলের আলোকেই আমরা ভিন্নমত পোষণ করেছি। ফিকহ-ফাতওয়ার ক্ষেত্রে তো অন্ধ তাকলিদ চলে না। আমি একজন হানাফি বটে। তবে আমি তো অন্ধ হানাফি নই; বুঝেশুনে হানাফি। প্রতি বছরই এ বই পড়ানোর আগে দীর্ঘ সময় আলোচনা করে এই ভিন্নমতের বিষয়টি আমাকে স্পষ্ট করতে হয়। না হলে দেখা যায়, কিছু ছাত্র বিষয়টা সহজভাবে নিতে পারে না।’


প্রসঙ্গক্রমে যোগ করি, আমাদের দৃষ্টিতে চারও মাযহাব আপন জায়গায় সত্য ও অনুসরণযোগ্য। হ্যাঁ, চার মাযহাবের অবস্থা, অবস্থান, বৈশিষ্ট্য ও স্তর সমান নয়। কোনো হানাফির চোখে হাম্বলি মাযহাবকে জাহেরি মাযহাবের কাছাকাছি মনে হতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, হাম্বলি মাযহাব অনুসরণযোগ্য নয়। আমাদের দেশের অনেকের ধারণা, আরববিশ্বের দু-চারজন বাদে বাকি সব আলিম জাহেরি। এমনকি এর ভিত্তিতে অনেকের কাছে তানজিমের গৃহীত কর্মপন্থাকেও ভাসাভাসা ও জাহেরি মনে হয়। তানজিমের শরিয়াহ বিভাগের সকল আলিমকে অতি জযবাতি মনে হয়। বা ইমারাতে ইসলামিয়্যাহর সীমানার ভেতর তাদের কাজকে সমর্থনযোগ্য মনে হলেও বৈশ্বিক পরিসরে তাদের প্রতিটি কাজকে বাড়াবাড়ি ও উগ্রতা মনে হয়। এটা কারও মনে হলে হতে পারে। একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। মনের ওপর তো কারও হস্তক্ষেপ নেই। কিন্তু এর ভিত্তিতে কেউ যদি মন্তব্য করে বসে, আরববিশ্বের সকলের উচিত, বা গোটা দুনিয়ার সকল মুসলিমের কর্তব্য আমাদের দেশে এসে আমাদের আলিমগণের কাছ থেকে সবক নেওয়া এবং তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে নিজেদেরকে ঢেলে সাজানো তবে তা তো নির্বুদ্ধিতা বৈ কিছু হবে না।

যারা পরমতসহিষ্ণুতার বয়ান দেয়, যারা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা লালন করতে বলে, তারাই আবার কীভাবে যেন নিজেদের মতকেই সর্বশেষ চূড়ান্ত মত হিসেবে গণ্য করে বাকি সবকিছুকে গোমরাহি ও বিভ্রান্তি মনে করে। রাসুলুল্লাহ সা. কত সময়ে কত ফায়সালা করেছেন। বিশিষ্ট সাহাবিগণ অনেক সময় এর ওপর আপত্তি তুলেছেন। কখনো তো সেই আপত্তিগুলোর ভাষা বেশ কড়া ছিল। এতদসত্ত্বেও রাসুল সা. কিন্তু তাদেরকে শাসিয়ে দেননি। বেয়াদব, গোমরাহ বা অতি জযবাতি ট্যাগ লাগাননি। কখনো তো এমনো হয়েছে যে, কাউকে ইসলাম গ্রহণের বিষয় গোপন রাখতে বলেছেন। কিন্তু সে গিয়ে প্রকাশ্যে ইসলামের কথা ঘোষণা দিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে। রাসুল সা. কিন্তু তাদের ব্যাপারেও ‘বেশি বোঝে’ বলে মন্তব্য ছুড়েননি। পরবর্তী খলিফাদের যুগেও কত ইস্যুতে ছোট সাহাবিরা বড়দের মতের ওপর আত্মপ্রশান্ত না হয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, প্রকাশ করেছেন, তাদের সঙ্গে মুনাকাশা করেছেন। কিন্তু তাদের পরমতসহিষ্ণুতা তাদের ভেতরে উদারতা এনে দিয়েছিল।

মাযহাবের ইমামগণও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যার কারণে তারা কারও ওপর নিজেদের মাযহাব চাপিয়ে দেননি। যে মাসআলায় তিনি কোনো ফাতওয়া দিয়েছেন, তার দৃষ্টিতে সে ক্ষেত্রে অন্যদের ভাতওয়া ভুল বা তুলনামূলক দুর্বল ছিল; এতদসত্ত্বেও সেই মতের অনুসারীদের ওপর তারা আপত্তি তুলেননি। বরং সবক্ষেত্রে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এমন এক যামানায় চলে এসেছি, যে সময় আমরা নিজেদের মতকে, নিজেদের ঘরানার মতকে, নিজেদের উস্তাদ বা প্রতিষ্ঠানের মতকেই সর্বশেষ চূড়ান্ত কথা মনে করি; যার পর আর কোনো কথা হতে পারে না। আমরা আমাদের উস্তাদদেরকে যদিও দেখি, তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলিলসাপেক্ষে তাদের উস্তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন; কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে আমাদের উস্তাদের কোনো ছাত্রের অধিকার নেই তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার। যদি কেউ করে তাহলে সে ‘বিভ্রান্ত’, ‘বিচ্ছিন্ন’, ‘বেয়াদব’ বা ‘অতি জযবাতি’। ইলম অন্ধত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু বর্তমানকালে ইলমের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষরাই কেমন যেন অন্ধত্বকে আগলে রাখে।

আমাদের বড় উস্তাদের কোনো ছাত্র যদি তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে আর তিনি যদি আমাদের ছোট উস্তাদ বা উস্তাদের উস্তাদও হয়ে থাকেন তাহলে তার ব্যাপারে সেই বড় উস্তাদের মন্তব্য/আপত্তি যৌক্তিক হলেও আমাদের জন্য কি তার শানে গোস্তাখি করা কখনোই সমীচীন? অথচ আমি নিজে সরাসরি তার ছাত্র বা তার ছাত্রের ছাত্র। আমার বিবেচনায় দুজনই তো শ্রদ্ধেয় উস্তাদ। এক উস্তাদের পক্ষ নিতে গিয়ে আরেক উস্তাদকে তাচ্ছিল্য করা বা তার শানে গোস্তাখি করা তো চরম অন্যায়। কিন্তু আমরা দিব্যি তা করে আসছি। এমনকি সেই বড় উস্তাদ আদাবুল ইখতিলাফ রক্ষা করে মন্তব্য করলে আমরা সব আদব-কায়দার গণ্ডি ডিঙিয়ে তার লুঙ্গি খোলার জন্য পর্যন্ত নেমে পড়ছি। এগুলো তো কোনো তালিবুল ইলমের বৈশিষ্ট্য নয়। ইমাম মুহাম্মাদ তো ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আবু ইউসুফ উভয়েরই শাগরিদ ছিলেন। তিনি তো উভয়ের মর্যাদা রক্ষা করেই উভয়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এমন তো হয়নি যে, তিনি ইমাম আবু হানিফার পক্ষ নিতে গিয়ে ইমাম আবু ইউসুফের শানে গোস্তাখি করেছেন বা তার ব্যাপারে অনৈতিকভাবে জবানদারাযি করেছেন।

আপনার অধিকার আছে, আপনি স্রেফ অন্ধভক্তির ভিত্তিতে নয়, বরং দলিলের আলোকে যেকোনো মত গ্রহণ করবেন। কিন্তু আপনার তো এই অধিকার নেই যে, আপনি অন্য কোনো দলিলের অনুসারীকে গালমন্দ করবেন, তাচ্ছিল্য করবেন বা তাকে নিয়ে উপহাস করবেন। আর যে উস্তাদের দোহাই দিয়ে আপনি গরম দেখাচ্ছেন, তিনি সবজান্তা হলেও আপনি কিন্তু সবজান্তা নন। আপনার যোগ্যতা সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ ধোঁয়াশায় থাকলেও আপনি নিজে কিন্তু স্বচ্ছ ধারণাই রাখেন। তো নিজের দৌড় কতটুকু, সে বিষয়টা মাথায় রেখেই কিন্তু আপনার হম্বিতম্বি ছোড়া উচিত। অন্যথায় পরের গরম কিন্তু বেশিকাল থাকে না। পরনির্ভর আগাছা একপর্যায়ে কর্তিত হয়। আস্তাকুড়েই তার স্থান হয়।

Share This