সালাফি ভাইরা বলে থাকে, তোমরা ইমাম আবু হানিফাকে বাদ দিয়ে আকিদার ক্ষেত্রে বিদআতি ইমাম আশআরি-মাতুরিদির অনুসরণ করো কেন? ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ করলেই তো হয়। তাঁর আকিদা আর অন্যান্য সালাফের আকিদা এক। (তাদের এই শেষ কথাটির কথার ভিত্তি হলো ইমাম ইবনু তাইমিয়ার একটি বক্তব্য) আর সালাফের আকিদাধারীদেরই সালাফি বলা হয়। তারা ভাবে, আমরা বুঝি সালাফে সালেহিনকে বাদ দিয়ে শুধু খালাফ নিয়েই পড়ে আছি। আসলে আমাদের মানহাজ সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে তাদের এই সংশয়। অথচ তারা নিজেরাই সালাফের মাযহাব থেকে সরে এসে এক বিদআতি মাযহাবের গোড়াপত্তন করেছে। আর এ সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ বেখবর।

আমরা তো ইমাম আবু হানিফাকে আকিদার ক্ষেত্রেও অনুসরণ করি। আচ্ছা, এরপরও না হয় সাময়িকভাবে তাদের কথা মেনে নিলাম। কিন্তু বাস্তবতা কি এ কথা বলে যে, ইমাম আবু হানিফার আকিদার অনুসরণ করলেই তারা আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবে? না, তা কিন্তু নয়। কীভাবে বুঝলাম? উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করার জন্য একটু সময় প্রয়োজন।

সালাফিদের ব্যাখ্যানুসারে ইমাম আবু হানিফা মুরজিয়া। তিনি ‘ইরজা’র আকিদা পোষণ করতেন। কীভাবে?

ক. তিনি বলেছেন, ‘ইমান হলো মুখে স্বীকার করা এবং অন্তরে সত্যয়ন করা।’ {দ্রষ্টব্য—আল-ফিকহুল আকবার, হাম্মাদ ইবনু আবি হানিফার বর্ণনা, ইমানের পরিচয় অধ্যায়}

এটা তো মুরজিয়াদের কথা। আহলুস সুন্নাহর বক্তব্য হলো, ‘আমল ইমানের অংশ।’ অর্থাৎ ইমান তিনটি বিষয়ের সমন্বিত রূপ—উপরিউক্ত দুটি এবং এটি। হাঁ, অন্যান্য মুরজিয়াদের সাথে তার বক্তব্যে অন্য জায়গায় পার্থক্য আছে।

শাইখ ইবনু উসাইমিন রহ. বলেন, ‘মুরজিয়া তিন প্রকার।

১ম প্রকার: যারা বলে, ইমান শুধু অন্তরে যা রয়েছে তার নাম।

এরা আবার দুই প্রকার:

ক. যারা অন্তরের আমলকে ইমানের সংজ্ঞায় প্রবেশ করায়। মুরজিয়াদের ফিরকাগুলোর মধ্যে এরাই সংখ্যায় সবচে বেশি।
খ. যারা অন্তরের আমলকেও প্রবেশ করায় না। এরা হলো জাহমিয়া এবং তার অনুসারীরা, যেমন আশআরি। তবে আশআরি কবিরা গুনাহকারীদের ক্ষেত্রে শাফাআত সাব্যস্ত করে।

২য় প্রকার: ইমান শুধু মুখের উচ্চারণ। এরা হলো কাররামিয়া। এদের পূর্বে আর কারও থেকে এ ধরনের মত জানা যায় না। এরা বলে, নিশ্চয়ই মুনাফিকও মুমিন। তবে মুনাফিক জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে।

৩য় প্রকার: যারা বলে, ইমান হলো অন্তরের স্বীকৃতি এবং মুখের উচ্চারণ। এরা হলো মুরজিয়াদের মধ্যে ফকিহ এবং আবিদ শ্রেণি। এদের মধ্যে রয়েছে আবু হানিফা এবং তার সঙ্গীরা।

খ. আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের ইমান মুমিন হিসাবে বাড়েও না এবং কমেও না। তবে প্রত্যয় ও বিশ্বাস হিসাবে তা বাড়ে এবং কমে। সকল মুমিন তাওহিদ এবং ইমানের দিক দিয়ে সমান, তবে আমলের নিরিখে মর্যাদায় তারতম্য হয়। {দ্রষ্টব্য—আল-ফিকহুল আকবার, হাম্মাদ ইবনু আবি হানিফার বর্ণনা, ইমানের অধ্যায়}
এই ইবারত দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। (‘লা’কে প্রথম জুমলায় রেখে কিংবা দ্বিতীয় জুমলায় এনে) তবে সর্বাবস্থায় ইমাম সাহেবের আকিদা হলো, ইমান বাড়ে না এবং কমে না।

তিনি আরও বলেন, ‘ইমান বাড়ে না এবং কমে না। কারণ ইমানের হ্রাস কল্পনা করা যায় না কুফরের বৃদ্ধি ছাড়া। আর ইমানের বৃদ্ধি কল্পনা করা যায় না কুফরের হ্রাস ছাড়া। তো, কীভাবে একজন ব্যক্তি একই অবস্থায় মুমিন এবং কাফির হতে পারে? মুমিন বাস্তবেই মুমিন। আর কাফির বাস্তবেই কাফির। ইমানের ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই, যেমন কুফরের ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। কারণ আল্লাহ বলেন, ‘তারাই প্রকৃতপক্ষে মুমিন।’ (সুরা আনফাল : ৪) এবং ‘ওরাই প্রকৃতপক্ষে কাফির।’ (সুরা নিসা : ১৫১)

উম্মাতে মুহাম্মাদির গুনাহগাররা বাস্তবে মুমিন। তারা কাফির নয়। আমল ইমান নয়। আর ইমান আমল নয়। দলিল হলো, অনেক সময় মুমিনের থেকে আমল উঠে যায়। অথচ এটা বলা বৈধ হয় না যে, তার থেকে ইমান উঠে গেছে। কারণ, আল্লাহ তাআলা ঋতুবতী নারীর থেকে সালাত উঠিয়ে নিয়েছেন। অথচ এটা বলা বৈধ হয়ে যায় না যে, আল্লাহ তার থেকে ইমান উঠিয়ে নিয়েছেন অথবা তাকে ইমান ত্যাগ করতে আদেশ করেছেন। শরিয়াহপ্রণেতা ঋতুবতী নারীকে নির্দেশ দিয়েছেন, তুমি সিয়াম (রোজা) ছেড়ে দাও। এরপর তা কাজা কোরো। অথচ এটা বলা বৈধ নয় যে, তুমি ইমান ছেড়ে দাও। এরপর তা কাজা কোরো। এটা বলা যায় যে, দরিদ্র ব্যক্তির ওপর জাকাত নেই। অথচ এটা বলা যায় না যে, দরিদ্র ব্যক্তির ওপর ইমান নেই।’ {ওসিয়্যাতুল ইমাম আবি হানিফা লি-আসহাবিহি}

তো এগুলো সুস্পষ্ট ইরজা নয় তো কী?

ইমাম আবু হানিফা জাহমিয়া। এটা কী বললেন? হুম, বিশ্বাস হয় না? তাহলে তার বক্তব্য পড়ুন—

‘আমাদের কুরআনের উচ্চারণ মাখলুক (সৃষ্ট)। আমাদের কুরআনের লিখন মাখলুক। আমাদের কুরআনের পঠন মাখলুক। কিন্তু কুরআন মাখলুক নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআনে মুসা বা অন্যান্য নবিগণের সম্পর্কে এবং ফিরাউন ও ইবলিস সম্পর্কে যা-কিছু বর্ণনা করেছেন, তা সবই তাদের সংবাদ-সংবলিত আল্লাহর কালাম। আল্লাহ তাআলার কালাম মাখলুক নয়। মুসা ও অন্যান্য সৃষ্টজীবের কালাম মাখলুক।’ {দ্রষ্টব্য—আল-ফিকহুল আকবার, হাম্মাদ ইবনু আবি হানিফার বর্ণনা, কুরআনের ব্যাপারে বক্তব্য অধ্যায়}

এই মতের কারণে উনাকে জাহমিয়া প্রমাণের ব্যাপারে এবার ইমাম আহমাদ, তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ এবং আবু বকর ইবনু আবি দাউদের বক্তব্য টেনে সহজেই উদ্দেশ্য হাসিল করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, তারা জাহমিয়াদের তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যার এক ভাগের বক্তব্য উপরিউক্ত বক্তব্যের অনুরূপ।

ইমাম আবু হানিফা রাফেজি বা তাদের অনুসারী। কেন? দেখুন তবে—

তিনি বলেন, ‘সকল নবি সগিরা এবং কবিরা গুনাহ থেকে, কুফর এবং অন্যায় কাজ থেকে মা‘সুম।’ {দ্রষ্টব্য—আল-ফিকহুল আকবার, হাম্মাদ ইবনু আবি হানিফার বর্ণনা, ইসমাতুল আম্বিয়া অধ্যায়}

ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘নবিরা কবিরা গুনাহ থেকে মা‘সুম ছিলো, সগিরা থেকে নয়—এটাই ইসলামের অধিকাংশ আলিম এবং সকল দলের মত। তেমনি তাফসির, হাদিস এবং ফিকহের অধিকাংশ শাস্ত্রজ্ঞের মতও এটা। বরং, সালাফ, ইমামগণ, সাহাবা, তাবেয়িন, তাবে-তাবেয়িন থেকে শুধু তা-ইই বর্ণিত হয়েছে, যা এই মতের অনুকূল।’ {মাজমুউল ফাতাওয়া : ৪/৩১৯}

তিনি আরও বলেন, ‘জুমহুর (অধিকাংশ) আলিমের থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবিরা সগিরা গুনাহের ওপর স্থির থাকার ব্যাপারে মাসুম নন। তবে তারা এর ওপর স্থির থাকেন না। তারা এ কথা বলেন না যে, কখনও তা হয় না। উম্মাহর দলসমূহের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম যাদের থেকে নিঃশর্তভাবে ইসমতের (মাসুম হওয়ার) অভিমত বর্ণিত হয়েছে এবং এ ব্যাপারে গুরুতর কথা বলেছে, তারা হলো রাফেজি। তারা এমনভাবে ইসমতের (মাসুম হওয়ার) কথা বলে যে, অনিচ্ছাকৃত, ভুলবশত বা তাবিলের সাথেও তাদের থেকে কোনো ভুল হতে পারে না। {মাজমুউল ফাতাওয়া : ৪/৩২০}

এতটুকুই? না, এ তো স্রেফ উদাহরণ। সালাফিরা আপনার প্রতি কিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না, যাবত না আপনিও একজন সালাফি হোন। এটাই বাস্তব। উল্লেখ্য, সালাফি নাম দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। শাইখ সাইদ ফুদার ভাষায় এদের সালাফি না বলে ‘তাইমি’ বলা উচিত। কারণ, তারা সাধারণত এসব ক্ষেত্রে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়ার মতামতকেই প্রাধান্য দেন। ইমাম ইবনু তাইমিয়া কে? শাইখ সাইদ রামাদান বুতি এবং শাইখ সাইদ ফুদার ভাষায় একজন মুজাসসিমা (দেহবাদী আকিদাধারী) বা মুশাববিহা। আর আকাবিরে দেওবন্দের ভাষায় একটু নরম করে বললে ‘তাশবিহ কি বু আতি হ্যায়’।

 

পুনশ্চ 

নব্য সালাফিদের দাওয়াতি পন্থা এবং ইমাম ইবনুল জাওযি হাম্বলি রহ.-এর নির্দেশনা

 

ইমাম ইবনুল জাওযি হাম্বলি রহ.কে আল্লাহ তাআলা উত্তম প্রতিদান দান করুন। তাঁর এই নির্দেশনা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তিনি বলেন,

‘একটি বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার হলো জনসাধারণের সামনে এমন বিষয়ের আলোচনা করা, যা তাদের অন্তর ধারণ করতে পারবে না কিংবা যার বিপরীত জিনিসটি তাদের অন্তরে প্রোথিত হয়ে আছে।

উদাহরণস্বরূপ: এক সম্প্রদায়ের অন্তরে তাশবিহ (সৃষ্টের সঙ্গে স্রষ্টার সাদৃশ্য) শেকড় গেঁড়ে বসে আছে। তাদের আকিদা হলো, মহান সৃষ্টিকর্তা—আমরা তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছি—আরশের সঙ্গে সংযুক্ত। তিনি আরশের পরিমাণ, তবে আরশের থেকে তাঁর দৈর্ঘ্য চার আঙুল বেশি।

তারা তাদের শাইখদের থেকে এমনটা শুনে এসেছে। তাদের কাছে এটাই প্রমাণিত যে, স্রষ্টা যখন অবতরণ করেন এবং প্রথম আকাশে স্থানান্তরিত হন, তখন অবশিষ্ট ছয় আকাশ তাঁর থেকে খালি থাকে।

এ পরিস্থিতিতে তাদের কাউকে যদি ‘তানযিহ’ (সাদৃশ্য-অস্বীকার)-এর দিকে আহ্বান করা হয় এবং এ কথা বলা হয় যে, বিষয়টি তেমন নয়, যেমন তোমার অন্তরে তা উদ্রেক হয়েছে, তোমার জন্য তো উচিত হলো তুমি হাদিসগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই রেখে দেবে (অর্থাৎ ‘তাফবিয’ করবে), এখন যা কল্পনা করছো মনে তা স্থান দেবে না তখন এটা দুকারণে তার জন্য কঠিন হয়ে যাবে:

১. তার ওপর আবেগ প্রবল থাকার কারণে আর জনসাধারণের ওপর সাধারণত আবেগ প্রবল হয়ে থাকে।

২. যেহেতু তারা তাদের শাইখদের থেকে এমনটাই শুনে এসেছে—যে শাইখরা তাদের থেকেও বেশি অজ্ঞ ছিলো।

সুতরাং তাকে সম্বোধনকারী নিজেকেই ঝুঁকির মুখে ফেলছে। আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে, জনৈক ধার্মিক ব্যক্তি—তাশবিহ যার অন্তরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিলো—কোনো আলিমের থেকে ‘তানযিহ’ (সাদৃশ্য-অস্বীকার)-এর ব্যাপারে কিছু শুনেছে, এরপর সে মন্তব্য করেছে, আল্লাহর কসম, যদি আমি সক্ষম হতাম, তা হলে অবশ্যই তাকে হত্যা করে ফেলতাম!

সুতরাং সাবধান, সাবধান! জনসাধারণের কারও সামনে এমন কিছু আলোচনা কোরো না, যা তাদের অন্তর ধারণ করতে পারবে না—কৌশল এবং বিনয়নম্রতা অবলম্বন ছাড়া। কারণ, নইলে তার অন্তরে যা রয়েছে তা তো দূর হবে না, অপরদিকে আলোচনাকারী নিজেকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে। উসুলুদ দীন তথা আকিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুর ক্ষেত্রেই এই একই কথা।’ {সাইদুল খাওয়াতির: ৪২৭}

উল্লেখ্য, নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলার এক অর্থ তো এই যে, নিজে বিপদে পড়ে যাওয়া। আরেক অর্থ হলো, নিজেকে ফিতনার ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলা। উত্তম কাজও পন্থা গলদ হবার কারণে সুফলের পরিবর্তে কুফল বয়ে আনে। আর কাজই যেখানে অনুচিত, অনুত্তম, বিদআত কিংবা বাতিল তা তো আর কিছু বলার অপেক্ষাই রাখে না।

এ বিষয়ে আরও পড়ুন

দুটি শিক্ষণীয় ঘটনা

Share This