১.
আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা.। একজন অন্ধ সাহাবি। রাসুলুল্লাহ সা. এর মদিনার জীবনীতে প্রথমদিকে তিনি বনু কায়নুকা গোত্রের এক ইহুদি নারীর ঘরে জায়গির থাকতেন। ইহুদি নারী তার আদর-আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি করতো না। সাধ্যমতো তাকে ভালো ভালো খাবার আহার করাতো, তার প্রতি সদাচারণ করতো। মদিনার ইহুদিরা রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে ‘যিম্মা চুক্তি’তে আবদ্ধ ছিলো।
সেই ইহুদি নারীর অভ্যেস ছিলো, সে মানবীয় দায়িত্ববোধ থেকে অন্ধ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের সাথে তো ভালো ব্যবহার করতো, কিন্তু ইসলামের নবি মুহাম্মাদে আরাবি সা. কে যাচ্ছেতাই গালমন্দ করতো। মানবতার মুক্তির দিশারী প্রিয় রাসুলের শানে সে এমন বাজে বাজে মন্তব্য করতো, যা শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. এর কলজে চিড়ে যেতো। তিনি অন্ধ ছিলেন, দরিদ্র ছিলেন; কিন্তু তার হৃদয় আল্লাহ এবং তার রাসুলের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিলো। তার জন্য ইহুদি নারীর এই আচরণ সহ্য করা কিছুতেই সম্ভবপর ছিলো না। তারপরও তার কীইবা করার আছে!
আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. অনেকদিন পর্যন্ত মুখ বুজে সব সয়েছেন। কিন্তু একরাতে সেই ইহুদি নারী রাসুলুল্লাহর শানে এমন এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে বসে, যা শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. এর মাথায় রক্ত চড়ে বসে। তিনি আর সহ্য করতে পারেন না। তার ধৈর্যের বাঁধ সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যায়। ইমানের আগুনে জ্বলে ওঠেন। অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও নিজের অক্ষমতাকে ভুলে ইহুদি নারীর দিকে এগিয়ে যান। ইহুদি নারী কিছু বুঝে ওঠার আগেই সর্বশক্তি দিয়ে তার গলা চেপে ধরেন। ইহুদি নারী সর্বশক্তি ব্যয় করে অন্ধ সাহাবির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইমানের বলে বলিয়ান অন্ধ সাহাবির হাত থেকে কিছুতেই সে আর নিজেকে ছোটাতে পারে না। অনন্তর আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. শ্বাসরোধ করে ইহুদি নারীকে হত্যা করেন, নবিপ্রেমের দাবিতে এক রাসুলদ্রোহীকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন।
ভোরবেলা পুরো মদিনায় ইহুদি নারীর হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে। রাসুলুল্লাহ সা. এর কানেও এই খবর এসে পৌঁছে। যেহেতু ইহুদিদের সাথে মুসলমানরা ‘যিম্মা চুক্তি’তে আবদ্ধ ছিলো, তাই রাসুলুল্লাহ সা. অপরাধীর বিচার করার জন্য খুনীকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. এর কানেও রাসুলুল্লাহ সা. এর নির্দেশ পৌঁছে। তিনি দাঁড়িয়ে যান। এরপর রাসুলুল্লাহ সা. এর সামনে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন। যা-কিছু ঘটেছে সব খুলে বলেন। পুরো বৃত্তান্ত শুনে রাসুলুল্লাহ সা. এর হৃদয়াকাশ থেকে দুশ্চিন্তার মেঘ সরে যায়। তার অধরে শুভ্র হাসির রেখা ফুঁটে ওঠে। তিনি ইহুদি নারীর হত্যার শাস্তিস্বরূপ আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. কে কোনো শাস্তিই দেননি। নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার কারণে তাকে এতোটুকু তিরস্কারও করেননি।
{সুনানে আবু দাউদঃ ৪৩৬২; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকিঃ ৭/৯৬, ৯/৩৩৬; আহকামু আহলিল মিলাল, খাল্লালঃ ৭৩০; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবিঃ ১/৩৬৩; আসসারিমুল মাসলুলঃ ১/১৩৪}
২.
রাসুলুল্লাহ সা. এর একজন অন্ধ সাহাবি। ইতিহাসে তার নাম সংরক্ষিত হয়নি। তার একটি অত্যন্ত সুশ্রী অমুসলিম দাসী ছিলো। যার চেহারার দিকে তাকালে হৃদয়তন্ত্রীতে প্রশান্তির স্নিগ্ধ সমীরণ বইতো। যার রূপ-লাবণ্য যেনো চাঁদকেও হার মানাতো। সেই সাহাবি দাসীটির প্রতি অনেক দুর্বল ছিলেন। তাকে জানপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন। দাসীটি ছিলো উম্মে ওয়ালাদ। উম্মে ওয়ালাদ শব্দের অর্থ— সন্তানের মা। ইসলামে স্ত্রীর সাথে যেমন মেলামেশা করা বৈধ, তেমনি দাসীর সাথেও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা বৈধ। এই মেলামেশার ফলে মনিবের ঔরস থেকে দাসীর যদি কোনো সন্তান হয়, তাহলে সেই দাসীকে উম্মে ওয়ালাদ বলা হয়। উম্মে ওয়ালাদ দাসীকে ক্রয়-বিক্রয় করা যায় না। মনিবের মৃত্যুর পর উম্মে ওয়ালাদ দাসী স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করে স্বাধীন নারীতে রূপান্তরিত হয়। মাতৃত্বের মর্যাদাস্বরূপ ইসলাম তার জন্য স্বাধীন জীবন সুনিশ্চিত করে।
সেই রূপসী দাসীর গর্ভ থেকে অন্ধ সাহাবির দু’টো ছেলে জন্মলাভ করে। ছেলেদু’টো ছিলো চকচকে মুক্তোর মতো। মায়ের সৌন্দর্যের বিভা তাদের মধ্যেও ছিলো পূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত। দিনকাল তাদের ভালোই যাচ্ছিলো। তবে সেই দাসীর একটা মন্দ স্বভাব ছিলো। সে রাসুলুল্লাহ সা. এর শানে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করতো। কখনও মেজাজ চড়ে গেলে প্রিয়নবিকে খারাপ ভাষায় গালমন্দ করতো। সেই সাহাবির জন্য উম্মে ওয়ালাদ দাসীর এই আচরণ মেনে নেয়াটা সম্ভবপর ছিলো না। সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহ সা. এর ভালোবাসাকে সবার এবং সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দিতেন। রাসুলুল্লাহ সা. এর জন্য সহাস্যবদনে নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে দিতেন। যেখানে রাসুলুল্লাহ সা. এর ভালোবাসার সামনে তাদের নিজেদের জীবনেরই কোনো মূল্য ছিলো না, সেখানে অন্যান্যদের ব্যাপার তো একেবারেই নস্যি।
অন্ধ সাহাবি উম্মে ওয়ালাদ দাসীকে অনেক করে বুঝিয়েছেন। তাকে এহেন আস্পর্ধা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। কিন্তু দাসী তার কোনো কথাই শোনেনি। তার কুকর্মের ধারা দীর্ঘায়িতই হচ্ছিলো। সে কোনো কিছুকেই পরোয়াই করতো না। রাসুলুল্লাহ সা. ছিলো তার জানের দুশমন।
একরাতের কথা। সেই দাসী রাসুলুল্লাহ সা. এর শানে খুব কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে থাকলো। খারাপ ভাষায় তাঁকে গালমন্দ করতে লাগলো। এবার আর অন্ধ সাহাবি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তিনি জানেন না, তার এই উদ্যোগের পরিণতি কী হতে পারে। তিনি জানেন না, পাছে আগামীকাল না আবার তার জীবনেরও সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু মানুষ যেখানে নিজের বাবা-মা’র নামেই কটু কথা শুনতে পারে না, সেখানে আল্লাহর রাসুলের সাহাবিরা কীভাবে চুপ করে প্রিয় রাসুলের শানে গালমন্দ সয়ে যাবে?! অনন্তর আল্লাহর ওপর ভরসা করে প্রিয়নবির ভালোবাসার দাবিতে অন্ধ সাহাবি উঠে দাঁড়ালেন। তখনও সেই দাসী বুঝে উঠতে পারেনি, একটু পরই কী ঘটতে যাচ্ছে। সাহাবি উঠে হাতড়ে হাতড়ে নিজের ধারালো সরু তরবারিটা বের করলেন। এরপর সেটা নিয়ে উম্মে ওয়ালাদ দাসীর দিকে এগিয়ে গেলেন। অনন্তর ধারালো সরু তরবারির ফলাটা প্রেমাষ্পদ দাসীর পেটে ঢুকিয়ে দিলেন। এরপর নিজের পুরো ভর দাসীর ওপর ঢেলে দিলেন। সেখানেই সেই রাসুলদ্রোহী দাসীর জীবননাটিকার যবনিকাপাত হলো।
অন্ধ সাহাবির দাসীটি ছিলো সন্তানসম্ভবা। সাহাবির তরবারির আঘাত দাসীর জরায়ুর পাশ ভেদ করলেও আল্লাহর অনুগ্রহে সন্তানটি বেঁচে যায়। সাহাবি যখন দাসীর পেট থেকে তরবারি বের করে আনেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যে গর্ভ থেকে সন্তানও ভূমিষ্ট হয়। সাহাবি দু’চোখে তো কিছু দেখতে পান না, তবে তিনি নবজাতক বাচ্চার কান্না শুনতে পান। সন্তান জন্মনলাভ করার পরে মায়ের পেট থেকে অঝোর ধারায় বয়ে যাওয়া রক্ত চেটেপুটে খেতে থাকে। পৃথিবীর সূর্য দেখার আগেই তার জীবনে কী ঘটে গেছে— তার কোনো বোধ-উপলব্ধিই তো আর এ শিশুর ছিলো না।
সকালবেলা মদিনার সর্বত্র ভাইরাল হয়ে দাসীর নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। রাসুলুল্লাহ সা. এর আদালতে বিচার বসে। আসামী তখনও চিহ্নিত হয়নি। রাসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদের সামনে ঘোষণা করেন, “আমি আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, গতরাতে যে এই হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে, তার ওপর আমার কিছু হক রয়েছে, সে যেনো নিজের থেকেই দাঁড়িয়ে যায়।” মজলিসের পেছনের দিকে উপবিষ্ট ছিলেন সেই অন্ধ সাহাবি। রাসুলুল্লাহ সা. এর ঘোষণা শুনে তিনি দাঁড়িয়ে যান। মানুষের কাঁধ ডিঙ্গিয়ে তিনি সামনের দিকে আসতে থাকেন। তার সারা শরীরে তখন কাঁপুনি ধরে গিয়েছিলো। তিনি কাঁপতে কাঁপতে অনেক কষ্ট করে মজলিসের সামনে আসলেন। এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সা.! আমি সেই ব্যক্তি। নিহত নারী ছিলো আমার দাসী। সে আপনার শানে কুরিচিপূর্ণ ও বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করতো। আপনার নাম নিয়ে খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করতো। তার গর্ভে আমার দুটো মুক্তোর মতো চকচকে ছেলে জন্মলাভ করেছে। সে ছিলো আমার পরমপ্রিয়া জীবনসঙ্গিনী। গতরাতে সে যখন আপনার নামে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও গালমন্দ করতে লাগলো, তখন আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। অনন্তর আমার একটি ধারালো সরু তরবারি নিয়ে আমি সেটাকে তার পেটে ঢুকিয়ে দেই। এরপর তার ওপর নিজের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দেই। এভাবে আমি তাকে হত্যা করি।
সব শুনে রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, “শোনো সাহাবিরা, তোমরা সাক্ষী থাকো, এই দাসীর রক্ত মূল্যহীন।”
{সুনানে আবু দাউদঃ ৪৩৬১; সুনানে নাসায়িঃ ৭/১০৭; সুনানে দারাকুতনিঃ ৩/১১২-১১৩; মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ৪/৩৫৪; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকিঃ ৭/৬০, ১০/১৩১; আসসারিমুল মাসলুলঃ ১৪১। ইমাম হাকিম বলেন, هذا حديث صحيح الإسناد على شرط مسلم ولم يخرجاه .। আল্লামা যাহাবিও ইমাম হাকিমের এই বক্তব্যের ওপর কোনো আপত্তি করেননি। হাফিজ ইবনে হাজার বুলুগুল মারাম গ্রন্থে (পৃ. ২৫৫, হাদিস নাম্বার, ১২৩০) বলেন, এর বর্ণনাকারীগণ সিকাহ-নির্ভরযোগ্য। শায়খ আলবানি, শায়খ শুআইব আরনাউতও আবু দাউদের টীকায় হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন}
৩.
এক অশীতিপর বৃদ্ধ। নাম তার আবু আফাক। ইহুদি ধর্মের অনুসারী। রাসুলুল্লাহ সা. যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখনই তার বয়স ১২০ বছর। দাঁড়ি চুল সব পেকে সাদা ধবধবে হয়ে গেছে সেই কবেই। বুড়োও জানে, তার এক পা কবরে চলে গেছে বহু আগেই। যেকোনো দিন, যেকোনো সময়ই তার পরপারের ডাক চলে আসতে পারে। ইহুদি গোষ্ঠীর রক্তের সাথে মিশে আছে ইসলামের প্রতি বৈরিতা। সুযোগ পেলেই ইসলামকে বধ করবে এমন এক অবস্থা। শুধু কি ইসলাম এবং মুসলমান! আল্লাহর কতো নবির রক্তে যে রঞ্জিত হয়েছে এই বর্বর গোষ্ঠীর হাত— তার সঠিক হিসাব আল্লাহই ভালো জানেন।
বৃদ্ধ আবু আফাকের কানেও ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছেছে। কিন্তু সে ইসলাম গ্রহণ করবে তো দূরের কথা, রাসুলুল্লাহর মদিনায় আগমন এবং মদিনাকে ইসলামি রাষ্ট্রে রূপান্তরিতকরণে তার ভেতরটা দগ্ধ হয়ে গেছে। সে যেনো ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডে প্রতিমুহূর্তে প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে। কীভাবে ইসলামের জ্বলন্ত দীপশিখাকে নিজের মুখের ফুৎকারে নেভাতে পারবে— এ ভেবেই তার দিন কাটে। বার্ধক্য তার দেহের বল কেড়ে নিয়েছে। তরবারি নিয়ে জঙ্গ করার সামর্থ্য তো আর এখন নেই। হাঁ, ইহুদিরা জঙ্গ করেছেই বা কবে?! ওদের অভ্যেস তো হলো, আগুন জ্বালিয়ে দেয়া। জনগণকে উত্তেজিত করে ফাসাদ সৃষ্টি করে সুকৌশলে ওরা কেটে পড়ে। এরপর গ্যালারিতে বসে মজা করে খেলা দেখে আর হাততালি বাহবা দিয়ে স্টেডিয়াম জমিয়ে রাখে। প্রচারের কাজটাও ভালোই সারতে পারে। ওরা রাখে থার্ড পার্টির ভূমিকা। সবকিছুর আড়ালে থেকে যারা শুধুই কলকাঠি নেড়ে যায় অবিরল।
ইহুদি আবু আফাকের ভাষণ দেয়ার যোগ্যতা ছিলো। তার কাব্যপ্রতিভাও ছিলো। জাহেলি যুগে কাব্য-সাহিত্যে বামদের দখল ছিলো বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। ইসলামের বিপক্ষে সে তার এই যোগ্যতাকেই কাজে লাগালো। রাসুলুল্লাহ সা. এর বিপক্ষে দ্রোহের আগুন উসকে দিলো। লোকজনকে ইসলাম ধ্বংস করার জন্য, নবি মুহাম্মাদ সা. কে হত্যা করার জন্য সাধ্যমতো প্ররোচিত করতে লাগলো। যদিও তারা মুসলমানদের সাথে ‘যিম্মা চুক্তি’তে আবদ্ধ ছিলো, কিন্তু বর্বর ইহুদি গোষ্ঠী এসব চুক্তি-টুক্তির থোরাই কেয়ার করতো। এক্ষেত্রে তার মুক্তচিন্তার আহ্বানকে অনেকেই পছন্দ করলো। অল্পদিনেই সে তার সমমনা একঝাঁক ফ্যান পেয়ে গেলো। ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক যে কাব্যই তার ভেতর থেকে উদগীরিত হতো, তাতে বিরুদ্ধবাদীদের লাইক-রিয়েক্টে ভরে যেতো।
বদর যুদ্ধে মুসলমানদের অভাবিত ও অপ্রত্যাশিত সাফল্য দেখে বুড়োর দ্বেষ ও জ্বালা আরো বেড়ে গেলো। যখন সে জানতে পারলো, ইসলামের নবি সা. নিজ হাতে হারিস ইবনে সুওয়াইদ ইবনুস সামিতকে হত্যা করেছেন, তখন সে খোল্লমখোলাই তার বেইমানি ও নেফাক প্রকাশ করে ফেললো। সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে লাগলো—
قد عشت حينا وما إن أرى … من الناس دارًا ولا مجمعا
أجم عقولا وآتى إلى … منيب سراعًا إذا ما دعا
فسلبهم أمرهم راكب … حرامًا حلالاً لشتى معا
فلو كان بالملك صدقتم … وبالنصر تابعتم تبعا
ইবনে হিশামের বর্ণনানুযায়ী কবিতার শব্দগুলো নিম্নরূপ—
لَقَدْ عِشْتُ دَهْرًا وَمَا إنْ أَرَى … مِنْ النَّاسِ دَارًا وَلَا مَجْمَعَا
أَبَرَّ عُهُودًا وَأَوْفَى لِمَنْ … يُعَاقَدُ فِيهِمْ إذَا مَا دَعَا
مِنْ أَوْلَادِ قَيْلَةَ فِي جَمْعِهِمْ … يَهُدُّ الْجِبَالَ وَلَمْ يَخْضَعَا
فَصَدَّعَهُمْ رَاكِبٌ جَاءَهُمْ … حَلَالٌ حَرَامٌ لِشَتَّى مَعَا
فَلَوْ أَنَّ بِالْعِزِّ صَدَّقْتُمْ … أَوْ الْمُلْكِ تَابَعْتُمْ تُبَّعَا
আল্লাহর রাসুলের সাহাবি সালিম ইবনে উমায়র রা. যখন আবু আফাকের এহেন আস্পর্ধার কথা জানতে পারেন, তখন তিনি বলেন, আমি মানত করে নিজের ওপর অপরিহার্য করে নিলাম, আমি এই জাহান্নামের কুকুর আবু আফাককে নিজের হাতে হত্যা করবো। যদি হত্যা করতে না পারি, তাহলে তার সামনে আঘাতে-প্রতিঘাতে নিজে শাহাদাতের সুধা পান করবো।
সালিম ইবনে উমায়র রা. ছিলেন অনেক বড় বুযুর্গ। নিজ গোত্রে ‘বাক্কা’ (তথা আল্লাহর ভয়ে যার চোখ থেকে সর্বদা অশ্রু ঝড়ে) হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বুযুর্গ হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর রাসুলের ডাকে তাঁর সঙ্গে জিহাদের ময়দানে শরিক থাকতেন সর্বাগ্রে। তার নফল ইবাদত-বন্দেগির ব্যস্ততা কখনোই তাকে দীনের পথে জীবনোৎসর্গ করার মহান খেদমত থেকে দূরে সরিয়ে রাখেনি। সালিম ইবনে উমায়র রা. ছিলেন বদরি সাহাবি, যাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ দুনিয়াতেই ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। {দ্রষ্টব্য— সহিহ বুখারি, মাগাযি অধ্যায়}। সালিম ইবনে উমায়র রা. লাইলাতুল আকাবায় অংশগ্রহণকারীদেরও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাবুক ছাড়া বদর পরবর্তী প্রায় সবগুলো যুদ্ধেই তিনি বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন সেই মহান সাত সাহাবির অন্যতম, যাদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল হয়েছে—
وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ
{সুরা তাওবাঃ ৯২}
রাসুলুল্লাহ সা. যখন তাবুক যুদ্ধে বের হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তখন তারা সাতজন সাহাবি এসে রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে আবেদন জানান, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের বাহনের ব্যবস্থা করুন। তারা দরিদ্র ছিলেন। তাই তাদের নিজেদের পক্ষে বাহনের ব্যবস্থা করা সম্ভবপর ছিলো না। কিন্তু দারিদ্যের কারণে জিহাদ থেকে পিছিয়ে থাকবেন, এটাও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। আখের নিজেদের অন্তরকেই কী বলে প্রবোধ দিবেন। সিরাতপাঠকারীদের অজানা নয়, তাবুকের যুদ্ধের সময় মুসলমানদের অবস্থা কী সকরুণ ছিলো। কোরআন মাজিদেই এ যুদ্ধকে ‘গাযওয়াতুল উসরা’ তথা কঠিন যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছেও তখন এ পরিমাণ সামর্থ্য ছিলো না। অনন্তর রাসুলুল্লাহ সা. ব্যথাতুর হৃদয়ে উত্তর দিলেন, আমার কাছে তো এই পরিমাণ সামর্থ্য নেই, যা দিয়ে তোমাদের বাহনের ব্যবস্থা করবো। বাধ্য হয়ে তারা তখন ফিরে গেলেন। কোরআন বলছে, ফেরার সময়ে তাদের অবস্থা ছিলো, আল্লাহর পথে খরচ না করতে পারায় দুঃখে তাদের অন্তর বিগলিত হয়ে দু’চোখ থেকে অশ্রুর ধারা প্রবাহিত হচ্ছিলো। সালিম ইবনে উমায়র রা. মুআবিয়া রা. এর যুগে তার ইন্তেকাল করেন। {দেখুন— তাবাকাতু ইবনি সা’দঃ ৩/৪৮০; উসদুল গাবাহঃ ২/৩১১; আলইসাবাহঃ ৩/৫৫}
সালিম ইবনে উমায়র রা. এরপর থেকে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন। তিনি অপেক্ষায় ছিলেন, কোনো সুযোগ পাওয়ামাত্রই এই নরাধম রাসুলদ্রোহীর ভবলীলা সাঙ্গ করবেন। একরাতের কথা। গ্রীষ্মের তাপদাহে সকলের অবস্থা কাহিল। বুড়োর জন্য অবস্থা আরো সুকঠিন। পরিশেষে গ্রীষ্মের তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে ঘরে আর থাকতে না পেরে বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের প্রাঙ্গনে এসেই শুয়ে পড়লো। সালিম ইবনে উমায়র রা. তো বহুদিন ধরে রেকি করছেন। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বুড়ো সর্বদাই তার সমমনা ফ্যানদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতো। গোত্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সর্বদা বুড়োর নিরাপত্তার জন্য ফেদা ছিলো। কারণ তারা জানতো, তারা দশজন মিলে ইসলামের বিরুদ্ধে যা না করতে পারবে, এক বুড়ো তার যবান এবং কলমের দ্বারা তারচে’ কয়েকগুণ বেশি করতে পারবে। সালিম ইবনে উমায়র রা. এজন্য অনেকদিন খুঁজে ফিরেও গেরিলা এটাক বা এসাসিনেইশনের জন্য মোক্ষম কোনো সুযোগ পাচ্ছিলেন না। গ্রীষ্মের তাপদাহ সেদিন তার জন্য সুযোগ বের করে দিলো।
মধ্যরাত। বুড়ো আবু আফাক গভীর ঘুমে বিভোর। নিরাপত্তারক্ষীরাও যে যার মতো ঘুমাচ্ছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির বাইরে রাতদুপুরে গেরিলা এটাক হতে পারে এটা তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। তাছাড়া তারা মুসলমানদেরকে শান্তিকামী এবং পরমতসহিষ্ণু হিসেবেই জানে। মুসলমানদের সঙ্গে তাদের যিম্মা চুক্তিও করা আছে। সবমিলিয়ে নিঃসঙ্কোচে তারা ঘুমাচ্ছে। এ সুযোগে সালিম ইবনে উমায়র রা. পা টিপে টিপে বুড়োর শয্যার কাছে এসে পৌঁছলেন। টার্গেট রেঞ্জের মধ্যে আসামাত্রই অযথা কালক্ষেপণ না করে রাসুলদ্রোহী আবু আফাকের কলজে বরাবর তরবারির ফলাটা ঢুকিয়ে দিলেন। বুড়ো আপ্রাণ শক্তিতে চিৎকার করে উঠলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুড়ো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
বুড়োর চিৎকার শুনে নিরাপত্তাকর্মীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তড়ঘড় করে ছুটে এলো। কিন্তু ততোক্ষণে কেল্লাফতেহ। তারা চারিদিকে মশাল জ্বালিয়ে কিলারকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাওই কারো দেখা পেলো না। অনন্তর তারা বুড়োকে কবরস্থ করলো। পরবর্তী দিনগুলোতেও তাদের অনুসন্ধান জারি থাকলো। পরিশেষে নিরাশ হয়ে গণমাধ্যমে তারা জানালো, যদি কোনোভাবে জানতে পারতাম, কে এই মহান কবিকে হত্যা করেছে, তাহলে আমরা হত্যাকারীকেও কোনো কথা ছাড়াই হত্যা করে ফেলতাম।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সা. এবার কোনো ট্রাইবুনালও বসাননি। সালিম ইবনে উমায়র রা. এর থেকে কোনো জবাবদিহিতাও তলব করেননি। হয়তো তার নিরাপত্তার জন্য। ইহুদিরা হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পারলে এক ‘মহান’ কবির বদলে সালিম রা. কেও হত্যা করে ফেলবে— এই আশঙ্কায় হয়তো রাসুলুল্লাহ সা. জনসমক্ষে এই অপারেশনের মহান নায়কের নাম প্রকাশ করেননি। আর কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই গুপ্তহত্যা পরিচালনার জন্য রাসুলুল্লাহ সা. ই তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এই ঘটনার পরে সাহাবিগণ অত্যন্ত খুশি হন। এক নারী সাহাবি উমামা রা. তার কালজয়ী কবিতাটি তখন আবৃত্তি করেন—
تُكَذِّبُ دِينَ اللَّهِ وَالْمَرْءَ أَحْمَدَا … لَعَمْرُ الَّذِي أَمْنَاكَ أَنْ بِئْسَ مَا يُمْنِي
حَبَاكَ حَنِيفٌ آخِرَ اللَّيْلِ طَعْنَةً … أَبَا عَفَكٍ خُذْهَا عَلَى كِبَرِ السِّنِّ
{আলামাগাযি, ওয়াকিদিঃ ১/১৭৪-১৭৫; সিরাতে ইবনে হিশামঃ ৪/২১৩; আসসারিমুল মাসলুলঃ ১/২১১; আসসাইফুল মাসলুলঃ ৩২৪; প্রাগুক্ত}
৪.
আসমা বিনতে মারওয়ান। বনু উমাইয়া বিন যায়দ গোত্রের মেয়ে। খাতমা গোত্রের ইয়াযিদ ইবনে যায়দের স্ত্রী। সংসার জীবন ভালোই কাটছিলো তার। স্বামী সন্তান নিয়ে দিনকাল সুখের সাথেই যাচ্ছিলো। বেচারির মাথায় ভূত চাপলো। পুরুষরা নবিজির বিরুদ্ধে এতোকিছু করছে, নারীরা কেনো পিছিয়ে থাকবে?! কবিতা রচনার যোগ্যতা ছিলো আসমার। আসমা তার কবিতায় নবিজি সা. এর নামে আজেবাজে কথা লিখতো। ইসলামের নামে প্রোপাগান্ডা চালাতো। তার গোত্রের মুক্তমনা লোকদেরকে নবিজি সা. এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য প্ররোচিত করতো। নারী হয়েও আসমা এক্ষেত্রে বেশ ভালোই ভূমিকা রাখছিলো।
রাসুলুল্লাহ সা. তখন বদর প্রান্তরে। মুসলমান এবং কুফফার গোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামের ইতিহাসের সবচে অবিস্মরণীয় জঙ্গ সংঘটিত হচ্ছে। বড় বড় সাহাবিরাও রাসুলুল্লাহ সা. এর সঙ্গে মদিনার বাইরে রয়েছেন। এ সুযোগে আসমা আরো জ্বলে ওঠলো। সেসময়ে সে তার সেই কুখ্যাত কবিতা রচনা করে সামাজিক প্রচারমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দিলো। আসমার সেই কবিতা নিম্নরূপ—
فباست بني مالك والنبيت + وعوف وباست بني الخزرج
أطعتم أتاوي من غيركم + فلا من مراد ولا مذحج
ترجونه بعد قتل الرؤوس + كما يرتجى مرق المنضج
ألا أنف يبتغي غرة + فيقطع من أمل المرتجي
বনু মালিক, নাবিত, আওফ কতোই না মন্দ! বনু খাযরাজকেও ধিক্কার! তোমরা এক ভিনদেশীর আনুগত্য করেছো, যে তোমাদের নিজেদের লোক নয়, মুরাদ বা মাযহিজ গোত্রেরও নয়। নেতৃবর্গের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর তোমরা তাকে নেতৃত্বের প্রত্যাশা দিচ্ছো যেমনিভাবে রাঁধুনীর সুস্বাদু ঝোলের প্রত্যাশা করা হয়। কেউ কি নেই, যে সুযোগ খুঁজে (তরবারির আঘাতে) প্রত্যাশাকারীর আশা কেটে দেবে।”
খাতমা গোত্রের এক অন্ধ সাহাবি উমায়র ইবনে আদি রা.। অন্ধ হওয়ার কারণে তিনি রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে কোনো যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করতে পারেননি। আসমার এহেন গোস্তাখির কথা তার কানে পৌঁছে। এতে তিনি খুব ব্যথিত ও মর্মাহত হন। তিনি আল্লাহর কাছে রোনাজারি করে বলেন, হে আল্লাহ, তোমার নামে কসম খেলাম, তুমি যদি রাসুলুল্লাহ সা. কে বদর প্রাঙ্গন থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করাও, তাহলে আমি অবশ্যই অবশ্যই এই গোস্তাখে রাসুলকে হত্যা করেই ছাড়বো। আল্লাহর অনুগ্রহে রাসুলুল্লাহ সা. বদর যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত বিজয় লাভ করেন। এরপর সাহাবিদেরকে সঙ্গে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। অন্ধ সাহাবি উমায়র রা. এর কানে যখন প্রিয়নবির সাফল্যের বার্তা পৌঁছে, তখন তিনি তার কসম পূর্ণ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
একরাতের কথা। রাত তখন অনেক গভীর। মদিনার সবাই ঘুমাচ্ছে। উমায়র রা. অনুমান করে করে আসমার ঘরে গিয়ে পৌঁছেন। আসমার চারপাশে তাকে জড়িয়ে তার সন্তানরা ঘুমাচ্ছে। এক সন্তান ঘুম ভেঙ্গে কান্না শুরু করায় আসমা উঠে তাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। এমন সময় উমায়র রা. দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেন। ঘরের ভেতর পুরোই অন্ধকার। অন্ধ সাহাবির কাছে তো পুরো দুনিয়াই অন্ধকার। আসমা প্রথমে উমায়র রা. এর এভাবে রাতদুপুরে ঘরে ঢুকে পড়ার ব্যাপারটা টের পায়নি। তার খেয়াল কোলের সন্তানের প্রতি। উমায়র রা. হাত বাড়িয়ে টার্গেট খুঁজতে লাগলেন। অনন্তর আসমা রা. এর গায়ে তার হাতের স্পর্শ লাগলো। অন্ধদের দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও অনুভব শক্তি থাকে বেশ শক্তিশালী। তিনি টার্গেট চিনে ফেললেন। আসমার কোলে যে এক সন্তান দুধ খাচ্ছে তাও বুঝে ফেললেন। হাতের স্পর্শ লাগায় আসমাও তখন সম্বিত ফিরে পেয়েছে। সে কিছু করতে যাবে তার আগেই উমায়র রা. এক হাতের ধাক্কায় কোলের সন্তানকে সরিয়ে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে আসমার বুকের মধ্যে তরবারির ফলাটা ঢুকিয়ে দেন। গোস্তাখে রাসুলের পিঠ ভেদ করে তরাবারির ফলাটা বেরিয়ে যায়। এক আঘাতেই রাসুলদ্রোহীর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়।
পরববর্তী দিন রাসুলুল্লাহ সা. এর সঙ্গে উমায়র রা. এর মুলাকাত হয়। রাসুলুল্লাহ সা. তাকে জিজ্ঞেস করেন, বিনতে মারওয়ানকে তুমি হত্যা করেছো? উমায়র রা. উত্তর দেন, হে আল্লাহর রাসুল আপনার জন্য আমার পিতা উৎসর্গিত হোক, জি হাঁ। প্রশ্ন শুনে উমায়র রা. কিছুটা ভয় পেয়ে যান। রাসুলুল্লাহর অনুমতি না নিয়ে এমন রক্তপাত করা বৈধ হলো কিনা— তার মনে সে প্রশ্নের উদ্রেক হয়। কিন্তু যেখানে প্রশ্ন ভালোবাসার ও আত্মমর্যাদার, যেখানে প্রশ্ন আল্লাহ এবং তার রাসুলের, সেখানে বিলম্ব বা ইজতিহাদের ফুরসত কোথায়! প্রকৃত প্রেমিক প্রেমাষ্পদের অপমানে অনিয়ন্ত্রিত ও আবেগতাড়িত হয়ে যায়, প্রেমাষ্পদের অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে তবেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অনন্তর উমায়র রা. রাসুলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল, এর জন্য আমার ওপর কি কোনো শাস্তি আরোপিত হবে? রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, এই মহিলার ব্যাপারে দু’টি ছাগলে গুঁতাগুঁতি করতে পারে না। অর্থাৎ তোমার ওপর কিছুই আপতিত হবে না। আর এই মাসআলা এতোটা সুস্পষ্ট, যা নিয়ে কেউ মতবিরোধ করবে না। { كناية عن المسألة الواضحة التي لا يختلف عليها اثنان} আননিহায়াঃ ৫/৭৪; মাজমাউল আমসালঃ ২/২২৮। বর্ণনাকারীর বক্তব্য, রাসুলুল্লাহ সা. এর মুখ থেকে এ ধরনের বাক্য সেবারই প্রথম শোনা গেছে।
উমায়র রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. এরপর আশপাশের সাহাবিদের দিকে তাকালেন। এরপর তিনি বললেন, যদি তোমরা এমন ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করতে ভালোবাসো, যে অদৃশ্যভাবে আল্লাহ এবং তার রাসুলকে সাহায্য করেছে, তাহলে উমায়র ইবনে আদিকে দেখো। উমর রা. বললেন, তোমরা এই অন্ধ সাহাবিকে দেখো, যে গভীর রাতে আল্লাহর আনুগত্য করেছে। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ওমর, অন্ধ বলো না, বরং বলো দৃষ্টিবান।
উমায়র রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর মজলিস থেকে যখন নিজ গোত্রে ফিরে আসেন, তখন দেখতে পান, একদল মানুষ আসমাকে কবরস্থ করছে। উমায়র রা. কে দেখে সকলে তড়ঘড় করে ছুটে আসে। রূঢ়স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করে, উমায়র, তুমিই কি আসমাকে হত্যা করেছো? উমায়র রা. তখন নিঃসঙ্কোচে বলে ওঠেন, হাঁ, আমিই তাকে হত্যা করেছে। এখন তোমরা আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করো। আমাকে মোটেও অবকাশ দিও না। সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন, তোমরা সবাই মিলে যদি সেই কথা বলতে, যা এই আসমা বলেছে, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের ওপর আমার তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। এরপর হয়তো নিজে মরতাম অথবা তোমাদের সবাইকে হত্যা করে ফেলতাম। উমায়র রা. এর সাহসী উচ্চারণ শুনে তারা হতচকিয়ে যায়। বর্ণনাকারী বলেন, সেদিন থেকে খাতমা গোত্রে ইসলাম বিজয় লাভ করে। এর আগে খাতমা গোত্রের একদল সাহাবি নিজেদের ইমান আনয়নের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। সেসময়ে তারা সকলেও নিজেদের ইসলামগ্রহণের কথা প্রকাশ করেন। কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায়, উমায়র রা. ছিলেন নিজ গোত্রের ইমাম। তার তেলাওয়াত ছিলো বড় সুমিষ্ট। ইলমি পাণ্ডিত্যও ছিলো ঈর্ষনীয়। এ ঘটনার পরে হাসসান ইবনে সাবিত রা. উমায়র রা. এর প্রশংসা করে স্তুতি রচনা করেন—
بني وائل وبني واقف … وخطمة دون بني الخزرج
متى ما ادعت أختكم ويحها … بعولتها والمنايا تجي
فهزت فتى ماجدا عرقه … كريم المداخل والمخرج
فضرجها من نجيع الدما … قبيل الصباح ولم تخرج
فأورده الله برد الجنا … ن جذلان في نعمة المولج
{আলকামিল, ইবনে আদিঃ ৬/১৪৫, ২১৫৬; তারিখে বাগদাদঃ ১৩/৯৯; তারিখে ইবনে আসাকিরঃ ৬/২১; আলইসাবাহঃ ৩/৩৪; কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়দঃ ২৩৪; আলমু’জামুল কাবির, তবরানিঃ ১৭/৬৪-৬৫; মাজমাউয যাওয়ায়িদঃ ৬/২৬০; আলমাগাযি, ওয়াকিদিঃ ১/১৭২-১৭৪; আসসারিমুল মাসলুলঃ ১৯৫-২১০; আসসাইফুল মাসলুলঃ ৩৪৬-৩৫২}