হজরাতুল উসতাদ শায়খ সফিউল্লাহ ফুয়াদ (হাফিজাহুল্লাহ)-এর সদ্য প্রকাশিত বই ‘ঈমান-কুফর ও তাকফির’। বইটি মূলত মুফতি শফি রহ.-এর ‘ইমান ও কুফর কোরআন কি রৌশনি মেঁ’ এবং ‘মুরতাদ কি সাজা ইসলাম মেঁ’ গ্রন্থদ্বয়ের বাংলা অনুবাদ। তবে বইটিতে হজরাতুল উসতাদের কিছু মূল্যবান সংযোজন রয়েছে। বইয়ের শুরুতে ‘অনুবাদকের নিবেদন’ শিরোনামে হজরাতুল উসতাদ ভূমিকার কথাগুলো ২১ পৃষ্ঠাব্যাপী আলোচনা করেছেন। এতে ‘ইসলামে মুরতাদের শাস্তি’ উপশিরোনামের অধীনে তিনি কাদিয়ানের বিষয়ে কয়েকটি কথা তুলে ধরেছেন। মূলত সেই কথাগুলোর ওপরই আমাদের এই ক্ষুদ্র পর্যালোচনা।
হজরাতুল উসতাদ লিখেছেন,
‘“ইসলামে মুরতাদের শাস্তি” পুস্তিকাও বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ কাদিয়ানিদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে গুরুত্বের কারণ ব্যাখ্যা করা যায়। কাদিয়ানিদেরকে কাফের ঘোষণা দেওয়ার আন্দোলনকারী মাশায়েখ ও আকাবিরগণ দ্ব্যর্থহীনভাষায় বলেন, আমরা শুধু “তারা কাফের, মুসলমান নয়” সরকারের এ ঘোষণাটিই দাবি করছি। তারপর অন্যান্য অমুসলিমরা যেভাবে নিজেদের অমুসলিম পরিচয়ে দেশে বসবাস করছে, তারাও সেভাবে বসবাস করবে। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
…প্রসঙ্গত একটি কথা হলো, আমরা ও আমাদের সরকার মুসলমান হলে, যিন্দিকদেরকে মুরতাদ ঘোষণা করার জন্য আন্দোলন তো দূরের কথা, আবেদনও করতে হবে কেন? শুধু কাদিয়ানিদেরকে নয়, বরং যিন্দিককে মুরতাদ ঘোষণা করে তাদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা, মুসলিম সরকারের নিজেরই দায়িত্ব।
…এক মাদরাসায় কাদিয়ানিদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার পদ্ধতি বিষয়ক একটি কর্মশালা হয়েছিল। তখন একজন আলেম বললেন, কাদিয়ানিদেরকে যদি মুরতাদ মনে করেন, তাহলে আমার মন্তব্য হলো, তাদের ব্যাপারে কিতাবে যা আছে তা আমরা করছি না এবং যা করছি, তা কিতাবে নেই। তাঁর এ মূল্যায়ন শ্রবণ করে সেখানকার প্রধান শায়খ তাঁকে কঠিনভাবে শাসিয়েছেন।… এ পরিস্থিতিতে এ পুস্তিকাটি অনুবাদ করা আশা করি আমার সার্থক হয়েছে।’”
হজরাতুল উসতাদের উপরিউক্ত আলোচনা থেকে অনুমিত হয়, প্রথমত তিনি জিনদিক ও মুরতাদকে সমার্থক মনে করেন। উল্লেখিত দ্বিতীয় প্যারা থেকে এমনটিই ফুটে ওঠে। আর দ্বিতীয়ত তিনি জিনদিক ও মুরতাদের শাস্তি অভিন্ন মনে করেন। এটা মূলত প্রথমটিরই অপরিহার্য ফলাফল। সুতরাং হজরতের পুরো কথার খোলাসা দাঁড়ায় : কাদিয়ানিরা মুরতাদ এবং তাদের ওপর মুরতাদের শাস্তি আরোপিত হবে। কারণ, যারাই জিনদিক, তারাই মুরতাদ। সুতরাং জিনদিকের শাস্তিও তা-ই, মুরতাদের শাস্তি যা। যদিও এর আলোকে প্রথমেই যে প্রশ্নটি আসবে তা হলো, সব কাদিয়ানি তো আর মুসলিম থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া নয়। বর্তমানে অনেক কাদিয়ানি এমনও আছে, যারা বুঝ হওয়ার পর থেকেই কাদিয়ানি ধর্মের ওপর বেড়ে উঠেছে। এখন তাদের ওপর ‘মুরতাদ’ শব্দ প্রয়োগ করা হলে এর অর্থ দাঁড়ায়, পূর্বে তারা মুসলিম ছিল, পরে ধর্ম পাল্টিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন। সুতরাং তাদেরকে মুরতাদ বললে মুরতাদ শব্দটি তার মর্ম হারাবে।
উল্লেখ্য, কাদিয়ানি এবং অন্যান্য কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে আমাদের একটি অনূদিত পুস্তিকা রয়েছে; যার শিরোনাম, কাদিয়ানি এবং অন্যান্য কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য। আগ্রহীগণ উক্ত লিংক ভিজিট করে পুরো বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জেনে নিতে পারেন। এখানে আমরা সংক্ষেপে কয়েকটি দিক তুলে ধরছি।
প্রথমে আমরা জেনে নিই, জিনদিক কাকে বলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকিহের মত হলো, জিনদিক এমন ব্যক্তি, যে নিজেকে মুসলিম দাবি করে, কিন্তু অন্তরে কুফরি আকিদা পোষণ করে। সহজ করে বললে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যুগে যাদের মুনাফিক বলা হতো, ফকিহগণের পরিভাষায় তাদেরই জিনদিক বলা হয়। ইমাম মালিক রাহ. থেকেও উক্তি বর্ণিত রয়েছে, আল্লাহর রাসুল ﷺ-এর যুগের মুনাফিকই হলো আজকের জিনদিক। ‘আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যাহ’ গ্রন্থে এসেছে,
وَالزَّنْدَقَةُ عِنْدَ جُمْهُورِ الْفُقَهَاءِ إِظْهَارُ الإْسْلاَمِ وَإِبْطَانُ الْكُفْرِ، فَالزِّنْدِيقُ هُوَ مَنْ يُظْهِرُ الإْسْلاَمَ وَيُبْطِنُ الْكُفْرَ. قَال الدُّسُوقِيُّ: وَهُوَ الْمُسَمَّى فِي الصَّدْرِ الأْوَّل مُنَافِقًا، وَيُسَمِّيهِ الْفُقَهَاءُ زِنْدِيقًا.
এবার আসি জিনদিক ও মুরতাদের মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে। ‘রাদ্দুল মুহতার’ (ফাতাওয়া শামি) গ্রন্থে এসেছে,
وَالْفَرْقُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْمُرْتَدِّ الْعُمُومُ الْوَجْهِيُّ لِأَنَّهُ قَدْ لَا يَكُونُ مُرْتَدًّا، كَمَا لَوْ كَانَ زِنْدِيقًا أَصْلِيًّا غَيْرَ مُنْتَقِلٍ عَنْ دِينِ الْإِسْلَامِ، وَالْمُرْتَدُّ قَدْ لَا يَكُونُ زِنْدِيقًا كَمَا لَوْ تَنَصَّرَ أَوْ تَهَوَّدَ، وَقَدْ يَكُونُ مُسْلِمًا فَيَتَزَنْدَقُ. وَأَمَّا فِي اصْطِلَاحِ الشَّرْعِ، فَالْفَرْقُ أَظْهَرُ لِاعْتِبَارِهِمْ فِيهِ إبْطَانَ الْكُفْرِ وَالِاعْتِرَافَ بِنُبُوَّةِ نَبِيِّنَا – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – عَلَى مَا فِي شَرْحِ الْمَقَاصِدِ، لَكِنَّ الْقَيْدَ الثَّانِيَ فِي الزِّنْدِيقِ الْإِسْلَامِيِّ بِخِلَافِ غَيْرِهِ.
(আক্ষরিক অর্থের বিবেচনায়) মুরতাদ ও জিনদিকের মধ্যে ‘উমুম ও খুসুস মিন ওয়াজহিন’র সম্পর্ক। কারণ এমনও হতে পারে যে, জিনদিক ব্যক্তি মুরতাদ নয়। যেমন, একজন ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম থেকে রূপান্তরিত না হয়ে আদি জিনদিক হতে পারে। আবার মুরতাদ যে হবে, সে জিনদিক না-ও হতে পারে। যেমন, সে খ্রিষ্টধর্ম বা ইহুদিধর্ম গ্রহণ করে নিল। আবার এমনও হতে পারে, সে মুসলিম ছিল, পরে জিনদিক হয়েছে। আর শরিয়াহর পরিভাষার বিবেচনায় পার্থক্য তো একেবারেই সুস্পষ্ট। কারণ, ফকিহগণ জিনদিকের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন তা হলো, সে কুফর গোপন করে রাখে এবং আমাদের নবি ﷺ-এর নবুওয়াত স্বীকার করে। ‘শারহুল মাকাসিদ’ গ্রন্থে এমনটিই এসেছে। তবে দ্বিতীয় শর্তটি (অর্থাৎ নবি ﷺ-এর নবুওয়াত স্বীকার করা) সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে মুসলিম নামধারী জিনদিক। অন্যদের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়।
আল্লামা ইবনু আবিদিন শামি রাহ. অন্যত্র জিনদিকের পরিচয় আরও স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন,
فَإِنَّ الزِّنْدِيقَ يُمَوِّهُ كُفْرَهُ وَيُرَوِّجُ عَقِيدَتَهُ الْفَاسِدَةَ وَيُخْرِجُهَا فِي الصُّورَةِ الصَّحِيحَةِ، وَهَذَا مَعْنَى إبْطَان الْكُفْرِ
জিনদিক ব্যক্তি তার কুফরকে ছদ্মাবরণ দ্বারা লুকিয়ে রাখে এবং তার বাতিল আকিদাকে বিশুদ্ধ রূপের আকৃতি পরিয়ে সমাজে প্রচার করে। এটাই হলো তার কুফর গোপন করার অর্থ।
সুতরাং বোঝা গেল, মুরতাদ ও জিনদিক আলাদা। মুরতাদ তাকে বলা হয়, যে ইসলাম ত্যাগ করে। আর জিনদিক তাকে বলা হয়, যে ইসলামের নাম ধারণ করে নিজের কুফরি আকিদা সমাজে প্রকাশ ও প্রচার করে। ইসলামে জন্য মুরতাদের চাইতে জিনদিক অধিক ক্ষতিকর। কারণ, জিনদিকের দ্বারা অন্যরা প্রতারিত হয়। তারা কুফরকে ইসলাম ভাবতে শুরু করে। অপরদিকে মুরতাদ ইসলাম ত্যাগ করার কারণে তার ব্যাপারে অন্যরা সাধারণত সজাগ ও সতর্ক থাকে। তার রিদ্দাহ জনসাধারণের সামনে সুস্পষ্ট ও প্রকাশিত থাকে। এ কারণে মুরতাদের চাইতেও জিনদিকের শাস্তি কঠিন রাখা হয়েছে। আল্লামা ইবনু আবিদিন শামি রাহ. লেখেন,
الزِّنْدِيقُ إذَا أُخِذَ قَبْلَ التَّوْبَةِ يُقْتَلُ وَلَا تُؤْخَذُ مِنْهُ الْجِزْيَةُ [تَنْبِيهٌ]. قَالَ فِي الْفَتْحِ قَالُوا لَوْ جَاءَ زِنْدِيقٌ قَبْلَ أَنْ يُؤْخَذَ فَأَخْبَرَ بِأَنَّهُ زِنْدِيقٌ وَتَابَ تُقْبَلُ تَوْبَتُهُ، فَإِنْ أُخِذَ ثُمَّ تَابَ لَا تُقْبَلُ تَوْبَتُهُ وَيُقْتَلُ لِأَنَّهُمْ بَاطِنِيَّةٌ يَعْتَقِدُونَ فِي الْبَاطِنِ خِلَافَ ذَلِكَ فَيُقْتَلُ وَلَا تُؤْخَذُ مِنْهُ الْجِزْيَةُ. اهـ. وَسَيَأْتِي فِي بَابِ الْمُرْتَدِّ أَنَّ هَذَا التَّفْصِيلَ هُوَ الْمُفْتَى بِهِ
জিনদিক ব্যক্তিকে তাওবার আগে গ্রেফতার করা হলে তাকে হত্যা করা হবে, তার থেকে জিযয়া গ্রহণ করা হবে না। ‘ফাতহুল কাদির’ গ্রন্থে এসেছে, ফকিহগণ বলেছেন, গ্রেফতার করার আগে কোনো জিনদিক যদি নিজের থেকে এসে সংবাদ দেয় যে, সে একজন জিনদিক আর সে তাওবা করেছে, তাহলে তার তাওবা কবুল করা হবে। যদি গ্রেফতার করার পর সে তাওবা করে, তাহলে তার তাওবা কবুল না করে তাকে হত্যা করা হবে। কারণ, তারা বাতিনিয়্যাহ। তারা বাতিনে (ভেতরে) এর বিপরীত আকিদা পোষণ করে। সুতরাং তাদেরকে হত্যা করা হবে, তাদের থেকে জিযয়া গ্রহণ করা হবে না। ‘মুরতাদ অধ্যায়ে’ আলোচনা আসবে যে, এই মতটিই হচ্ছে ‘মুফতা বিহি’ (এর আলোকে ফাতওয়া দেওয়া হয়)।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মুরতাদের চাইতে জিনদিকের বিষয়টি গুরুতর। যেখানে মুরতাদকে গ্রেফতার করার পরও তিন দিন অবকাশ দেওয়া হয় এবং তার সংশয় দূর করার জন্য চেষ্টা চালানো হয়, সেখানে জিনদিক একবার গ্রেফতার হলে তার তাওবাই আর কবুল করার সুযোগ থাকে না। তাই জিনদিককে আলাদা প্রকার না ধরে মুরতাদের অন্তর্ভুক্ত করে দিলে জিনদিকের বিষয়টি হালকা করে ফেলা হয়। শরিয়াহ তার ব্যাপারে যে কঠোরতা প্রয়োগ করেছে, তাতে শিথিলতা আরোপ করা হয়। হজরাতুল উসতাদ কাদিয়ানিদের সাধারণ কাফির মনে করেননি, এ বিষয়টির সাথে আমরা একমত। তবে তাঁর বক্তব্যে কাদিয়ানিদের যথার্থ অবস্থাও উঠে আসেনি। তিনি কাদিয়ানিদেরকে মুরতাদ ক্যাটাগরিতে ফেলতে চেয়েছেন। এতে কাদিয়ানিদের প্রতি নমনীয়তা ফুটে ওঠে। বস্তুত কাদিয়ানিরা এর উপযুক্ত নয় যে, তাদেরকে তিন দিন আদর-সোহাগ করে আপ্যায়ন করা হবে।
উপরন্তু তারা নবি ﷺ-এর সঙ্গে গোস্তাখিকারীও বটে। নবি ﷺ-কে গালি দিলেই শুধু তাঁর অবমাননা হয় না; বরং তাঁর খতমে নবুওয়াত অস্বীকার করলে, তাঁর পর অন্য কাউকে, বিশেষ করে গোলাম আহমদ কাদিয়ানির মতো একটা ইতর ও কামিনা লোককে নবি বলে আখ্যায়িত করলে এতেও তাঁর চরম অবমর্যাদা হয়। সুতরাং শরিয়াহর পক্ষ থেকে কাদিয়ানিদের জন্য যে কঠোরতা প্রাপ্য রয়েছে, তাদের ওপর তা-ই প্রয়োগ করা হবে। এতে কোনোপ্রকার শিথিলতা করা হবে না। একজন ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়া আর সে মুসলিম পরিচয় ধারণ করে কাদিয়ানি ধর্মমত গ্রহণ করা এক কথা নয়। সমাজে মুরতাদ শব্দটি পরিচিত থাকলেও জিনদিক শব্দটি পরিচিত নয়। তাই হয়তো এই অসতর্ক বিভ্রম ঘটেছে। আল্লাহ তাআলা সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমিন। আখেরে, এই মুআদ্দাবানা গুজারিশের আদব সঠিকভাবে রক্ষা করতে না পারায় হজরাতুল উসতাদের নিকট বিনীতভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।