ইমাম বুখারি রহ. তার ‘সহিহ’ গ্রন্থে ফিতনা অধ্যায়ে ‘কালের এমন পরিবর্তন হবে যে, মানুষ মূর্তিপূজা করবে’ শিরোনামে সাহাবি আবু হুরায়রা রা. সূত্রে একটি হাদিস বর্ণনা করেন; রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَخْرُجَ رَجُلٌ مِنْ قَحْطَانَ يَسُوقُ النَّاسَ بِعَصَاهُ.

কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না কাহতান গোত্র থেকে এমন এক লোক বের হবে, যে মানুষকে লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে নেবে। [সহিহ বুখারি : ৭১১৭; সহিহ মুসলিম : ২৯১০]

চিন্তার বিষয় হলো, শিরোনামের সঙ্গে এই হাদিসের কী মিল? ইবনু বাত্তাল রহ. লিখেছেন,

أن المهلب أجاب بأن وجهه أن القحطاني إذا قام وليس من بيت النبوة ولا من قريش الذين جعل الله فيهم الخلافة فهو من أكبر تغير الزمان وتبديل الأحكام بأن يطاع في الدين من ليس أهلا لذلك.

‘মুহাল্লাব রহ. এর জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, কাহতানি নবি ﷺ-এর আহলে বাইত নয়। আবার সে কুরাইশ গোত্রেরও নয়, আল্লাহ তাআলা যাদের মধ্যে খিলাফাতের যোগ্যতা রেখেছেন। সুতরাং এটা হচ্ছে কালের বিবর্তন এবং বিধিবিধান পরিবর্তনের অন্যতম নিদর্শন যে, দীনের ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তির আনুগত্য করা হবে, যে এর উপযুক্ত নয়।’

ইবনু বাত্তাল রহ.-এর এই ব্যাখ্যার পক্ষে সহিহ বুখারির একটি হাদিস থেকেই প্রমাণ মেলে। মুহাম্মাদ ইবনু জুবায়র ইবনু মুতইম রহ. বর্ণনা করেন,

أَنَّهُ بَلَغَ مُعَاوِيَةَ وَهُوَ عِنْدَهُ فِي وَفْدٍ مِنْ قُرَيْشٍ، أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ يُحَدِّثُ أَنَّهُ سَيَكُونُ مَلِكٌ مِنْ قَحْطَانَ، فَغَضِبَ مُعَاوِيَةُ ، فَقَامَ فَأَثْنَى عَلَى اللَّهِ بِمَا هُوَ أَهْلُهُ، ثُمَّ قَالَ : أَمَّا بَعْدُ، فَإِنَّهُ بَلَغَنِي أَنَّ رِجَالًا مِنْكُمْ يَتَحَدَّثُونَ أَحَادِيثَ لَيْسَتْ فِي كِتَابِ اللَّهِ، وَلَا تُؤْثَرُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأُولَئِكَ جُهَّالُكُمْ، فَإِيَّاكُمْ وَالْأَمَانِيَّ الَّتِي تُضِلُّ أَهْلَهَا ؛ فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : ” إِنَّ هَذَا الْأَمْرَ فِي قُرَيْشٍ، لَا يُعَادِيهِمْ أَحَدٌ إِلَّا كَبَّهُ اللَّهُ عَلَى وَجْهِهِ، مَا أَقَامُوا الدِّينَ “.

মুআবিয়া রা. -এর নিকট কুরাইশ প্রতিনিধিদের সাথে তার উপস্থিতিতে সংবাদ পৌঁছাল যে, আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রা. বর্ণনা করেন, শীঘ্রই কাহতান বংশীয় জনৈক বাদশাহর আগমন ঘটবে। এ কথা শুনে মুআবিয়া রা. ক্রুদ্ধ হয়ে খুতবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার পর তিনি বললেন, আমি জানতে পেরেছি, তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক এমন সব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে, যা আল্লাহর কিতাবে নেই এবং আল্লাহর রাসুল ﷺ থেকেও বর্ণিত হয়নি। এরাই মূর্খ, এদের হতে সাবধান থেকো এবং এমন কাল্পনিক ধারণা হতে সতর্ক থেকো, যা ধারণাকারীকে বিপথগামী করে। আল্লাহর রাসুল ﷺ -কে আমি বলতে শুনেছি, এই খিলাফাহ কুরাইশের মধ্যেই থাকবে। এ বিষয়ে যে-ই তাদের সাথে শত্রুতা করবে, আল্লাহ তাকে অধোঃমুখে নিক্ষেপ করবেন—যতদিন তারা দীন কায়েম করবে। [সহিহ বুখারি : ৩৫০০]

খিলাফাহ কুরাইশের হাতে থাকবে—এটা মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হাফিজ ইবনু হাজার রহ.-এর একটি পুস্তিকাই রয়েছে এ ব্যাপারে, যার নাম ‘লাযযাতুল আইশ ফি তুরুকি হাদিসি আল-আয়িম্মাতু মিন কুরাইশ’; যাতে তিনি এ-সংক্রান্ত হাদিসের বর্ণনাসূত্রগুলো সংকলন করেছেন। উক্ত হাদিস থেকে অনুমিত হচ্ছে, কাহতানি-সংক্রান্ত হাদিস মুয়াবিয়া রা.-এর নিকট পৌঁছায়নি। তাই তিনি কালের বিবর্তন এবং শরয়ি বিধানের এমন পরিবর্তনের কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়েছেন আর স্পষ্ট ভাষায় তা অস্বীকার করেছেন। তো এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল, কাহতানির হাদিসটি মূলত ইমাম বুখারি রহ.-এর শিরোনামের প্রথম অংশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থাৎ, কালের পরিবর্তন ঘটার আগে কিয়ামত সংঘটিত হবে না। আর এই পরিবর্তনের একটি উদাহরণ হচ্ছে, শাসনক্ষমতার বাগডোর কুরাইশের হাত থেকে কাহতান গোত্রের জনৈক ব্যক্তির হাতে চলে যাবে। হাফিজ ইবনু হাজার রহ. ‘ফাতহুল বারি’ গ্রন্থে লেখেন,

واستدل بقصه القحطاني عن أن الخلافة يجوز أن تكون في غير قريش

কাহতানির ঘটনা দ্বারা ইমাম বুখারি রহ.-এর এ বিধান উদ্ঘাটন করলেন যে, খিলাফাহ কুরাইশ ছাড়া অন্যদের হাতেও হতে পারে।

অবশ্য কুরাইশের হাতে খিলাফাহ থাকার সঙ্গে এ হাদিসটির মৌলিক বিরোধ নেই। কারণ, কাহতানি শাসকের খিলাফাহ আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের শুরার সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠিত হবে না; বরং তা হবে জোরপূর্বক ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে। [তুহফাতুল আহওয়াজি : ২২২৮]

এরপর দ্বিতীয় বিষয় হলো, কাহতান গোত্রের এই শাসকের পরিচয় কী? ইমাম কুরতুবি রহ. ‘তাযকিরা’ গ্রন্থে লিখেছেন,

ولعل هذا الرجل القحطانيّ هو الرجل الذي يقال له الجهجاه المذكور في الحديث الآخر عند مسلم

সম্ভবত এই কাহতানি শাসকই হলো জাহজাহ নামের সেই ব্যক্তি, যার বিবরণ সহিহ মুসলিমের অন্য হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে।

ইমাম কুরতুবি রহ.-এর এই মতটি হাফিজ ইবনু হাজার রহ. ‘ফাতহুল বারি’ গ্রন্থে (১৩/৭৭-৭৮) এবং ইমাম কাসতাল্লানি রহ. ‘ইরশাদুস সারি’ গ্রন্থে (১০/২০২) উল্লেখ করেছেন।

কুরতুবি রহ. সুনিশ্চিতভাবে এই দাবি করেননি; বরং তিনি একটি সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছেন মাত্র। তবে তাহকিক হলো, এই সম্ভাবনাটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, জাহজাহ হবে একজন আজাদকৃত গোলাম আর কাহতানি শাসক হবে স্বাধীন ব্যক্তি। জাহজাহের হাদিসটি লক্ষণীয় :

لَا تَذْهَبُ الْأَيَّامُ وَاللَّيَالِي حَتَّى يَمْلِكَ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ : الْجَهْجَاهُ

 রাত-দিন শেষ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না জাহজাহ নামে কোনো লোক শাসনকর্তা হবে। [সহিহ মুসলিম : ২৯১১]

لَا يَذْهَبُ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ حَتَّى يَمْلِكَ رَجُلٌ مِنَ الْمَوَالِي، يُقَالُ لَهُ : جَهْجَاهُ “.

‘জাহজাহ’ নামক কোনো এক মুক্তদাস অধিপতি না হওয়া পর্যন্ত দিন-রাতের অবসান (কিয়ামাত) হবে না। [সুনানুত তিরমিজি : ২২২৮; মুসনাদু আহমাদ : ৮৩৬৪]

এ কারণেই শায়খ আবদুল আজিজ তারিফি লেখেন,

والذي أجزم به أن القحطاني ليس هو الجهجاه، وذلك أن قحطان قبيلة، والجهجاه من الموالي، فقد جاء في صحيح الإمام مسلم أن النبي عليه الصلاة والسلام قال: (لا تقوم الساعة حتى يملك رجل من الموالي يقال له: جهجاه)، والموالي الأصل فيهم أنهم لا ينتسبون، وقول النبي عليه الصلاة والسلام في الصحيح: (رجل من قحطان) يعني: أنه على ظاهره ينتسب إلى هذه القبيلة، ويقر له بذلك الأمر، وهناك قال: إنه من الموالي، وقد أشار بعض العلماء إلى احتمال أن يكون القحطاني هو الجهجاه، وفي ذلك نظر على هذا التعليل.

আমি দৃঢ়ভাবে বলব, কাহতানি শাসক জাহজাহ নয়। কারণ, কাহতান হচ্ছে একটি গোত্র। আর জাহজাহ হচ্ছে মুক্তদাস। সহিহ মুসলিম (তথ্যসূত্রটা ‘সুনানুত তিরমিজি’ হবে—উসামা) গ্রন্থের হাদিসে এসেছে, ‘কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না জাহজাহ নামক একজন মুক্তদাস শাসক হবে।’ মুক্তদাসের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, তাদেরকে গোত্রীয় লোকদের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় না। সহিহ হাদিসের রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বাণী এসেছে—‘কাহতান গোত্রের এক ব্যক্তি’। অর্থাৎ, সে বাহ্যিকভাবে কাহতান গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে এবং তার এ বিষয়টি স্বীকৃত হবে। অথচ জাহজাহের ব্যাপারে বলা হয়েছে, সে একজন মুক্তদাস। কোনো কোনো আলিম এই সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, কাহতানি শাসকই হয়তো জাহজাহ। তবে উল্লেখিত কারণে এ ব্যাখ্যায় আপত্তি রয়েছে। [আশরাতুস সাআহ রিওয়ায়াতান ওয়া দিরায়াতান : ২০]

ইমাম কাওরানি রহ. লেখেন,

ورده شيخ الإسلام بأن الجهجاه من الموالي فلا يصح حمل القحطاني عليه.

শাইখুল ইসলাম রহ. এই প্রমাণ পেশ করে কুরতুবির অভিমত খণ্ডন করেন যে, জাহজাহ হচ্ছে একজন মুক্তদাস। সুতরাং কাহতানি শব্দ তার ব্যাপারে প্রয়োগ করা শুদ্ধ নয়। [আল-কাউসারুল জারি ইলা রিয়াজি আহাদিসিল বুখারি : ১১/৪২]

কাহতানি শাসক কে হতে পারে—এর আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা করেছেন শায়খ সাইদ হাওয়া রহ.। তিনি লেখেন,

أقول: يجمع النساب العرب على أن الأكراد أصولهن عربية قحطانية، وممن حكم من الأكراد ودان له الناس السلطان صلاح الدين الأيوبي العالم المجاهد العابد، فهل هو المراد بالحديث أو غيره؟ الله أعلم.

وقد ذهب بعضهم إلى أن الحديث لم يقع وإنما وقوعه قبيل قيام الساعة بعد وفاة المسيح عليه السلام.

আমি বলব, আরব বংশতালিকাবিশারদ সংকলন করেছেন যে, কুর্দি বংশের মূল হলো আরবি কাহতানি গোত্র। কুর্দিদের মধ্যে যিনি শাসনকার্য করেছেন এবং মানুষ যার আনুগত্য করেছে, তিনি হলেন মহান আলিম মুজাহিদ আবিদ সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবি। এই হাদিসে কি তিনি উদ্দেশ্য নাকি অন্য কেউ, তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে কোনো কোনো আলিম এই মত পোষণ করেছেন যে, এই হাদিসটি এখনো সংঘটিত হয়নি; বরং ইসা আ.-এর ওফাতের পর কিয়ামতের অল্প কাল আগে সংঘটিত হবে। [আল-আসাসু ফিস সুন্নাহ ওয়া ফিকহিহা : ২/৯৯২]

আমাদের সমাজে যারা ফিতনা-বিষয়ক আলোচনা করেন, তারা সাধারণত কাহতানিকে মহান খলিফা হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। এক্ষেত্রে তাদের অন্যতম পুঁজি হলো নুয়াইম বিন হাম্মাদের ‘ফিতান’ গ্রন্থের কিছু অপ্রমাণিত ও অগ্রহণযোগ্য হাদিস। বিশুদ্ধ সূত্রের আলোকে কাহতানির চরিত্র কী উঠে আসে, তা-ই আমাদের এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম গ্রন্থে কাহতানির হাদিসের শেষাংশে বলা হয়েছে,

يَسُوقُ النَّاسَ بِعَصَاهُ.

সে মানুষকে লাঠি দ্বারা তাড়িয়ে নেবে/পরিচালনা করবে।

এখন চিন্তার বিষয় হলো, মানুষকে কি লাঠি দ্বারা হকের দিকে তাড়িয়ে নেবে নাকি হক থেকে বাতিলের দিকে তাড়িয়ে নেবে, এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। শায়খ উমর সুলায়মান আশকার লেখেন,

وهل يسوق هذا الرجل الناس إلى الخير أم الشر؟ ليس عندنا بيان من الرسول صلى الله عليه وسلم بذلك.

এই ব্যক্তি কি মানুষকে কল্যাণের দিকে পরিচালিত করবে নাকি অকল্যাণের দিকে, আমাদের নিকট এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত কোনো বিবরণ নেই। [আল-কিয়ামাতুস সুগরা : ২০৩]

আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে লাঠি দ্বারা পরিচালনা করার অর্থ কী? হাফিজ ইবনু হাজার রহ. ‘ফাতহুল বারি’ গ্রন্থে লেখেন,

قال القرطبي في التذكرة: قوله: ” يسوق الناس بعصاه ” كناية عن غلبته عليهم وانقيادهم له، ولم يرد نفس العصا، لكن في ذكرها إشارة إلى خشونته عليهم، وعسفه بهم. قال: وقد قيل: إنه يسوقهم بعصاه حقيقة كما تساق الإبل والماشية لشدة عنفه وعدوانه.

কুরতুবি রহ. ‘তাযকিরা’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মানুষকে লাঠি দ্বারা তাড়িয়ে নেবে’—এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে, সে মানুষের ওপর প্রবল হবে এবং মানুষ তার আনুগত্য করবে; প্রকৃত লাঠি উদ্দেশ্য নয়। তবে এ শব্দটি উল্লেখ করার দ্বারা ইশারা করা হয়েছে, সে মানুষের ওপর রূঢ় (কঠোর) হবে এবং মানুষকে জোর করে তার অনুগত বানাবে। আবার কেউ এর ব্যাখ্যা করেছেন, প্রকৃত অর্থেই সে মানুষকে লাঠি দ্বারা চালিয়ে নেবে, যেমন উট ও মেষপাল চালানো হয়। এটা হবে তার কঠোরতা ও সীমালঙ্ঘনের কারণে।

শায়খ তাহির হিন্দি রহ. ‘শরহু গারিবিল আসার’ গ্রন্থে শারহুল মাসাবিহ সূত্রে লেখেন,

أنه عبارة عن التسخير، كسوق الراعي

(লাঠি দ্বারা পরিচালিত করা) কথাটা দ্বারা মানুষকে বশীভূত করা বোঝায়; যেমন রাখাল তার পশুপাল চড়ায়।

‘আদ-দুরারুস সুন্নিয়্যাহ’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে শায়খ সাদ ইবনুশ শায়খ হামদ ইবনু আতিকের বক্তব্য উল্লেখিত হয়েছে,

إن المذكور في الحديث يكون له تسلط على الناس حتى يقهرهم ويستولي عليهم كاستلاء الراعي على غنمه بحيث لا يتخلف أحد من رعيته عن طاعته

হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে, সর্বস্তরের মানুষের ওপর কাহতানি প্রভাব বিস্তার করবে। সে সবাইকে বশীভূত করে রাখবে এবং সবার ওপর কর্তৃত্ব করবে; যেমন রাখাল তার মেষপালের ওপর কর্তৃত্ব করে। অবস্থা এমন হবে যে, তার কোনো প্রজা তার আনুগত্য থেকে পিছপা হতে পারবে না।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতিভাত হচ্ছে, কাহতানি শাসক আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের শুরার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এবং মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত বাইয়াতের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে না। বরং সে জোরপূর্বক শাসনক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে এবং মানুষের সঙ্গে কঠোর ও রূঢ় আচরণ করবে। সে তার ক্ষমতা ও দাপট ব্যবহার করে মানুষকে নিজের অনুগত করে রাখবে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, হাদিসেও তাকে খলিফা বলে উল্লেখ করা হয়নি; বরং বলা হয়েছে, তার আবির্ভাব ঘটবে। জাহজাহের ব্যাপারেও বলা হয়েছে, সে শাসনকর্তা হবে। বলা বাহুল্য, খলিফা এবং শাসনকর্তা সমার্থক নয়।

তবে হাফিজ ইবনু হাজার রহ.-এর আলোচনা থেকে প্রতিভাত হয়, কাহতানি শাসকের আবির্ভাব শেষ জামানায় ঘটবে; যখন মানুষের মধ্যে দীনদারির পরিবর্তন ঘটবে। কেউ কুফরের দিকে ফিরে যাবে, আর কেউ পাপাচারের পথ ধরবে। তিনি লেখেন,

وحاصله: أنه مطابق لصدر الترجمة وهو تغير الزمان، وتغيره أعم من أن يكون فيما يرجع إلى الفسق أو الكفر، وغايته أن ينتهي إلى الكفر، فقصة القحطاني مطابقة للتغير بالفسق مثلا، وقصة ذي الخلصة للتغير بالكفر… وأجاب ابن العربي بأنه إنذار بما يكون من الشر في آخر الزمان من تسور العامة على منازل الاستقامة.

মোদ্দাকথা, হাদিসটি শিরোনামের প্রথমাংশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আর তা হচ্ছে, কালের পরিবর্তন। এই পরিবর্তন ব্যাপক; হতে পারে তা পাপাচারে পরিবর্তন কিংবা কুফরে পরিবর্তন। তবে এর চূড়ান্ত সীমা হলো, তা পাপাচার দ্বারা সূচিত হলেও পরিণামে কুফরে গিয়ে সমাপ্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ বর্ণিত কাহতানির ঘটনা পাপাচারের দ্বারা পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আর এর পরে উল্লেখিত যিল খালাসার ঘটনা কুফরের দ্বারা পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ইবনুল আরাবি এ ব্যাপারে বলেছেন, এই হাদিস দ্বারা শেষ জামানায় সংঘটিত অনিষ্টের ব্যাপারে সতর্ক করে অবিচলতার স্তরে উত্তীর্ণ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ইবনু বাত্তাল রহ. তার সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থে লেখেন,

قال المهلب: وأما حديث عبد الله بن عمرو أنه سيكون ملك من قحطان، فيحتمل أن يكون ملكًا غير خليفة على الناس من غير رضا به، وإنما أنكر ذلك معاوية لئلا يظن أحد أن الخلافة تجوز فى غير قريش، ولو كان عند أحد فى ذلك علم من النبى – صلى الله عليه وسلم – لأخبر به معاوية حين خطب بإنكار ذلك عليهم، وقد روى فى الحديث أن ذلك إنما يكون عند ظهور أشراط الساعة وتغيير الدين، روى أبو هريرة عن النبى – صلى الله عليه وسلم – أنه قال: «لا تقوم الساعة حتى يخرج رجل من قحطان يسوق الناس بعصاه» فقوله: «لا تقوم الساعة» يدل أن ذلك من أشراط القيامة ومما لا يجوز، ولذلك ترجم البخارى بهذا الحديث فى كتاب الفتن فى باب تغير الزمان حتى تعبد الأوثان، وفهم منه هذا المعنى.

মুহাল্লাব বলেছেন, আবদুল্লাহ বিন আমর রা.-এর হাদিসে যে রয়েছে, কাহতান গোত্র থেকে একজন শাসক হবে, সম্ভাবনা রয়েছে, সে কোনো খলিফা নয়, বরং মানুষের অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও তাদের ওপর চেপে বসা একজন রাজা হবে। মুয়াবিয়া রা. বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, যাতে কেউ এ ধারণা না করে বসে যে, কুরাইশ ছাড়া অন্য কারও হাতে খিলাফাহ থাকা বৈধ। মুয়াবিয়া রা. যখন এই বক্তৃতা করেছেন, তখন এ ব্যাপারে কারও কাছে যদি রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত কোনো ইলম থাকত, তাহলে অবশ্যই তার কথার ওপর আপত্তি জানিয়ে তাকে তা অবগত করত। হাদিসে এসেছে, কাহতানি শাসকের আবির্ভাব ঘটবে সে সময়, যখন কিয়ামতের আলামতসমূহ প্রকাশিত হবে এবং দীনের পরিবর্তন হতে থাকবে। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন; রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না কাহতান গোত্র থেকে এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে, যে মানুষকে তার লাঠি দ্বারা পরিচালিত করবে। হাদিসের বাণী—‘কিয়ামত সংঘটিত হবে না’ থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, এটা কিয়ামতের একটি নিদর্শন এবং নাজায়িয বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য ইমাম বুখারি রহ. এই হাদিসটিকে ফিতনা অধ্যায়ে ‘কালের এমন পরিবর্তন ঘটবে যে, মূর্তিপূজা হতে থাকবে’ শিরোনামের অধীনে এনেছেন এবং তিনি এ হাদিস থেকে এই অর্থই বুঝেছেন।

ইবনু হাজার হাইতামি রহ. ‘আল-কাউলুল মুখতাসার’ গ্রন্থে লেখেন এবং তার সূত্রে ইমাম বারযানজি রহ. ‘আল-ইশাআহ লি আশরাতিস সাআহ’ গ্রন্থে (পৃ. ২৯৭-২৯৮) উদ্ধৃত করেন,

الذي يتعين اعتقاده ما دلت عليه الأحاديث الصحيحة من وجود المهدي المنتظر الذي يخرج الدجال، وعيسى عليه السلام في زمانه، ويُصلي عيسى خلفه، وأنه المراد حيث أُطْلِقَ المهدي، والمذكورون قبله لم يصح فيهم شيء، والذين بعده أمراء صالحون أيضًا لكن ليسوا مثله، فهو الأَخْيَر في الحقيقة. انتهى

যে বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্বাস করতে হবে, যার প্রমাণ সহিহ হাদিস থেকে মেলে তা হলো, প্রতীক্ষীত মাহদির অস্তিত্ব সঠিক। তার সময়েই দাজ্জাল ও ইসা আ.-এর আবির্ভাব ঘটবে এবং তার পেছনে ইসা আ. নামাজ আদায় করবেন। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন—ঈসা আ. ও মাহদির আগমন : একযুগে নাকি ভিন্নযুগে?) মাহদি শব্দ ব্যবহার করা হলে তিনিই উদ্দেশ্য হন। তার পূর্বে যাদের আগমনের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তাদের কারও আগমনের বর্ণনাই সহিহ নয়। আর তার পরেও কয়েকজন নেককার আমির রয়েছে; তবে তারা তার অনুরূপ নয়। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে তিনিই সর্বশেষ।

এরপর ইমাম বাযরানজি রহ. তার অভিমত তুলে ধরেন এবং জাকারিয়া কান্ধলবি রহ.-ও টীকায় তার সঙ্গে দ্বিমত করেননি। তিনি লেখেন,

غاية ما يمكن في الجمع: أن المهدي الكبير هو الذي يفتح الروم، ويخرج الدجال في زمنه، ويُصلي عيسى عليه السلام خلفه، وأن الخلافة تكون له ولقريش من بعده، وأن عيسى عليه السلام لا يَسْلبُ قريشًا مُلكها رأسًا، وإنما تكون إليه المشورة وهو الحَكَمُ فيهم يعلمهم الدين.

স্ববিরোধী বর্ণনাগুলোকে সবচে সুন্দরভাবে সমন্বয় করার পন্থা হলো এই ব্যাখ্যা করা যে, মূল মাহদিই রোম বিজয় করবেন। তার যুগেই দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। ইসা আ. তার পেছনেই নামাজ আদায় করবেন। তিনি খলিফা হবেন এবং তার পর কুরাইশরাই খলিফা হবে। ইসা আ. মূলত কুরাইশদের থেকে শাসন ছিনিয়ে নেবেন না। তিনি হবেন শুরার প্রধান এবং তাদের মধ্যে ফয়সালাদাতা। তিনি মানুষকে দীন শেখাবেন।

তারপর তিনি এ বিষয়ক কিছু অপ্রমাণিত হাদিসের স্ববিরোধিতার মধ্যেও সমন্বয় করার পন্থা উল্লেখ করেন। তবে তা যেহেতু আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়, তাই এখানে আর তা উদ্ধৃত করার প্রয়োজন অনুভব করছি না।

কাহতানি ও জাহজাহ কি মুসলমান হবে নাকি মুনাফিক হবে নাকি কাফির হবে, এ বিষয়েও সহিহ হাদিসে কিছু পাওয়া যায় না। যেহেতু এটা অদৃশ্যের বিষয়, তাই এক্ষেত্রে অনুমানের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়াই সংগত। একইভাবে তার শাসনকাল কয় দিন, কয় মাস বা কয় বছর স্থায়ী হবে, এ ব্যাপারেও সহিহ হাদিসে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। কাহতানির প্রকৃত নাম কী এবং কোত্থেকে প্রকাশিত হবে, এ ব্যাপারেও কোনো সহিহ বর্ণনা নেই। তবে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের হাদিস থেকে অনুমিত হয়, কাহতানি একজন জালিম শাসক হবে।

এর প্রথম প্রমাণ হলো, হাদিসে বলা হয়েছে, সে মানুষকে তার লাঠি দ্বারা পরিচালিত করবে। সে যদি সৎ ও আদর্শবান হতো, তাহলে তাকে মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতার বাগডোর গ্রহণ করতে হতো না। সুতরাং হাদিসের এই বাক্যটি মূলত তার জুলুমের দিকে ইঙ্গিত করে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا ؛ قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ

দু-শ্রেণির মানুষ জাহান্নামি, যাদের আমি এখনো দেখিনি। এক শ্রেণি হলো সেসব মানুষ, যাদের সঙ্গে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, তা দ্বারা তারা লোকজনকে মারবে। [সহিহ মুসলিম : ২১২৮]

নুয়াইম বিন হাম্মাদের ফিতান গ্রন্থে কিছু বর্ণনা এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, কাহতানি একজন সৎ ব্যক্তি। কিন্তু এর কোনো বর্ণনাই হাদিসশাস্ত্রের নীতি অনুসারে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের নয়। সুতরাং সহিহ হাদিসের ভাষ্যের বিপরীতে তা কিছুতেই দলিল হবে না।

দ্বিতীয় প্রমাণ হলো, কিয়ামতের আলামত-সংক্রান্ত হাদিসসমূহের ক্ষেত্রে একটা মূলনীতি হলো, সাধারণভাবে এগুলোর দ্বারা আরবের অবস্থা বোঝায়। কারণ, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সম্বোধনের ক্ষেত্র ছিল তারাই। আর ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করে এসেছি যে, কাহতানির আগমন ঘটবে শেষ যুগে—মাহদির সময়ে বা তারও পরে। আর সে সময় আরবে মুমিনদের সংখ্যাই হবে বেশি। নেতৃত্বের আসনে আসীন হওয়ার পর সে সময় তার তো প্রয়োজন ছিল মুমিনদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা; তাদের ওপর লাঠি চালনা করা নয়। হাদিস থেকে তো অনুমিত হয়, যাদের ওপর তার শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত থাকবে, সে তাদের ওপর লাঠি প্রয়োগ করবে। সুতরাং হাদিসের তো এই ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই যে, কাহতানি মুমিনদেরকে সঙ্গে নিয়ে কুফফারের ওপর লাঠি প্রয়োগ করবে। ইমাম ইবনু কাসির রহ. ‘আন-নিহায়া ফিল ফিতান ওয়াল মালাহিম’ গ্রন্থে কাহতানির হাদিসের আলোচ্য অংশ উল্লেখ করার পর লেখেন,

إشارة إلى ظهور ظالم من قحطان قبل قيام الساعة

এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কিয়ামতের পূর্বে কাহতান গোত্র থেকে একজন জালিমের আত্মপ্রকাশ ঘটবে।

Share This