ফিকহুস সিরাত – ৯
আবু তালিব কুরাইশদের ধর্মেরই একজন অনুসারী ছিল। ভাতিজা মুহাম্মাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবস্থান অন্যা্ন্যদের মতো হবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। এ কারণে কুরাইশের অন্যান্য নেতৃবর্গ আবু তালিবের কাছে বিচারপ্রার্থী হলো। তারা এসে বলল, ‘হে আবু তালিব, তোমার ভাতিজা তো আমাদের উপাস্যদের গালমন্দ করেছে, আমাদের ধর্মের দোষ বর্ণনা করেছে, আমাদের বিবেককে বোধবুদ্ধিহীন বলে আখ্যায়িত করেছে আর আমাদের পিতৃপুরুষদের পথভ্রষ্ট বলে অভিহিত করেছে। এখন হয়তো আপনি তাকে আমাদের ব্যাপারে নিবৃত্ত করবেন, নতুবা আমাদের মাঝে এবং তার মাঝে কোনো প্রতিবন্ধক হবেন না। কারণ, তার এসবের বিরোদিতায় আপনারও সেই অবস্থান, আমাদের কুরাইশ নেতৃবৃন্দের যে অবস্থান।’ তখন আবু তালিব তাদের নম্র ভাষায় উত্তম কথা বলে বিদায় করলেন।
রাসুলুল্লাহ সা. কোনো গালমন্দকারী, অপবাদ আরোপকারী কিংবা অশ্লীল কথাবার্তা উচ্চারণকারী ছিলেন না।[1] তার জিহ্বা কখনোই কোনো নোংরা কথা উচ্চারণ করেনি। এতদসত্ত্বেও মক্কার মুশরিকরা এখানে অভিযোগ দায়ের করছে যে, তিনি তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোকে গালমন্দ করেছেন, তাদের পিতৃপুরুষদের ব্যাপারে মন্দ কথা বলেছেন। সাম্প্রদায়িকতা এবং পিতৃপুরুষদের অন্ধ অনুকরণ সে সময়ে তাদের মনন এবং কার্যক্রমের ওপর পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থও যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছিল। রাসুলুল্লাহ সা. যে ‘উলুহিয়্যাত’র দাওয়াত দিচ্ছেন্ন এর মর্ম এবং তাৎপর্য তারা ঠিক-ঠিকই ঠাহর করেছিল; যদিও বর্তমানকালে অধিকাংশ মুসলিম দিনরাত মুখে এই কালিমা আওড়ালে এর তাৎপর্য এবং অন্তর্নিহিত মর্ম অনুধাবন করে না, এমনকি তার প্রয়োজনীয়তাটুকুও বোধ করে না। আমাদের সমাজে সুন্নত-মুস্তাহাব আমলকে পর্যন্ত যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাওহিদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিকে তার সিকিভাগও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সমাজ থেকে এর চর্চা যেন পুরোই বিলীন হয়ে গেছে।
তারা আবু তালিবের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়ার পরও রাসুলুল্লাহ সা.’র দাওয়াতের গতি পূর্বের মতোই বহাল থাকল। তিনি পূর্বে যেমন ছিলেন, এখনও তেমনই থাকলেন। তাদের বিরোধিতা তার কার্যক্রমের গতিকে মোটেও শ্লথ করতে পারেনি। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পুনরায় আবু তালিবের কাছে উপস্থিত হলো। তবে এবার আর তারা নম্র ভাষা ব্যবহার করল না। বরং কঠোর ভাষায় সতর্কবাণী শুনিয়ে দিয়ে গেল। ‘হে আবু তালিব, আপনি বয়স, মর্যাদা এবং আভিজাত্যে আমাদের সকলের মধ্যে একজন সম্রান্ত ব্যক্তিত্ব। আমরা ইতঃপূর্বে আপনার ভাতিজাকে বারণ করে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম; কিন্তু আপনি তাকে বারণ করেননি। আল্লাহর কসম করে বলছি, আমরা কিন্তু আমাদের পিতৃপুরুষদের গালমন্দ করা, আমাদের বিবেককে বোধবুদ্ধিহীন বলা এবং আমাদের উপাস্যদের দোষচর্চার ব্যাপারে আর সবর করব না। এখন হয়তো আপনি তাকে আমাদের ব্যাপারে নিবৃত্ত করবেন কিংবা আমরা তার এবং আপনার বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব; এ লড়াই জারি থাকবে, যতক্ষণ না উভয় দলের এক দল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।’ আবু তালিবের কাছে বিষয়টি গুরুতর হয়ে ঠেকল। এখন তার সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা রয়েছে—হয়তো তার কাওমের সঙেগ সম্পর্ক ছিন্ন করবেন, যার পরিণামে তার মাঝে এবং তাদের মাঝে প্রকাশ্য শত্রুতার সূত্রপাত হবে কিংবা আপন ভাতিজাকে হেয় করে তাদের সামনে সমর্পিত করবেন। উভয়টিই তার জন্য ছিল অসম্ভবপ্রায়; কিন্তু দুটোর কোনো একটি তাকে বেছে নিতেই হবে। আবু তালিব ভাতিজাকে ডাকলেন। তিনি দরদের সঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাতিজা, তোমার জাতির লোকজন তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করে কেন?’ রাসুলুল্লাহ সা. নিঃসঙ্কোচে বলে উঠলেন, ‘আমি চাই, তারা এমন একটি কালিমা মেনে নিক, যার ফলে সমগ্র আরব তাদের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারব লোকজন তাদের জিযয়া (আনুগত্য-নির্দেশক কর) দেবে।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কালিমাটি কী?’ রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।’ এ কথা শুনে মক্কার মুশরিকরা বলে উঠল, ‘সে তো দেখি সকল ইলাহকে এক ইলাহ বানিয়ে ফেলেছে।’ তাদের এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনের সুরা সোয়াদ অবতীর্ণ হলো। তখন রাসুলুল্লাহ সা. তাদের সুরা সোয়াদের প্রথম পাঁচ আয়াত পাঠ করে শোনালেন।[2]
আবু তালিব রাসুলুল্লাহ সা.কে এ ব্যাপারে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তার সব কথা শোনার পর রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘হে চাচা, আল্লাহর কসম, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দেয়—এ শর্তে যে, আমি এ দীনকে ছেড়ে দেব, যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে বিজয়ী করেন কিংবা এ পথে আমার জীবনের যবনিকাপাত হয়, তবুও আমি কিছুতেই তাকে পরিত্যাগ করব না।’ এ কথা বলে রাসুলুল্লাহ সা. কেঁদে ফেললেন। এরপর তিনি উঠে চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময় আবু তালিব তাকে ডেকে বলে দিলেন, ‘ভাতিজা, যাও, তোমার যা ভালো লাগে তুমি বলো। আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে কখনোই কোনো কিছুর সামনে সমর্পণ করব না।’
ফিকহ
১. মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ সা.’র সাহায্যে আবু তালিবের অবস্থান ইসলামের শক্তিকে অনেক সুদৃঢ় করেছিল। রাসুলুল্লাহ সা.ও কোনোপ্রকার আপত্তি জ্ঞাপন ছাড়া তার সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে উত্তম মানসিকতার অধিকারী মুশরিক ব্যক্তির থেকে সাহায্য গ্রহণ করা বৈধ। হাঁ, এর জন্য কিছু শর্ত-বিধি রয়েছে, ফিকহশাস্তের গ্রন্থাদিতে যে সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে।[3]
২. আবু তালিবের প্রশ্নের জবাবে রাসুলুল্লাহ সা. নিজের দাওয়াতের পরিচয় তুলে ধরছেন—‘আমি চাই, তারা এমন একটি কালিমা মেনে নিক, যার ফলে সমগ্র আরব তাদের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারব লোকজন তাদের জিযয়া (আনুগত্য-নির্দেশক কর) দেবে।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কালিমাটি কী?’ রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।’
এই কালিমা তো আমরাও নিত্যদিন পাঠ করি। আমরা এর জিকির করি। শতবার-হাজারবার পাঠ করে কেউ-বা খতমও পূরণ করি। আমরা আমাদের বয়ান-বক্তৃতা-আলোচনায় এর অর্থও বয়ান করি—‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।’ তো এই কালিমার মধ্যে এমন কী আছে, যার কারণে রাসুলুল্লাহ সা. ইসলামের সূচনালগ্নে কুফফার দ্বারা পরিবেষ্টিত জনপদে বসে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছেন—‘আমি চাই, তারা এমন একটি কালিমা মেনে নিক, যার ফলে সমগ্র আরব তাদের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারব লোকজন তাদের জিযয়া (আনুগত্য-নির্দেশক কর) দেবে।’ এর থেকে অনুমিত হয় যে, এই কালিমা শুধু মুখে উচ্চারণ করা কিংবা এর মুখস্থ এক লাইনের অর্থ বয়ান করার নামই নয়; বরং এর রয়েছে অপার্থিব শক্তি, যা ইসলামকে বিজীত করে, মুসলিমদের সম্মান ও মর্যাদার আসনে এবং জমিনে আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধিত্বের আসনে আসীন করে।
‘তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে আল্লাহ তাদের এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি পৃথিবীতে অবশ্যই তাদের খিলাফাত (প্রতিনিধিত্ব) দান করবেন, যেমনি তিনি খিলাফাত (প্রতিনিধিত্ব) দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের দীনকে—যা তিনি মনোনীত করেছেন তাদের জন্য—সুদৃঢ় করবেন এবং ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে। আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। এরপর যারা কুফরি করবে তারাই সত্যত্যাগী।’
মক্কার মুশরিকরাও তাওহিদের স্বীকৃতি দিত। কুরআন বলছে—
‘যদি আপনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, কে আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়ন্ত্রিত করেছে? তাহলে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ। তবে ওরা উল্টো পথে কোথায় ফিরে যাচ্ছে? …যদি আপনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আকাশ থেকে কে পানি বর্ষণ করেছে, অনন্তর এর দ্বারা ভূমিকে তার মৃত্যুর পর পুনরায় সঞ্জীবিত করেছে? তাহলে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ। আপনি বলুন, সকল প্রশংসা আল্লাহর। বরং তাদের অধিকাংশই বিবেককে কাজে লাগায় না।’[4]
উপরিউক্ত আয়াত দুটি থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছে যে, মক্কার মুশরিকরা প্রভুত্বের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। তবে তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সঙ্গে অন্যদেরও শরিক করত। কুরআনে এসেছে—
‘একনিষ্ঠ আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, “আমরা এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদের আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে।” ওরা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তার ফায়সালা করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না, যে মিথ্যাবাদী অবিশ্বাসী।’[5]
সায়্যদি আবুল হাসান আলি নদবি রহ. বলেন—
পরিষ্কার মেধা, গভীরতা এবং সত্যানুসন্ধিৎসার সাথে কুরআন অধ্যয়ন করলে এ বিষয়টি প্রতিভাত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সা.’র সময়কালের কুফফার গোষ্ঠী তাদের বাতিল উপাস্যদের এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর সমকক্ষ কিংবা সমমর্যাদার অধিকারী গণ্য করত না। বরং তারা এটা স্বীকার করত যে, এরা আল্লাহর বান্দা এবং মাখলুক। তাদের বিশ্বাস কখনোই এ ছিল না যে, তাদের এ সকল উপাস্য কোনোভাবেই আল্লাহ তাআলার চেয়ে কম নয়, বরং আল্লাহ এবং এ সকল উপাস্য সমমরয্রাদায় অধিষ্ঠিত। তাদের কুফর এবং শিরক শুধু এ ছিল যে, তারা তাদের বাতিল উপাস্যদের ডাকত, তাদের দোহাই দিত, তাদের নামে মানত করত, তাদের নামে কুরবানির পশু জবাই করত এবং তাদের ব্যাপারে এই বিশ্বাস রাখত যে, তারা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে, তাদের বিপদাপদ দূর করে এবং তাদের কার্যাবলি সম্পাদন করে। এ জন্য প্রত্যেক এমন ব্যক্তি, যে অন্য কারও সঙ্গে সেরূপ আচরণ করবে, যেমনটা কুফফার গোষ্ঠী নিজেদের বাতিল উপাস্যদের সঙ্গে করেছিল সে যদি এ কথা স্বীকারও করে যে, অমুক তো আল্লাহর বান্দা এবং মাখলুক এরপর তার মাঝে এবং জাহেলি জামানার বড় বড় মূর্তিপূজারীদের মাঝে মুশরিক হওয়ার বিচারে কোনো ফারাক থাকবে না। শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. বলেন—
‘জেনে রাখা প্রয়োজন যে, তাওহিদের চারটি স্তর রয়েছে :
১. এ কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে, একমাত্র আল্লাহ তাআলাই অপরিহার্য অস্তিত্ববিশিষ্ট সত্তা। তাই তিনি ছাড়া আর কোনো অপরিহার্য অস্তিত্ববিসিষ্ট সত্তার অস্তিত্ব নেই।[6]
২. আরশ, আকাশ, পৃথিবী এবং প্রত্যেক এমন জিনিস, যা সত্তাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলাকেই জ্ঞান করা।
তাওহিদের এ দুটি স্তর এমন, যে ব্যাপারে আসমানি কিতাবসমূহ আলোচনারই কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। আর না এ ব্যাপারে আরবের মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর মাঝে কোনো অস্বীকৃতি বা মতবিরোধ ছিল। বরং কুরআন তো এ বিষয়টি স্পষ্ট করছে[7] যে, এ উভয় বিষয় তাদের কাছে সর্বজনস্বীকৃত বিষয়সমূহেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৩. আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মাঝে আর যা কিছু রয়েছে তার নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনাকে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে বিশেষিত মনে করা।
৪. আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের উপযুক্ত মনে না করা।[8]
এই দুই স্তর পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে একটি অপরটির জন্য অপরিহার্য অংশের মতো। তাওহিদের এ দুই স্তর কিংবা প্রকার সম্পর্কে কুরআন আলোচনা করেছে এবং কাফিরদের সন্দেহ-সংশয়ের বিস্তর জবাব দিয়েছে[9]।[10]
তাওহিদের কালিমা শুধু একটা বাক্যই নয়, বরং পুরো দীনের শিরোনাম। তাই তো কেউ যদি অন্য সকল ধর্ম এবং কুফরি মতবাদকে আন্তরিকভাবে অস্বীকার না করে শুধু এই কালিমা পাঠ করে কিংবা ইসলামের প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত বিশেষ কোনো বিধানের প্রতি ইমান না রেখে এই কালিমা মুখে উচ্চারণ করে তাহলে এর দ্বারা সে মুমিন হবে না এবং তার এই কালিমা আল্লাহ তাআলার কাছে গৃহীত হবে না। আল্লাহ বলেন—
অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর প্রতি ইমান আনয়ন করে এমতাবস্থায় যে, সে একজন মুশরিক।[11]
সুতরাং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শুধু একটা বাক্যই নয়; বরং পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থা। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু এক আল্লাহর কর্তৃত্ব এবং নেতৃত্বের কথা ঘোষণা করে। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শরিয়াহর বিধান নির্দেশ করে। পবিত্র কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতগুলো লক্ষ করুন—
‘সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে সে তো এক মজবুত হাতলকে আঁকড়ে ধরল, যা কখনো ভাঙার নয়। আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’[12]
‘আপনি কি তাদের দেখেননি যারা দাবি করে, তারা আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও ইমান এনেছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতেও; (কিন্তু) তাদের অবস্থা এই যে, তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, অথচ তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যেন তারা সুস্পষ্টভাবে তাগুতকে অস্বীকার করে? বস্তুত শয়তান তাদের ধোঁকা দিয়ে দিয়ে চরমভাবে গোমরাহ করতে চায়।’[13]
আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা তাকি উসমানি (হাফিজাহুল্লাহ) বলেন, ‘‘তাগুত’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘ঘোর অবাধ্য’। কিন্তু এ শব্দটি শয়তানের জন্যও ব্যবহৃত হয় এবং বাতিল ও মিথ্যার জন্যও। এ স্থলে শব্দটি দ্বারা এমন বিচারক ও শাসককে বোঝানো হয়েছে, যে আল্লাহ ও তার রাসুলের বিধানাবলির বিপরীতে নিজ খেয়ালখুশি মতো ফায়সালা দেয়। আয়াতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে, কিন্তু আল্লাহ ও রাসুলের বিধানাবলির ওপর অন্য কোনো বিধানকে প্রাধান্য দেয় তবে সে আর মুসলিম থাকতে পারে না।’
ইমাম ইবনু জারির তাবারি রহ. বলেন, ‘আমার মতে তাগুতের সঠিক সংজ্ঞা হলো, যা কিছুকে আল্লাহর স্থানে আসীন করা হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে যা কিছুর উপাসনা করা হয়—উপাসনাকারীর নিজ ইচ্ছায় কিংবা যাকে উপাসনা করা হচ্ছে তার বাধ্যবাধকতার কারণে—সেটাই তাগুত; যার উপাসনা করা হচ্ছে তা মানুষ হোক, শয়তান হোক কিংবা কোনো মূর্তি বা পাথর হোক।’[14]
‘না, আপনার প্রতিপালকের কসম, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানে, তারপর তুমি যে রায় দাও সে ব্যাপারে অন্তরে কোনোরূপ কুণ্ঠাবোধ না করে এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করে নেয়।’[15]
আল্লাহ ছাড়া আর কারও বিধান দেওয়ার অধিকার নেই।[16]
আল্লাহ বিধান দেন আর তার বিধানকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করার কেউ নেই।[17]
তিনি নিজ বিধানের কর্তৃত্বে কাউকে শরিক করেন না।[18]
তারা কি জাহিলিয়াতের বিচার কামনা করে? বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম বিধানদাতা কে?[19]
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
নিশ্চয় আল্লাহই হচ্ছেন বিধানদাতা এবং বিধান প্রদান তারই অধিকার।[20]
সুতরাং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, স্বতন্ত্র সভ্যতা-সংস্কৃতি, আর এ সবকিছু সুচারুরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড দাবি করে; যে ভূমিতে ইসলাম বিজয়ী ধর্ম হিসেবে থাকবে, যেখানকার রাজনীতি অর্থনীতি বিচারব্যবস্থা সভ্যতা-সংস্কৃতি সব কিছুই ইসলামি বিধিবিধানের আলোকে পরিচালিত হবে। ইসলামি ভূখণ্ডে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও বাস করতে পারবে এবং তারা মুসলমানদের মতো পূর্ণ অধিকার ও নিরাপত্তাও পাবে। হাঁ, উভয়ের অধিকার সমান হলেও মর্যাদা যে সমান হবে না বা হতে পারে না তা তো সহজেই অনুমেয়। তারা তাদের ধর্মীয় বিধান-উপাসনাও পালন করতে পারবে। তবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা-কার্যাবলি পরিচালিত হবে সম্পূর্ণ ইসলামের আলোকে। আর ইসলাম তো শুধু মুসলমানদেরই নয়; বরং ইসলাম হলো মানবতার ধর্ম, শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম, ন্যায় এবং ইনসাফের ধর্ম। ইসলাম শুধু ধর্মই নয়, বরং ইসলাম হলো দীন; যা ধর্মের থেকেও অনেক ব্যাপক। আল্লাহ বলেন—
তিনি সেই সত্তা, যিনি তার রাসুলকে হিদায়াত এবং সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন, সেই দীনকে সকল দীন (ধর্ম-মতবাদ)-এর ওপর বিজয়ী করার জন্য, তা মুশরিকদের জন্য যতই অপ্রীতিকর হোক।[21]
হাদিসে এসেছে—
ইসলাম উচ্চে থাকে। তার ওপর অন্য কিছু উচ্চ হতে পারে না।[22]
ইসলাম পৃথিবীতে এসেছেই ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আর জুলুম এবং জাহিলিয়াতকে দূর করার জন্য। সাহাবি রিবয়ি ইবনু আমির রা.’র কথায় বিষয়টি সুন্দরভাবে ফুলে উঠেছে—
আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন, তিনি যাদের ব্যাপারে ইচ্ছা করেন আমরা যেন তাদের বের করে আনি বান্দাদের উপাসনা থেকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে তার প্রশস্ততার দিকে এবং ধর্মসমূহের জুলুম থেকে ইসলামের ন্যায়পরায়ণতার দিকে।[23]
৩. ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল, অদম্য ইচ্ছা এবং সকল বাধা-প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করে টিকে থাকার জন্য পর্যাপ্ত ধৈর্য। দাওয়াতের মিশন বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে চাচার পরামর্শ শুনে রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘হে চাচা, আল্লাহর কসম, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দেয়—এ শর্তে যে, আমি এ দীনকে ছেড়ে দেব, যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে বিজয়ী করেন কিংবা এ পথে আমার জীবনের যবনিকাপাত হয়, তবুও আমি কিছুতেই তাকে পরিত্যাগ করব না।’
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আল্লাহ তাকেই কবুল করেন এবং দৃঢ়পদ রাখেন, যে নিজের জীবনকে এ পথে ওয়াকফ করে দেয়। পক্ষান্তরে যারা অনুকূল পরিস্থিতিতে ইসলামের পক্ষে থাকলেও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইসলাম থেকে ছিটকে পড়ে, পরিণামে তাদের জন্য রয়েছে চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং পার্থিব ও পারলৌকিক ক্ষতি। আল্লাহ বলেন—
‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ এমনও আছে, যে আল্লাহর ইবাদত করে এক প্রান্তে থেকে। যদি তার কোনো কল্যাণ লাভ হয়, তবে তাতে সে আশ্বস্ত হয়ে যায় আর যদি কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তবে সে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। সে দুনিয়ায় এবং আখিরাত উভয় জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত। আর এটাই তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।’
‘তোমরা কি মনে করেছ, তোমরা (এমনিতেই) জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের ওপর সে ধরনের অবস্থা আসেনি, যেমনটা এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। তাদের ওপর এসেছিল অর্থ-সংকট এবং দুঃখ-কষ্ট এবং তাদের করা হয়েছিল প্রকম্পিত, এমনকি রাসুল এবং তার ইমানদার সঙ্গীরা বলে উঠেছিল, “আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?” জেনে রেখো, আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।’
এর থেকেই অনুমিত হয় যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন অসাধারণ আত্মত্যাগ, প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা এবং আলোর শত্রুদের অমানসিক নির্যাতন-নিপীড়নের ওপর সবর করার মতো দুদর্ম্য হিম্মত এবং এক আল্লাহ তাআলার ওপর পূর্ণ ভরসা। কবি সুন্দর বলেছেন—‘ইসলাম যিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বা‘দ।’
টীকা
[1] সহিহ বুখারি : ৬০৩১, ৬০৪৬
[2] সুনানুন নাসায়ি : ৪৫৬; সুনানুত তিরমিযি : ৩২৩২; আলমুসতাদরাক, হকাইম : ২/৪৩২
[3] যাদুল মাআদ : ৩/৩০১; হাশিয়াতুন নাবাবি আলা সহিহ মুসলিম : ১২/১৯৯; তাফসিরু কুরতুবি : ৮/৯৯-১০০; তালখিসুল হাবির, ইবনু হাজার : ৪/১০১
[4] সুরা আনকাবুত : ৬১-৬৩
[5] সুরা যুমার (৩৯) : ৩
[6] এটাকে পরিভাষায় ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ’ বলা হয়।
[7] দ্রষ্টব্য—সুরা যুখরুফ : ৯
[8] পরিভাষায় এটাকে ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ’ বলা হয়।
[9] হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ : ১/৫৯-৬০ (সংক্ষেপিত)
[10] দস্তুরে হায়াত : ৭৬-৭৭
[11] সুরা ইউসুফ (১২) : ১০৬
[12] সুরা বাকারা (২) : ২৫৬
[13] সুরা নিসা (৪) : ৬০
[14] তাফসিরুত তাবারি : ৫/৪১৯; ৮/৪৬৫
[15] সুরা নিসা (৪) : ৬৫
[16] সুরা ইউসুফ (১২) : ৪০
[17] সুরা রা‘দ (১৩) : ৪১
[18] সুরা কাহাফ (১৮) : ২৬
[19] সুরা মায়িদা (৫) : ৫০
[20] সুনানু আবি দাউদ : ৪৯৫৭; সুনানুন নাসায়ি : ৫৩৮৭; সহিহ ইবনু হিব্বান : ৫০৪
[21] সুরা সফ (৬১) : ৯
[22] সহিহুল জামিয়িস সাগির : ২৭৭৮
[23] আল-কামিল ফিত-তারিখ : ২/২৯৮; তারিখু ইবনি খালদুন : ২/৫৩০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৭/৪৬
লেখার অনেক জায়গায় অপ্রচলিত শব্দের বহুল প্রয়োগ লক্ষ্য করেছি। কীজন্যে এমনটা হল, তা ঠিক বোধগম্য নয়। যেমন : নির্মূল/সমাপ্তি অর্থে ‘যবনিকাপাত’ শব্দের প্রয়োগ।
তাছাড়া, সত্তা (সত্ত্বা), জ্ঞান করা (জানা/মানা), আমাদের মাঝে এবং তার মাঝে (তার ও আমাদের মাঝে), সা. (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), জিযয়া (জিযিয়া), ইত্যাদি প্রয়োগে সাবধানতা কাম্য।
লক্ষণীয় ব্যাপার হল, লেখালেখির ক্ষেত্রে যে বানানরীতি এখানে অনুসৃত হয়েছে, তা পূর্ণাঙ্গভাবে পরিস্ফুট হয়নি। কেননা, এক জায়গায় ‘মুহাম্মাদ’ পেলেও অন্য জায়গায় ‘ইমান’ পেয়েছি। আবার, কোথাও কোথাও ভিন্নরূপ বেশ লক্ষণীয়!
এখানে, একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব যে, আপনি এক হাদিসের বঙ্গানুবাদে লিখেছেন….. ‘হে চাচা!…’ এখানে আমার একটু আপত্তি ছিল। আপত্তিটা হল ভাষার প্রাঞ্জলতা ও গ্রহণযোগ্যতার উপর ভিত্তি করেই। আপনি এখানে, ‘হে চাচা’ না বলে যদি ‘চাচাজান!’ লিখতেন, তবে তাতে দুটি ব্যাপার স্পষ্ট হত :
১. দরদের সাথে চাচাকে সম্বোধন
২. তাওহিদের বর্ণনার পাশাপাশি আত্মীয়তার মর্যাদার কথাও ভুলে না যাওয়া
উল্লেখ্য যে, আমি শুধুই ভাষার প্রাঞ্জলতার কথা মাথায় রেখে এরূপ অনুবাদ করতে বলেছি। নয়তো, যদি ঐ হাদিসের প্রেক্ষাপটই যদি এরকম হয় যে, অর্থ তেমনটা না করলে তার মর্ম অন্যরকম রূপে দাঁড়াবে, তবে সেব্যাপারে আপনি আমার চেয়ে বিজ্ঞ। আমি নির্দ্বিধায় তা মেনে নিতে রাজি।
যেসব ব্যাপারে আমি বলেছি, তা আপনার লিখনিতে ‘স্খলন’ না হয়ে ‘সূক্ষ্ম ভ্রম’ রূপে চিহ্নিত হলেই আমি খুশি হব। পক্ষান্তরে, আমার চিন্তার মাঝে কোন ‘ভুল’ দৃষ্টিগোচর হলে, জানানোর নিবেদন রইল।
ফাকাদ ওয়াসসালাম
শুকরান। এ লেখাগুলো অসম্পাদিত। এমনকি লেখার পর দ্বিতীয়বার নজরও বুলানো হয়নি। মূলত এগুলো বই হবে। তখন পুরো লেখা নতুন করে সম্পাদনা হবে। এখানেও তখন এডিটকৃত রূপ বসিয়ে দেওয়া হবে। এটাকে আপাতত খসড়া হিসেবে ধরতে পারেন।