দেওবান্দিয়াত এক পবিত্র ধারার নাম

আলী হাসান উসামা

 

দেওবান্দিয়াত এক পবিত্র ধারার নাম। দারুল উলুম দেওবন্দের সিদ্ধান্তই দেওবান্দিয়াত নয়। দারুল উলুমের ছাত্র-শিক্ষকের কোনো সিদ্ধান্তও দেওবান্দিয়াতের খেলাফ হতে পারে। যা হক, তাই দেওবান্দিয়াত। এজন্যই হাজারো বিষয়ের ক্ষেত্রে দেওবন্দি আলিমদের পরস্পরের মধ্যে ইখতিলাফ দেখতে পাবেন। এসব ক্ষেত্রেও দারুল উলুমের সিদ্ধান্তই সর্বদা সঠিক হবে আর অন্যদের সিদ্ধান্ত সর্বদা ভুল হবে বা দারুল উলুমের একক সিদ্ধান্ত মেনে নেয়াই সকলের জন্য অপরিহার্য হবে – বিষয়টি এমন নয়।

দারুল উলুম থেকে সেক্যুলারিজম সমর্থনের মতো বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। (যদিও সকলের দাবি, ভারতের মতো দেশে অবশ্যই তা কৌশলের অংশ; আরসা যেমন নিজেদেরকে জাতীয়তাবাদী দল বলে দাবি করে)। পাক-ভারতের অনেক বিদগ্ধ আলিম তার বিরোধিতাও করেছেন। এছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে এখন এমন সব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, বাহ্যত বলা যায়, শায়খুল হিন্দ রহ. বা কাশ্মীরী রহ.-রা জীবিত থাকলে তা কখনোই সমর্থন করতেন না।

কারি তৈয়ব সাহেব রহ. দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী দারুল উলুমের মুহতামিম থেকেও শেষাবধি দারুল উলুম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, কাশ্মীরী রহ.-কেও দেওবন্দ ছাড়তে হয়েছে, এখনও দেখা যাচ্ছে একই ছাদের নিচে বাস করা সত্ত্বেও বাহরুল উলুম নেয়ামাতুল্লাহ আজমি দা. বা. শায়খ পালনপুরি দা. বা.-র খণ্ডনে রীতিমতো কিতাব লিখে ফেলছেন। আদিবুল হিন্দ খলিল আমিনি দা. বা. উত্তেজিত হয়ে কখনো দু-চার কথা বলে ফেলছেন, জামিল সাহেব দা. বা.-র সাথে কৃত আচরণ নিয়েও রয়েছে অনেকের তুলকালাম; সে যা-ই হোক, দারুল উলুমের একক বা সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অবশ্যই সম্মানীয়; কিন্তু সবক্ষেত্রে তা-ই যে শতভাগ সঠিক হবে – বিষয়টা এমন নয়।

দেওবান্দিয়াত একটি ধারার নাম, নির্দিষ্ট আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির নাম, দারুল উলুমের কোনো ছাত্র-শিক্ষকের ব্যক্তিগত মতামত বা সিদ্ধান্তের নাম নয়। যদি এমনই হতো, তাহলে নিশ্চয়ই নদওয়া বা মাজাহিরের আলিমদেরকে দেওবন্দি গণ্য করা হতো না। এতো এতো মাসআলায় ভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদানের পর দারুল উলুম করাচিকে নিশ্চয়ই এতোদিনে আলাদা করে দেয়া হতো।

ভুল কোনো কিছুকে দেওবান্দিয়াত বলে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। দেওবন্দের পরিচালনায় রয়েছেন বা কেয়ামতের আগে থাকবেন – এমন যে কারো ভুল বা বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত-মতামতকে দেওবন্দিয়াতের মোড়ক লাগিয়ে চালিয়ে দেয়া অনেক বড় অসততা। দেশীয় বা বিদেশী কোনো অসৎ চাটুকার জ্ঞানী লোক যদি দেওবন্দের অনেক বড় সার্টিফিকেটধারীও হয়, তবুও এটা জরুরি নয় যে, তিনি নবিদের মতো একজন নিষ্পাপ মানবরূপে তার দেশে বা তার সমাজে আবির্ভূত হবেন এবং তার সকল গোমরাহিকেও শুধু সার্টিফিকেটের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করে নিতে হবে।

মসজিদে রশিদ, দারুল উলুম দেওবন্দ

মসজিদে রশিদ, দারুল উলুম দেওবন্দ

অনেক বেদাতি বা গোমরাহ ফেরকার পৃষ্ঠপোষকরাও এককালে দেওবন্দ মাদরাসায় সুনামের সাথে লেখাপড়া করেছে। এজন্য তাদের সকল কুকীর্তি বৈধতা পায় নি। সাহাবিদের মধ্যেও অনেকে যদি মুরতাদ হয়ে যেতে পারে, আর তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে থাকে, তাহলে এই ফিতনার যুগে এসে তা নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। মনে রাখতে হবে, দেওবন্দের সার্টিফিকেট কোনো জান্নাতের বা ভুলের উর্ধ্বে অবস্থানের সনদ নয়। দেওবন্দিয়াত হক। যা কিছু বাতিল, তা যার থেকেই উৎসারিত হোক না কেনো, তা কখনোই এবং কিছুতেই দেওবান্দিয়াতের অংশ হতে পারে না।

অন্য দেশের রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়েও দেওবন্দ সবিশেষ মাথা ঘামায় না। এজন্যই পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে হেফাজতের যে সুবিশাল আন্দোলন হলো – তা নিয়ে দেওবন্দের কোনো অফিসিয়াল বিবৃতি কেউ দেখাতে পারবে কি? (আফগানিস্তানের চলমান লড়াই, পাকিস্তানের বিভিন্ন সহিংসতা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একই কথা।) তেমনি ৯০ হাজার ছোট চুল আর ১৫ হাজার বড় চুল কর্তৃক স্বাক্ষরিত ফতোয়া নিয়েও দেওবন্দ কোনো তুলকালাম করেছে কি?

দেওবন্দ জ্ঞানীদেরকে তার জ্ঞানের কারণে মূল্যায়ন করে। এমনও হয় যে, কোনো ব্যক্তির সাথে দেওবন্দের অনেক বিষয়ে আদর্শিক মতপার্থক্য রয়েছে, এরপরও দেওবন্দ তার আদর-আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি করে নি। তাই কাউকে দেওবন্দ কর্তৃক আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে সোফায় বসা অবস্থায় দেখলেই এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, দেওবন্দ তার সকল কর্ম-কীর্তির অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে।

মাওলানা আবদুল মালেক দা. বা. বলেন, কাউকে ভালোভাবে আদর-আপ্যায়ন করতে দেখলেই কখনো এটা ভাববে না যে, তোমাদের উস্তাদ বুঝি তার সকল চিন্তা-ফিকিরকে সমর্থন করেন। মেহমানদারির সুন্নাহ পালনের উদ্দেশ্যে এমন অনেক ব্যক্তিত্বরও আদর-আপ্যায়ন করা হয়, যার অধিকাংশ চিন্তা-ফিকিরের সাথেই আমরা একমত নই। এমনকি কাউকে তোমাদের সামনে আলোচনা করতে দেয়া হলে তারও উদ্দেশ্য এ নয় যে, তোমরা অবলীলায় তার সব কথা গ্রহণ করে নেবে। যা হক, শুধু তাই গ্রহণীয় হবে। যা ভুল, তা সর্বদাই প্রত্যাখ্যাত হবে; এজন্য প্রত্যেকবার আলাদা মজলিস করে সতর্ক করে দিতে হবে – বিষয়টি এমন নয়।

দেওবন্দি আলিমদের পারস্পরিক মতভিন্নতা ছিলো, আছে এবং থাকবে। প্রত্যেক ফুলের ঘ্রাণ আলাদা। তবে সর্বদা শুধু তাই গ্রহণীয় হবে, যা নিরেট হক। আর হকের অপর নামই দেওবান্দিয়াত। বাতিল কখনো দেওবান্দিয়াতের অংশ ছিলো না, এখনও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ না করুন, দেওবন্দি ধারার সকল প্রতিষ্ঠানও যদি কোনোদিন গোমরাহ হয়ে যায়, তবুুও মহান দেওবান্দিয়াতের গায়ে একটুও দাগ বা কালিমা লাগবে না, লাগতে পারে না। চিরকাল চেতনার ফেরিওয়ালা একদল এমন থাকবে, যারা সর্বদা হকের পতাকাবাহী হবে; যদিও শেষ যুগে এসে তারা হয়ে যাবে গুরাবা। আর জেনে রেখো, সুসংবাদ তাদের জন্য, যারা গুরাবা। তাওহিদের পুনর্জাগরণ, ইযহারুদ দ্বীন, ই’লাউ কালিমাতিল্লাহ, ইমহাউল বাতিল (বিশেষত বিদ’আহ) এবং সঠিক নববি ইলমের ধারা কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত ও অক্ষত রাখা উলামায়ে দেওবন্দের অনন্য বৈশিষ্ট্য আর দ্বীনের এসব ক্ষেত্রই তাদের কর্মক্ষেত্র।

জয়তু দেওবান্দিয়াত!

দারুল উলুমের একপ্রান্তের প্রবেশদ্বার

দারুল উলুমের একপ্রান্তের প্রবেশদ্বার

 

দেওবন্দিয়াত সম্পর্কে খুচরা কথা

আবুল কাসেম আদিল

 

দেওবন্দিয়াত একটি শিক্ষাব্যবস্থা। ভারতবর্ষের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে অভিনব শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হয়েছে। সেই ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এখনও বলবৎ থাকায় দেওবন্দিয়াতের কার্যকারিতা আজও বিদ্যমান রয়েছে। এই অঞ্চলে শুদ্ধ দ্বীনি শিক্ষা এখন পর্যন্ত একমাত্র দেওবন্দি মাদরাসাসমূহই দিয়ে আসছে। দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে দেওবন্দিয়াতের বিকল্প এখন পর্যন্ত তৈরি হয় নি। ফলে এখনও আমি দেওবন্দিয়াতের প্রতি আস্থা রাখি।

মাসলাকে দেওবন্দ বলতে এইটুকুই। এইটুকু ভিন্ন আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামায়াতের মতাদর্শের বাইরে দেওবন্দের আলাদা মতাদর্শ নেই, আলাদা ভাষ্য নেই। দেওবন্দের প্রতি অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে কেউ যদি মাসলাকে দেওবন্দ বলে এর চেয়ে বেশি কিছু বোঝাতে চান, গোলটা বাঁধবে তখনই। তখন দেওবন্দিয়াত ফিরকা আকারে হাজির হবে। আশা করি সবাই স্বীকার করবেন, দেওবন্দ ইসলামের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ফিরকা নয়। অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে দেওবন্দকে ফিরকায় পরিণত করা দেওবন্দের জন্যই বরং ক্ষতিকর হবে।

আমি দেওবন্দি। এই অর্থে যে, আমি দেওবন্দি শিক্ষাব্যবস্থায় পড়েছি। এই শিক্ষাব্যবস্থার একজন নগণ্য শিক্ষার্থী হিসেবে আমি দেওবন্দের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি পারিবারিকভাবে ‘সেকুলার ইসলামী’। ‘সেকুলার ইসলামী’ মানে সেকুলাররা ইসলামকে যেভাবে ব্যাখ্যা করে, পৈত্রিক সূত্রে সেই ইসলাম প্রাপ্ত হয়েছিলাম। সত্যিকার অর্থে যেই ইসলামের সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের যোগ নেই। দেওবন্দ আমাকে রক্ষা করেছে। ইসলামকে ইসলামের চোখে দেখতে শিখিয়েছে। সুতরাং দেওবন্দিয়াতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া আমার উপায় নেই।

দেওবন্দের সকল কৃতিত্ব স্বীকার করেই, এও স্বীকার করতে হবে যে— দেওবন্দিয়াতের ভিত্তি অহী নয়। সময়ের চাহিদার ভিত্তিতে ভৌগোলিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেওবন্দ প্রবর্তিত হয়েছে। যেহেতু দেওবন্দিয়াতের ভিত্তি অহী নয়, সেহেতু এর সব কিছু অকাট্য জ্ঞান করা আবশ্যক নয়। দেওবন্দের সব কিছুর সঙ্গে একমত না হলে যাঁরা আকাবিরবিরোধী, দেওবন্দের চেতনাবিরোধী, নতুন ফিরকার প্রবর্তক বলেন— তাঁদের মতো স্থূলতায় আমি বিশ্বাসী নই। দেওবন্দের চিন্তাভাবনা নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনার সুযোগ আছে। দেওবন্দের কোনো চিন্তা ও মত নিয়ে কেউ যদি সশ্রদ্ধচিত্তে ভাবনা ও পর্যালোচনা পেশ করতে চায়, তার জন্য সেই সুযোগ অবারিত থাকা উচিত।

দেওবন্দকে দেওবন্দের স্থানে রেখে শ্রদ্ধা করা এই উপমহাদেশের মানুষদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু দেওবন্দকে ‘হকের একমাত্র’ ঝাণ্ডাবাহী বললে বিশ্বের অন্যান্য মুসলমানকে খাটো করা হয়। আমি দীর্ঘ ষোলো বছর কওমী মাদরাসায় পড়েছি এবং কয়েক বছর যাবত পড়াচ্ছি। তবু এই ‘জাতীয়তাবাদ’ গ্রহণ করতে পারি নি। এই কথাগুলো বলছি ভেবে-বুঝে। আমার জন্য না বলাই ভালো ছিল। স্রোতের অনুকূলে থাকাই আরামদায়ক।

দেওবন্দ বিষয়ক যে কোনো বইয়ের শুরুতেই লেখা থাকে, ‘দেওবন্দ একটি আন্দোলন, একটি চেতনা…।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে আমার ঐকমত্য আছে। বরং ইসলামই একটি কেন্দ্রীয় চেতনা, একটি আন্দোলন। ইসলাম শুরুতেই মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। ইসলামপন্থীরা সব দেশে সব যুগে বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, যুদ্ধ করেছে। দেওবন্দের আন্দোলন ইসলামের কেন্দ্রীয় আন্দোলনের সঙ্গে ঐক্যসূত্রে গাঁথা। এই আন্দোলনকে ইসলামের কেন্দ্রীয় আন্দোলন থেকে আলাদা করলেই জন্ম নেবে জাতীয়তাবাদ, দেওবন্দ জাতীয়তাবাদ। যা ইসলাম-সমর্থিত নয়।

ইসলাম আসাবিয়্যাত অপছন্দ করে। আসাবিয়্যাত মানে স্বজনপ্রীতি, স্বদলপ্রীতি, স্বগোত্রপ্রীতি ইত্যাদি। প্রীতি তো অবশ্যই ভালো জিনিস, প্রশংস্য। কিন্তু প্রীতির সঙ্গে যখন নেতিবাচক ‘স্ব’ যুক্ত হয়, তখন তা নিন্দনীয়। দুঃখজনক হলো, এই নিন্দনীয় প্রীতি অনেক দেওবন্দিয়াতের ঝাণ্ডাবাহীর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। দেওবন্দি ছাড়া অন্যদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হওয়ার বিষয় নাহয় বাদ দিলাম, অনেকে তো নিজের মাদরাসা ছাড়া অন্যগুলোকে তুচ্ছজ্ঞান করে; নিজের শিক্ষককে অপরিমিত মান্য করে, অথচ অন্য বিজ্ঞ আলেমের সমালোচনায় লিপ্ত হয়। নিজ গোত্রের ত্রুটি যেভাবে মার্জনা করতে পারে, এবং যে কোনো প্রীতিভাজনের অপ্রীতিকর দোষত্রুটির ইতিবাচক ব্যাখ্যা দাঁড় করতে পারে, অন্যদের বেলায় তা পারে না। বস্তুত, আসাবিয়্যাতদুষ্ট ছিদ্রান্বেষণের ছিদ্রযুক্ত মন দেওবন্দের নামে হলেও তা নিন্দনীয়। বরং বলা ভালো, তা যদি সত্যিকার দেওবন্দিয়াত হয়, তাহলে দেওবন্দিয়াতই বর্জনীয়। তবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, দেওবন্দ এসব ক্ষুদ্রতা থেকে অনেক বেশি পবিত্র।

 

পাঠাগার, দারুল উলুম দেওবন্দ

পাঠাগার, দারুল উলুম দেওবন্দ

 

আকাবিরে দেওবন্দের অনুসরণ : প্রসঙ্গ কথা

—মাওলানা আবদুল মালেক দা. বা.

 

আকাবিরের নকশে কদম তথা পদাঙ্ক থেকে দূরে সরে যাওয়া ঠিক নয়। যে অঞ্চলে যাদের মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার প্রসার হয়েছে তারাই সে অঞ্চলের আকাবির। তবে শর্ত হল তাদেরকে হতে হবে ‘মুনীব ইলাল্লাহ’ তথা আল্লাহর প্রতি অভিমুখী। কুরআনে কারীমে আছে-

وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيّ
তুমি তার পথের অনুসরণ করো, যে আমার প্রতি অভিমুখী হয়েছে।

এমনিভাবে আছে,
أُولَئِك الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ
তারাই সেসকল লোক, যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তাদের হিদায়াতের অনুসরণ করো।

অর্থাৎ তাদেরকে হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এরপর কারো অনুসরণের জন্য যে শরয়ী ‘মি’য়ার’ তথা মাপকাঠি আছে তার উপস্থিতির পর নতুন কোনো শর্ত আরোপ করা ঠিক নয়।

এই উপমহাদেশে ‘মুনীব ইলাল্লাহ’ তথা আল্লাহর প্রতি অভিমুখী হলেন আকাবিরে দেওবন্দ। শুধুই তাঁরা নন; বরং আরো অনেকেই। তবে তাঁদের কুরবানি ও মুজাহাদা এ অঞ্চলে অনেক বেশি এবং তাঁদের সময়ে তাঁদের খেদমতই বেশি স্মরণীয়-বরণীয়। তাছাড়া আমাদের ওপর তাঁদের ইহসান-অনুগ্রহ অনেক। একদিকে তাঁদের ইহসান, অন্যদিকে এই এলাকায় তাদের তালীম-তরবিয়তের চর্চা। সেজন্যে স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাঁদের অনুসরণ করি। তবে এসবের আগে আমরা দেখে নিয়েছি যে, তাঁদের মাঝে শরয়ী মিয়ার বা মানদন্ড আছে কি না। সেটা আছে। কারণ যেমনিভাবে তাঁরা মুনীব ইলাল্লাহ, তেমনিভাবে রব্বানি হিদায়াতের ওপরও প্রতিষ্ঠিত।

আর ইত্তিবার ক্ষেত্রে তো ‘যাল্লাত’ তথা স্খলন-বিচ্যুতি সবসময়ই ‘মুসতাসনা’ তথা বর্জিত। অতএব যখন শরয়ি মিয়ার-মানদন্ড উপস্থিত, আবার যাল্লাত-বিচ্যুতি মুসতাসনা-বর্জিত, তখন কেউ নজদের, নাকি অন্য কোনো অঞ্চলের সে বিষয় নিয়ে পেরেশান হওয়ার কিছু নেই। নজদওয়ালারা নজদী শায়খের ইত্তিবা করুক। আর আমরা আমাদের এখানে যাঁদের তালীম-তরবিয়ত মারূফ ও মুরাওয়াজ (পরিচিত ও সুপ্রচলিত) এবং আমরা আমাদের মায়ের কোল থেকেই যাদের দ্বীনী তত্ত্বাবধান পেয়ে এসেছি তাঁদের ইত্তিবা করি। আর এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা থেকে আমরা সরে আসতাম যদি তাঁদের মাঝে শরয়ি মিয়ার-মানদন্ড না থাকতো।

সদর গেইট থেকে একনজরে দারুল উলুম দেওবন্দ

সদর গেইট থেকে একনজরে দারুল উলুম দেওবন্দ

((এই আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, কেউ যদি বিশেষ কোনো কারণে, শরিয়াহ্‌র দাবিতেই ইলমের বিশেষ কোনো অধ্যায়ে নজদি বা অন্য যেকোনো হকপন্থী ধারার শায়খদের ইত্তেবা করে, আর সে বিষয়ে আকাবিরে দেওবন্দ থেকে কিছু বর্ণিত না থাকে অথবা যা-কিছু বর্ণিত ইলমের মানদন্ডেই তার কাছে তা অনুসরণীয় বলে মনে না হয়ে থাকে, তাহলে এজন্য তাকে পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করার কোনোই সুযোগ নেই। হাঁ, একান্ত ও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এমনটা করা অর্থহীন! উদাহরণস্বরূপ কেউ যদি খিলাফাহব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে চায়, আর এক্ষেত্রে সে বাধ্য হয়েই অন্য কোনো অঞ্চলের শায়খদের রোডম্যাপ অনুসরণকেই সঙ্গত ও উপকারি বলে মনে করে, তাহলে তাকে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বলার কোনোই অধিকার নেই। কারণ, উদ্দেশ্য তো হকের অনুসরণ ও তার প্রতিষ্ঠা। তার জন্য এগুলো তো সব মাধ্যম বা উপলক্ষ্য। উপলক্ষ্যের পেছনে পড়ে লক্ষ্যকে তো বর্জন করার সুযোগ নেই। যদিও স্বাভাবিকভাবে উপলক্ষ্য অবলম্বন করা ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছানো দুরূহ। কিন্তু মূলকথা তো এই যে, অঞ্চলভিত্তিল আলিম ভাগ করাটা কুরআন-সুন্নাহ্‌র কোনো বিধান নয়। হিকমাহ এবং মাসলাহার দাবিতেই এ কথা বলা হয়ে থাকে। এখন কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত হিকমাহ এবং মাসলাহাতই যদি ভিন্ন কিছু দাবি করে, আর তখনও কেউ সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে সত্যানুসরণের সকল পথ রুদ্ধ করে দিতে চায়, তাহলে নিশ্চয়ই তা চরম গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব ছাড়া কিছু নয়। – সংকলকের পক্ষ থেকে সংযোজিত।))

কোনো অমুসলিম যদি ‘মুহাররাফ’ তথা বিকৃত ইসলামওয়ালা কারো কাছে ইসলাম গ্রহণ করে; তাহলে কি পরেও সেই ইসলামের উপরই তাকে বহাল থাকতে হবে?

যেমন কেউ যদি কোনো বেরেলবীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে, যাদের মধ্যে ‘ইনাবাত’ নেই, হিদায়াতের সঠিক তালীম নেই, সুন্নতের ইত্তিবা নেই, এমনকি ফরয পর্যায়ের অনেক আকীদায় যাদের গড়বড়ি আছে, তাহলে তাকে অবশ্যই সহীহ ও সঠিক দ্বীনের পথে ফিরে আসতে হবে। আকীদা দুরস্ত করতে হবে। হিদায়াতের সঠিক তালীম নিতে হবে এবং সুন্নতের পূর্ণ ইত্তিবা তাকে করতে হবে। তবে ইসলাম গ্রহণে সেই বেরেলবীর মধ্যস্থতার জন্য তার শোকরগুযার সে হবে, তার ইহসান সে স্বীকার করবে। সেটা ঠিক আছে; বরং তাকেও সুন্নতের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাবে।

তো আমরা যে আকাবিরে দেওবন্দের ইত্তিবাকে গ্রহণ করেছি, সেটা এইজন্য নয় যে, তাঁরা আমাদের অঞ্চলের এবং তাদের মানহাজ ও মাশরাবে আমাদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা, এককথায় তাঁদের অনেক ইহসান আমাদের উপর, এইসব বিষয় ওজহে তারজীহ বা প্রাধান্য প্রদানের একটি দিক মাত্র, তবে তাঁদের ইত্তিবাকে ইখতিয়ার বা গ্রহণ করার মূল কারণ হল, তাঁদের ইনাবাত ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর প্রতি অভিমুখিতা এবং ‘ইহতিদা’ তথা হিদায়াতপ্রাপ্ত হওয়ার মিয়ার বা মানদন্ডে তাঁদের উত্তীর্ণ হওয়া।

এ কারণে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা ও আমল এবং মাসলাক-মাশরাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত যেকোনো আকাবিরের ইত্তিবাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি। আর সেই গ্রহণ করার দ্বারা আমাদের মাকসাদ হাসিল হয়ে যাবে। তবে আকাবিরে দেওবন্দকে আমরা প্রাধান্য দেব এইজন্য যে, এই দেশে তাঁদের তালীম তারবিয়তের চর্চা হয়েছে এবং তাঁদের মাধ্যমে অনেক ইহসান আমাদের ওপর আছে।

ঈষৎ সংযোজিত, সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত

সূত্র: http://www.alkawsar.com/article/1092
পুরো লেখাটি পড়তে এই লিংক ভিজিট করুন।

 

উম্মুল মাদারিসিল কাওমিয়্যাহ দারুল উলুম দেওবন্দ

উম্মুল মাদারিসিল কাওমিয়্যাহ দারুল উলুম দেওবন্দ

 

দেওবন্দিদের পারষ্পারিক মতপার্থক্য

আব্দুল্লাহ মায়মুন

 

আমাদের অনেক ভাইয়ের ধারণা যে, শুধু দেওবন্দি আলেমদের মধ্যে পারষ্পারিক এত মতভিন্নতা! আচ্ছা, অন্য কোনো মাসলাকের আলেমদের মধ্যে কি এই মতভিন্নতা নেই?

যদিও এ ধরনের মন্তব্যের জন্যে শুধু ইলমচর্চার অপ্রতুলতা প্রধানত দায়ী। কিন্তু এরপরেও যদি আমরা বিষয়টা তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো যে, মতভিন্নতা শুধু উলামায়ে দেওবন্দের মধ্যে নয়, বরং অন্যান্য (মাসলকে) মতাদর্শের আলেমদের মধ্যেও বিদ্যমান।

বর্তমানে মুসলিমবিশ্বে আরো দুই মাসলাকের উলামারা শক্তিশালী প্রভাব রাখেন।

১- জামেয়া আযহারের আযহারি উলামায়ে কেরাম।

২- শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহ. এর প্রবর্তিত সংস্কারের নজদি উলামায়ে কেরাম।

এই দুই মাসলাকের আলেমদের মধ্যেও পারষ্পরিক অনেক মতভিন্নতা রয়েছে।

আযহারি আলেমদের মতপার্থক্যের উদাহরণ:

যেমন- ডক্টর ইউসুফ আল-কারযাবি একজন আযহারি আলেম। এমনিভাবে আল-আযহারের বর্তমান প্রধান আহমদ তায়্যিবও একজন আযহারি। ইউসুফ কারযাবি ডক্টর মুরসিকে বৈধ শাসক মনে করতেন, কিন্তু আহমদ তায়্যিব ডক্টর মুরসির পদত্যাগের ফতোয়া দিলেন, জালিম সিসির পক্ষে তার অবদান সবচেয়ে বেশি। এমনিভাবে যদি আমরা আযহারি আলেমদের পারষ্পরিক মতভিন্নতা তলিয়ে দেখি তাহলে বিস্ময়ের শেষ থাকবে না।

নজদি আলেমদের মতপার্থক্য:

বর্তমানে সৌদি আলেমদের শীর্ষ আলেমরা সবাই নজদি। এরাও আবার প্রধানত: দু’ভাগে বিভক্ত। এক: দরবারী। দুই: হক্কানি-রাব্বানি। দরবারি আলেমদের স্থান সরকারি প্রাসাদে, আর হক্কানি আলেমদের স্থান কারাগারের লৌহকপাটে। উভয়গ্রুপের দলিলের উৎস একই। গত কয়েকদিনে দালাল মুনাফিক পরিবার যে-সব আলেমদের গ্রেফতার করেছে, তাদের সিংহভাগই নজদি মতাদর্শের আলেম। এই মজলুম আলেমদের বিরুদ্ধে ওই দরবারি আলেমরা ফতোয়া দিয়েছে, এরা নাকি খারিজি ও সন্ত্রাসীদের মদতদাতা।

আচ্ছা এবার আপনারাই বলুন, আযহারি আলেমদের পারষ্পরিক মতভিন্নতা আর নজদি আলেমদের পারষ্পরিক মতভিন্নতার দরুন আমরা কি ঢালাওভাবে উলামায়ে নজদ ও উলামায়ে আযহারকে দোষারোপ করি? না, তাদের মধ্যে হক্কানি ও রব্বানিকে পার্থক্য করি? তাহলে কেনো আমাদের কিছু সংখ্যক ভাই কিছু ছুতো পেলেই ঢালাওভাবে উলামায়ে দেওবন্দকে দোষারোপ করেন? দেওবন্দ ও দেওবন্দি নিয়ে আমার এই লেখা পড়তে পারেন। (http://bit.ly/2xhSsy7)!

আমাদের মধ্যে অনেকে যেভাবে দেওবন্দ ও দেওবন্দিকে একটি আসাবিয়্যাহ্‌র রূপ দিয়েছেন, এমনিভাবে আমাদের কিছুসংখ্যক অতি-উৎসাহী ভাই দেওবন্দ-বিরোধিতায় আসাবিয়্যাহ্‌য় লিপ্ত রয়েছেন।

আমার জানামতে বর্তমানে পুরো দেওবন্দি ঘরানায় এমন একজনও দেওবন্দি আলেম নেই, যার প্রতিটি কথা, মত ও অবস্থান সমগ্র দেওবন্দিরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অন্ধের মত মেনে নেয়। বর্তমানে দেওবন্দিদের শীর্ষ আলেম হচ্ছেন আল্লামা তাকী উসমানি সাহেব দা.বা.! আপনি কি মনে করেন, তাকী উসমানি সাহেবের সব কথা সব দেওবন্দিরা মেনে নেয়? তাকী উসমানি সাহেবের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বাকিদের অবস্থা কী হবে?

এছাড়া দেওবন্দ অনুসৃত যত প্রতিষ্ঠান আছে এগুলোর সবটাই একটি আরেকটির সাথে শতভাগ মিল পাবেন না। হাটহাজারী-দেওবন্দ-দারুল উলুম করাচী-বানুরী টাউন-পটিয়া-সাহারানপুর সবগুলোর মধ্যে পারষ্পারিক ছোটখাটো অনেক পার্থক্য আছে। তাই বর্তমানে যেভাবে দেওবন্দের সব ফতোয়া সব দেওবন্দিদের প্রতিনিধিত্ব করে না, এমনিভাবে গুটিয়ে কয়েক দেওবন্দির ‘শান্তির ফতোয়া’ও সব দেওবন্দিদের প্রতিনিধিত্ব করে না।

আমরা যদি এ ইখতেলাফ ও আদাবে ইখতেলাফ লক্ষ করি তাহলে সহজেই বুঝে আসে যে, ‘আলেমদের ইখতেলাফ রহমতস্বরূপ’, আলেমদের ইখতেলাফ ওয়াসআত (প্রশস্ততা) এর দরজা খুলে দেয়। তাই আমাদের জানা উচিৎ, যে, আমরা আকাবিরের অনুসরণ কীভাবে করবো? কতটুকু করবো? যাল্লাত কীভাবে ত্যাগ করবো? কীভাবে ইখতেলাফের আদাব রক্ষা করে চলবো? আর এসব নীতিমালা জানতে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের এই লেখাটি পড়া যেতে পারে (http://bit.ly/2yJD1QC)!

ওপরের লেখা শুধু দেওবন্দি আকাবির নয়, বরং সব মাসলাকের আকাবির অনুসরণের নীতিমালা।

আল্লাহুম্মা আরিনাল হাক্কা হাক্কাওঁ ওয়ারযুকনা ইত্তিবাআহ, ওয়া আরিনাল বাতিলা বাতিলাওঁ ওয়ারযুকনা ইজতিনাবাহ…

Share This