সুলতান বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতি বা অনুমতি না থাকলে কি জুমআ আদায় বিশুদ্ধ হবে না?
ফিকহের গ্রন্থাদিতে কিছু শর্ত উল্লেখ করা হয় সত্তাগত অপরিহার্যতার কারণে আর কিছু শর্ত উল্লেখ করা হয় মাসলাহাত (কল্যাণ বিবেচনা)-এর কারণে। জুমআ আদায়ের বিশুদ্ধতা সুলতান বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতি কিংবা অনুমতির ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটি মাসলাহাতের বিবেচনায় আরোপিত শর্ত মাত্র। যদি দেশে সুলতান বা তার প্রতিনিধি থাকেন, সেক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। আর যদি তারা না থাকেন, তবে তাদের অনুপস্থিতির কারণে জুমআর গুরুত্বপূর্ণ সালাত বন্ধ থাকবে না।
ইমাম মালিক রহ. ও হানাফি মাজহাবের প্রখ্যাত ইমাম তহাবি রহ. বর্ণনা করেন :
عن أبي عبيد مولى ابن أزهر قال: «شهدت العيد مع علي بن أبي طالب عليه السلام، وعثمان محصور، فجاء فصلى، ثم انصرف فخطب»
ইবনু আজহারের আজাদকৃত গোলাম আবু উবায়েদ রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, (খলিফা) উসমান রা. যখন অবরুদ্ধ, তখন আমি আলি রা.-এর সঙ্গে ইদের জামাতে উপস্থিত হয়েছি। তিনি (মানুষকে নিয়ে) ইদের সালাত আদায় করেছেন। তারপর ফিরে খুতবা প্রদান করেছেন। [মুশকিলুল আসার : ৪৫০; মুয়াত্তা মালিক : ৪৩০]
এর ভিত্তিতেই ইমাম তহাবি রহ. বলেন :
وذكر عن محمد أن أهل مصر لو مات واليهم جاز أن يقدموا رجلا يصلي بهم الجمعة حتى يقدم عليهم وال.
মুহাম্মাদ রহ. থেকে বর্ণিত। কোনো শহরবাসীর প্রশাসক মারা গেলে তাদের জন্য বৈধ, তারা একজন ব্যক্তিকে সামনে অগ্রসর করে দেবে, যিনি তাদের নিয়ে জুমআর সালাত আদায় করবেন। যতদিন না (নতুন) প্রশাসকের আগমন ঘটে, ততদিন এভাবেই চলবে। [মুখতাসারু ইখতিলাফিল উলামা : ১/৩৪৫]
ফাতওয়া শামিতে এসেছে :
ولذا لو مات الوالي أو لم يحضر لفتنة ولم يوجد أحد ممن له حق إقامة الجمعة نصب العامة لهم خطيبا للضرورة كما سيأتي مع أنه لا أمير ولا قاضي ثمة أصلا وبهذا ظهر جهل من يقول لا تصح الجمعة في أيام الفتنة مع أنها تصح في البلاد التي استولى عليها الكفار كما سنذكره فتأمل (رد المحتار: 3/6)
‘এ কারণেই যদি প্রশাসক মৃত্যুবরণ করেন অথবা ফিতনার কারণে উপস্থিত হতে না পারেন এবং এমন কাউকেও না পাওয়া যায়, যার জুমআ কায়েমের অধিকার রয়েছে, তাহলে জরুরতের কারণে সাধারণ মানুষ নিজেদের জন্য একজন খতিব নির্ধারণ করে নেবে, যেমনটি সামনে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে। অথচ এখানে আমির কিংবা কাজি কেউ-ই নেই। আমাদের এ বক্তব্য থেকে ওই ব্যক্তির অজ্ঞতা স্পষ্ট হয়ে গেছে যারা বলে, ফেতনার দিনগুলোতে জুমআ সহিহ হবে না। অথচ ওই সমস্ত শহরেও জুমআ সহিহ, যেগুলো কাফেররা দখল করে নিয়েছে, যেমনটি আমরা সামনে উল্লেখ করব। [রাদ্দুল মুহতার : ৩/৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]
فلو الولاة كفارا يجوز للمسلمين إقامة الجمعة اهـ. -رد المحتار: 3/14
আর যদি প্রশাসক কাফের হয়, তাহলেও মুসলমানদের জন্য জুমআ কায়েম করা বৈধ। [রাদ্দুল মুহতার : ৩/১৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]
এর ভিত্তিতেই আকাবিরগণ হিন্দুস্তান দারুল হারব হওয়া সত্ত্বেও তাতে জুমআ ফরজ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। কিফায়াতুল মুফতি, ফাতওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ, মাহমুদিয়্যাহ প্রভৃতি দ্রষ্টব্য। যেমন, কিফায়াতুল মুফতি গ্রন্থে মুফতিয়ে আজম কিফায়াতুল্লাহ রহ.-এর ফাতওয়া বিবৃত হয়েছে :
هندوستان ميں جمعه فرض هے اور امام يعني سلطان اور مصر كي وه تعريف جو نفاذ حدود احكام شرعيه پر مشتمل هے خود فقهاۓ حنفيه كي تصريح سے متروك هو چكي هے بلاد عليها ولاة كفار يجوز للمسلمين إقامة الجمع والأعياد فيها (رد المحتار)
হিন্দুস্তানে জুমআ ফরজ। ইমাম তথা সুলতান এবং শহরের সংজ্ঞা, যাতে ইসলামি দণ্ডবিধি ও শরয়ি বিধিবিধান বাস্তবায়নের কথা রয়েছে, হানাফি ফকিহগণের সুস্পষ্ট বক্তব্যের ভিত্তিতেই তা পরিত্যাজ্য হয়ে গেছে।
স্মর্তব্য যে, জুমআর সালাত আদায় বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য বা অপরিহার্য হওয়ার জন্য ফিকহের নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থে অঞ্চল ‘দারুল ইসলাম’ হতে হবে, এরূপ শর্ত আরোপ করা হয়নি। শুধু হানাফি ফিকহে ইমাম বা তার প্রতিনিধি উপস্থিত থাকার শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা যে, এটিও সত্তাগতভাবে অপরিহার্য কোনো শর্ত নয়; বরং মাসলাহাত (কল্যাণ বিবেচনা)-এর ভিত্তিতে আরোপিত শর্ত মাত্র। যেহেতু বর্তমান সময়ে এসব অঞ্চলে এই শর্তটি বিবেচ্য থাকছে না, তাই জুমআর বিধান মৌলিকভাবে যা ছিল, তা-ই থাকবে। অঞ্চলভেদে তথা দারুল ইসলাম না হয়ে দারুল কুফর হওয়ার কারণে এই বিধানে কোনো পরিবর্তন আসবে না। সুতরাং চারও মাযহাবের আলোকেই এসব অঞ্চলের মুসলিমদের ওপর জুমআর সালাত আদায় করা ফরজ।
mashalllah