বিয়ের বিধান
অধিকাংশ মানুষ ইসলামকে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুগামী করে বুঝে নিয়েছে এভাবে যে, ‘এক বিয়ে সুন্নত, একাধিক বিয়ে বৈধ’। অথচ এর কোনোই ভিত্তি নেই। যেসব হাদিসে বিয়েকে সুন্নত বলা হয়েছে, সেগুলোতে কোনো সংখ্যাই নির্ধারণ করা হয়নি। বলা হয়েছে, বিয়ে সুন্নত। কয় বিয়ে? এক না একাধিক? কিছুই বলা হয়নি। তার মানে বিষয়টা ব্যাপক। প্রথম বিয়েও যেমনিভাবে সুন্নত, দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ বিয়েও একইভাবে সুন্নত। হ্যাঁ, শর্ত হলো ইনসাফ রক্ষা করা।
এই ইনসাফ শুধু একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রেই শর্ত নয়; এক বিয়ের ক্ষেত্রেও শর্ত। এ জন্যই তো আল্লাহ বলছেন, ইনসাফ করতে পারবে না এই আশঙ্কা করলে একজনকে বিয়ে করো বা দাসীকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো। তার মানে যেই ব্যক্তি কোনো স্ত্রীর প্রতি ইনসাফ করতে পারবে না বলে আশঙ্কা করে, তার বিয়ে না করে দাসী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তো যারা শুধু এক বিয়েকে সুন্নত বলে প্রচার করে, তারা এই প্রসঙ্গটি কেন এড়িয়ে যায়? যদি বলা হয়, এই যুগে দাসী নেই। তাহলে এর জবাব হলো, যুদ্ধবন্দি কাফিররাই তো দাসী। দাসী পাওয়ার পথ বন্ধ করে রাখলে দাসী আসবে কোত্থেকে? বিয়ে করতে চাইলে যেমন অনেক ধাপ পাড়ি দিতে হয়, দাসী পেতে চাইলেও কিছু কষ্ট তো করতেই হবে।
আল্লাহ বলেছেন, ইনসাফ করতে পারবে না এই আশঙ্কা করলে এক বিয়ে করো বা দাসী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো। আশঙ্কা করা আর অনুমান বা ধারণা করা এক কথা নয়। আশঙ্কার পেছনে নিশ্চিত কোনো যুক্তি থাকে। আপনি ইনসাফ করতে পারবেন না কেন? আপনার সমস্যা কোথায়? এখানে ইনসাফ মানে তো সমহারে যৌনমিলন নয়। ইনসাফ মানে তো অন্তরের ভালোবাসা একই সমান হওয়া নয়। কারণ, এগুলো রাসুল আ. থেকেই প্রমাণিত নয়। তিনি আয়িশা রা.-কে পরে বিয়ে করলেও সর্বাধিক ভালোবাসতেন। ইনসাফ মানে যদি হয় সতিনদের মধ্যে মনোমালিন্য না হওয়া, তাহলে কথা হলো, রাসুলুল্লাহ সা.-এর পবিত্র স্ত্রীগণের পরস্পরের মধ্যেও মনোমালিন্যের ঘটনা অনেক ঘটেছে। ইনসাফ মানে হলো রাত্রিযাপন ও ভরণপোষণসহ অন্যান্য হক প্রদানে সমতা রক্ষা করা। যারা জালিম নয়, তারা সদিচ্ছা করলে এটা কোনো ব্যাপারই নয়। ইনসাফ মানে যদি সবক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা হয়, তাহলে এই আয়াতের অর্থ কী হবে, ‘তোমরা কিছুতেই নারীদের মধ্যে সমতা করতে পারবে না, যদিও আগ্রহী হয়ে থাকো। সুতরাং কোনো একজনের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না যে, অন্যদেরকে ঝুলন্ত অবস্থায় ফেলে রাখবে।’
বিয়ের বিধানটি স্বাভাবিক অবস্থায় সুন্নাহ। কথাটি ব্যাপক অর্থে। এটাকে এক বা একাধিক কোনোটির সঙ্গে সীমিত করার সুযোগ নেই। বিয়ে কখনো ফরজ বা ওয়াজিবও হয়ে যায়। কারও জন্য হারাম বা মাকরুহও হয়ে যায়। যার দৈহিক মিলনের কোনো সক্ষমতাই নেই, তার জন্য স্বাভাবিকভাবে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। যার এক বিয়ের দ্বারা তাকওয়া রক্ষিত হচ্ছে না। সে এখন পরকীয়ায় লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে অথবা পতিতালয় বা পর্নোগ্রাফির জগতে হারিয়ে যাওয়ার ভয় করছে, তার জন্য দাসীর ব্যবস্থা করা বা একাধিক বিয়ে করা জরুরি। মূল হলো তাকওয়া। দুনিয়ার মানুষের কথার দিকে তাকিয়ে তাকওয়া নষ্ট করা জাহিলিয়্যাত। কেমন যেন সে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ জান্নাত প্রস্তুত করেছেন তাকওয়াবানদের জন্য; যারা অন্যদের কথা শুনে নিজের শরিয়াহকে কাস্টমাইজ করে নেয়, তাদের জন্য নয়।
এক বিয়ের বিষয়টি যেমন স্বাভাবিক, একাধিক বিয়ের বিষয়টিও স্বাভাবিক। এক বিয়েও যেমন সুন্নাহ, একাধিক বিয়েও তেমনি সুন্নাহ। এটা হলো সাধারণ বিবেচনা। কখনো এটা ফরজ-ওয়াজিব বা হারাম-মাকরুহও হতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন বিবেচনায় এক বা একাধিক বিয়ের বিধানে পার্থক্য আসতে পারে। যেমন, কোনো নারীর চরিত্র পবিত্র রাখার জন্য বা কারও দায়িত্ব গ্রহণ করে তার জীবন যাপনে সহযোগিতা করার জন্য কিংবা অধিক সন্তান জন্ম দান করার জন্য তাকে মাসনা-সুলাসা করে ঘরে তুললে এর জন্য আলাদা প্রতিদান পাওয়া যাবে। যার এক বিয়েতে যথেষ্ট হচ্ছে না, তার জন্য প্রথমার মুখের দিকে তাকিয়ে একাধিক বিয়ে থেকে বিরত থেকে গোপনে গোনাহ করা কোনোই বুজুর্গির পরিচায়ক নয়। কেউ এমন ফাতওয়া নিয়ে হাজির হলে সে এখনো ফিকহের ক-খ’ই বোঝেনি বলে প্রতীয়মান হবে। হ্যাঁ, কারও যদি বিয়েরই প্রয়োজন না থাকে, তার কথা তো আলাদা। ইবনু তাইমিয়া ও নববি থেকে শুরু করে কত মনীষী তো বিয়েই করেননি। একইভাবে কেউ যদি একজনের চাহিদা পূরণ করতেই সক্ষম না হয়, তার মুখে একাধিক বিয়ের কথা তো হাস্যকর বৈ কিছু নয়। এককথায়, পুরো ব্যাপারটা বিবেক ও প্রকৃতি দ্বারাই অনুভব করা সম্ভব। বাঙালি অযথাই লেবুকে বেশি কচলে তিতা বানিয়ে ফেলে।
বিয়ের উদ্দেশ্য
বিয়ের উদ্দেশ্য কী হবে? বিয়ের অনেক উদ্দেশ্যই হতে পারে। সহিহ বুখারির প্রথম হাদিসের দ্বিতীয় অংশ সামনে রাখলেই বিষয়টা বোঝা যাবে। ‘ব্যক্তির জন্য রয়েছে, যা সে নিয়ত করেছে’। এখানে ‘যা’ শব্দটা ব্যাপক। এ থেকে মুহাদ্দিসগণ বলেন, এক আমলে একাধিক নিয়ত থাকলে ব্যক্তি সবগুলোরই প্রতিদান পেয়ে যাবে। দুজন ব্যক্তি একই আমল করল; কিন্তু একজনের নিয়ত হচ্ছে একটি, আরেকজনের নিয়ত হচ্ছে একাধিক। তাহলে দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রতিদানের মাত্রা বেড়ে গেল। এখান থেকে বুজুর্গরা বলেন, ঘরে জানালা রাখবে শুধু বাতাস খাওয়ার নিয়তে নয়; বরং এর পাশাপাশি আজান শোনার নিয়তও করবে। তাহলে তোমার বাতাস খাওয়াও হয়ে যাবে; নিয়তের বরকতে অতিরিক্ত সওয়াবও পেয়ে যাবে।
এক জি হা দের পেছনেও কত নিয়ত কার্যকর থাকে দেখুন। ইসলাম বিজয়ী করা, শরিয়াহ বাস্তবায়ন করা, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করা, কুফফারের হাত থেকে মুসলিমদের ভূমি উদ্ধার করা, শহিদানের খুনের বদলা নেওয়া, মাজলুম মুসলমানদেরকে উদ্ধার করা, কাফিরদের ক্রোধ ও ক্ষোভ জাগ্রত করা, কুফরের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া, মুসলিম নারীদের ইজ্জত রক্ষা করা, বন্দি মুসলিমদের উদ্ধার করা প্রভৃতি। একইভাবে বিয়েও একটি মহান ইবাদত। যদিও খুব কম মানুষই এটাকে ইবাদত ভেবে সম্পন্ন করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এটি একটি ইবাদত এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এক নবির সুন্নাহই নয়; বরং প্রায় সকল নবির সুন্নাহ।
বিয়ের মূল নিয়ত কী হবে? মূল নিয়ত তা-ই হবে, যে জন্য আল্লাহ বিয়ের বিধান প্রদান করেছেন। আর তা হচ্ছে চারিত্রিক পরিশুদ্ধি ও তাকওয়ার সুরক্ষা। বলা বাহুল্য, এ দুটো ফরজ। এর মাধ্যম হিসেবে বিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় সুন্নাতে মুয়াক্কাদা; ক্ষেত্রবিশেষ ফরজ-ওয়াজিব বা হারাম-মাকরুহও হয়ে থাকে। সুতরাং বিয়েতে এক নিয়ত হতে পারে, চারিত্রিক পরিশুদ্ধি ও তাকওয়ার সুরক্ষা। আরেক নিয়ত হতে পারে, সুন্নাহ পালন। এর পাশাপাশি আরও নিয়ত হতে পারে, অধিক সন্তান জন্মদান; যা আলাদা সুন্নাহ। একজন নারীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে তার জীবন যাপন সহজ করা। তার সন্তানদের মাথার ওপর ছায়া হওয়া। তার দুঃখ দূর করা।
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বিয়েগুলোতেও একাধিক নিয়তের বিষয়টি অনুমান করা যায়। যায়নাবের সঙ্গে তার বিয়ের দ্বারা একটি কুসংস্কার দূর হয়েছে। আয়িশার সঙ্গে বিয়ের দ্বারা ইলম সংরক্ষিত হয়েছে। কিছু বিয়ের দ্বারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে; পরবর্তীতে এর বরকতে যাদের হিদায়াতের দুয়ার খুলেছে। তার কোনো বিয়ের দ্বারা ইসলামি রাজনীতি শক্তিশালী ও সুসংহত হয়েছে। এভাবে তার বিয়েগুলো প্রভূত কল্যাণ ও উপকার বয়ে এনেছে। আলিমগণ তাঁর একাধিক বিয়ের হিকমত হিসেবে এসব বিষয় উল্লেখ করেছেন। হতে পারে, এগুলো তাঁর নিয়তে ছিল।
আপনি একজন যেনতেন নারীকে বিয়ে করে তার সঙ্গে সংসার করা আর উত্তম নিয়তে একজন শহিদের স্ত্রীর ‘সাহারা’ হওয়া নিশ্চয়ই এক কথা নয়। রাসুলুল্লাহ ﷺ শহিদের স্ত্রী বিয়ে করেছেন। উম্মু সালামা রা. তার স্বামী আবু সালামার মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে নিজের বধূ করে ঘরে তুলে তার মন জয় করে নিয়েছিলেন। সুহৃদ ও নিকটজনের সঙ্গেও বৈবাহিক বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। আবু বকর ও উমর রা.-এর দুই মেয়েকে বিয়ে করেছেন এবং উসমান ও আলি রা.-এর কাছে তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। উসমান রা.-এর সংসারে তার দু-মেয়ে পরলোকগমন করলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন, আরও মেয়ে থাকলে তাদেরকেও তার সঙ্গে বিয়ে দিতেন। নিকটজনদের ভালোবাসার হক পুরোপুরি আদায় করেছেন এবং এই বৈবাহিক বন্ধনের দ্বারা সেই সম্পর্ককে আরও বেশি সুদৃঢ় করেছেন।
এই যুগে নিয়তের বিষয়টা গৌণ হয়ে যায়। অথচ মুমিনের শান হলো, যেকোনো কাজের শুরুতে নিয়ত যাচাই করে নেওয়া। নিয়তে কোনো গলতি থাকলে তা সহিহ করে নেওয়া। সম্ভব হলে এক আমলে একাধিক বিশুদ্ধ নিয়ত করা। বৈবাহিক বন্ধনের দ্বারা ইসলাহ ও সংশোধনের পথ খুলে যায়। ফুরফুরার একটি ধারার সংশোধনের পেছনে আমি যতটুকু জানি, প্রয়াত ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেবের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।
একটি অজ্ঞতা
ইসলামের শাশ্বত, অকাট্য ও আবশ্যিকভাবে সুবিদিত বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করুন। কারণ, মুসলিম সমাজে থেকে এসব বিধিবিধানের ব্যাপারে অজ্ঞতা গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ যদি এ ধরনের মাত্র একটা বিষয়ও অস্বীকার করে, তবে সে কাফির হয়ে যায়। মেসওয়াক করা ফরজ নয়; কিন্তু মেসওয়াকের বিধান অস্বীকার করা কুফর। দাসদাসীর প্রথা বর্তমান সময়ে নেই; কিন্তু তা অস্বীকার কুফর। জিন অদৃশ্য, উপরন্তু জিন সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে জানার দ্বারা আমাদের ইহজগৎ বা পরজগতের সাফল্যের সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে কোনো আমলেরও সংযোগ নেই। কিন্তু তা অস্বীকার করা কুফর। একাধিক বিয়ে এসব দেশে করে কয়জন মানুষ! কিন্তু অধিকাংশ নারী ইসলামের এ বিধানের ক্ষেত্রেও কুফরে আক্রান্ত। আল্লাহ তাআলার একটি বিধানের ব্যাপারে তারা অন্তরে সংকীর্ণতা অনুভব করে। কেউ কেউ তো রীতিমতো বিরক্ত; পারে না শুধু সেই বিরক্তি মুখে উচ্চারণ করতে। ফেসবুকে বিভিন্ন দীনি গ্রুপের লেখাজোখায় এ মানসিকতা বেশ ভালোরকম চোখে পড়ে।
আল্লাহ যার জন্য যে বিধান দিয়েছেন, সেটা মেনে নেওয়াই তার বন্দেগি। কেউ বলে, তাকওয়াই একমাত্র সমাধান; একাধিক বিয়ে নয়। এর দ্বারা তারা শরিয়াহর একটি বিধানের ভিন্ন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। তো কথা হলো, তাকওয়াই যখন সব কিছু, তাহলে এক বিয়েরই বা কী দরকার! আরে পাগল, কুরআনে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে দুর্বলরূপে। তাই এক্ষেত্রে তাদের প্রাকৃতিক দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে তাকওয়া রক্ষা করার মাধ্যম হিসেবেই আল্লাহ এ বিধান দিয়েছেন। আল্লাহর সুন্নাহ থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাকওয়া রক্ষা করতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই তা আর সম্ভব হয় না। উপরন্তু একই কথা তো জি হা দে র ব্যাপারেও বলা যায়। সবরই একমাত্র সমাধান; লড়াই-জঙ্গ নয়। মৃত্যু তো সুনির্ধারিত। যখন আসার তখনই আসবে, তাই ওসব লড়াইয়ে সময় না দিয়ে ইবাদত-বন্দেগি করো। এটাই ঢের উত্তম।
অধিকাংশ নারী জাহান্নামি। কেন? হাদিসে কিছু কারণ তুলে ধরা হয়েছে। তারা অভিশাপ বেশি দেয়, স্বামীর অকৃতজ্ঞতা করে। এছাড়াও এই যুগে অধিকাংশ নারীর আকিদাই ঠিক থাকে না। রীতিমতো মিসকিন হয়ে থাকে এক্ষেত্রে। তারা নিজেদের প্রবৃত্তি দ্বারা শরিয়াহর ব্যাখ্যা করে। দীনি ইলমের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার প্রতি তাদের অধিকাংশের আগ্রহ শূন্যের কোঠায়। একজন সেক্যুলার নারী ও কথিত দীনদার নারীর মধ্যে পার্থক্য পাওয়া যায় শুধু ব্যক্তিজীবনকেন্দ্রিক বিশেষ কিছু প্রতীকী ইবাদত ও আরাধনায়। এছাড়া ভাবনাচিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতার ক্ষেত্রে সবিশেষ পার্থক্য নেই। আর পার্থক্য আসবেই বা কীভাবে! ইলম তো নেই। আছে শুধু নফস দ্বারা শরিয়াহর মনগড়া ব্যাখ্যা করার সুনিপুণ যোগ্যতা।
কারও কাছে যদি তালাককে অযৌক্তিক বিধান মনে হয়, দাসীর সঙ্গে যৌনমিলনকে অসার মনে হয়, একাধিক বিয়েকে মনে হয় নারী জাতির ওপর জুলুম, তবে সে নির্দ্বিধ কাফির। রাসুলুল্লাহ সা. নারীদেরকে সাধারণভাবে সবচে ক্ষতিকর ফিতনা বলেছেন, দীনদারি ও বিবেকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন, শয়তানের রশি বলেছেন, শয়তানের রূপে যাতায়াতকারী বলেছেন ইত্যাদি। কুরআনেও একদিকে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল। অন্যত্র ইউসুফ আ.-এর জবানিতে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই তোমাদের (নারীদের) চক্রান্ত শক্তিশালী। এসব আয়াত ও হাদিসের তাৎপর্য ও প্রকৃত অর্থ নিয়ে অনুধ্যান না করে কোনো নারী যদি তাঁর উক্তির ব্যাপারেই বিরক্তিকর মনোভাব লালন করে, তবে তার ইমান নিয়েও নতুন করে ভাবা উচিত।
পুরুষের জন্য জি হা দের মতো কঠোর বিধান দিয়েছেন। দিয়েছেন রাজনীতি। দিয়েছেন আরও কত কী। এগুলো মেনে নেওয়াই তাদের বন্দেগি। নারীদের জন্য দিয়েছেন সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব, সতিনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার দায়িত্ব, ঘরোয়া কাজকারবার সম্পন্ন করার দায়িত্ব, পুরুষদেরকে সাহস ও উদ্যম জোগানোর দায়িত্ব। এগুলোই তাদের বন্দেগি। কেউ যদি বলে, নারী কি শুধু সন্তান জন্মদানের মেশিন? তাকে বলা হবে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমরা এমন নারীকে বিয়ে করো, যে অনেক ভালোবাসতে জানে এবং অধিক সন্তান জন্মদান করার সক্ষমতা রাখে। কারণ, তোমাদের দ্বারা উম্মাহর আধিক্য দেখে কিয়ামতের দিন আমি গর্ব করব।’ যদি বলা হয়, নারীর দায়িত্ব কি শুধু ঘরোয়া কাজ করা? তাকে বলা হবে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারী উম্মুল মুমিনিনগণও একই কাজ করে গেছেন। এভাবেই প্রতিটা ক্ষেত্রে শরিয়াহর সামনে নির্দ্বিধ আত্মসমর্পণের নামই হচ্ছে ইসলাম। আর দুদিনের দুনিয়ার তুচ্ছ চাহিদা পূরণ করার জন্য শরিয়াহর বিধানের ব্যাপারে ভ্রূকুটি, বিতৃষ্ণা ও বিরক্তিবোধই হচ্ছে কুফর।
একাধিক বিয়ের প্রসঙ্গ আসলেই শুধু ইনসাফের ভয় দেখিয়ে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়। প্রথম কথা হলো, ইনসাফ কি শুধু একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রেই জরুরি? একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে ইনসাফ জরুরি নয়? একাধিক ছাত্রের ক্ষেত্রে ইনসাফ জরুরি নয়? সেসব ক্ষেত্রে কি ইনসাফের ভয় দেখিয়ে একজনের অধিক গ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়?
দ্বিতীয় কথা হলো, খুশু-খুজু ও ইখলাস না থাকলে তো নামাজও কবুল হয় না। এখন নামাজ আদায়ে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে খুশু-খুজু ও ইখলাস অর্জনের পরামর্শ দেওয়া হয় নাকি এগুলোর ভয় দেখিয়ে তাকে নামাজ আদায়ে নিরুৎসাহিত করা হয়? যার ভেতরে তাকওয়া আছে, সে অবশ্যই ইনসাফ করবে। কারণ, এটা বান্দার হক। ইনসাফ করতে পারছে কি না, এটা তো একাধিক বিয়ে করেই দেখতে হবে। শুধু তত্ত্বকথা আওড়ালে তো নামাজের খুশুকেও অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। কেউ বলে উঠতে পারে, নামাজ তো ফরজ আর একাধিক বিয়ে তো ফরজ নয়। এর জবাব হলো, নামাজের শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। অধিকাংশ নামাজ ফরজ নয়। সুন্নত ও নফল নামাজেও এসব গুণ থাকা অপরিহার্য। অপরদিকে বিয়ে সর্বদা সুন্নতই থাকে না; বরং ক্ষেত্রবিশেষ তা ওয়াজিব ও ফরজও হয়ে যায়। তদুপরি উপমার ক্ষেত্রে সব দৃষ্টিকোণ থেকে সাদৃশ্য থাকা জরুরি নয়।
তৃতীয় কথা হলো, ইনসাফ দ্বারা কী উদ্দেশ্য? প্রথমার সঙ্গে যৌনমিলন করলে বাকিদের সঙ্গেও যৌনমিলন করতে হবে? এমনটা ভেবেই অনেক মানুষ ভয় পেয়ে যায়। অথচ ইনসাফের ক্ষেত্রে সমহারে যৌনমিলনের কোনো কথা নেই। এটা ব্যক্তির আগ্রহ ও উদ্যমের ওপর নির্ভর করবে। হ্যাঁ, রাত্রিযাপনে সমতা রক্ষা করতে হয়। তবে রাত্রিযাপন ও যৌনমিলন সমার্থক নয়। এছাড়া ভরণপোষণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করবে। এটাকে অভ্যাসে পরিণত করলে আহামরি কোনো ব্যাপার নয়। যাদের ১০/১২ টা সন্তান, পড়ালেখার সুবাদে একেকজন থাকে একেক এলাকায়, তাদের মধ্যে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করে কীভাবে?
আসসালামু আলাইকুম
আমি আপনার অনুদিত ও মৌলিক বেশ কয়েকটি বই পড়েছি। ইবন তাইমিয়া (রঃ)র মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া বইটির অনুবাদ করার জন্য আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
جزاك الله خيرا