মুসলিম বিশ্ব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অবস্থা দেখলে মনে হয়, মুসলমানরা নিজেদের জন্য এটাকেই চূড়ান্ত করে নিয়েছে যে, আগামীতে তারা আর কখনোই পৃথিবী এবং পৃথিবীবাসীর নেতৃত্বভার গ্রহণ করবে না; পৃথিবীতে মানবসৃষ্টির সূচনা থেকে এইতো কিছুকাল আগ পর্যন্ত যা তাদের কর্তৃত্বেই ছিল।
তারা নিজেদের সব দায়দায়িত্ব সেসব লোকের কাঁধে অর্পণ করে দিয়েছে, যারা তাদের হাকিকি মাবুদ আল্লাহ তাআলার দুশমন, তাঁর রাসুলের দুশমন, গোটা সৃষ্টিজগতের দুশমন, এমনকি তাদের নিজেদের জান ও মালেরও দুশমন। মুসলমানরা নিজেদের দায়দায়িত্ব নিজেরা পরিচালনা করার হিম্মত একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। যার ফলে রবের তাওহিদ প্রতিষ্ঠা এবং তাঁর প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে নিজেদের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব করার দায়িত্ব অন্যদের কাঁধে তুলে দিয়েছে।
অবস্থা এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, তাওহিদের কালিমা স্বীকার করতে হলেও কোনো রাম বা মিস্টারের দপ্তর থেকে তা পাশ করিয়ে নিতে হচ্ছে। নিজেদের দেশ বা নিজেদের আদালত কোন আইন ও বিধানের আলোকে পরিচালিত হবে, তা কুরআন, হাদিস ও ইসলামি ফিকহের আলোকে নির্ধারণ না করে সরাসরি বিধর্মীদের থেকে বা তাদের দেশীয় এজেন্টদের থেকে শিখে নিতে হচ্ছে। একজন মুসলমান তার ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবন কীভাবে পরিচালনা করবে, এ বিষয়টিও ইসলামের কোনো দুশমনের থেকে জেনে নিতে হচ্ছে। স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে নিজের ওপর চিরতরে হারাম করার পরও সেই হারাম স্ত্রী থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারবে নাকি তার সাথেই বাকি জীবন সংসার করতে হবে, এ বিষয়টিও সেক্যুলার আদালত থেকে ফায়সালা করে নিতে হচ্ছে। একটা ছেলে একটা মেয়ের সঙ্গে ‘কাছে আসার গল্প’ রচনা করার জন্য বিয়ের প্রয়োজন আছে নাকি নেই, এর সিদ্ধান্তও আল্লাহ ও পরকাল অস্বীকারকারী ব্যক্তিবর্গের থেকে নিতে হচ্ছে।
বর্তমান পৃথিবীতে এ কথাগুলো কোনো কাল্পনিক বা সম্ভাব্য বিষয় নয়। কোনো হতাশ বা অসহায় ব্যক্তির দুঃস্বপ্নও নয়। বরং এ সবই দৈনন্দিন বাস্তবতা, ধ্রুব সত্য, প্রত্যক্ষ ও পরম নিত্যতা। তবে এ অবস্থাগুলো দেখে একদিকে কিছু মানুষ বেদনা ও দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারে না। তারা যেকোনো মূল্যে এই নব্য জাহিলিয়াতের যবনিকাপাত চায়। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে হলেও সোনালি সুদিন ফিরিয়ে আনতে চায়। অপরদিকে কিছু মানুষের মধ্যে কোনো ভাবান্তরই নেই। তাদের সুখ ও বিনোদনের জীবনের মধ্যে এ সবকিছুর কোনো ছোঁয়াই লাগেনি। মজলুমের আহাজরি তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। ইসলামের বিজয়ের স্বপ্ন তাদের দু-চোখে আলো ছড়ায় না। আরেকটা শ্রেণি আছে এ দুইয়ের মাঝামাঝি। যাদের সংখ্যাটাই সম্ভবত সবচে বেশি।
অবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন ফরজ বিধানগুলোকেও সংশয় ও সন্দেহের তালিকায় ফেলা হচ্ছে। নিত্যদিনের দীনি অপরিহার্য বিষয়গুলোকে অনর্থক মনে করা হচ্ছে। রাত-দিনের আবশ্যক কাজগুলোকে নিষ্ফল ও ফায়দাহীন বলে অভিহিত করা হচ্ছে। কুরআন, হাদিস ও ইসলামি ফিকহের তথ্যসূত্রগুলোকে পর্যন্ত অজ্ঞতা বা ভাসাভাসা পর্যবেক্ষণ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ইলমি সমালোচনা ও পর্যালোচনাকে একবাক্যে বেয়াদবি ও বেত্তমিজি বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
এসব অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনেক লেখক ও চিন্তক বর্তমান সময়ে একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়েও নিজেদের গবেষণা ও মতামত তুলে ধরতে দ্বিধাবোধ করে। তারা দলিল-প্রমাণের আলোকেও স্বাধীনভাবে নিজেদের চিন্তা ও ভাবনা উপস্থাপন করার সত্সাহস করে উঠতে পারে না, যতক্ষণ না তাদের চিন্তা ও ভাবনা সমাজে স্বীকৃত ও প্রচলিত ধ্যানধারণার অনুকূল হয়ে ওঠে।
ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ইতিহাসের আলোকে আমাদের দেশ, নাকি আমাদের শত্রুদের দেশ, নাকি বন্ধু ও শত্রু উভয়ের সম্মিলিত দেশ? আমার ধারণা, এ প্রশ্নটা বন্ধু ও শত্রু যে-কারও কাছেই কিম্ভূতকিমাকার লাগবে। এমনকি জাত-পাত ভুলে নির্বিশেষে সকলে প্রশ্নকারীর দিকে বাঁকা চোখে ও সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে। যদি বলা হয়, বর্তমান সময়ে এই প্রশ্নটি পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত হবে, তবে এটা মোটেও অত্যুক্তি হবে না।
আমরা যে সময়টাতে ‘আমাদের’ বলে মুসলমানদের এবং ‘শত্রুদের’ বলে অমুসলিমদের বোঝাচ্ছি, সে সময়কার পৃথিবীতে এ ধরনের ধর্মভিত্তিক বিভাজন অনুমোদিত নয়; বরং এটা সাম্প্রদায়িকতা, অনৈক্য ও উগ্রতার শামিল।
ইতিহাস সাক্ষী, সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে মুসলমান শাসকরা। তাদের শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল ইসলামি আইন। সুতরাং কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামি ফিকহের দৃষ্টিতে এই অঞ্চল পুরোটাই দারুল ইসলাম হিসেবে স্বীকৃত ও পরিগণিত ছিল। তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো জো নেই, এই উপমহাদেশের ইতিহাসের অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। যদি বলা হয়, এর ইতিহাসের কোনো শতাব্দীর সাথে পূর্বাপর শতাব্দীর মিল নেই, তবে তা অবাস্তব হবে না। একদিকে যেমন এর ভৌগোলিক সীমারেখাও বিভিন্নরকম ছিল, আরেকদিকে এখানকার শাসকবর্গও ইমান ও আকিদার বিচারে বিভিন্ন ধরনের এসেছিল। এমনকি এখানকার ইতিহাসে মুসলমান নাম ধারণকারী এমন কিছু শাসকও বিগত হয়েছে, শরিয়ার দৃষ্টিতে যাদেরকে মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করার দূরতম সুযোগও নেই। আবার কিছু শাসক এমনও ছিল, তাদেরকে শরিয়ার দৃষ্টিতে মুসলমান বলা গেলেও না তারা নিজেরা সহিহ আকিদাধারী ছিল আর না সহিহ আকিদা বিষয়ে তাদের ন্যূনতম জানাশোনা ছিল। এসব কারণে এখানকার ইসলামি ইতিহাসের আলোচনা খানিকটা জটিলই বটে।
তবে ইতিহাসের যে অংশের ব্যাপারে কোনো ভিন্নমত বা ধোঁয়াশা নেই, সে অংশের শরয়ি বিবেচনাও আমাদের সামনে উঠে আসলে বর্তমান সময়ের কিছু মৌলিক সমস্যার সমাধান করা আমাদের জন্য অনেকটা সহজ হয়ে আসবে। এমনকি যেসব বিষয়ে সাহসিকতার সাথে কথা বলতে আমাদের ভেতরেও প্রচণ্ড দ্বিধাবোধ হয়, সেসব বিষয়ে আমাদের নিজেদের ভয় ও হীনমন্যতাও পুরোপুরি দূর হবে।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে সকল মহান শাসহ ইসলামি আইন ও শরয়ি বিধিবিধানের আলোকে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের নাম নিম্নরূপ,
- নাসিরুদ্দীন মাহমুদ রাহ. (৬৬৪ হিজরি)
- গিয়াসুদ্দীন বলবন রাহ. (৬৮৬ হিজরি)
- আলাউদ্দীন খিলজি রাহ. (৭১৬ হিজরি)
- শামসুদ্দীন ইলতুতমিশ রাহ. (৭৩৩ হিজরি)
- মুহাম্মাদ তুঘলক রাহ. (৭৫২ হিজরি)
- ফিরোজ শাহ রাহ. (৭৯৯ হিজরি)
- সেকান্দার বিন বাহলুল লুধি রাহ. (৯২৩ হিজরি)
- শের শাহ সুরি রাহ. (৯৫২ হিজরি)
- শাহ জাহান তৈমুরি রাহ. (১০৬৮ হিজরি)
- আওরঙ্গজেব আলমগীর রাহ. (১১১৮ হিজরি)
উল্লেখিত শাসকগণ ছাড়াও আরও অনেক সুলতান ও আমির বিগত হয়েছেন, যারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করেছেন এবং একটা পর্যায় পর্যন্ত সফলও হয়েছেন। এই ধারার সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন মোঘল সালতানাতের সর্বশেষ সুলতান বাহাদুর শাহ জফর। তার বিদায়ের দ্বারা ইসলামি হুকুমতের নামে যে সালতানাত বাকি ছিল, তার অন্তিম সমাপ্তি ঘটল।
যতদিন ভারতবর্ষে মুসলমান শাসকদের অধীনে ইসলামি শরিয়াহ প্রতিষ্ঠিত ছিল, ততদিন পর্যন্ত এই অঞ্চলকে দারুল হারব বলে আখ্যায়িত করার কোনো কারণ ছিল না। এমনকি এজাতীয় ফাতওয়া কেউ দিলে তা বৈধও হতো না। কিন্তু যখন অবস্থা বদলে গেল এবং শাসনব্যবস্থা মুসলমানদের হাত থেকে ছুটে অমুসলিমদের হাতে চলে গেল, তখন এই অঞ্চলের শরয়ি বিধান তুলে ধরা অপরিহার্য হয়ে দেখা দিলো। বিশেষভাবে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজুদ দৌলা এবং ১৭৯৯ সালে সুলতান ফতেহ আলি টিপু ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াইয়ে শাহাদাত বরণ করার পর এই অঞ্চলের মুসলমানদের নিকট আর এমন কোনো প্রতিরক্ষাশক্তি বাকি থাকল না, যা দ্বারা তারা ব্রিটিশদের মোকাবিলা করবেন কিংবা নিজেদের অধিভুক্ত এলাকাগুলোতে ইসলামি আইন ও ইসলামি শরিয়াহ বাস্তবায়ন করবেন।
দিল্লীতে তখনো মোঘল সালতানাতের শেষ প্রদীপ নিভু নিভু করে জ্বলছিল। কিন্তু সে সময় মোঘল সুলতান দ্বিতীয় শাহ আলমের হাতে স্রেফ দিল্লীর লাল কেল্লা আর রাজার পোশাক ও সাজগোজের আসবাবপত্র ছাড়া মুসলমান শাসক হিসেবে কোনো প্রতাপ বা ক্ষমতাই ছিল না। তখন ভারতবর্ষের ওপর না কেন্দ্রীয় হুকুমতের কোনো কন্ট্রোল ছিল আর না প্রাদেশিক হুকুমতের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল। ব্রিটিশ এবং অন্যান্য ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো এই সুযোগকে ভালোভাবে কাজে লাগাল। তারা পুরো স্বাধীনভাবে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিল। নীতিনির্ধারণ এবং আইনকানুন প্রণয়নের বাগডোরও এবার তাদের হাতে চলে আসল; সামরিক ক্ষমতা তো এর বহু আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
সে সময় সিরাজুল হিন্দ শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ. তার সেই ‘দারুল হারব’র ঐতিহাসিক ফাতওয়া দিলেন এবং এর দ্বারা সবার নিকট এই বার্তা পৌঁছে দিলেন, এখন তোমাদের ওপর এমন কিছু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, ইতিপূর্বে দারুল ইসলামের অধিবাসী থাকাকালে যা তোমাদের ওপর আবশ্যক ছিল না। শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রাহ.-এর সেই ফাতওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং কারণগুলো আমাদের জন্য লক্ষণীয়,
- ভারতবর্ষ থেকে ইসলামি আইনকানুন ও বিধিবিধান হারিয়ে গিয়েছিল।
- ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ শাসক মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ইসলামি আইন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম ছিল না।
- সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, আদালত এবং আইন প্রণয়নকারী এসেম্বলির ওপর কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামি ফিকহের কর্তৃত্ব নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।
- রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা ও পার্লামেন্ট অমুসলিম শক্তির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে পরিচালিত হতো। তাদের ফায়সালা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতো।
- মুসলমান ইবাদত, লেনদেন ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান ও দিকনির্দেশনা ততটুকুই মানতে পারত, অনৈসলামিক সরকার ও অনৈসলামিক আইন যতটুকু মানার অনুমতি তাদেরকে দিত।
- ব্রিটিশ সরকার নিজেদের অর্থায়নে মাদরাসা চালাত। সেখানে কুরআন-সুন্নাহও পড়ানো হতো। কিন্তু সেসব মাদরাসায় পঠিত তত্ত্বসমূহকে বাস্তবজীবনে ও জনসমাজে প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি ছিল না।
- সেই অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থার বাগডোর যাদের হাতে থাকত, পদাধিকার বলে তারাই মাদরাসাগুলোর প্রধান পরিচালক হতো। কিন্তু তারা ছিল সেসব ব্যক্তি, যারা কুরআন-সিম্মাজপ্র আইনকানুন ও বিধিবিধানকে অন্তর থেকে অপছন্দ করত।
এ হলো এমন ধ্রুব বাস্তবতা, বন্ধু বা শত্রু কারও পক্ষেই যা অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য অস্বীকার করার কোনো প্রয়োজনীয়তাও তাদের অন্তরে জাগেনি। কারণ, এসব অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। হঠাত্ উদ্ভূত হয়ে এত বেশি সূক্ষ্মভাবে সমাজের পরতে পরতে পৌঁছে গেছে এবং সর্বত্র জাল বিছিয়ে পুরো সমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে যে, অধিকাংশ মানুষ বুঝেই উঠতে পারেনি, কোথাকার জল কোথায় গড়িয়েছে।
কিন্তু ইসলামের সদা জাগ্রত অতন্দ্র প্রহরী যারা, তাদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কোনো ইসলামবিরোধী শক্তি বা শরিয়াহবিরোধী কার্যকলাপ সমাজে জাল বিস্তার করতে পারে না। শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ. সার্বিক অবস্থা দেখেই তার সেই ঐতিহাসিক ‘দারুল হারব’ ফাতওয়া দিয়েছিলেন। আর সেই ফাতওয়া পেয়ে আল্লাহর বান্দারা বসে থাকেনি। বরং একদল ঠিকই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ফাতওয়ার আলোকে যা করণীয় ছিল, প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে তারা সেই কর্তব্য পালন করতেই ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এই ঐতিহাসিক ফাতওয়া প্রদানের সময় দেশ ও সমাজের যে অবস্থা ছিল, দীর্ঘকাল (দুই শতাব্দীরও অধিক সময়) পেরিয়ে যাওয়ার পর আজও কিন্তু প্রেক্ষাপট ও অবস্থা একই রয়ে গেছে। মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। হ্যাঁ, সাইন্স ও টেকনোলজিতে পরিবর্তন এসেছে, উন্নয়ন ও উন্নতির বড় ধরনের ছোঁয়া লেগেছে; কিন্তু এগুলো তো সব পার্থিব বিবেচনা। আমরা তো কথা বলছি শরিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে; জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। দুইশ বছর আগের চিত্রের সাথে আমরা যদি বর্তমানের চিত্রকে মিলাই তাহলে দেখতে পাই,
- বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সংসদ, আদালত বা কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামি ফিকহের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নেই।
- উক্ত তিনও দেশের সকল আইন ও বিধান প্রণীত হয় সরকারপ্রধানদের সিদ্ধান্ত ও ফায়সালার ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে তারা মুসলমান নাকি অমুসলিম, তা দেখার কোনো নিয়ম নেই।
- ব্রিটিশরা যে আইনকানুন বাস্তবায়ন করে এই অঞ্চলকে দারুল ইসলাম থেকে দারুল হারবে পরিণত করেছিল, এতকাল পেরিয়ে যাওয়ার পরও ঠিক সেই আইনকানুনগুলো এই তিনও দেশে আজও সগর্বে দুর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে।
- উক্ত তিনও দেশের ওপর এমন সব ব্যক্তির শাসনক্ষমতা কার্যকর রয়েছে, যারা পারলৌকিক বিবেচনায় একমাত্র দীন ইসলামের অনুসরণ করার কোনো আবশ্যকতা বোধ করে না।
- উক্তি তিনও দেশের শাসনক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত রয়েছে তাদের আকিদা হলো, কোনো মুসলমান আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও ইসলামের বিধানের ওপর চলতে হলে অমুসলিমদের প্রণয়ন করা আইন ও বিধান থেকে এর অনুমোদন নিতে হবে। অন্যথায় তা রাষ্ট্রদ্রোহ ও সংবিধান লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।
- এসকল শাসকের আকিদা হলো, মুসলমানদের যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য ইসলামের নামে কুরআন-সুন্নাহর সূত্রে কোনো আইন প্রণয়ন করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ. তার সেই ঐতিহাসিক ‘দারুল হারব’ ফাতওয়া দেওয়ার পর ভারতবর্ষের ওপর দিয়ে তিন ধরনের যুগ অতিবাহিত হয়েছে।
ক. যে সময় ফাতওয়া প্রকাশিত হয়, সে সময় শাসক মুসলমান ছিল; কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ অমুসলিমদের হাতে ছিল। আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অমুসলিমদের তত্ত্বাবধান এবং অনৈসলামিক আইনের আলোকে পরিচালিত হতো। এই ধারা চলেছিল ১৮০০ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত।
খ. এর পরবর্তী ধাপে শাসনক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত ছিল, তারা অমুসলিম ছিল। এই ধারা চলেছে ১৮৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত।
গ. এই ধাপে এসে কিছু অংশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো মুসলমানরা আর কিছু অংশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো অমুসলিমরা। কিন্তু পুরো অংশের মূল নিয়ন্ত্রণ থাকল অমুসলিমদের হাতে। আদালত থেকে শুরু করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালিত হলো অনৈসলামিক আইনকানুনের অধীনে। এই ধারা ১৯৪৭ সাল থেকে আজও পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
এই তিন ধাপের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ,
- প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের সময় এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘হিন্দুস্তান’ আর এখন তা তিনটি দেশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে; যার একটির নাম বাংলাদেশ, একটির নাম ভারত এবং আরেকটির নাম পাকিস্তান।
- প্রথম ধাপের সময় শাসক মুসলমান ছিল। নামে হলেও দেশ মুসলমানদের হাতে ছিল; যদিও সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের ওপর অমুসলিমদেরই নিয়ন্ত্রণ ছিল। দ্বিতীয় ধাপের সময় শাসক অমুসলিম ছিল। আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহও তাদের হাতেই ছিল। আর তৃতীয় ধাপে এসে কিছু এলাকার শাসক নিজেদের অমুসলিম বলে পরিচয় দেয় আর কিছু এলাকার শাসক নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু উভয় শ্রেণির আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহেই অনৈসলামিক আইনকানুন ও বিধিবিধান চলে। এমনকি নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেক বা অমুসলিম, উভয় শ্রেণির আকিদা হলো, আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহে কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামি শরিয়াহ টেনে আনা সময়ের সবচে বড় অপরাধ।
- প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে অধিকাংশ আলিম ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অমুসলিমদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনৈসলামিক আইনকানুনের অধীনতার ওপর ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট ছিল। অপরদিকে তৃতীয় ধাপে এসে অধিকাংশজন তাগুতি শক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং অনৈসলামিক আইনকানুনের অধীনতার ব্যাপারে হয়তো সন্তুষ্টচিত্ত হয়ে গিয়েছে কিংবা ভয়াবহ রকমের নীরবতা গ্রহণ করে নিয়েছে।
- প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে অধিকাংশ মুসলমান এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে নিজেদের মুক্ত ও স্বাধীন করাকে শরয়ি জিম্মাদারি মনে করত। আর এখন অধিকাংশ মুসলমান মনে করে, অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থা এবং অনৈসলামিক আইনকানুন ও আদালতের অধীনে অবস্থান করাও এক ধরনের জীবনধারা। এরপর একদল আবার মনে করে, এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায়ই নেই। আরেকদল মনে করে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো আবশ্যকতা নেই।
- প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে অমুসলিমদের প্রতিনিধিদেরকে গভর্নর (রাজ্যের প্রশাসক) এবং ভাইসরয় (উপরাজ) বলা হতো। আর এখন তাদেরকে এম্বাসেডর (রাষ্ট্রদূত), এনভয় (রাষ্ট্রদূতের পরবর্তী পদমর্যাদার কূটনীতিক) এবং জাতিসংঘ প্রতিনিধি বলা হয়।
- প্রথম ধাপে অমুসলিমদের কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপ অবৈধ ছিল। এর কোনো আইনি বৈধতা ছিল না। তবে বৈধতা-অবৈধতার কোনো পরোয়া না করে তারা নিজেদের দুর্দণ্ড প্রতাপ ও অন্যায় হস্তক্ষেপ চালিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপে তো সবকিছু তাদের নিজেদের হাতেই ছিল। আর তৃতীয় ধাপে এসে তাদের কর্তৃত্বের আইনি বৈধতাও রয়েছে। তবে নিজেদের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আড়াল করার জন্য বিভিন্ন চেষ্টাই চালানো হয়ে থাকে, যা মোটামুটি সবাই-ই জানে। সবাই মিলেই বিষয়গুলো আড়াল করে রখে। সহজ ভাষায় যেটাকে আপনি ‘ওপেন সিক্রেট’ বলতে পারেন।
- প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে মনে করা হতো, মুসলমানদের জন্য অনৈসলামিক আইনকানুনের অধীনে জীবনযাপন করার কোনো অনুমতি নেই। তৃতীয় ধাপে এসে সাধারণভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই এ কথা প্রচার করা হয়, এ ধারার জীবনযাপনে কোনো সমস্যা বা জটিলতা নেই।
এগুলো এমন সব পার্থক্য, যা মূল মাসআলায় কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ ধরনের পার্থক্যের কারণে ‘দারুল হারব’ ‘দারুল ইসলামে’ পরিণত হয়ে যাবে না। কোনো অঞ্চল ‘দারুল হারব’ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, খ্রিষ্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যেমন তার অস্তিত্ব ছিল, ১৮৫৭ সালের পরও তা সবই বিদ্যমান ছিল আর ১৯৪৭ সালের পর থেকে অদ্যাবধিও তা বিদ্যমান রয়েছে।
একইভাবে খ্রিষ্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে হিন্দুস্তান ‘দারুল হারব’ ঘোষিত হওয়ার পর এখানকার মুসলমানদের ওপর যে ফরজ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, ১৮৫৭ সালের পরও মুসলমানদের জিম্মায় যে ফরজ বহাল ছিল, ১৯৪৭ সালের পর থেকে অদ্যাবধি মুসলমানদের ওপর সেই একই ফরজ দায়িত্ব অবধারিত রয়েছে। এখন অঞ্চলগুলোর নাম ভাগ করে কোনোটাকে বাংলাদেশ, কোনোটাকে ভারত আর কোনোটাকে পাকিস্তান বলা হলেও যে দায়িত্বগুলো দু-শতাব্দী পূর্বে মুসলমানদের ওপর অবধারিত হয়েছিল, সেসব দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা এই দীর্ঘ সময়ে ঘটেনি। সুতরাং সিরাজুল হিন্দ শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ.-এর সেই ঐতিহাসিক ফাতওয়া মোটেও পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি; বরং আজও তা সমানভাবে বহাল রয়েছে। ‘দারুল হারব’ হিন্দুস্তান ‘দারুল হারব’ই রয়ে গেছে। কখনো এর নেতৃত্ব সরাসরি তাগুতের হাতে গেছে আর কখনোবা তাগুতের এজেন্টরা নেতৃত্বের বাগডোর সামলিয়েছে। তবে সর্বোপরি মুসলমানদের আকাশে ইসলামি হুকুমতের সূর্য আজও উদিত হয়নি। দুইশ বছরেরও অধিক সময়ে একদিনের জন্যও ইসলামি খিলাফাহ ও শরয়ি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো কি সময় হয়নি ঘুম ভাঙার? আর কতকাল গোলামির শিকল কাঁধে করে বয়ে বেড়াব?
ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ;
ছিড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দাবাদ!
মূল : শায়খ ফজলুর রহমান হাফি.
সরল অনুবাদ : আলী হাসান উসামা
SUSPOSTO ITIHAS… TOBU GHUME BEKHOBOR MUSOLMAN….