“এহাঁ হাম সব মুসাফির হেঁ, ওহি আখের ঠিকানা-
কোয়ি আগে রাওয়ানা হ্যায়, কোয়ি পিছে রাওয়ানা।”
হ্যাঁ, এই পঙক্তিদুটিই এখন সান্ত্বনা। যে বীজ সুদীর্ঘকাল সযন্তে মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকে, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে জাতিকে উপহার দিয়েছে এক প্রকাণ্ড মহীরুহ- তার অন্তর্ধানের পর সবকিছু কেমন যেনো শূন্য হয়ে পড়েছে; শূন্যতার নির্মম ক্রন্দনধ্বনি আক্ষেপিত করে করে তুলছে হৃদয় বারবার। সকলের আস্থাভাজন, শিক্ষার্থীদের সুখ-দুঃখের ঠিকানা, সদা চিন্তাশীল, বিনীত, একনিষ্ঠ, মিশুক প্রকৃতির বর্ষিয়ান এই মহান শিক্ষাবিদ- যার জীবনের সুদীর্ঘ চার যুগ, ১৯৭৮ থেকে ২০১৬- প্রায় অর্ধশতাব্দি কেটেছে কওমি শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নতি ও শিক্ষার মানোন্নায়নের ভাবনায়। সর্বদা সন্তানের মতো করে বেফাককে আগলে রাখায় ব্যক্তিজীবনে অর্থকড়ি ও বিওবৈভবের ছোঁয়া কখনো পাননি। এসবের পেছনে ছোটার সুযোগও তাঁর হয়নি। বড় কষ্টে কেটেছে জীবন। সহাস্যবদনে আর্থিক অনটন বরণ করে রেখেছেন আমরণ। দেশের আঠারোটি কওমি শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে আজ বেফাকের যে সুদৃঢ় অবস্থান ও সুউচ্চ মর্যাদা তা এই সংগ্রামী সাধকের অক্লান্ত পরিশ্রমেরই ফসল। কওমি অঙ্গনে তাঁর অন্তর্ধানের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটেছে এক আলোকিত অধ্যায়ের। সেই শৈশবে সর্বপ্রথম তাঁর নাম শুনেছি বেফাকের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক আমার পরমপ্রিয় উস্তাদ আল্লামা নুরুদ্দীন গহরপুরী রহ.-এর মুখে, তাঁর ত্যাগ ও কীর্তিগাঁথা শুনেছি শুদ্ধেয় উস্তাদ মাওলানা আব্দুল আযীয দয়ামিরী রহ.-এর যবানে। ছোট্ট থেকেই তাঁর নামটি তাই গেঁথে ছিলো আমার হৃদয়ফলকে।
মাওলানা আব্দুল জব্বার জাহানাবাদী রহ. ১৯৩৭ সালের আগস্ট মাসে বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানাধীন সহবতকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাই ও এক বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা শেখ নাসিমুদ্দীন বিন আয়জুদ্দীন। মা নুরজাহান বেগম। বাগেরহাটের পূর্বের নাম ছিলো জাহানাবাদ। খাজা খানজাহান আলীর নামানুসারে এর এই নাম। ব্রিটিশ শাসনামলে ইসলামি ঐতিহ্য ও ভাবধারা বিলুপ্ত করার মানসে ইংরেজ সরকার এর নাম পরিবর্তন করে রাখে বাগেরহাট। বাগ অর্থ বাগান। সেকালে বাগানে হাঁট বসতো। তাই সে অনুসারে এলাকার নামই রাখা হয় বাগেরহাট। মাওলানা আব্দুল জব্বার রহ. মুসলমানদের আলোকোজ্জ্বল ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য নিজের নামের সাথে ‘জাহানাবাদী’ অভীধাটি যুক্ত করেন।
তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়েছে নিজ গ্রামের হাজেরখালী জুনিয়র মাদরাসায়। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে গজালিয়া গ্রামে অবস্থিত একটি কওমি মাদরাসায় একবছর পড়াশোনা করেছেন। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছেন পিরোজপুর জেলার সাত কাসেমিয়া মাদরাসায়। ১৯৫৬ সনে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বড়কাটারা মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকেই ১৯৬১ সনে দাওরায়ে হাদিস সমাপন করেন। মেধাবী এই মানুষটি সর্বদাই জামাআতে প্রথম স্থান অর্জন করতেন। তাই তিনি অর্জন করেছিলেন উস্তাদগণের বিশেষ আস্থা ও ভালোবাসা। সে সময়ই তার মধ্যে ইন্তেজামি কাজ আঞ্জাম দেয়ার অসাধারণ গুণের প্রকাশ ঘটে। যে কাজে অপরাপর ছেলেদের সময় লেগে যেতো প্রায় ঘণ্টাখানেক, তিনি সেই কাজ মাত্র পনেরো মিনিটে সুচারুরূপে সম্পন্ন করে ফেলতেন।
তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য- মাওলালানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী হুজুর রহ., মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ., শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ও মুফতি মহিউদ্দীন রহ.।
ছাত্রজীবন থেকেই তার লেখালেখির অভ্যেস ছিলো। আমরণ তিনি প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখতেন। লেখালেখির প্রেরণা লাভ করেন তিনি ফরিদপুরী রহ.-এর কাছ থেকে। তিনি যখন সাত কাসেমিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করেন, তখন ফরিদপুরী রহ. সেখানে বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে ছাত্রদেরকে লেখালেখির চর্চা করাতেন। জাহানাবাদী রহ.-এর লেখায় হাতেখড়িও সেখানেই হয়। স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে তিনি প্রায়ই বলতেন, ফরিদপুরী রহ. মাঝেমধ্যেই আমাদেরকে একথাটি বলতেন- “মাতৃভাষা হিসাবে বাংলা শিখো। কোরআনের ভাষা হিসাবে আরবি শিখো। আকাবিরের ভাষা হিসাবে উর্দু শিখো। আখলাকের জন্য ফার্সি শিখো। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে ইংরেজি শিখো।”
তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয় ১৯৬২ সনে বড়কাটার মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মাধ্যমে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে সেখানে বেশিদিন আর থাকা সম্ভব হয় না। তারপর একবছর তিনি ইসলামপুর ইসলামিয়া লাইব্রেরিতে কাজ করেন। তারপর ছ’বছর অধ্যাপনা করেন জামিয় আরারিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসায়। যাত্রাবাড়ি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম তিনি। ২৬মার্চ ১৯৭১ এ স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলে মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৬ এ পুনরায় মাদরাসায় স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেন। এরপর ১৯৭৮ সনে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ায় যোগদান করেন। মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ চার যুগ এই বেফাকের সাথেই যুক্ত থাকেন।
জাহানাবাদী রহ.-এর প্রথম বিয়ে হয় গোপালগঞ্জে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ থানায়। তার একমাত্র ছেলে হাবীবুল্লাহ ছ’বছর বয়সে মারা যায়। মৃত্যুর সময় জাহানাবাদী রহ. তিন মেয়ে রেখে ইহরাম ত্যাগ করেন।
তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও আদর্শপুরুষ ছিলেন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.। তাঁরই পরামর্শে তিনি বায়আত হয়েছিলেন হাফিজুল হাদিস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ.-এর হাতে। লেখক হিসেবেও জাহানাবাদী রহ.-এর বেশ সুনাম ছিলো। একাধিক পাঠ্যপুস্তক রচনা ছাড়াও কওমি মাদরাসার পাঠ্যবইয়ের সম্পাদনায় তিনি কালজয়ী ভূমিকা পালন করেছেন। অসংখ্য পাঠ্যবইয়ে তার রচিত ছড়া-কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তিনি যেসব গ্রন্থ রচনা করে গেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ১. ইসলাম ও আধুনিক প্রযুক্তি ২. মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ৩. ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ও তাদের গৌরবময় ইতিহাস ৪. ইসলামে নারীর অধিকার ৫. পাশ্চাত্যের অধিকার বঞ্চিত লাঞ্ছিতা নারী।
তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না ঠিক। কিন্তু ইসলামি সংগঠন ও রাজপথ উত্তপ্তকারী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিলো অসামান্য। তিনি ছিলেন কওমি সনদের স্বীকৃতির পুরোধা। শাইখুল হাদিস আল্লামা নুরুদ্দীন গহরপুরী রহ.-এর নির্দেশে কওমি সনদের স্বীকৃতির জন্য সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন তিনি। সে সময়ে “কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি আমরা কেন চাই” নামে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন। এবিষয়ে সরকারি দপ্তরে তিনিই সর্বপ্রথম কাগজপত্র দাখিল করেন। বর্তমান প্রস্তাবিত কওমি সনদের সিলেবাসও তাঁরই হাতে তৈরি।
জীবদ্দশায় তিনি তিনবার পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন। ২০১৪ সনে দেওবন্দ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে সফর করেছেন। সারাজীবন বেফাক নিয়ে পড়ে থাকায় এছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রে সফর করার সুযোগ তার হয়নি।
জাহানাবাদী রহ. দীর্ঘদিন ধরে ডায়বেটিস, কিডনির সমস্যা, হার্টের ব্যাধি ও শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগশোকে ভুগছিলেন। সম্প্রতি কওমি ইস্যু নিয়ে নানানমুখী রাজনৈতিক চাপে তিনি অনেকটা ভেঙে পড়েছিলেন। এতে করে শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। বৃহস্পতিবার সকালে অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। এরপর থেকেই তিনি চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছিলো। আজীবন কওমি শিক্ষব্যবস্থা ও বেফাকের জন্য কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদ বলতে তার তো তেমন কিছুই ছিলো না। জমাজমি বলতেও ছিলো শুধু সেই অজপাড়াগাঁয়ের এক জীর্ণ কুটির আর সামান্য কিছু। মুমূর্ষু অবস্থায় সরকার, বেফাক কিবা আলিমসমাজের পক্ষ থেকে এই একনিষ্ঠ শিক্ষাবিদের উন্নত চিকিৎসা ও বিদেশে প্রেরণের জন্য কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। অনেকেই হাসপাতালে গিয়ে তাঁকে একনজন দেখে এসেছেন। এই তো কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাঁকে দেখার জন্য হাসপাতালে পদধূলি দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এই সুকরুণ মুহূর্তে তার উন্নত চিকিসৎসার উদ্যোগ কেউই গ্রহণ করেনি। অবশেষে পার্থিব মায়াজাল ছিন্ন করে ১৮ নভেম্বর, রোজ শুক্রবার, সকাল ১০টা ১০ মিনিটে চলে গেছেন তিনি প্রভুর সান্নিধ্যে। ৭৯ বছর বয়সে ঢাকাস্থ মগবাজার হলি ফ্যামিলি হাসপালালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেদিনই বাদ এশা জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় নামাযে ইমামতি করেন তাঁর অর্ধশতাব্দীর সহকর্মী বেফাকের উপমহাপরিচালক শাইখুল হাদিস মাওলানা আশরাফ আলী দা.বা.। তাঁর শেষ স্বপ্ন ছিলো, মৃত্যুর পরও তাঁকে যেনো যাত্রাবাড়ির ভাঙ্গাপ্রেসে অবস্থিত বেফাকের জায়গায় কবরস্থ করা হয়। আমরণ থেকেছেন যে বেফাককে নিয়ে, মৃত্যুর পরও সে বেফাককেই জড়িয়ে থাকতে চেয়েছিলেন পরম মমতায়। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে তার শেষ স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভবপর হয়নি। পরদিন দ্বিতীয় জানাযা শেষে নিজ গ্রামেই তাঁর দাফনকর্ম সম্পন্ন করা হয়।
আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। পরিবারের লোকদেরকে ছবরে জামিল নছিব করুন। তাঁর স্বপ্নের বেফাকের সোনালি অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখুন। আমিন।