এক.

ঢাকা থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানা। বাংলাদেশের বৃহৎ বেদেপল্লীগুলোর একটি। এখন সেখানে ঘরবাড়ি ও পল্লী গড়ে উঠলেও এইতো কিছুকাল আগেও নৌকায়ই বাস করতো বেদেরা। নদীর জলে ভেসে বেড়াতো চার-চারশ নৌকা। প্রতিটি নৌকায় একটি করে বেদে পরিবার। জমাজমি কিংবা অর্থবিত্ত- কিছুই ছিলো না তাদের। তবে সকলেই তারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির অভাবে দৈনন্দিন জীবন-যাপন ইসলামি তরিকায় ছিলো না ঠিক, তবে প্রত্যেকের ভেতরে ছিলো সুদৃঢ় ইমানি চেতনা ও ধর্মীয় ভাবাবেগ। যেকোনো মূল্যে ইমানের অমূল্য সম্পদ হারাতে তারা কিছুতেই প্রস্তুত ছিলো না। একসময়ে খ্রিস্টান মিশনারির দৃষ্টি পড়ে তাদের ওপর। মিশনারির কয়েকজন প্রশিক্ষিত উদ্যমী সদস্য প্রবল আত্মবিশ্বাস ও সাফল্যের বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে বেদেদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশে কাজ নেমে পড়ে। কিন্তু টানা কয়েক দিনের অবিশ্রান্ত চেষ্টা-সাধনার ফল দাঁড়ায়- শূন্য। বড় বিস্মিত ও চিন্তিত হয়ে পড়ে তারা। চেষ্টায় কোন ত্রুটি নেই। সাধ্যের অন্ত নেই। তবুও ফলাফল শূন্য কেনো- এর উত্তর তারা খুঁজে পায় না। সরলমনা বেদেদেরকে তারা কতো করে বুঝিয়েছে। আলোকিত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছে। প্রত্যেককে ডাঙায় জমি কিনে ঘর করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের অঙ্গিকার করেছে। তবুও পার্বত্য চট্টগ্রামের অভাবিত সাফল্যের পর ব্যর্থতা ও পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই তাদেরকে ফিরতে হয়েছে। গোত্রপতির দৃপ্তকণ্ঠের ঘোষণা তাদের স্বপ্নের প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সর্দার বলেছে, “আমাদের একজন নেতা আছে; হযরত মুহাম্মাদ সা. যার নাম। আমরা কখনো তার অবাধ্য হবো না। তার আনীত ধর্ম ছেড়ে কিছুতেই অন্য ধর্ম গ্রহণ করবো না। আপনারা আপনাদের পথ দেখতে পারেন”।

দুই.

বাংলাদেশের সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর নাম বেদে। মরুভূমি বা সমভূমির যাযাবরদের মতো এরা এদেশের একমাত্র যাযাবর সম্প্রদায়। বেদেদের বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের উৎপত্তি আরব বেদুইনদের থেকে। বেদুইনদের মতো বেদেদের সকলেই মুসলমান ও সমাজের মূলধারা থেকে তাদের দূরত্বে অবস্থান- এদুটি বিষয় তাদের বক্তব্যের সত্যতার দিকেই ইঙ্গিত করে। বেদেদের নাম শুনলে অনেকেই মনে করেন, তারা হয়তো বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী কিংবা বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাদের জীবন-জীবিকা জড়িত। অথচ বাস্তবতা হলো বৌদ্ধধর্ম কিংবা বাদ্যযন্ত্র- এদুয়ের সাথে বেদেদের নেই দূরতম সম্পর্ক। ভারতের আসামসহ কয়েকটি প্রদেশে বেদেদের বিক্ষিপ্ত অস্তিত্ব থাকলেও তাদের মূল অবস্থান নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশে। ঢাকার সাভার, নাটোরের সিংড়া, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে ওঠেছে বেদেপল্লী। এছাড়াও সুনামগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জে বিক্ষিপ্তভাবে একদল বেদের অবস্থান রয়েছে। এরমধ্যে সবচে বিপুল সংখ্যক বেদেদের বসবাস সাভারে। তাই সাভারের বেদেপল্লী বা “বাইদ্যাপাড়া” বেদে সম্প্রদায়ের রাজধানী বলে পরিচিত। সাপ নিয়েও বেশি কারবার এ রাজধানীর বেদেরাই করে।
বাংলাদেশে বেদেদের মোট জনসংখ্যা আট থেকে দশ লাখের মতো। তবে বিক্ষিপ্ত বেদেদের মধ্যে সমন্বয় ও কেন্দ্রীয় সংগঠন না থাকায় তারা অনেক মৌলিক অধিকার ও প্রাপ্য সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত। দেশের উপজাতি সম্প্রদায়গুলোর মতো সরকারের কাছ থেকে নিজেদের দাবি-দাওয়া পূরণ করে নেয়া এবং চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে অল্পশিক্ষায়ও অগ্রাধিকার পাওয়ার সুবিধাদি বেদেরা পায় না। ফলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সুদীর্ঘকালেও তাদের আর আশানুরূপ উন্নতি ও অগ্রগতি হয় না। প্রতিটি বেদেপল্লীতে একজন করে দলপতি থাকে। সামাজিক বিচারকার্য ও দায়-দায়িত্ব তিনিই পালন করেন। তার আদেশই আইন; সকলেই তাকে মেনে চলে।
বেদে সম্প্রদায়ের আদি পেশা হলো, তাদের মেয়েরা কাঁচের চুড়ি, খেলনা ও হালকা প্রসাধনী ইত্যাদি নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ফেরি করে ব্যবসা করে। কেউ আবার বাতের ব্যথার চিকিৎসা হিসেবে সিঙ্গা লাগায়। আবার কেউ গাছের শেকড়-বাকল, জুড়ি-বুটি ইত্যাদি দিয়ে নানাবিধ ওষুধ বানিয়ে সেগুলো বিক্রি করে। পুরুষেরা সাধারণত সাপের খেলা দেখায়, মন্ত্র পড়ে সাপ ধরে, সাপে কামড়ালে ওঝা হয়ে তার চিকিৎসা করে। কেউবা বাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে। ক্ষেত্রবিশেষ একাকী, যৌথ কিংবা দল বেঁধে তাদের ব্যবসায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গাঁয়ে-গ্রামে আগে যেহেতু সাঁপের বেশ উৎপাত ছিলো। মাঝেমধ্যেই বিষাক্ত সাপ কাউকে না কাউকে কামড়ে দিতো। তাছাড়া সাপে কামড়ালে ওঝা দিয়ে ঝারানো ছাড়া ভিন্ন কোনো চিকিৎসাও ছিলো না। গ্রামগুলোতে বাচ্চাদের খেলনা ও মহিলাদের প্রসাধনী পাওয়া যায়- এমন দোকানপাটও খুব একটা ছিলো না। তাই গাঁয়ে-গ্রামে বেদেদের ছিলো ব্যাপক চাহিদা। নৌকায় বাস করেও তাদের দিনকাল তাই ভালোই কাটছিলো।
কিন্তু ক্রমে ক্রমে যখন দেশ উন্নতির পথে এগোতে শুরু করে, পাড়াগাঁয়েও বেশ দোকানপাট গড়ে ওঠে, সাপের উপদ্রবও দিনদিন কমে যেতে থাকে; তাছাড়া নদীর নব্যতাও দিনদিন হারিয়ে যেতে থাকে। তাই বেদেরা ডাঙায় উঠে আসতে বাধ্য হয়। সাধ্যমতো জায়গা-জমি কিনে ঘরবাড়ি বানিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রয়াস পায়। মসজিদ কেন্দ্রিক গড়ে ওঠে দুস্থ বেদে সমাজ। চেহারায় আলাদা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য না থাকায় এবং ধর্ম-সংস্কৃতি এক হওয়ায় সহজেই সমাজের মূলধারার সাথে মিশে যাওয়া তাদের জন্য সম্ভবপর ছিলো। কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পার্শ্ববর্তী মুসলমানদের অসদাচরণ এবং মুখে ও কর্মে অসমর্থন। সাপ নিয়ে বেদেদের কারবার থাকায়, অবৈধ তাবিজ-তদবির (যেসবের সাথে শিরকি তন্ত্রমন্ত্রের সম্পর্ক বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক)-এর সাথে জড়িত থাকায় এবং নারীদেরকে জীবিকার স্বার্থে ব্যবহার করায় তাদের এবং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে গড়ে ওঠে অঘোষিত বাধার দেয়াল ও ঘৃণার প্রাচীর। তারা যখন স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন দেখে, সে-লক্ষ্যে প্রয়াস গ্রহণ করে তখন পায় না অপরাপর মুসলমানদের প্রত্যক্ষ কিবা পরোক্ষ সাহায্য-সহযোগিতা, সমর্থন কিবা সাড়া। তাদের দুঃখ ও অসহায়ত্বের করুণ মুহূর্তেও তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায় না, একটুখানি আপন করে নেয়ার আগ্রহ, মানবীয় সম্প্রীতি-ভালোবাসা কারো কাছে তারা পায় না। জীবনের এ অধ্যায়ে বড় তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন হয় তাদের। অবশেষে সব বাধা উপেক্ষা করে নিজেদের জীবননায়ের হাল নিজেরাই ধরে। সর্বশক্তি ব্যয় করে স্রোতের উল্টো দিকে একটু একটু করে এগোতে থাকে। আত্মপরিচয় গোপন করে চাকরি ও ব্যবসাক্ষেত্রে কেউ কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাইমারি ও হাইস্কুলের স্তর ডিঙিয়ে একদল মেধাবী বেদে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অর্থাভাবে বহু সম্ভাবনা ও প্রতিভা অকালেই ঝরে যায়। অন্যদের কটূক্তি ও ঘৃণার মনোভাব সইতে না পেরে কেউবা নিজেকে আঁধারজগতে ঠেলে দেয়। কিছু বেদে হাফিজে কোরআন, মাওলানা ও মুফতি হওয়ার সৌভাগ্যও অর্জন করে। তবে সাধারণ মুসলমানদের সহযোগিতা ও সুদৃষ্টির অভাবে গোটা বেদে সম্প্রদায় এখনোও আশানুরূপ উন্নতি ও অগ্রগতি করতে পারেনি।
মাওলানা জালালাবাদীর মুখে বেদেদের প্রতি মুসলমানদের অবহেলার একটি ঘটনা শুনে দুচোখে কুম্ভীরাশ্রুর বন্যা বয়ে যায়। মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে গত এপ্রিল-২০১৪ তে সফরকালে এমন এক নির্মম দৃশ্য দেখার সুযোগ তাদের হয়। এক বেদে মুসলমানের লাশ পড়ে আছে। গোসল করিয়ে কাফনও পড়ানো হয়েছে। কিন্তু ইমাম সাহেব সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কোনো বেদের জানাযা পড়াবেন না। সাধারণ মুসলমানদের কেউও সে জানাযায় অংশগ্রহণ করেনি। তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া তো দূরের কথা; বেদেদের বিয়েশাদিত সাধারণ মুসলমানরা উপস্থিত হওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখায় না

তিন.

মাওলানা আবু সাঈদ মোহাম্মাদ ওমর আলী রহ.। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা। এদেশে অমুসলিমদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের মহান ধারাপাত যার মাধ্যমে হয়েছিল। দেশবাসীর কছে তিনি এতোটাই পরিচিত ও বরিত- নতুন করে তার পরিচয় তুলে ধরা অযথা সময়ক্ষেপণ মাত্র। বেদেসমাজের উন্নয়নে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনিই প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর সাথে তার ছিলো গভীর সখ্যতা। একদিন কথাপ্রসঙ্গে তিনি তাকে বলেন, “জালালাবাদী সাহেব, আপনি কি জানেন, এই বেদে সমাজের সবাই মুসলমান? তার কথায় বিস্মিত হয়ে চমকে ওঠেন মাওলানা জালালাবাদী। “কী বলছো তুমি! বেদেরা সবাই মুসলমান!” “জি হুজুর, আর এজন্যই আজ ওদের কপালে এতোটা দুর্ভোগ! মুসলমান বলে এনজিওগুলোর কোনো প্রকার সহযোগিতা ওরা পায় না। ভিন্ন ধারার পেশায় জড়িত বলে মুসলমানরাও ওদেরকে চরমভাবে ঘৃণা করে। কয়েক বছর ধরে ওদের মধ্যে আমার যাতায়াত। লৌহজংয়ে আল্লাহর ফজলে একটি ছোট্ট মসজিদও করে দিয়েছি। এখনও মুসলমানদের তেমন সাড়া পাইনি। তবে আমার স্বপ্ন, কারো সাড়া পাই বা না পাই আমরণ এই দুস্থ বেদেদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবো।”
এই কথোপকথনের কিছুকাল পরেই মুসলিম উম্মাহর দরদী মনীষী মাওলানা ওমর আলী রহ. আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। মাওলানা জালালাবাদীর অন্তরে বিষয়টি তখন দাগ কাটে। তিনি দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যে-করেই হোক অনুজপ্রতিম ওমর আলী রহ.-এর স্বপ্নকে তিনি আঁকড়ে ধরবেন, তার অসম্পূর্ণ মিশনকে সম্পূর্ণ করবেন। অন্যদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা কিংবা সাড়ার অপেক্ষা না করে, বয়সের বাধা উপেক্ষা করে একাকী নেমে পড়েন বেদে সমাজ উন্নয়নের আলোকিত স্বপ্ন পূরণে। সাধ্যমতো বেদেদেরকে সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি সহৃদয় বিত্তবানদের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। অবশেষে দীর্ঘ অর্ধযুগ পরে তার স্বপ্ন পেখম মেলে। কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তির সাড়া পান তিনি। উনিশ সদস্যের ক্ষুদ্র কাফেলা নিয়ে গড়ে ওঠে ‘বেদে সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’।

চার.

গাড়ি চলছে সাভারের পথে। গন্তব্য সাভার পোড়াবাড়ি বেদেপাড়া জামে মসজিদ। সেখানে আজ জুম‘আ পড়াবেন মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। লৌহজংয়ের তিনজন বেদে আলিম পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য অগ্রগামী কাফেলা হিসেবে একদিন আগেই সেখানে গিয়ে পৌঁছেছেন। আমাদের এ ক্ষুদ্র কাফেলায় প্রবীণ আলিম ও মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা জালালাবাদী ছাড়াও আরো যারা রয়েছেন- ৬৯-এর গনঅভ্যুন্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদের অগ্রজ প্রকৌশলী রশীদুজ্জামান সাহেব, দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক চিফ রিপোর্টার সৈয়দ আখতার ইউসুফ এবং মারকাযুদ দাওয়াহ আলই সালামিয়ার ইফতা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষানবিশ আলী হাসান উসামা। এই কাফেলায় আরো থাকার কথা ছিলো শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মাওলানা আবদুল মালেক দা.বা.-র; কিন্তু ব্যস্ততার কারণে হুজুর আর সময় করে উঠতে পারেননি। খোদার জন্য একনিষ্ঠ এই মহান মানুষটি সর্বদা সেবামূলক কর্মকান্ডে দু’হাতভরে সহযোগিতা প্রদান করেন, প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনাও দেন, কিন্তু নিজেকে লুকিয়ে রাখেন পর্দার অন্তরালে, আকাশসম উদারতার কথা জানতে দেন না কাউকে। মানবতার মঞ্চে দানবীর হিসেবে বরিত হতে চান না তিনি। বিনিময় লাভের প্রত্যাশা রাখেন একমাত্র মহামহিম আল্লাহর কাছে। এ যেনো ঠিক মানবতার মুক্তির দিশারী সেই মহান রাসুলের আদর্শেরই মূর্তপ্রতীক। বেদে সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বরাবরই তিনি সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত রেখেছেন, কিন্তু একেবারে সংশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়া সেকথা কেউই জানেনি।
জুম‘আর সময় একেবারে ঘনিয়ে এসেছে। অচেনা অপরিচিত পথে অগ্রে প্রেরিত কাফেলার মুঠোফোনের নির্দেশনার আলোকে আমরা এগিয়ে চলছি গন্তব্যের সন্ধানে। সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে পশ্চিম দিকে রেলকলোনি হয়ে পনেরো বিশ মিনিট এগোলেই পোড়াবাড়ি বেদেপাড়া। কিন্তু বারবার পথ ভুল করে এই পনেরো বিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় ঘণ্টাখানেক। উদ্ভ্রান্তের মতো অনেকক্ষণ ঘুরে, পথচারীদেরকে বারবার জিজ্ঞেস করে করে আমরা যখন গন্তব্যে পৌঁছি, বেলা বাজে তখন ১টা। গাড়ি থেকে নেমে দেখি, এই অজপাড়াগাঁ আজ সেজেছে সম্পূর্ণ এক নতুন রঙে। চারদিকে পুলিশ আর পুলিশ। ভাবসাবে মনে হচ্ছে, এখানে বুঝি উদযাপিত হবে বড় কোনো আয়োজন। এগিয়ে এসে আমাদেরকে ইস্তেকবাল জানান ইছলাহুন্নিছা মহিলা মাদরাসার মুহাদ্দিস বন্ধুবর মাওলানা আব্দুল মান্নান এবং আমাদের সেই অগ্রগামী কাফেলার তিন বেদে মাওলানা। তাদের সাথে আমরা মসজিদে প্রবেশ করি। পুরো মসজিদ কানায় কানায় ভরা। মসজিদে স্থান স্থান সংকুলান না হওয়ায় পাশের সুবিশাল ঈদগাহেও মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড়। জায়নামায বিছিয়ে সামনের কাতার পুরোটাই তারা আমাদের জন্য খালি করে রেখেছে। বেদে মুসল্লিদের আচরণ আমাদেরকে অভিভূত করে। আমি কখনো ভুলবো না, ভুলতে পারবো না সেই মানুষগুলোর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত দৃষ্টি, মায়াভরা চাহনি। তাদের সেই সরল হৃদয়কাড়া চাহনি আর অধরে ফোটা শুভ্র হাসির রেখা যেনো স্বগৌরবে ডেকে ডেকে বলছিলো, দেখো, ঐ যে দেখো, আমাদের সুদিন এসে গেছে। বিধাতা আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন ত্রাণকর্তা। আমরাও এখন সভ্য পৃথিবীর অংশে পরিণত হবো। কর্মক্ষেত্রে অপরাপর মুসলমানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারবো। পারবো আমাদের কলজের টুকরো সন্তানদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে। পারবো আমাদের মেয়েদেরকে ভালো ভালো ছেলেদের সাথে বিয়ে দিতে। বিশ্বাস করো পাঠক, দু’চোখের অশ্রু তখন কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলাম না। বেদনারা হৃদয়টাকে প্রবলভাবে ঝাপটে ধরেছিলো। বেদনার্ত হৃদয় থেকে কুম্ভীশ্রুর ধারা উৎসারিত হয়ে দু’চোখ বেয়ে জলপ্রপাতের মতো গড়িয়ে পড়ছিলো তখন। সেখানেই মনে মনে অঙ্গিকার করেছি, আমার তো সামর্থ্য নেই ঠিক, চাইলেই আমি নিমিষে এই অবহেলিত জনপদের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাতে পারবো না; কিন্তু আমি তো এক খুদে লিখিয়ে, কলম আছে আমার হাতে। এর সাহায্যে তাদের করুণ চিত্র আমি তুলে ধরবো বিশ্বমানবতার সামনে। হতেও তো পারে, আমার সেই চিত্র ছুঁয়ে যাবে কোনো পাঠকের হৃদয়, ব্যাথাতুর হৃদয়ে যিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন এই অবহেলিত জনপদের রক্ষায়, মানবেতর জীবনযাপনের অবসান ঘটিয়ে বের করে আনবেন তাদেরকে আলোকিত জীবনের পথে।
মিম্বারে ওঠেন মাওলানা জালালাবাদী। সংক্ষিপ্ত সময়ে সারগর্ভ হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করেন তিনি। তার সেই আলোচনা শুনে অনুধাবন করি, বঙ্গভবনে তার জুম‘আর আলোচনা শুনে শুনে তার প্রতি কেনো এতো দুর্বল-অনুরক্ত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। সেদিন মাওলানা জালালাবাদীর প্রতিটি বাক্য থেকে ঝরে পড়ছিলো সে কী আবেগ ও মায়া ! এখানে তার সারকথা তুলে ধরেছি।
“হামদ ও সালাতের পর। আমার বেদে ভাইয়েরা, আমরা সবাই একই পথের যাত্রী। আমাদের সবার গন্তব্য সেই অন্ধকার কবর। কবর জগত থেকে সূচিত হবে আমাদের নতুন জীবন। তা-ই হবে প্রকৃত জীবন, কখনো যার সমাপ্তি হবে না।
“মওত কো সমঝা হ্যয় গাফিল ইখতেতামে যিন্দেগী
হ্যয় ইয়ে শামে যিন্দেগী, ছুবহে দাওয়ামে যিন্দেগী”।
গাফেল হে, মৃত্যুকে ভেবেছো তুমি জীবনের পরিসমাপ্তি।
মৃত্যু এ জীবনের সাঁঝ, চিরস্থায়ী আরেক জীবনের প্রভাত।
প্রিয় ভাইয়েরা আমার, মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের মধ্যকার বিভেদরেখা চিরতরে মুছি যাবে। সেখানে থাকবে না ধনী-গরীবের পার্থক্য, থাকবে না শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের বিভেদ। দেখা হবে না, কে বেদে আর কে মাইমল। সেখানে শুধু পরীক্ষা নেয়া হবে ঈমানের । চিহ্নিত করা হবে বিশ্বাসীদের, এরপর বিশ্বাসীরা স্থান পাবে জান্নাতে আর কাফের-বেঈমানেরা চিরদুর্ভোগ কপালে নিয়ে নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামে। আমার বেদে ভাইয়েরা, তোমরা আমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ো। মিনতি ভরা কণ্ঠে করজোড় করে তোমাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমরা তোমাদেরকে ঠকিয়েছি, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি। আমরা সর্বদা তোমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। আমাদের প্রিয়নবি সা. তার উম্মতের মধ্যকার বিভেদরেখাকে অবলেপন করে দিয়েছেন, দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, “কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। অনারবের ওপর আরবের কোনো মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র ভিত্তি হলো তাকওয়া”। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচে’ মর্যাদাবান সে, যে সবচে’ বেশি মুত্তাকি”। আর তাইতো ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতে গিয়ে আল্লামা ইকবাল বলেছেন-
“আইনে জঙ্গ মেঁ জব আগায়া ওয়াকতে নামায,
একহি সফ মেঁ খাড়ে হো গায়ে মাহমুদ ও আয়ায”।
আমার দেহ কেটে গেলে যেমন লাল রক্ত ঝরে, তোমার দেহ কেটে গেলেও তো অনুরূপ রক্তই ঝরে। কোনো পার্থক্যই নেই তোমাদের এবং আমাদের মাঝে। আমরা এখানে এসেছি তোমাদেরকে জাগিয়ে তুলতে এরপর সবাই মিলে এক গণজাগরণ সৃষ্টি করতে। ছ’লক্ষের বেশি ভোট যখন তোমাদের হাতে, এরপরও কেনো তোমরা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে! তোমাদের উন্নয়নের জন্য আমরা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটা কমিটি গঠন করেছি। এই কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে প্রতিটি বেদেপাড়ায় আমরা একটি করে উপ-কমিটি গঠন করবো, এরপর সবাই মিলে আলোকিত ভবিষ্যত বিনির্মাণের প্রয়াস পাবো। আমার ভাইয়েরা, আমাদের এ সংগ্রামে তোমারাও কি আমাদের পাশে থাকবে?” গগনবিদারী ধ্বনিতে সকল বেদে সমস্বরে চিৎকার করে তাদের সমর্থন জানায়।

পাঁচ.

আমাদের এই আখ্যানে একজন মহৎ হৃদয়ের মানুষের কথা উল্লেখ না করা হলে তার প্রতি বড় অকৃতজ্ঞতা হবে। ঢাকা জেলার পুলিশের ডিআইজি জনাব হাবিবুর রহমান সাহেব। লৌহজংয়ের বেদেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেমন সর্বপ্রথম মাঠে নামেন মাওলানা ওমর আলী রহ., তেমনি সাভারের বেদেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন আলোকিত হৃদয়ের এই পুলিশ সুপার। সাভারের বেদেদের জন্য তিনি কী না করেছেন। নিজের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়াও বেদেদের অসহায় ও সুকরুণ অবস্থার প্রতি আরো বহু সহৃদয় বিত্তবান ব্যক্তির সুদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। আমরা গাড়ি থেকে নেমেই যে শত শত পুলিশের আনাগোনা ও সুবিশাল আয়োজন দেখেছিলাম, তা মূলত এই আলোকিত মানুষটিরই উদ্যোগে। তার আয়োজনে আজ জুম‘আর পরে এই ঈদগাহে তিন বেদেযুগলের বিয়ে দেয়া হবে। এরপর তাদের প্রত্যেক যুগলকে দেয়া হবে নগদ আশি হাজার টাকা করে। আর সে উপলক্ষে পুরো এলাকাবাসীর জন্য বিয়েভোজনের ব্যবস্থা তো থাকছেই। বেদেদের উন্নয়নে তার প্রতিটি পদক্ষেপই প্রশংসনীয়। এই সফরেরর পরে অন্য একদিন সময় নিয়ে আমরা মিলিত হয়েছিলাম জনাব হাবিবুর রহমান সাহেবের সাথে। আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তিনি এতোটাই খুশি হয়েছিলেন, খুশির কান্না যে কতো গভীর হতে পারে, সেদিনই প্রথম তা উপলব্ধি করেছিলাম। মাওলানা জালালাবাদীকে জড়িয়ে ধরে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, এতোদিন কোথায় ছিলেন আপনারা! আপনাদেরকেই তো আমি খুঁজে ফিরেছি বছরের পর বছর। দয়াময় আল্লাহর কাছে কেঁদেকেটে কতো বিনিদ্র রাত পার করেছি জায়নামাযে বসে। অবশেষে আল্লাহ আপনাদেরকে মিলিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার বিশ্বাস হয়ে গেছে, অচিরেই আসবে এই অবহেলিত বেদেজনগোষ্ঠীর শুভ সকাল।

ছয়.

সারাদিনের সব কার্যক্রম শেষ করে মাগরিবের পরে আমরা রওয়ানা হই মিরপুরের উদ্দেশ্যে। আজকের সফরের পরিসমাপ্তি এখানেই। আসার আগেই বেদেদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পরবর্তী সফর হবে ছাতকের বেদেপল্লীতে। ফেরার পথে আমরা যাত্রাবিরতি করি রানা প্লাজার কাছে, অন্ধ সংস্থা মার্কেটের পেছনে অবস্থিত ইছলাহুন্নিছা মহিলা মাদরাসায়। বন্ধুবর মাওলানা আব্দুল মান্নানের দাওয়াতে এখানে আসা। মাদরাসায় এসে কথা হয় তার পরিচালক মাওলানা জুনায়েদ করীমের সাথে। অন্যান্য আলাপচারিতার পরে মাওলানা জালালাবাদী বিনীত কণ্ঠে দু’টো অনুরোধ করেন পরিচালক সাহেবের কাছে। ১. আপনারা এখানে অন্তত বিশটি বেদে মেয়েকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ালেখার করার ব্যবস্থা করে দিন। যেহেতু এখানকার ছয়শ ছাত্রীর প্রায় সবাই বেতন দিয়ে লেখাপড়া করে, তাই মাত্র বিশটি মেয়ের জন্য এই ব্যবস্থা করা বোধ করি আপনাদের জন্য মোটেও কঠিন হবে না। ২. আপনারা শিক্ষিকা-ছাত্রীদেরকে ভাগ ভাগ করে সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও পার্শ্ববর্তী বেদে মেয়েদের মধ্যে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতের সুফলে সাভার বেদেপাড়ার অনেকের জীবনের মধ্যেই আমি দেখেছি সম্পূর্ণ বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। আপনারও যদি সে ধারাকে অব্যাহত রাখতে পারেন, বিশেষ করে বেদে মেয়েদেরকেও সম্পূর্ণ ইসলামি ভাবপরায় পরিচালিত করতে পারেন, তবে এই অবহেলিত বেদেদের ভাগ্যাকাশে অচিরেই উদিত হবে নতুন দিনের সোনালি সূর্য। মাদরাসার পরিচালক সাহেবও প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত খুশি হন এবং সাদরে তা গ্রহণ করেন। মাওলানা জালালাবাদী এরপর ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে এক আবেগমাখা মর্মস্পশী বক্তৃতা করেন। এশার নামাজের পরে আমরা রওয়ানা করি যে যার গন্তব্যের পথে। পাঠক, আজকের মতো এখানেই বিদায় নিচ্ছি। আবারো দেখা হবে অন্য কোনো সফরে। বেদেদের সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় ইতি টানছি এই আখ্যানের।
Share This