মিথ্যা, জালিয়াতি, বেইনসাফি ও অসততা কেন যেন আমার একদমই সহ্য হয় না। আপনি কোনো একটা মতাদর্শ অনুসরণ করেন ভালো কথা। তাই বলে অন্যের নামে মিথ্যা রটনা করা ও মিথ্যা প্রচার করার অধিকার আপনাকে কী দিলো? দুপুরবেলা মানজুরুল কারিম ভাই (আল্লাহর জন্য আমি তাকে ভালোবাসি) অপবাদ আরোপ করলেন, যারা ‘ইসতিওয়া’র অর্থ গ্রহণ করে, আমি নাকি তাদেরকে তাকফির করি। এখন চোখে পড়ল ইবনু জাকির ভাই এরচে বড় অপবাদ আরোপ করলেন পুরো মাতুরিদি মাযহাবের ওপর। আমি বুঝি না, বঙ্গদেশীয় আসারি মাযহাব কি এভাবে মিথ্যার ওপর ভর করেই প্রতিষ্ঠিত হতে চায়? তাদের মতো মানুষের থেকে অন্তত এগুলো আশা করিনি। ইবনু জাকির ভাইয়ের পোস্টটি অনেককে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। এখানে তার সেই পোস্ট ও তার করা মন্তব্য হুবহু উল্লেখ করছি।
//মাতুরিদি আকিদাহ : ‘যে ব্যক্তি অন্তর থেকে সত্যায়ন করবে, কিন্তু মুখে স্বীকার করবে না, সে আমাদের দৃষ্টিতে কাফের, কিন্তু আল্লাহর নিকট মুমিন এবং জান্নাতি।’
[শারহুল আকায়িদ আন-নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ১২১]//
ভাইয়ের মন্তব্য :
//এটা ঠিক হলে নবিদের আগমন অর্থহীন হয়ে পড়ে, মক্কার আবু তালেব আর মদিনার ইহুদিদের মুমিন সাব্যস্ত করা অনিবার্য হয়ে পড়ে।//
এই পোস্ট পেয়ে একই ধারার অনুসারীগণও বেজায় খুশি। বাস্তবতা যাচাই না করেই তারাও হাতে তালি বাজাতে শুরু করলেন। যেমন, ইসলামি বই গ্রুপের এডমিন আমাদের প্রিয়ভাই শোয়াইব আহমদ (আল্লাহ তাকে প্রশান্ত অন্তর দান করুন) মন্তব্য করেছেন :
//হা হা হা! ভারতীয় হুজুর সুপসাপ ছক্কা মেরে দিলেন। ইবনু জাকির ভাই আমার মুহাব্বতের মানুষ। ভালোবাসার মানুষ। ভাইকে ছক্কা মারতে দেখলে আমার ভালোই লাগে।//
আমার বোধগম্য নয়, এভাবে উল্লাস প্রকাশ করার হেতু বা তাৎপর্য কী? আপনারাই না অনুগ্রহ করে (?) মাতুরিদিদেরকেও আহলুস সুন্নাহর এক প্রান্তে ঠাঁই দেন। তাহলে তাদের নিয়ে এভাবে উল্লাস করা কেমন দেখায়?
যাহোক, এবার আসি বাস্তবতায়। ইবনু জাকির ভাই নিজেই তার লেখার রেফারেন্স দিয়েছেন। তিনি ‘শারহুল আকায়িদ’ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটি রচনা করেছেন শাফেয়ি মাযহাবের অনুসারী আল্লামা সাদ তাফতাজানি রহ.। তিনি উপরিউক্ত বক্তব্যের আরবি টেক্সট উদ্ধৃত করেননি। প্রথমে আমরা আরবি টেক্সটের দিকে নজর দিই :
فمن صدق بقلبه ولم يقر بلسانه، فهو مؤمن عند الله، وان لم يكن مؤمنا فى أحكام الدنيا.
অর্থ : যে ব্যক্তি অন্তর দ্বারা ‘তাসদিক’ করবে এবং মুখে স্বীকারোক্তি প্রদান না করবে, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে মুমিন; যদিও দুনিয়ার বিধিবিধানের বিবেচনায় সে মুমিন না হয়।
উভয় অনুবাদে কি মিল পেলেন? তিনি শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘স্বীকার’; যার শাব্দিক অর্থ হলো, ‘সম্মতিদান’ ও ‘গ্রহণ’। অথচ এর যথার্থ অনুবাদ হলো, ‘স্বীকারোক্তি করা’। কোনো কিছু স্বীকার না-করা, অস্বীকার করা আর তার স্বীকারোক্তি প্রদান না-করা কি এক কথা? এটাকে কি আমি তার আরবির দুর্বলতা বলব, নাকি ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে অনিচ্ছাকৃত ভুল বলব, নাকি ইচ্ছাকৃত অসততা বলে আখ্যায়িত করব?
এই আকিদার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ‘এটা ঠিক হলে নবিদের আগমন অর্থহীন হয়ে পড়ে, মক্কার আবু তালেব আর মদিনার ইহুদিদের মুমিন সাব্যস্ত করা অনিবার্য হয়ে পড়ে।’ তার মানে মাতুরিদি আকিদাকে যদি সঠিক মানা হয়, তাহলে আবু তালিব ও ইহুদিদেরকেও মুমিন বলতে হয়। ফলাফল আর তিনি স্পষ্ট করেননি। তার উভয় কথাকে মিলালে ফলাফল বের হয়, যেহেতু আবু তালিব ও ইহুদিদের মুমিন বলার সুযোগ নেই, নবির আগমনকেও অর্থহীন বলার কোনো উপায় নেই, সুতরাং মাতুরিদি আকিদাকেও হক বলে মেনে নেওয়ার জো নেই।
আমরা শত শত রেফারেন্স টেনে তার এই পয়েন্ট নিয়ে বিশ্লেষণ করব না। স্বভাবতই তার কথাটা দেখলে যে-কারও মনে প্রশ্নে জাগবে, তাহলে মাতুরিদি আকিদা কি এতটাই অসার ও বাস্তবতা-বিবর্জিত? অতীতে হাজার হাজার বিজ্ঞ আলিম তাহলে এই অসার মাযহাবই মেনে এসেছেন? এই অসার মাযহাব মেনে আদৌ কি মুক্তি পাওয়া সম্ভব? এখানে লেখকের অসততা কী, তা তার উল্লেখিত রেফারেন্সের বই থেকেই তুলে ধরছি।
ইবনু জাকির ভাই ‘তাসদিক’ শব্দের অর্থ বোঝেননি বা বুঝলেও প্রকাশ করেননি। ইমাম তাফতাজানি রহ. তো কথাটা বাংলায় বলেননি; বলেছেন আরবিতে। তিনি শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘তাসদিক’; যার বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ‘সত্যায়ন’। আরবিতে ‘তাসদিক’ দ্বারা কী বোঝায়—এটা জেনে নিলে ‘ইমান মানে হচ্ছে অন্তর দ্বারা তাসদিক করা’ কথাটাও সহজেই বোঝা যাবে। যার রেফারেন্সে ইবনু জাকির ভাই উপরিউক্ত কথাটি বিবৃত করেছেন, তিনি নিজেই দু-দুবার এর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন :
(والايمان) فى اللغة: التصديق. أى اذعان حكم المخبر وقبوله وجعله صادقا
ইমানের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘তাসদিক’। অর্থাৎ সংবাদদাতা (আল্লাহ ও তাঁর রাসুল)-এর বিধানের সামনে আনুগত্য প্রদর্শন করা, তা গ্রহণ করা এবং তাকে সত্যে পরিণত করা।
«الايمان أن تؤمن بالله» الحديث. أى تصدق وليس حقيقة التصديق أن يقع فى القلب نسبة الصدق الى الخبر أو المخبر عن غير اذعان وقبول، بل هو اذعان وقبول لذلك، بحيث يقع عليه اسم التسليم. على ما صرح به الامام الغزالى. وبالجملة: هو المعنى الّذي يعبر عنه بالفارسية بگرويدن.
‘তাসদিক’র হাকিকত (তত্ত্বকথা) এ নয় যে, আনুগত্য বরণ ও গ্রহণ করা ব্যতিরেকে শুধু অন্তরে সংবাদ (কুরআন-সুন্নাহ) বা সংবাদদাতা (আল্লাহ ও তাঁর রাসুল)-এর দিকে সত্যতার নিসবত (সম্বন্ধ) তৈরি হবে। বরং ‘তাসদিক’ হলো তার জন্য আনুগত্য বরণ করা এবং তা এমনভাবে গ্রহণ করে নেওয়া যে, তার ব্যাপারে ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দ প্রয়োগ করা যায়; যেমনটা ইমাম গাজালি রহ. স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। মোদ্দাকথা, ‘তাসদিক’র অর্থ হলো ফার্সি ভাষার گرويدن শব্দের অনুরূপ।
উল্লেখ্য, ফার্সিতে گرويدن শব্দের অর্থ হলো, ‘ফরমাঁবরদার’ তথা আনুগত্যপরায়ণ। ‘মুতি’ তথা অনুগত। ‘পায়রো’ ও ‘মুতাকিদ’ তথা অনুসারী ও ভক্ত। যেই শব্দটি এত ব্যাপক ও বিস্তৃত অর্থ ধারণ করে এবং যার ব্যাখ্যাও লেখক নিজেই সুস্পষ্ট ভাষায় করে দিয়েছেন, তার মনগড়া ব্যাখ্যা করে মাযহাবের অসারতা প্রমাণ করার চেষ্টা কি আদতে সততা নাকি অসততা?
কথা এখানেই শেষ নয়। ইমাম তাফতাজানি রহ. আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন :
ولو حصل هذا المعنى لبعض الكفار، كان اطلاق اسم الكافر عليه من جهة أن عليه شيئا من أمارات التكذيب والانكار، كما اذا فرضنا ان أحدا صدق بجميع ما جاء به النبي عليه السلام وسلمه وأقر به وعمل. ومع ذلك شد الزنار بالاختيار، أو سجد للصنم بالاختيار، نجعله كافرا، لما أن النبي عليه السلام جعل ذلك علامة التكذيب والانكار.
এই বৈশিষ্ট্য যদি কোনো কাফিরের অর্জিত হয়, তাহলে তার ওপর ‘কাফির’ শব্দ প্রয়োগ করা হবে এই বিবেচনায় যে, তার মধ্যে নাকচ ও অস্বীকারের প্রতীক রয়েছে। যেমন ধরুন, কোনো ব্যক্তি নবি ﷺ-এর আনীত সবকিছু তাসদিক করল, স্বীকারোক্তিও দিলো এবং তা অনুযায়ী আমলও করল; কিন্তু পাশাপাশি সে ইচ্ছাকৃতভাবে (বিধর্মীদের প্রতীক) ফিতা বাঁধল অথবা স্বেচ্ছায় মূর্তিকে সিজদা করল, তাহলে আমরা তাকে কাফির বলে গণ্য করব। কারণ, নবি ﷺ এগুলোকে নাকচ ও অস্বীকারের প্রতীক বলে নির্ধারণ করেছেন।
পরিশেষে বলব, প্রিয় ভাই, আল্লাহর জন্য আপনাকে ভালোবাসি। দয়া করে আল্লাহ ভয় করুন। আমরা কোনো হকপন্থী আলিমের থেকে গোত্রীয় দলান্ধতা ও অসততা প্রত্যাশা করি না। শারহুল আকায়িদ কিতাবটি আমি নিজে ফজিলত ২য় বর্ষের ছাত্রদের দরস দিই। এই কিতাবের হাওয়ালায় যখন এমন মিথ্যাচার দেখলাম, পুরো যেন অকস্মাৎ আকাশ থেকে পড়লাম। ইখতিলাফ ও মতানৈক্য থাকতেই পারে। ইনসাফপূর্ণ দালিলিক আলোচনাকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু এ ধরনের বেইনসাফি আচরণ আমাদেরকে আহত করে।
ভাই, সহজ এই বিষয়টা নিয়ে এত মাতামাতির কি আছে।
এরা তো অন্তর দিয়ে কাফের হত্যাকরে, আর হাত দিয়া বগল চুলকায়।
আমি গতবছর শরহে আকাঈদ কিতাবটি পড়েছি। অনেকেই কিতাবটাকে কাঠিন্যতার কারণে গুরুত্ব না দিলেও, আমার আগ্রহ ছিল প্রবল।
ঠিক এই জায়গায় এসে ‘তাসদিক’-এর এই সুক্ষ্ম পার্থক্য বুঝতে না পারায়, আমিও এই রকম দু’টানায় পড়ে গিয়েছিলাম। শ্রদ্ধেয় উস্তাদও আমার কাঙ্খিত উত্তর দেননি। আজ শায়খের এই লেখায় ব্যপারটা স্পষ্ট হলো, আলহামদুলিল্লা!!.
জাযাকাল্লাহু ওয়া বারাকা ফিল ইলমিকা!!
সহীহ বুখারী এর কিতাবুত তাওহীদ এ রয়েছে মুজাহিদ রহ ইস্তিওয়ার বাহ্যিক অর্থ নিয়েছেন
আমি এটি কিছুতেই মানতে পারছি না
Please help me