প্রারম্ভিকা
পবিত্র কোরআনের একটি শব্দও অনর্থক নয়। যে বিষয়গুলোকে আলকোরআনে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদেরও উচিত সেই বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে নেয়া। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে এই উম্মতকে মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। ইবরাহিম আ.এর কথা মোট পঁচিশটি সুরায় উল্লেখ করেছেন। আলকোরআনে তাঁর বর্ণনা এসেছে সর্বমোট উনসত্তর বার। আল্লাহ তাআলা তাঁর থেকে অনেক পরীক্ষা নিয়েছেন। সবগুলো পরীক্ষায় তিনি কৃতকার্য হয়েছেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ইবরাহিম আ. ছাড়া এমন কেউ নেই, যে এই দীনের ব্যাপারে পরীক্ষিত হয়ে সম্পূর্ণভাবে কৃতকার্য হয়েছে। তিনি ইসলামের ব্যাপারে পরীক্ষিত হয়েছেন। সফলতার সাথে তিনি তা পূর্ণ করেছেন । [তাফসিরে তাবারি- ১/৫৭২]
ইহুদিরা মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসারী হওয়ার দাবি করতো, যেহেতু তারা ইবরাহিম আ.এর পুত্র ইসহাক আ.এর বংশধর। খ্রিস্টানেরাও একই দাবি করতো, কেননা তাদের নবি ঈসা আ.এর বংশধারা তাঁর মা মারয়াম আ.এর সূত্রে ইবরাহিম আ.এর সাথে গিয়ে মিলেছে। মক্কার মুশরিকরাও সেই দাবি করতো, কারণ ইসমাইল আ. জুরহুম গোত্রে বিয়ে করেছিলেন; যামযামের ঘটনার পর থেকে যারা স্থায়ীভাবে আরবনিবাসী। আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার (১৩০-১৪০) আয়াতে তাদের দাবি খণ্ডন করেছেন এবং দাবির অসারতা খুলে খুলে বর্ণনা করেছেন। এরপর মুসলমানদেরকে মিল্লাতে ইবরাহিমের প্রকৃত অনুসারী বলে ঘোষণা করেছেন।
ইবরাহিম আ.এর অসংখ্য গুণের বর্ণনা আলকোরআনে এসেছে। তার মধ্যে ১১টি গুণের কথা সবিশেষ গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসেও এসেছে তাঁর অনেক গুণের বর্ণনা। ইবরাহিম আ.-এর পরের নবিগণও তাঁর মিল্লাতেরই অনুসরণ করেছেন। উল্লেখ্য যে, ইবরাহিম আ.এর পরে সকল নবি তাঁর বংশ থেকেই এসেছে। আল্লাহ তাআলাও সুরা আনআম- ৮৪, সুরা আনকাবুত- ২৭ ও অন্যান্য আয়াতে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ইবরাহিম আ.এর ছেলে ইসহাক আ.। তাঁর ছেলে ইয়াকুব আ., কোরআনের ভাষায় যিনি ‘আসবাতে’র পিতা। তাঁদের থেকেই এসেছে বনি ইসরাইলের সকল নবি। ঈসা আ.এর মাধ্যমে যে ধারার সমাপ্তি ঘটেছে। এরপর মুহাম্মাদে আরাবি সা. এসেছেন ইসমাইল আ.এর বংশ থেকে। আর তাঁর মাধ্যমেই নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ইবরাহিম আ. জাতিরও পিতা, নবিগণেরও পিতা।
ইবরাহিম আ.এর বড় বৈশিষ্ট্য- তিনি ছিলেন ”হানিফ”। পবিত্র কোরআনে হানিফ শব্দটি ১২ বার এসেছে। ৮ বারই এসেছে তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয়ে। আমাদেরকেও ”হানিফ মুসলিম” হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী কোনো লেখায় বিষয়টি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
দাওয়াতের ক্ষেত্রেও তিনি অনুপম আদর্শ। কী সুন্দর হিকমাতের সাথে তিনি দাওয়াত দিয়েছেন তাঁর বাবা আযরকে, তাঁর সম্প্রদায়ের উভয় দল- মূর্তিপূজারী ও তারকাপূজারীদেরকে, বাবেলের শাসক নমরুদকে, যে ছিলো সাম ইবনে নুহের বংশধর। তাঁর থেকে দাওয়াতের পন্থা শেখাটাও দায়ীদের জন্য অপরিহার্য। উপরন্তু আল্লাহ তাআলাই যেখানে বলে দিয়েছেন- ”তোমাদের জন্য ইবরাহিম এবং তাঁর সঙ্গীদের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যখন সে…”।
আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা হাদিসের ভাষায় আল্লাহর কাছে সবচে পছন্দনীয় আমল। আলওয়ালা ওয়াল বারা তাওহিদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মিল্লাতে ইবরাহিমের অন্যতম বৈশিষ্ট্যও এগুলো। ইবরাহিম আ. সম্পর্কে জানার আছে অনেক কিছু। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর সম্পর্কে জানার ও নিজেদের মধ্যে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
দ্বীন মিল্লাত এবং শরিয়তের পার্থক্য
সকল নবির দ্বীন এবং মিল্লাত এক ও অভিন্ন। মিল্লাত কখনো রহিত হয়নি, হবেও না। আদি থেকে অন্ত— একই মিল্লাত চলছে, চলবে। হাঁ, প্রত্যেকের শরিয়ত ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের শরিয়ত পূর্বের সকল শরিয়তকে রহিত করে দিয়েছে। এখন কেউ পূর্ববর্তী কোনো নবির শরিয়ত অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে চাইলে তার জন্য সে অবকাশ নেই। প্রত্যেককেই আবশ্যিকভাবে রাসুলুল্লাহ সা.এর শরিয়ত মেনে চলতে হবে। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই এই শরিয়ত থেকে কিছুতেই বিমুখ হওয়া যাবে না। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন—
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَوْ كَانَ مُوسَى حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلَّا أَنْ يَتَّبِعَنِي
ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মুসা জীবিত থাকতেন, তবে আমার অনুসরণ করা ছাড়া তাঁর কোনও গত্যন্তর থাকতো না। [মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা— ২৬৪২১]
সকল নবির দ্বীন এক ও অভিন্ন ছিলো- এর দলিল কী?
قال النبي صلى الله عليه وسلم: والأنبياء إخوة لعلات، أمهاتهم شتى ودينهم واحد. متفق عليه.
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন— নবিগণ সকলে বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁদের মা ভিন্ন; কিন্তু সবার দ্বীন এক। [বুখারি, মুসলিম]
সুফয়ান সাওরি রহ. বলেন—
قَالَ الثَّوْرِيُّ: «الْكُفْرُ مِلَّةٌ، وَالْإِسْلَامُ مِلَّةٌ»
কুফর এক মিল্লাত আর ইসলাম এক মিল্লাত। [মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকা- ১০২৩৪]
অর্থাৎ মিল্লাত মূলত দু’টি- কুফর এবং ইসলাম। এর বাইরে আর কোনো মিল্লাত নেই। আলকোরআনেও এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ
ইহুদি ও খ্রিস্টানেরা তোমার ওপর কিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না, যাবত না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করো। [সুরা বাকারা— ১২০]
আল্লাহ তাআলা বলেন—
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য দ্বীন শুধুই ইসলাম। [সুরা আলে ইমরান— ১৯]
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অবলম্বন করার ইচ্ছে করবে, তার থেকে কিছুতেই সে দ্বীন গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। [সুরা আলে ইমরান— ৮৫]
আল্লাহ তাআলা বলেন—
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيّاً وَلا نَصْرَانِيّاً وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفاً مُسْلِماً وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
ইবরাহিম ইহুদি ছিলো না, খ্রিস্টানও ছিলো না। সে তো ছিলো একনিষ্ঠ মুসলিম। মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না কখনোই। [সুরা আলে ইমরান— ৬৭]
মৃত্যর সময়ে ইবরাহিম আ. তাঁর সন্তানসন্ততিদের উদ্দেশে ওসিয়ত করছেন, কোরআনের ভাষায়—
وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَابَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
ইবরাহিম তার সন্তানদেরকে ওসিয়ত করলো এবং ইয়াকুবও (তার সন্তানদেরকে) — হে আমার পুত্রগণ, আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমাদের মৃত্যু যেনো এ অবস্থায়ই আসে যখন তোমরা মুসলিম থাকবে। [সুরা বাকারা— ১৩২]
এজন্যই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের অসংখ্য জায়গায় রাসুলুল্লাহ সা.কে এবং তাঁর উম্মতকে মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
[দেখুন— সুরা বাকারা- ১৩০, ১৩৫; আলে ইমরান- ৯৫; নিসা- ১২৫; আনআম- ১৬১; নাহল- ১২৩; হজ- ৭৮]
কিন্তু কোথাও ইবরাহিম আ.এর শরিয়ত অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়নি এবং কারো জন্য সে অবকাশও রাখা হয়নি। আরবের মুশরিকরা দাবি করতো, তারা মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসারী। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতকে মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এবং মক্কার মুশরিকদের সামনে খুলে খুলে তাদের দাবির অসারতা বর্ণনা করেছেন। {মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের নির্দেশ দেয়ার পেছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে, যা আমরা পরবর্তী কোনো লেখায় ইনশাআল্লাহ আলোচনা করবো।} এজন্য কোনো মুসলমান যদি দাবি করে, আমি মিল্লাতে ইবরাহিমের ওপর আছি, তবে তার কথা ভুল হবে না। একথার কারণে তার ওপর কিছুতেই মুরতাদের বিধান আরোপ করা যাবে না। সে তো কোরআনের কথাই তার মুখে উচ্চারণ করেছে মাত্র। অন্য কোনো নবির নাম নিয়েও যদি বলে, যেমন- আমি মিল্লাতে নুহের ওপর আছি, তাহলে সেক্ষেত্রেও একই কথা। তবে একথা বলার কোনো অবকাশ নেই যে, আমি অমুক নবির শরিয়তের ওপর আছি। কেননা সকল নবির মিল্লাত একই। আর তা হলো ইসলাম। কিন্তু প্রত্যেকের শরিয়ত ভিন্ন ভিন্ন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ
আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র শরিয়ত এবং পথ নির্ধারণ করেছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে একই উম্মত বানিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি (পৃথক শরিয়ত এজন্য দিয়েছেন) যাতে তিনি তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন, তা দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। [সুরা মায়িদা— ৪৮]
স্মতর্ব্য যে— ১. মিল্লাত শব্দটি আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয় না। অনুরূপ কোনো উম্মাতির ওপরও এ শব্দ প্রয়োগ করা যাবে না। ‘মিল্লাতুল্লাহ’ বা ‘মিল্লাতে উসামা’ বলার কোনো অবকাশ নেই। ২. দ্বীন শব্দটি আল্লাহর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। তেমনি উম্মতের ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রেও তা প্রয়োগ করা যায়। কোনো নির্দিষ্ট ফেরকার ব্যাপারেও বলা যায়। দ্বীন শব্দটি মিল্লাত অর্থেও ব্যবহৃত হয়, আবার রূপক অর্থে শরিয়তের ব্যাপারে বা তার কোনো শাখাগত মাসআলার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়। [প্রয়োজনে দেখুন- তাফসিরে রুহুল মাআনি- ১/৩৭১]
মিল্লাতে ইবরাহিম নিয়ে আলোচনা কেনো প্রয়োজন
পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় রাসুলকে মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন—
ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
এরপর (হে নবি!) আমি ওহির মাধ্যমে তোমার প্রতি এই হুকুম অবতীর্ণ করেছি যে, তুমি মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসরণ করো, যে নিজেকে আল্লাহর অভিমুখী করে রেখেছিলো এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। [সুরা নাহল— ১২৩]
قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
(হে নবি!) বলে দাও, আমার প্রতিপালক আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করেছেন, যা বক্রতা থেকে মুক্ত দ্বীন— মিল্লাতে ইবরাহিম, যে একনিষ্ঠভাবে নিজেকে আল্লাহর অভিমুখী করে রেখেছিলো আর সে ছিলো না শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত। [সুরা আনআম— ১৬১]
রাসুলুল্লাহ সা. এর উম্মতকেও মিল্লাতে ইবরাহিমের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন—
فَاتَّبِعُوا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
সুতরাং তোমরা মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসরণ করো, যে ছিলো সম্পূর্ণ সঠিক পথের ওপর আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। [সুরা আলে ইমরান— ৯৫]
وَقَالُوا كُونُوا هُودًا أَوْ نَصَارَى تَهْتَدُوا قُلْ بَلْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
এবং তারা (ইহুদি ও খ্রিস্টানেরা মুসলমানদেরকে) বলে, তোমরা ইহুদি বা খ্রিস্টান হয়ে যাও, তবে সঠিক পথ পেয়ে যাবে। বলে দাও, বরং আমরা তো মিল্লাতে ইবরাহিম মেনে চলবো, যিনি যথাযথ সরল পথের ওপর ছিলেন। তিনি সেই সব লোকের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্যদেরকে শরিক করতো। [সুরা বাকারা— ১৩৫]
وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ
এবং তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো, যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে (তার দীনের জন্য) মনোনীত করেছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। নিজেদের পিতা ইবরাহিমের দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো। সে পূর্বেই তোমাদের নাম রেখেছে ‘মুসলিম’ এবং এ কিতাবেও (তোমাদের নাম তা-ই রাখা হয়েছে)। যাতে এই রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষী হতে পারে আর তোমরা সাক্ষী হতে পারো অন্যান্য মানুষের জন্য। [সুরা হজ— ৭৮]
যারা মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করে, তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَاتَّخَذَ اللَّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا
তার চেয়ে উত্তম দ্বীন আর কার হতে পারে, যে সৎকর্মপরায়নশীল হয়ে নিজেকে আল্লাহর সমুখে অবনত করেছে এবং একনিষ্ঠ ইবরাহিমের মিল্লাতের অনুসরণ করেছে! আর আল্লাহ ইবরাহিমকে খলিল (বিশিষ্ট বন্ধু) -রূপে গ্রহণ করেছেন। [সুরা নিসা— ১২৫]
যারা মিল্লাতে ইবরাহিম থেকে বিমুখ হয়, তাদেরকে ভৎসনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ
যে নিজেকে নির্বোধ সাব্যস্ত করেছে সে ছাড়া আর কে ইবরাহিমের মিল্লাত পরিহার করে! বাস্তবতা তো এই যে, আমি দুনিয়ায় তাকে বেছে নিয়েছি আর আখিরাতে সে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। [সুরা বাকারা— ১৩০]
মিল্লাতে ইবরাহিমকে ‘হানিফিয়্যাহ’ও বলা হয়। অসংখ্য হাদিসে এর কথা উল্লেখ হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّ الْأَدْيَانِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ؟ قَالَ: ” الْحَنِيفِيَّةُ السَّمْحَةُ ”
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় দ্বীন কোনটি? তিনি বললেন, সহজ সরল হানিফিয়্যাহ (মিল্লাতে ইবরাহিম)। [সহিহ বুখারি— ১/৯৩; আলআদাবুল মুফরাদ— ২৮৭; মুসনাদে আহমদ— ২১০৭]
إِنَّ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” لَتَعْلَمُ يَهُودُ أَنَّ فِي دِينِنَا فُسْحَةً، إِنِّي أُرْسِلْتُ بِحَنِيفِيَّةٍ سَمْحَةٍ ”
আয়িশা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ইহুদিরা অবশ্যই জানে যে আমাদের দীনে ব্যাপকতা ও সার্বজনীনতা আছে। নিশ্চয়ই আমি সহজ সরল হানিফিয়্যাহ (মিল্লাতে ইবরাহিম) সহ প্রেরিত হয়েছি। [মুসনাদে আহমদ— ২৪৮৫৫]
উপরিউক্ত আয়াত এবং হাদিসের দ্বারা মিল্লাতে ইবরাহিমের গুরুত্বের কথা অনুমিত হয়। কেউ কেউ এই আয়াত এবং হাদিসগুলো জেনে সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার অন্তরে প্রশ্ন জাগে— আমরা তো দীনে ইসলামের অনুসারী। আমাদের নবি তো হযরত মুহাম্মাদ সা.। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইসলামকে পরিপূর্ণ দ্বীন বলে উল্লেখ করেছেন। ইসলাম ছাড়া আর কোনো দ্বীন তার কাছে গ্রহণীয় নয় বলে ঘোষণা করেছেন। কোরআন বলছে, “যে ইসলাম ছাড়া অন্য যে-কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইবে, তার থেকে আল্লাহ কখনো তা গ্রহণ করবেন না এবং সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” তাছাড়া আমাদের শরিয়ত তো পূর্বের সকল শরিয়তকে রহিত করে দিয়েছে। এমনকি রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “যদি মুসা আ. জীবিত থাকতো, তবে আমার অনুসরণ করা ছাড়া তারও কোনো গত্যন্তর থাকতো না।”
এতোদসত্ত্বেও নবিজি সা. কে এবং আমাদেরকে মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণ করতে বলার, তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার নির্দেশ দেয়ার হেতু কী? মিল্লাতে ইবরাহিম আসলে কী? আমরা কি মিল্লাতে ইবরাহিম মেনে চলবো না ইসলাম মেনে জীবন পরিচালনা করবো? আর শুধু ইবরাহিম আ. এর মিল্লাত অনুসরণ করতে বলার পেছনে রহস্য কী? অন্যান্য নবিগণের নামও তো বলা যেতো। কেনো তা না করে শুধুই মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণ করতে বলা হলো? আমরা কীভাবে মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসারী হতে পারি? কীভাবে ইবরাহিম আ. এর আদর্শ আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি? হাঁ, সাধারণ পাঠকদের অন্তরে জাগ্রত হওয়া এসব প্রশ্নের সমাধানের জন্যই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস— “মিল্লাতে ইবরাহিম”। আল্লাহ তাআলা আমাদের এ প্রয়াসকে কবুল করুন। আমাদের সবার যিন্দেগিতে মিল্লাতে ইবরাহিম পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মিল্লাতে ইবরাহিমের পরিচয়
মিল্লাতে ইবরাহিমের অপর নাম হলো হানিফিয়্যাত। হানিফিয়্যাতের অনুসারী ব্যক্তিকে বলা হয় হানিফ। যার বহুবচন হুনাফা। হানিফ এবং হুনাফা শব্দদুটি পবিত্র কোরআনে সর্বমোট বারোবার উল্লেখিত হয়েছে। এরমধ্যে আটবার ইবরাহিম আ. এর সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় উল্লেখিত হয়েছে। {দেখুন— সুরা বাকারাঃ ১৩৫; সুরা আলে ইমরানঃ ৬৭, ৯৫; সুরা নিসাঃ ১২৫; সুরা আনআমঃ ৭৯, ১৬১; সুরা নাহলঃ ১২০, ১২৩}
কোরআনের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, মিল্লাতে ইবরাহিমের হাকিকত নিয়ে বহু গোষ্ঠী পারস্পরিক মতবিরোধ লালন করতো। যেমন— ইহুদিরা দাবি করতো, ইবরাহিম আ. ছিলেন একজন ইহুদি। অর্থাৎ মিল্লাতে ইবরাহিম মূলত ইহুদি ধর্ম। দাবির পক্ষে তারা প্রমাণ হিসেবে বলতো, ইহুদি জাতি হলো ইসহাক আ. এর সন্তান। আর ইসহাক আ. হলেন ইবরাহিম আ. এর পুত্র। যার ফল দাঁড়াচ্ছে, তারা পৈতৃক সূত্রে যে ধর্ম পেয়েছে, তাই ইবরাহিম আ. এর ধর্ম— মিল্লাতে ইবরাহিম।
একই দাবি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও করতো। তারা বলতো, ইসা আ. এর বংশধারা তাঁর মায়ের সূত্রে ইবরাহিম আ. এর সঙ্গে গিয়ে মিলেছে। তাই ইসা আ. যে ধর্মের দাওয়াত দিয়েছেন, তা মূলত তাঁর পিতা ইবরাহিম আ. এর ধর্মই। আর এরই নাম— মিল্লাতে ইবরাহিম। অর্থাৎ খ্রিস্টান সম্প্রদায় খ্রিস্টবাদকেই মিল্লাতে ইবরাহিম মনে করতো।
অপরদিকে মক্কার মুশরিকদের দাবি ছিলো, তারা যে আচাররীতি লালন করছে, তা-ই মূলত মিল্লাতে ইবরাহিম। কেননা আরবজাতির উৎপত্তি ঘটেছে জুরুহুম গোত্র থেকে, যমযম কূপের ঘটনার পর যারা যমযমের আশেপাশেই নিবাস গড়েছিলো। ইবরাহিম আ. এর পুত্র ইসমাইল আ. এই জুরহুম গোত্রেই বিয়ে করেছিলেন। তাই আরবরা পৈতৃক সূত্রে যে ধর্ম পেয়েছে, তাকেই তারা ইবরাহিম আ. এর দ্বীন তথা মিল্লাতে ইবরাহিম ভাবতো।
মহান আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার ১৩০-১৪০ এবং সুরা আলে ইমরানের ৬৫-৬৮ আয়াতে এই তিনও গোষ্ঠীর অসার দাবিকে খণ্ডন করেছেন। এবং তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, ইবরাহিম আ. এর দ্বীন ছিলো ইসলাম। বিকৃত ইহুদিবাদ ও খ্রিস্টবাদ কখনোই তার ধর্ম নয়। ইবরাহিম আ. কখনো শিরকেও লিপ্ত হননি। তাই উপরিউক্ত তিনও গোষ্ঠী মূলত নির্বোধ ছাড়া কিছু নয়। তারা ইবরাহিম আ. এর ওপর মিথ্যাচার বৈ কিছু করছে না; বাস্তবতার সঙ্গে যার ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই।
শুধু মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের নির্দেশ কেনো
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়— সকল নবির দ্বীন এবং মিল্লাত যদি একই হয়, ভিন্নতা যদি শুধু শরিয়তের মধ্যেই হয়, তাহলে এতো এতো নবি থাকতে বারবার ইবরাহিম আ. এর নাম কেনো উল্লেখ করা হলো? সকল নবির মিল্লাত যখন এক ও অভিন্ন, তাহলে আল্লাহ তাআলা কোরআনে বারবার কেনো আমাদেরকে শুধু মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণ করার ও তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার নির্দেশ দিলেন? একবারও কেনো মিল্লাতে নুহ, মিল্লাতে সুলায়মান, মিল্লাতে মুসা ইত্যাদির কথা বলেননি? এর রহস্য কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো—
১. কুরআনের বক্তব্যের প্রথম সম্বোধিত পাত্র ছিলো আরবরা। আর তারা ইবরাহিম আ.এর সাথে যেভাবে পরিচিত ছিলো, তেমনটি আর কারো সাথে ছিল না। তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও আকিদা-বিশ্বাসে যার ব্যক্তিত্বের প্রভাব সর্বব্যাপী ছিলো, তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম।
২. হযরত ইবরাহিম আ.-ই একমাত্র এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁর উন্নত চরিত্রের ব্যাপারে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান, আরবের মুশরিক ও মধ্যপ্রাচ্যের সাবেয়ি গোষ্ঠী তথা নক্ষত্র পূজারীরা- সবাই একমত ছিলো। নবিগণের মধ্যে দ্বিতীয় এমন কেউ ছিলেন না এবং নেই, যাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে সবাই অনুরূপ একমত হতে পারে।
৩. ইহুদিরা মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসারী হওয়ার দাবি করতো, যেহেতু তারা ইবরাহিম আ.এর পুত্র ইসহাক আ.এর বংশধর। খ্রিস্টানেরাও একই দাবি করতো, কেননা তাদের নবি ঈসা আ.এর বংশধারা তাঁর মা মারয়াম আ.এর সূত্রে ইবরাহিম আ.এর সাথে গিয়ে মিলেছে। মক্কার মুশরিকরাও মিল্লাতে ইবরাহিমের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি করতো, কারণ ইসমাইল আ. জুরহুম গোত্রে বিয়ে করেছিলেন- যামযামের ঘটনার পর থেকে যারা স্থায়ীভাবে আরবনিবাসী এবং তাদের পূর্বপুরুষ। আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার (১৩০-১৪০) আয়াতে তাদের দাবি খণ্ডন করেছেন এবং দাবির অসারতা খুলে খুলে বর্ণনা করেছেন। এরপর মুসলমানদেরকে মিল্লাতে ইবরাহিমের প্রকৃত অনুসারী বলে ঘোষণা করেছেন। তাদেরকেও অসার দাবি ছেড়ে প্রকৃত অর্থে মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসারী হওয়ার জন্য আহ্বান করেছেন।
৪. হযরত ইবরাহিম আ. এসব মিল্লাতের জন্মের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছেন। ইহুদিবাদ, খ্রিস্টবাদ ও সাবেয়িবাদ সম্পর্কে তো সবাই জানে যে, এগুলো পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত হয়েছে আর মক্কার মুশরিকদের ব্যাপারে বলা যায়, তারা নিজেরাও একথা স্বীকার করতো যে, তাদের সমাজে মূর্তি পূজা শুরু হয় আমর ইবনে লুহাই থেকে। সে ছিলো বনু খুযা’আর সরদার। মা’আব (মাওয়াব) এলাকা থেকে সে ‘হুবল’ নামক একটা মূর্তি নিয়ে এসেছিলো। তার সময়টা ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের বড়জোর পাঁচ-ছ’শ বছর আগের। কাজেই এ মিল্লাতটিও হযরত ইবরাহিম আ.এর শত শত বছর পরে উদ্ভাবিত হয়েছে। এ অবস্থায় কোরআন যখন বলছে- এ মিল্লাতগুলোর পরিবর্তে ইবরাহিম আ.এর মিল্লাত গ্রহণ করো তখন কোরআন আসলে এ সত্যটি জানিয়ে দিচ্ছে যে, যদি হযরত ইবরাহিম আ. সত্য ও হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে থাকেন (যা তোমরাও বিনা বাক্যব্যয়ে স্বীকার করো) এবং এ মিল্লাতগুলোর মধ্য থেকে কোনোটিই তার মিল্লাত না হয়ে থাকে, তবে তোমরা এগুলোর পেছনে কেনো ছুটছো! উপরন্তু যখন সেসব মিল্লাতের নবির তিরোধানের পর সেগুলোতে মারাত্মক রকমের বিকৃতি ঘটেছে ও মূল মিল্লাতের সিকিভাগই কেবল বাকি থেকেছে। তাঁর মিল্লাতই সত্য মিল্লাত। আর মুহাম্মাদ সা. এ মিল্লাতের দিকেই দাওয়াত দিচ্ছেন। তাই তোমরাও মিল্লাতে ইবরাহিম গ্রহণ করে ইহকাল ও পরকালে সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হও।
৫. ইবরাহিম আ. এর জীবনীতে সকল মুসলমানদের জন্য অনুপম কিছু আদর্শ রয়েছে। ইমান বিল্লাহ এবং কুফর বিত তাগুতের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টান্ত শুধু তিনিই। ইবরাহিম আ.এর কী শান! একা মানুষ পুরো কাওমের সাথে লড়েছেন! সবার সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন! এমনকি বাবার সাথেও! শক্তি-সামর্থ্য অর্জিত হবে, জনবল তৈরি হবে, কৌশলের সাথে এগোতে হবে, ক্ষেত্র তৈরি হবে, কিছুদিন তো হিকমাতের সাথে চলা উচিত- এমন কিছুই ভাবেননি তিনি! পরিণামের কথা চিন্তা করেননি! কাওমের সবগুলো ‘খোদা’ ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন, বড়টাকে রেখে সেটার গলায়ও কুড়াল ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছেন! ইমান ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই পুরো আল্লাহর দিকে অভিমুখী হয়েছেন, কুফর ও কুফফারের সাথে প্রকাশ্যে দৃপ্তকণ্ঠে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন! আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। কালবিলম্ব না করে ছেলের গলায়ই ছুড়ি চালানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছেন!
তার সন্তান মুহাম্মাদে আরাবি সা.ও তারই মূর্ত প্রতীক। মক্কায় শক্তি-সামর্থ্যের অপেক্ষা করেননি। আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তাওহিদের ঘোষণা দিয়েছেন। মূর্তিপূজার অসারতা খুলে খুলে বর্ণনা করেছেন। মুশরিকদের মাঝে থেকেই ওদের উপাস্যদেরকে মন্দ বলতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। ভাবেননি এদিকসেদিকের কিছু। যা বলেছেন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন; কারচুপি করে নয়। কিছুদিন তো শুধু সৎকাজের নির্দেশের ওপরই ক্ষান্ত থাকতে পারতেন। অসৎকাজ হতে নিষেধ আরো কিছুকাল পরেও শুরু করতে পারতেন। কিন্তু না। ইমান এনেই তাগুতের বিরুদ্ধে হুংকার ছেড়েছেন।জঙ্গে সাহাবিরা পেছনে ছুটছে। কারো নির্ভরতা ছাড়াই রাসুল এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। ঢুকে পড়ছেন বেষ্টনীর মধ্যে। মৃত্যুর কোনো ভয় নেই। বদরেও নেমেছেন মাত্র ৩০৫-৩০৮ নিয়ে। এরচে কম সংখ্যক সাথি থাকলে তা নিয়েই নেমে পড়তেন; অস্ত্র ছাড়াই সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবেলায়। খেজুরের ডালই শেষে পরিণত হয়েছে তরবারিতে। তাদের দৃষ্টি যমিনে ছিলো না; ছিলো আসমানে। আসবাবের ওপর নির্ভর করেননি কখনও। প্রচলিত হিকমাত যদি তারা অবলম্বন করতেন, তবে ইসলাম আর কোনোদিন পৃথিবীর আকাশে আলো বিকিরণ করতে পারতো না। আল্লাহু আকবার! আল্লাহর রাসুলদের শান! মিল্লাতে ইবরাহিম! জিহাদ বিলম্বিত হয়েছে। কিন্তু ‘আলবারা’ একমুহূর্তও বিলম্বিত হয়নি। উপরন্তু আলবারা ত্যাগের কারণে বনি ইসরাইলের বুযুর্গ সম্প্রদায়ও শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে। গুনাহ থেকে বারণ করেছে ঠিকই; কিন্তু পরে আবার তাদের সাথেই খাওয়াদাওয়া ওঠাবসা চলাফেরা আড্ডায় মেতে ওঠা অব্যাহত রেখেছেন। আল্লাহর আযাবও নেমে এসেছে তাদের ওপর। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন। যারা ফল পাকার প্রত্যাশায় বাগানে ফল এমনিই রেখে দেয়, তাদের আর ফল খাওয়া হয় না। সময়ের প্রতীক্ষায় থেকে থেকে সময় আর আসে না, আসবেও না।
মিল্লাতে ইবরাহিমের মূল বৈশিষ্ট্য
মিল্লাতে ইবরাহিমের মূল বৈশিষ্ট্য দুটি—
১. সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা।
২. শিরক এবং মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, শত্রুতার ঘোষণা দেয়া এবং প্রকাশ্যে তাগুতকে অস্বীকার করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন—
“তোমাদের জন্য ইবরাহিম এবং তার সঙ্গীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। স্মরণ করো ঐ সময়ের কথা, যখন তারা নিজ কাওমের লোকদেরকে বললো, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের উপাসনা করো, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনোই সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের (আকিদা-বিশ্বাস-নীতিমালা) অস্বীকার করি। আমাদের মধ্যে এবং তোমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেছে, যতোক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে।” {সুরা মুমতাহিনাঃ ৪}
মিল্লাতে ইবরাহিম তাওহিদে কাওলি এবং তাওহিদে আমলি (মৌখিক ও প্রায়োগিক তাওহিদ) -এর সমন্বিত রূপ। সুরা ইখলাস মৌখিক তাওহিদের শিক্ষা দেয় আর সুরা কাফিরুন আমলি তাওহিদের দীক্ষা দেয়। রাসুলুল্লাহ সা. এর জীবনীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই মিল্লাতে ইবরাহিমের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। জাবির রা. থেকে বর্ণিত সহিহ বুখারির এক দীর্ঘ হাদিসে বিবৃত হয়েছে, “মুহাম্মাদ ফারাকুন বাইনান নাস”— অর্থাৎ মুহাম্মাদ মানুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। সুরা নিসার তাফসিরে সহিহ বুখারিতেই বিবৃত হয়েছে, আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, কেয়ামতের দিন এক ঘোষক ঘোষণা দিবে, প্রত্যেক জাতি যেনো তার অনুসারী হয়, যার উপাসনা তারা করতো। ঘোষণার পর সকল মুশরিকরা তাদের উপাস্যদের সঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। স্রেফ ইমানদার বান্দারা ময়দানে থাকবে। তারা বলবে, হে আমাদের রব, আমরা দুনিয়াতে সে সময়ে মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম, যখন তাদের সাহায্য-সহায়তা আমাদের বড় প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তারা (মুশরিক হওয়ায়) আমরা তাদের সঙ্গ গ্রহণ করিনি।
রাসুলুল্লাহ সা. কে মদিনায় আনার পূর্বে আসআদ ইবনে যুরারা রা. মদিনাবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “হে ইয়াসরিববাসী, ধীরেসুস্থে ভেবে নাও, আজ রাসুলুল্লাহ সা. কে মক্কা থেকে বের করে আনার পরিণতি হবে সমগ্র আরববাসীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, তোমাদের নেতৃবর্গের নিহত হওয়া এবং তরবারির আঘাতে তোমাদের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। যদি তোমরা এসব বিষয় ভেবেই তাকে আনার ব্যাপারে মনস্থির করো, তাহলে তোমাদের প্রতিদান আল্লাহর যিম্মায়। আর যদি নিজেদের ব্যাপারে আশঙ্কাবোধ করো, তাহলে বাদ দাও। সিদ্ধান্ত স্পষ্টই জানিয়ে দাও। আল্লাহর কাছে তোমরা মাযুর বলে গণ্য হবে। {মুসনাদে আহমদ, বায়হাকি; হাফিজ ইবনে কাসির বলেন, সনদটা ইমাম মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ। ফাতহুল বারি গ্রন্থে হাফিজ ইবনে হাজার রহ. ও বর্ণনাটিকে হাসান বলেছেন।}
এজন্যই শায়খ আব্দুল লাতিফ আদদুরারুস সানিয়্যাহ গ্রন্থে বলেছেন, “এটা ভাবাই যায় না যে, কোনো ব্যক্তি তাওহিদ জানবে এবং তার ওপর আমল করবে অথচ সে মুশরিকদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে না। যে তাদের সঙ্গে শত্রুতা রাখবে না, তার ব্যাপারে বলাই হবে না যে, সে তাওহিদ জেনেছে এবং এর ওপর আমল করেছে।”
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। মা-শা-আল্লাহ অসাধারণ লিখেছেন।জাঝাকাল্লাহু খইরান।