র‍্যান্ড পরিচিতি

RAND Corporation। অ্যামেরিকান গ্লোবাল পলিসি থিংক ট্যাংক হিসেবে সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত পরিচিত এক নাম। RAND Corporation শব্দের বিস্তারিত রূপ হলো Research and Development Corporation। র‍্যান্ড কর্পোরেশন হলো অ্যামেরিকার একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান। এর কাজ হলো আমেরিকার অর্থনৈতিক, সামাজিক, সমরনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণী বা থিংক ট্যাংক হিসেবে গবেষণা করা। এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত আলোচনা-পর্যালোচনার পর যেকোনো ধরনের মার্কিন নীতি বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে অ্যামেরিকাকে সারাবিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জেনারেল হেনরি হাপ আর্নল্ডের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম RAND Corporation-এর যাত্রা সূচিত হয়। এরপর ক্রমে ক্রমে তার গ্রহণযোগ্যতা ও সুখ্যাতি বৃদ্ধি পেতে থাকে।

যাত্রার শুরুর দিকেই RAND Corporation সফলভাবে মহাশূন্যে রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে সারাবিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। এরপর ১৯৫৭ সালে মার্কিন বিমানবাহিনী RAND Corporation-এর প্রযুক্তি হায়ার করে মহাশূন্যে স্পাই স্যাটেলাইট তৈরি করতে সক্ষম হয়। এর নাম দেওয়া হয়েছিল Corona। মাত্র দুবছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবেলায় এই Corona অ্যামেরিকার সবচে মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হয়। এরই ভিত্তিতে Pravda নামক সোভিয়েত পত্রিকা RAND Corporation-এর নাম দেয় the academy of science and death and destruction। এভাবেই ১৯৬০ সালের মধ্যে RAND Corporation বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও অ্যামেরিকাসহ সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠে।

এরপর সময় গড়াতে থাকে। RAND Corporation-এর পরিধিও বিস্তৃত হতে থাকে। তখন আর তারা শুধু যুদ্ধের জন্য প্রযুক্তি-অনুসন্ধানের মধ্যে ক্ষান্ত না থেকে কীভাবে শত্রুপক্ষকে বিভক্ত করা যায়, কীভাবে জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে বিনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়—এসবের গবেষণা করতে থাকে। একেক দেশ ও জাতির জন্য তারা একেক ধরনের নীতি অনুসরণ করে; যাতে করে বিনা যুদ্ধে সেই দেশ ও জাতিকে অ্যামেরিকার কর্তৃত্বাধীন করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা মূলত RAND-এর গবেষণার বাস্তবায়ন মাত্র। মুসলিমরাও যাতে কখনো পরাশক্তি হয়ে উঠতে না পারে, সর্বদাই যেন তারা অ্যামেরিকার অধীনস্থ থাকে—সে লক্ষ্যে RAND বিপুল গবেষণা করে বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী রিপোর্টই বের করেছে।[1] অ্যামেরিকান গভর্নমেন্টের কাছে সেই অনুসন্ধানী রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর গভর্নমেন্ট তা বাস্তবায়ন করে চলছে। সেই ৬০-এর দশক থেকেই এভাবে তাদের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।

র‍্যান্ডের দৃষ্টিতে মুসলমানদের প্রকার

RAND নিজেদের অ্যাজেন্ডাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়নের সুবিধার্থে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের চার ভাগে ভাগ করে থাকে :

  1. ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিম : অর্থাৎ মৌলবাদী ও চরমপন্থী মুসলিম। এরা হচ্ছে সে সকল মুসলিম, যারা ইসলামকে শুধু কতক আচার-অনুষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত আচার-ইবাদতের ধর্ম মনে করে না; বরং ইসলামকে মনে করে এক পরিপূর্ণ দীন এবং মানবমুক্তির বিকল্পহীন জীবনব্যবস্থা। যারা চায় আল্লাহ তাআলার নাজিলকৃত বিধান দিয়ে শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করতে। চায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসরেও ইসলামকে একচ্ছত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এককথায়, তারা বিজয়ী ধর্মকে সবক্ষেত্রেই বিজয়ী রাখতে চায়। আল্লাহর ভূমিতে আল্লাহর শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরা হলো অ্যামেরিকার সর্বপ্রধান শত্রু। যেকোনো মূল্যে এদের বিনাশ করা অ্যামেরিকার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
  2. ট্রেডিশনালিস্ট মুসলিম : অর্থাৎ ঐতিহ্যবাদী মুসলিম। এরা হচ্ছে সে সকল মুসলিম, যারা ইসলামের ঐতিহ্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে রেখেছে। ইলমচর্চা, ধর্মপ্রচার এবং আত্মশুদ্ধিকেন্দ্রিক কাজগুলোকেই যারা ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে আছে। মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ নিয়ে পড়ে থাকাই যাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। অ্যামেরিকা এদের ঝুঁকি মনে করে না। এরা অ্যামেরিকান সভ্যতা-সংস্কৃতির জন্য হুমকি কিংবা ক্ষতিকর নয়। হ্যাঁ, তবে এরা যদি কোনোভাবে ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিমদের সঙ্গে মিলে যেতে পারে, তবে এরা অ্যামেরিকার জন্য বিপদ এবং মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য যেকোনো উপায়ে এদেরকে তাদের নিজ নিজ পরিমণ্ডলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কোনোভাবে ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিমদের সঙ্গে মিলতে দেওয়া যাবে না। বরং সাধ্যানুসারে উভয় দলের মধ্যে কোন্দল ও বিভেদ জিইয়ে রাখতে হবে।
  3. মডারেট মুসলিম বা মডার্নিস্ট মুসলিম : অর্থাৎ আধুনিকতাবাদী মুসলিম। এরা আদি ও আসল ইসলামকে সেকেলে মনে করে। তাই ইসলামকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে চায়, ইসলামের পরিমার্জিত সংস্করণ বের করতে চায়। এদের এসব ব্যাখ্যার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো, ইসলামকে প্রবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। ইসলামকে পাশ্চাত্য ধারার জীবনব্যবস্থা এবং তার সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা; যাতে করে ইসলামের ইতিবাচক দিকগুলোও পালন করা যায়, আবার প্রবৃত্তিপূজার অংশ হিসেবে নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যেও অংশগ্রহণ করা যায়। এদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার সুবাদেই বর্তমানে অস্তিত্বলাভ করেছে সবকিছুর ইসলামি (!) ভার্সন। ইসলামি মিউজিক, ইসলামি মদ, ইসলামি সুদ, ইসলামি জুয়া, ইসলামি পতিতালয়, ইসলামি সিনেমাহল, ইসলামি গণতন্ত্র, ইসলামি সমাজতন্ত্র প্রভৃতি।

মডারেট মুসলিমরা আল্লাহ তাআলার দীনকে পরিপূর্ণভাবে মানতে রাজি নয়; বরং তারা দীনের কেবল ততটুকু মানতে চায়, যতটুকু তাদের মনঃপুত হয়, যতটুকু মানতে তাদের কোনো কষ্ট-ক্লেশ সইতে হয় না কিংবা ত্যাগ-তিতিক্ষা করতে হয় না। এবং তা-ও কেবল সে উপায়েই মানতে চায়, যা তাদের সমাজে প্রচলিত কিংবা তাদের পূর্বসুরি বাপ-দাদাদের থেকে প্রাপ্ত। এ ছাড়া আল্লাহ তাআলার অন্যান্য বিধানগুলোকে তারা অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করে।

র‍্যান্ডের পলিসি সাজেশন হলো, মডারেট মুসলিমদের সাহায্য করতে হবে, এদের জন্য ফান্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। আর বিশেষভাবে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এদের প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এদের উল্লেখযোগ্য অবস্থান ও সবিশেষ গ্রহণযোগ্যতা নেই, তাই মিডিয়ার মাধ্যমে এদেরকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে; যাতে তাদের আহ্বান মানুষের কর্ণকুহরে পৌঁছে যায়।[2]

  • সেক্যুলারিস্ট মুসলিম : অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মুসলিম। এরা প্রথম থেকেই অ্যামেরিকার পকেটে রয়েছে। তাই এদের নিয়ে আলাদা চিন্তা বা মাথাব্যথা নেই। এরা কারও জন্য কোনো ঝুঁকির কারণ নয়। সেক্যুলারিস্ট মুসলিমরা মূলত মুসলিমই নয়। কারণ, তারা ইসলামকে কেবল ব্যক্তিজীবনে পালনীয় ধর্ম মনে করে এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা মনে করে। এদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি থাকবে ধর্মের বলয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এরাই মূলত তারা, যাদের সম্বোধন করে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশের প্রতি ইমান রাখো, আর কিছু অংশকে অস্বীকার করো? তোমাদের মধ্যে যে-কেউ এমনটা করবে তার শাস্তি এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, ইহকালে তাদের জন্য থাকবে লাঞ্ছনা আর কিয়ামত দিবসে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে ভয়াবহ শাস্তির দিকে। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে উদাসীন নন।’ (সুরা বাকারাহ)

আর প্রকাশ থাকে যে, ইসলাম গ্রহণ করার জন্য দীনের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি ইমান আনয়ন করতে হয়। কোনো একটি বিষয়ের প্রতি অস্বীকৃতি বা সংশয় থাকলে ব্যক্তি কখনো মুমিন হতে পারে না। অনুরূপভাবে একবার ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় ইসলামহারা হওয়ার জন্য দীনের প্রতিটি বিষয়কে অস্বীকার করতে হয় না, বরং যেমনিভাবে ওজু সম্পন্ন করার জন্য নিদেনপক্ষে চারটি অঙ্গ ধৌত করা লাগলেও ওজু ভঙ্গ হওয়ার জন্য ওজু ভঙ্গের কারণগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একটি কারণ পাওয়া যাওয়াই যথেষ্ট, একইভাবে ইসলাম নষ্ট হওয়ার জন্য দীনের অন্তর্ভুক্ত স্বীকৃত বিষয়সমূহের মধ্য থেকে যেকোনো একটি বিষয়ের প্রতি অস্বীকৃতি বা সংশয় পাওয়া যাওয়াই ইসলামহারা হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

প্রেক্ষিত : মডারেট ইসলাম প্রচার

২০০৩ সালে অ্যামেরিকান গ্লোবাল পলিসি থিংক ট্যাঙ্ক RAND Corporation একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। ঠিক কীভাবে ও কাদের সহায়তায় অ্যামেরিকার বৈশ্বিক পলিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নতুন ইসলাম প্রবর্তন করা যায়, Civil Democratic Islam: Partners, Resources & Strategies নামের এই রিপোর্টে তা আলোচিত হয়। অ্যামেরিকাবান্ধব এই নতুন ইসলামেরই নাম দেওয়া হয় ‘মডারেট ইসলাম’ বা Civil Democratic Islam। এরপর ২০০৭ সালে Building Moderate Muslim Networks নামে একটি বিস্তারিত ফলোআপ রিপোর্ট প্রকাশ করে RAND।

রিপোর্টগুলোতে মূলত ৩টি বিষয় আলোচিত হয় :

ক) কেন অ্যামেরিকাবান্ধব এই নতুন ইসলামের প্রবর্তন ও প্রচার করা উচিত?

খ) একজন মডারেট মুসলিমের বৈশিষ্ট্য কী হবে?

গ) কীভাবে মুসলমানদের মধ্যে এই মডারেট ইসলামের প্রচার ও প্রচলন ঘটানো যায়?

RAND এর এই রিপোর্টে বেশ কিছু সম্ভাব্য পলিসি নিয়ে আলোচনা করা হয়। তার মধ্যে একটি হলো, ইসলামের ব্যাপারে পুরনো ধ্যান-ধারণাকে ভেঙ্গে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ‘পশ্চিমা ইসলাম’, ‘অ্যামেরিকান ইসলাম’ ইত্যাদি ধারণাকে প্রমোট করা। তার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ পলিসি সাজেশান ছিল, মডার্নিস্ট ও মডারেট দায়ি ও আলিমদের চিহ্নিত করা, তাদেরকে বিশ্বব্যাপী প্রমোট করা এবং তাদেরকে দিয়ে নতুন নতুন বই ও কারিকুলাম তৈরি করা। এ ছাড়াও কীভাবে আপাত রক্ষণশীলদের (Conservatives) এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়েও রিপোর্টগুলোতে আলোচনা করা হয়।

পরবর্তীতে ২০১৩ সালে Promoting Online Voices for Countering Violent Extremism নামে তৃতীয় একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে RAND। এই রিপোর্টে মডারেট ইসলামের প্রচারের জন্য এবং প্রকৃত ইসলামি শিক্ষাকে (যেটাকে RAND কট্টরপন্থা বলে) মোকাবেলার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। কট্টরপন্থার বিপরীতে ‘সহিষ্ণুতা ও ক্ষমা’-এর শিক্ষা দেওয়া অনেক ‘মডারেট শায়খ’ এবং মুসলিম কমিউনিটি লিডার ও সংগঠনের নাম নির্দিষ্টভাবে এই রিপোর্টে আলোচিত হয়। RAND-এর পলিসি বাস্তবায়নে এ ধরনের ব্যক্তি ও সংগঠনের সোশ্যাল মিডিয়া উপস্থিতিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়েও আলোচনা করা হয় এই রিপোর্টে।

মডারেট ইসলামের লক্ষ্য

২০০৭ সালে RAND Corporation তাদের Civil Democratic Islam নামে যে রিপোর্টটি প্রকাশ করে, তাতে তারা লিখেছে :

‘গোটা মুসলিম বিশ্বে আজ তাদের তাদের নিজেদের মধ্যে একটি লড়াই চলছে। যে লড়াই মূলত বিশ্বাস ও মতাদর্শের লড়াই। এই লড়াইয়ের ফলাফলই নির্ধারণ করবে, মুসলিম বিশ্বের ভাগ্য কী হবে।’

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের চতুর্মাসিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে :

‘যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে এমনই এক যুদ্ধে লিপ্ত, যা একই সঙ্গে সামরিক ও আদর্শিক। এ যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় কেবল তখনই অর্জিত হওয়া সম্ভব, যখন চরমপন্থীদেরকে (মুজাহিদদেরকে) তাদের স্বজাতি, পরোক্ষ সমর্থক এবং নিজেদের দেশের জনগণের চোখে খারাপ ও কলঙ্কিত করে তোলা যাবে।’

ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে রয়েছে :

‘৯/১১-এর আক্রমণের পর বারবার ভুল পদক্ষেপ নিলেও ওয়াশিংটন এখন ঠিকই লক্ষ্যভেদী পাল্টা আক্রমণ হেনে যাচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের চেয়েও আরও ব্যাপক রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সামরিক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং সি.আই.এ-এর গোপন অভিযান পরিচালনাকারী দলগুলো মিডিয়া এবং বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রকাশ্যে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া আরম্ভ করেছে। ওয়াশিংটন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে এমন এক প্রচারণায়, যার উদ্দেশ্য কেবল মুসলিম সমাজকেই প্রভাবিত করা নয়; বরং স্বয়ং ইসলামকেই বিকৃত করে ফেলা।

‘ওয়াশিংটন গোপনে কমপক্ষে দুই ডজন দেশে অর্থ-সাহায্য দিয়ে আসছে। মডারেট ইসলামকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনে ইসলামি অনুষ্ঠান (!) প্রচার করা, মুসলিম স্কুলে বিভিন্ন কোর্স চালু করা, রাজনৈতিক কর্মশালা করা, মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ক্রয় করা, মসজিদ নির্মাণ, কুরআন ছাপা, ইসলামি স্কুল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ-সাহায্য দিয়ে আসছে।’

মডারেট মুসলিমের বৈশিষ্ট্য  

  1. একজন মডারেট মুসলিমকে গণতন্ত্রমনা হতে হবে। গণতন্ত্রমনা বলতে সেই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে, উদারনৈতিক পশ্চিমা ঐতিহ্যে গণতন্ত্র হিসেবে যা পরিচিত। গণতন্ত্রের সমর্থককে ইসলামি রাষ্ট্র-ধারণার বিরোধী হতে হবে। কোনো দল নিজেদের গণতান্ত্রিক দল দাবি করার অধিকার রাখবে না, যদি গণতন্ত্রকে তারা নিছক ক্ষমতায় আরোহণ ও সরকার গঠনের মাধ্যম মনে করে। যেমন : মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন (মুসলিম ব্রাদারহুড)।
  2. একজন মডারেট মুসলিমের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, অসাম্প্রদায়িক (ধর্মনিরপেক্ষ) আইন গ্রহণ করে নেওয়া। চরমপন্থী (প্রকৃত) মুসলিম এবং মডারেট মুসলিমের মধ্যে আসল পার্থক্য হলো শরিয়াহ আইনের বাস্তবায়ন চাওয়া এবং না চাওয়া।
  3. নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের (!) প্রতি সম্মান প্রদর্শন। সুতরাং হিজাব বাধ্যতামূলক করা নারী অধিকারে হস্তক্ষেপ করার নামান্তর। অমুসলিমদের ওপর জিযয়া কর আরোপ করা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
  4. সন্ত্রাসবাদ ও অবৈধ সহিংসতাবিরোধী হতে হবে।

এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য তারা একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করেছে। যার উত্তরের ভিত্তিতে তারা নির্ণয় করবে, কে মডারেট মুসলিম আর কে প্রকৃত মুসলিম। প্রশ্নগুলো নিম্নরূপ :

  • এই ব্যক্তি বা দল কি সহিংসতা (জিহাদ)-কে সমর্থন করে বা সেটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে? এখন সমর্থন না করলেও কি অতীতে কখনো সমর্থন করেছে বা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছে?
  • তারা কি গণতন্ত্রকে সমর্থন করে? করলে কি পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে নির্ধারিত ব্যক্তি অধিকারকে সমর্থন করে?
  • তারা কি (কুফফার গোষ্ঠী রচিত) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডকে সমর্থন করে?
  • এসব ক্ষেত্রে তারা কি কোনো ব্যতিক্রম করতে চায়? যেমন : ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে?
  • তারা কি বিশ্বাস করে যে, ধর্ম পরিবর্তন করা ব্যক্তিগত অধিকার?
  • তারা কি বিশ্বাস করে যে, শরিয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত ফৌজদারি দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন করা উচিত?
  • তারা কি মনে করে যে, তাদের রাষ্ট্রে শরিয়াহ বহির্ভূত পছন্দমাফিক অন্য কোনো আইনে বিচারপ্রার্থনার সুযোগ থাকা উচিত?
  • তারা কি বিশ্বাস করে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারও (!) একজন মুসলিম নাগরিকের সমান? তারা কি বিশ্বাস করে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরাও মুসলিম দেশে মুসলিম নাগরিকদের মতো সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেতে পারে?
  • তারা কি বিশ্বাস করে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা মুসলমানদের শাসিত দেশগুলোতে তাদের ধর্মের প্রচার-প্রসারের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারে?
  • এই ইসলামি রাষ্ট্র কি অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত কোনো আইনি ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে?

সিভিল ডেমোক্রেটিক ইসলামের প্রস্তাবনা

  1. মডারেট মুসলিমদের লেখা বই-পুস্তক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি ভর্তুকি দিয়ে প্রকাশ করা।
  2. সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে যুবক শ্রেণির জন্য বইপত্র রচনা করতে মডারেট মুসলিমদের উদ্বুদ্ধ করা।
  3. মডারেট মুসলিমদের মতাদর্শকে ইসলামি শিক্ষার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা।
  4. সংশ্লিষ্ট দেশের শিক্ষা-সিলেবাস ও প্রচারমাধ্যমে তাদের ইসলামপূর্ব জাহিলি সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে এর চর্চাকে উৎসাহিত করা।
  5. মুসলিম জনগণের মধ্যে সুফিবাদকে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
  6. বেআইনি অবৈধ দলসমূহ ও তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করা।
  7. তাদের সহিংস (জিহাদি) কর্মকাণ্ডগুলোর পরিণাম জনসমক্ষে তুলে ধরা।
  8. মৌলবাদী, চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের (মুজাহিদদের) প্রতি কোনো রকম সম্মান প্রদর্শন করা কিংবা তাদের কোনো প্রশংসা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  9. তাদেরকে জনগণের সামনে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং কাপুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে; প্রতিপক্ষের বীরযোদ্ধা হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।
  10. মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী (মুজাহিদ) ব্যক্তি ও সংগঠনের দুর্নীতি কপটতা ও অনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে তদন্ত করে (মিথ্যার প্রলেপ লাগিয়ে) তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট আরও বলেছে যে,

‘বিভিন্ন দেশে সিআইএ বর্তমানে বেশ কিছু অভিনব কার্যকরী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে জঙ্গি (মুজাহিদ) সংগঠনের সদস্য সংগ্রহকারী ও অ্যামেরিকাবিদ্বেষী আলিম-উলামাদের নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া।’

আলিম-উলামা পরিচয়ধারী লোকদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা আরেক জঘন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে। তারা প্রস্তাব করেছে,

‘তোমরা যদি দেখতে পাও যে, রাস্তার এক প্রান্তে মোল্লা ওমর একটি কাজ করছে, তাহলে রাস্তার অপর প্রান্তে তোমরা মোল্লা ব্র্যাডলিকে বসিয়ে দাও তার বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য।’

  1. মৌলবাদীদের মধ্যে দলাদলি ও বিভাজন সৃষ্টি করা।

আমাদের করণীয়

এ পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী হতে পারে, এ ব্যাপারে সুন্দর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন শহিদ আনওয়ার আওলাকি (রাহিমাহুল্লাহ) তার এক বক্তৃতায়।

  1. অ্যামেরিকা যদি প্রকাশ্যে নির্লজ্জের মতো ঘোষণা দেয় যে, তারা ইসলামকে বিকৃত করতে বদ্ধপরিকর, তাহলে আমাদেরও উচিত, নিজেদের দীন ও আদর্শকে এই কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই শয়তানদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া।

ইসলামের যেসব বিষয়কে এরা অপপ্রচারের মাধ্যমে বিতর্কিত করে ফেলেছে, আমাদের উচিত সেসব ব্যাপারে ইসলামের সঠিক বক্তব্যকে আপোষহীনতার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ও তা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি গোটা বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করা।

আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শরিয়াহভিত্তিক শাসন তথা খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে কথা বলা। কুফফার গোষ্ঠীর ল্যাবরেটরিতে উদ্ভাবিত সম্পূর্ণ কুফরি মতাদর্শ গণতন্ত্রের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের সামনে তুলে ধরা এবং ইসলামি শুরাব্যবস্থার সুফল ও কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করা। ইসলামি দণ্ডবিধি, হদ-কিসাস, ইসলামি ফৌজদারি আইন, বহুবিবাহ, নারী অধিকার ও মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য এবং আমাদের অবস্থান আপোষহীনভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা।

মুসলিম জনসাধারণ যেন পশ্চিমা কুফফার মিডিয়ার চক্রান্তের শিকার না হয়, তাদের মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডার দ্বারা প্রতারিত না হয়, সে জন্য এসব ব্যাপারে সততা, স্বচ্ছতা ও আমানতদারির সঙ্গে আপোষহীনভাবে হৃদয়গ্রাহী করে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরা এবং তা প্রচার করা।

  • অ্যামেরিকার যাবতীয় বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। কারণ, তারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যেকোনো উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে পিছপা হবে না। ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট তাদের নিবন্ধে লিখেছে,

‘মুসলিমদের পথভ্রষ্ট করার জন্য সম্ভাব্য যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে। এমনকি মিউজিক, কৌতুক, কবিতা, ইন্টারনেট ইত্যাদি সবকিছুর মাধ্যমে অ্যামেরিকার দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণযোগ্যভাবে গোটা আরব তথা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে।’

অতএব তাদের যেকোনো ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

  • এই কুফফার গোষ্ঠী যেহেতু সত্যিকার মুসলিমদের হেয়-প্রতিপন্ন করতে এবং তারা যে সত্যের পথে লড়াই করছে, সেই শুভ্রোজ্জ্বল পথকে বিতর্কিত করতে বদ্ধপরিকর, এ জন্য আমাদের ওপর আবশ্যক যে, আমরা সত্যপন্থী আলিম-উলামা ও দায়িদের পক্ষাবলম্বন করব এবং তাদের বক্তব্য বেশি বেশি প্রচার করব। তারা যদি আমাদের চিরন্তন আদর্শকে নস্যাৎ করতে চায়, তাহলে আমাদের উচিত হবে নিজেদের আদর্শের প্রচার-প্রসার ও তা প্রতিষ্ঠায় আরও বেশি আত্মনিয়োগ করা।
  • সত্যের বাণীসমৃদ্ধ যাবতীয় উপায়-উপকরণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। সত্যের মুখপত্র বই-পুস্তক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, পত্র-পত্রিকা, অডিও-ভিডিও, ওয়েবসাইট তথা যেকোনো উপায়-উপকরণকে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে বেশি থেকে বেশি প্রচার করা উচিত।
  • নিদেনপক্ষে আমাদের কথা ও সম্পদের জিহাদে অংশগ্রহণ করা উচিত। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘তোমরা সম্পদ, প্রাণ এবং কথার মাধ্যমে জিহাদ করো।’ সঠিকভাবে সত্যের প্রচারও জিহাদের একটি অংশ। …আল্লাহ তাআলা আমাদের বিজয় দান করবেন—এ কথা মনে করে আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। বরং আমাদের উচিত সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। ‘আত-তায়িফাতুল মানসুরা’ বা ‘আল-ফিরকাতুন নাজিয়া’র অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন। কারণ, বিদআতের প্রসারে এখন আর শুধু স্বল্প সামর্থ্যবান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোই নিয়োজিত নয়; বরং খোদ অ্যামেরিকা এবং তার দোসররা বিদআতের প্রচার-প্রসারে ব্যাপক অর্থায়ন শুরু করে দিয়েছে। অতএব হক ও বাতিলের এই আদর্শিক যুদ্ধে গোটা বিশ্ববাসীর সামনে সত্যকে তুলে ধরা সত্যপন্থীদের নৈতিক দায়িত্ব।

[1] উদাহরণস্বরূপ দ্রষ্টব্য :

  1. In Their Own Words, Voices of Jihad-
http://www.rand.org/pubs/monographs/2008/RAND_MG602.pdf
  • Civil Democratic Islam. Partners, Resources, and Strategies
http://www.rand.org/pubs/monograph_reports/MR1716/MR1716.pdf
  • Maritime Terrorism Risk and Liability
http://www.rand.org/pubs/monographs/2006/RAND_MG520.pdf
  • Counterinsurgency in Afghanistan
http://www.rand.org/pubs/monographs/2008/RAND_MG595.pdf
  • Radical Islam in East Africa
http://www.rand.org/pubs/monographs/2009/RAND_MG782.pdf
  • Beyond al qaeda. Part one. The Global Jihadist Movement
http://www.rand.org/pubs/monographs/2006/RAND_MG429.pdf
  • Beyond al qaeda. Part two. the Outer Rings of the Terrorist Universe
http://www.rand.org/pubs/monographs/2006/RAND_MG430.pdf
  • The Muslim World After 9/11
http://www.rand.org/pubs/monographs/2004/RAND_MG246.pdf

[2] মডারেট মুসলিমদের সম্পর্কে র‍্যান্ডের বিস্তর গবেষণা সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য দ্রষ্টব্য :

  1. Civil Democratic Islam
  2. Building Moderate Muslim Networks
Share This