রাসুলুল্লাহ সা.-এর বয়স তখন উনচল্লিশ বছর পেরিয়ে আরও ছয় মাস। তাঁর গুহায় ধ্যানমগ্নতার কাল হয়ে গেছে প্রায় আড়াই বছর। জাহিলিয়াতের প্রতি, জাহেলি মানুষগুলোর প্রতি, তাঁর পরবর্তী নবুওয়াতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোর প্রতি বেজায় রকম ঘৃণা জন্মেছে তাঁর অন্তরে। শৈশব থেকেই তিনি পৌত্তলিকতা এবং কাব্য-গীতির প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন—
‘যখন আমি বেড়ে উঠতে শুরু করি, তখন থেকেই মূর্তির প্রতি দ্বেষ ও ঘৃণা আমার অন্তরে গেঁথে দেয়া হয় এবং কাব্যের প্রতিও আমার অন্তরে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে দেয়া হয়।’[1]
নবি শব্দটি এসেছে ‘নাবাউন’ ধাতুমূল থেকে। সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ খবরকে আরবি ভাষায় ‘নাবাউন’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়; সাধারণ সংবাদ-খবরকে ‘নাবাউন’ বলা হয় না। নবিকে নবি এজন্যই বলা হয়, যেহেতু তিনি ওহির মাধ্যমে অবগত হয়ে গাইবের খবর প্রদান করেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবতার সঙ্গে শতভাগ সামঞ্জস্যপূর্ণ, মিথ্যের লেশও যার মধ্যে নেই।[2]
অধিকাংশ আলিমের মতানুসারে, রাসুলুল্লাহ সা.-কে নবুওয়াত প্রদান করা হয় কুরআনে বর্ণিত আবরাহার হস্তিবাহিনীর প্রসিদ্ধ ঘটনার একচল্লিশ বছর পর রবিউল মাসের আট তারিখে। এই রবিউল আউয়ালেই জন্ম হয়েছিলো প্রিয়নবি সা.-এর। ওফাতও হয়েছে এ মাসেই। নবুওয়াতপ্রাপ্তির সময় রাসুলুল্লাহ সা.-এর বয়স ছিলো চল্লিশ বছর।[3] তাঁর নবুওয়াতের সূচনা হয়েছিলো স্বপ্নের মাধ্যমে। জাগরণের অবস্থায় হেরা গুহায় জিবরিল আ. তাঁর ওপর যে ওহি নিয়ে আগমন করেন, তা অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে লাগাতার ছয় মাস তাঁকে স্বপ্ন দেখানো হয়। ইমাম বুখারি রহ. আয়িশা রা. থেকে বর্ণনা করেন—
‘রাসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি সর্বপ্রথম যে ওহি যা আসে, তা ছিলো ঘুমের মধ্যে যথাযথ স্বপ্ন। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর মতো প্রকাশ পেতো।’[4]
রবিউল আউয়াল থেকে সূচিত হয়ে এভাবে দীর্ঘ ছয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর হেরা গুহায় তাঁর ওপর সুরা ইকরার প্রথম যে পাঁচটি আয়াত অবতীর্ণ করা হয়, তা ছিলো একই বছরের রমজান মাসে, রোজ সোমবারে।[5]
হাফিজ ইবনু হাজার রহ. তার ফাতহুল বারি গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘ইমাম আবু নুয়াইম তার দালায়িলুন নুবুওয়াহ গ্রন্থে হাসান সনদে বর্ণনা করেন—
‘নবিগণকে সর্বপ্রথম স্বপ্ন দেখানো হয়। যখন তাঁদের অন্তর প্রশান্ত হয়ে যায়, তখন জাগ্রত অবস্থায় তাঁদের ওপর ওহি অবতীর্ণ করা হয়।’[6]
ইবনু আবি জামরা রহ. বলেন, ‘যথাযথ স্বপ্নকে ভোরের সাথে উপমা দেয়া হয়েছে এজন্য যে, তখনও নবুওয়াতের ভোরের সূর্য উদিত হয়নি। যেমনিভাবে সুবহে সাদিকের আলো সূর্যোদয়ের ভূমিকাস্বরূপ, তেমনি যথাযথ স্বপ্নও নবুওয়াত এবং রিসালাতের ভূমিকা।’[7]
এ ছাড়াও হাদিসের ভাষ্যানুসারে যথাযথ স্বপ্ন নবুওয়াতের অংশ।[8] সহিহ বুখারি এবং সহিহমুসলিমের হাদিসে এসেছে—
‘স্বপ্ন নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের[9] এক ভাগ।’[10]
নবিগণের স্বপ্ন সর্বদা সত্য হয়। তাঁদের স্বপ্নে মিথ্যের কোনো সম্ভাবনাই নেই, যেহেতু তা ওহি। আর ওহিতে কোনো ধরনের মিথ্যের লেশমাত্রও থাকে না, থাকা সঙ্গতও নয়। আল্লামা ইদরিস কান্ধলবি রহ. বলেন, ‘নেককার বান্দাদের স্বপ্নও সাধারণত সত্য হয়। হাঁ, কখনো তা হয় অর্থহীন বা দুশ্চিন্তাপ্রসূত স্বপ্ন কিংবা এলোমেলো অলীক স্বপ্ন। তবে এটা তুলনামূলক বিরল। পক্ষান্তরে পাপাচারী-পাপিষ্ঠদের স্বপ্ন প্রায়শই হয় অর্থহীন, হাঁ, কখনো তাদের স্বপ্নও হয় যথাযথ। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, “যে ব্যক্তি নিজের কথাবার্তায় সর্বাপেক্ষা সত্যবাদী, সে তার স্বপ্নেও সর্বাধিক সত্যবাদী।”’[11]
উল্লেখ্য, ‘যথাযথ স্বপ্ন’ বোঝানোর জন্য হাদিসে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো ‘আররুওয়াস সালিহাহ’। হাফিজ ইবনু হাজার রহ. বলেন, ‘অন্য বর্ণনায় রয়েছে ‘আররুওয়াস সাদিকাহ’। আখিরাতের বিবেচনায় এ দুটির অর্থ একই। তবে দুনিয়ার বিবেচনায় এ দুই শব্দের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। ‘সালিহাহ’ তথা যথাযথ শব্দটি ‘সাদিকাহ’ তথা সত্য শব্দের তুলনায় কিছুটা সীমিত অর্থবিশিষ্ট। নবির স্বপ্ন সবই ‘সাদিকাহ’ তথা সত্য। আর তার অধিকাংশই হয় ‘সালিহাহ’ তথা যথাযথ। তবে দুনিয়ার বিবেচনায় কখনো কখনো এমনও হয় যে, তা যথাযথ হয় না, যেমনটি ঘটেছিলো উহুদের দিনের স্বপ্নে।’[12] হাফিজ ইবনু হাজার রহ.-এর এই ব্যাখ্যাটি স্মরণ রাখলে সিরাতের স্বপ্নকেন্দ্রিক কোনো বিষয় নিয়ে ইন শা আল্লাহ কখনো সংশয় জাগবে না।
আয়িশা রা. বলেন—
‘এরপর তাঁর নিকট নির্জনতাকে প্রিয় করে তোলা হয়। তিনি হেরা গুহায় নির্জনে থাকতেন।’[13]
আয়িশা রা. এর পূর্বে স্বপ্নের কথাটি বলেন। ‘রাসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি সর্বপ্রথম যে ওহি যা আসে, তা ছিলো ঘুমের মধ্যে যথাযথ স্বপ্ন। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর মতো প্রকাশ পেতো।’ অর্থাৎ তিনি রাসুলুল্লাহ সা.-এর স্বপ্ন দেখার পরবর্তী ধাপ হিসেবে উল্লেখ করেন, ‘এরপর তাঁর নিকট নির্জনতাকে প্রিয় করে তোলা হয়। তিনি হেরা গুহায় নির্জনে থাকতেন।’ অথচ পাঠক ইতোপূর্বে জেনে এসেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সা. এরও আড়াই বছর পূর্ব থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এমনকি পুরো রমজান মাস তিনি সেখানেই ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকতেন। তো অবশ্যই তাঁর কাছে নির্জনে অবস্থান এবং ধ্যানমগ্নতা প্রিয় ছিলো বিধায়ই তিনি তা করতেন। তা হলে নতুন করে ‘তাঁর কাছে প্রিয় করে তোলা হয়েছে’ বলার অর্থ কী?
এখানে আয়িশা রা. একটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করছেন। রাসুলুল্লাহ সা. যদিও এরও অনেক পূর্ব থেকেই নির্জনতাপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু এ পর্যায়ে এসে তাঁর নির্জনতাপ্রিয়তায় প্রচুর পরিমাণ প্রবৃদ্ধি ঘটেছিলো। যেহেতু তখনও তাঁর নবুওয়াতের বিষয়টি শুধু স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো, চূড়ান্ত গুরুদায়িত্ব প্রদানের জন্য ইলাহি তারবিয়াতে তাঁর মানসজগতকে এজন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিলো, তাই বিষয়গুলো শুধু তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। অন্যরা এ বিষয়ে অবগত ছিলো না। তিনি নিজেও এ বিষয়টি পূর্ণভাবে ঠাহর করতে পারেননি। তবে তাঁর ভেতরে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছিলো। তিনি তখন প্রায় পুরোটা সময়ই নির্জনতায় কাটাতে ভালোবাসতে শুরু করেন। পূর্বের থেকেও তাঁর ধ্যানমগ্নতার পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক বেশি। কোন অজানা কারণে তাঁর সহসা এই পরিবর্তন তা কেউই যথাযথভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। ‘এরপর তাঁর নিকট নির্জনতাকে প্রিয় করে তোলা হয়।’ অর্থাৎ কোন বিষয়টি আচমকা তাঁকে এই পর্যায়ের নির্জনতাপ্রিয় করে তোলে, তা বোঝা যাচ্ছিলো না।
আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত এবং অনুগ্রহ লাভ করার জন্য নির্জনে থেকে একান্তচিত্তে তাঁর ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগী হওয়া এক অনন্য উপায়। কাহাফের সেই যুবকদের ঘটনায় কুরআন জানাচ্ছে—
তোমরা যখন তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা করে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তখন গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য নিজ রহমত বিস্তর করে দেবেন এবং তোমাদের বিষয়টা যাতে সহজ হয় সেই ব্যবস্থা করে দেবেন।’[14]
পবিত্র কুরআনে ইবরাহিম আ.-এর ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে—
‘আমি আপনাদের থেকে এবং আপনারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করেন তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছি। আমি আমার প্রতিপালককে ডাকতে থাকবো। আমি পরিপূর্ণ আশাবাদী যে, আমি আমার প্রতিপালককে ডেকে ব্যর্থকাম হবো না। যখন সে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকতো তাদের থেকে পৃথক হয়ে গেলো, তখন আমি তাকে (নেয়ামতস্বরূপ) ইসহাক ও ইয়াকুব দান করলাম এবং তাদের প্রত্যেককে নবি বানালাম।’[15]
প্রথম ওহি : সিরাত-এর বাকি অংশ পরবর্তী পর্বে ইন শা আল্লাহ
টীকা
[1] আলমাতালিবুল আলিয়াহ : ৪২০৩; ইতহাফুল খিয়ারাহ : ৭/১৬; আলমুসতাদরাক, ইমাম হাকিম : ৭৯৬৩; কানযুল উম্মাল : ৬/৩০৫
[2] নবুওয়াতের হাকিকতকে সুন্দরভাবে বয়ান করেছেন ইমামে রাব্বানি মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমাদ সারহিন্দি রহ.। দেখুন—মাকতুব : ৩৬৬, পৃ. ১১৮-১১৯
[3] এ মতটি বর্ণিত হয়েছে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা., জুবাইর ইবনু মুতইম রা., কাবাস ইবনু আশয়াম রা., আনাস ইবনু মালিক রা., আতা রহ., সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. প্রমুখ মনীষীদের থেকে। সিয়ার-আসারবিশারদগণের কাছেও এ মতটিই গৃহীত এবং প্রসিদ্ধ।
[4] সহিহ বুখারি : ৩
[5] সহিহ মুসলিম : ১১৬২; সুরা বাকারা : ১৮৫; যাদুল মাআদ : ১/৭৮; ফাতহুল বারি : ১/২৭; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ : ২/৩৪০; আররাওযুল আনফ : ১/৩৯৬
[6] ফাতহুল বারি : ১/৭
[7] সিরাতে মুস্তফা : ১/১৫০
[8] সহিহ মুসলিম : ৪৭৯
[9] এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা এসেছে। ইমাম নববি রহ. বলেন, ‘এ ব্যাপারে মৌলিকভাবে তিন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়: ১. সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ হলো, স্বপ্ন নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। ২. পঁয়তাল্লিশ ভাগের এক ভাগ। ৩. সত্তরভাগের এক ভাগ। কাজি রহ. বলেন, তাবারি রহ. এ দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, এই ভিন্নতা স্বপ্নদ্রষ্টার ভিন্নতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। নেককার মুমিনের স্বপ্ন হয় ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। আর বদকার মুমিনের স্বপ্ন হয় সত্তরভাগের এক ভাগ।’ (শারহুন নাবাবি থেকে সহিহ মুসলিমের ২২৬৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য) উল্লেখ্য, স্বপ্নের একাধিক প্রকার রয়েছে। সব প্রকারের বিধান এক নয়। তেমনি নবিদের স্বপ্ন আর অন্যদের স্বপ্ন এক নয়। সিদ্দিক এবং নেককার বান্দাদের স্বপ্ন আর অন্যদের স্বপ্নও এক নয়। সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদিতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য, স্বপ্ন নবুওয়াতের কয় ভাগের এক ভাগ—এ ব্যাপারে বর্ণিত বিভিন্নমুখী বর্ণনাগুলোর মধ্যে আরেক ধরনের সমন্বয় উল্লেখ করেছেন হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালি রহ. তার ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন গ্রন্থের ‘আলফাকর ওয়ায যুহ্দ’ অধ্যায়ে। আরও দেখুন—মাদারিজুস সালিকিন : ১/২৮
[10] সহিহ বুখারি : ৬৯৮৩, ৬৯৮৭, ৬৯৮৮, ৬৯৮৯, ৬৯৯৪, ৭০১৭, সহিহ মুসলিম : ২২৬৩, ২২৬৪, ২২৬৫
[11] সহিহ মুসলিম : ২২৬৩ ; সিরাতে মুস্তফা : ১/১৪৮-১৪৯
[12] ফাতহুল বারি : ১২/৩৩১-৩৩২ (সহিহ বুখারির ৬৫৮১ নম্বর বর্ণনার ব্যাখ্যায়)
[13] সহিহ বুখারি : ৩
[14] সুরা কাহাফ : ১৬
[15] সুরা মারয়াম: ৪৮-৪৯