প্রথম পর্ব
আমাদের একজন সম্মানিত ভাই এ বিষয়ে একটি সুদীর্ঘ প্রামাণিক পোস্ট করেছেন। সেখানে তার দাবি ছিল, ‘আল্লাহ তাআলা আরশে সমাসীন/উপবিষ্ট/উপবেশিত/অধিষ্ঠিত/বসা’ ইত্যাদি অনুবাদ করা শুদ্ধ ও যথার্থ। এতে আকিদার কোনো সমস্যা নেই। আমরা ইনশাআল্লাহ এ ব্যাপারে উদ্ধৃতি-সহকারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের স্বীকৃত আকিদার আলোকে আমাদের মতামত তুলে ধরব। তবে তার আগে আমরা মুহতারাম ভাইয়ের দাবির পক্ষে উল্লেখিত দলিলগুলোর পর্যালোচনা করব। ধারাবাহিকভাবে দলিলের পর্যালোচনা শেষ হওয়ার পর পয়েন্ট আকারে আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
মুহতারাম ভাই তার দাবির পক্ষে কয়েক ধরনের দলিল দিয়েছেন। কিছু দলিল ছিল হাদিস থেকে, কিছু ছিল আসার (সাহাবি-তাবেয়িন-তাবে তাবেঈনের বাণী) থেকে আর কিছু ছিল পরবর্তীদের উক্তি থেকে। এছাড়াও ভাষা অভিধানের উদ্ধৃতি এবং কিছু যুক্তিও তিনি উল্লেখ করার প্রয়াস পেয়েছেন। যেহেতু তার লেখাটি ছিল বেশ দীর্ঘ, তার পুরোটার পর্যালোচনা একসঙ্গে প্রকাশ করলে তা আরও কয়েকগুণ দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এত দীর্ঘ লেখা পড়তে অনেক পাঠকই খেই হারিয়ে ফেলেন। তাই আমরা পর্বাকারে লেখাগুলো প্রকাশ করব ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে আমরা কোনো বিন্যাস রক্ষা করব না। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য করব। এগুলো আপাতত খসড়া হিসেবে থাকবে। চূড়ান্ত ধাপে পরিমার্জিতরূপে পুরো লেখাটি একটি নিবন্ধের রূপ পরিগ্রহ করবে। এরপর আল্লাহ চাইলে তা আরও সংযোজিত হয়ে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হবে। যাহোক, এবার ফিরি মূল আলোচনায়। আজ আমরা প্রথম পর্বে শুধু তার দাবির পক্ষে উল্লেখিত চারটি হাদিসের মান বিশ্লেষণ করব। দাবি প্রমাণ হওয়ার জন্য দলিলগুলো উপযুক্ত কি না—তা যাচাই করে দেখব।
‘আল্লাহ তাআলা কুরসিতে বসা’র পক্ষে মুহতারাম ভাইয়ের উল্লেখিত দলিলসমূহের বিশ্লেষণ
প্রথম হাদিস
এ প্রসঙ্গে তিনি জিয়া মাকদিসি রহ.-এর আল-আহাদিসুল মুখতারা গ্রন্থের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন :
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ أَتَتِ امْرَأَةٌ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يُدْخِلَنِي الْجَنَّةَ فَعَظَّمَ الرَّبَّ ثُمَّ قَالَ إِنَّ كُرْسِيَّهُ وَسِعَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ وَإِنَّهُ يَقْعُدُ عَلَيْهِ.
‘উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক মহিলা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট এসে বলল, আল্লাহর নিকট দুআ করুন, যেন তিনি আমায় জান্নাতে প্রবেশ করান। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর যথাযথ মর্যাদা বর্ণনা করে বললেন, নিশ্চয়ই তাঁর কুরসি সব আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর তিনি তাতে উপবিষ্ট আছেন।’
উল্লেখ্য, মুহতারাম ভাই পুরো হাদিসটি উল্লেখ করেননি। হয়তো-বা অপ্রাসঙ্গিক মনে করার কারণে তিনি এর বাকি অংশ অনুল্লেখ রেখেছেন। তবে সেই অংশটা বেশ আকর্ষণীয় এবং হাদিসের হুকুম বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক। উল্লেখিত বর্ণনার পরবর্তী অংশ হলো :
مَا يَفْضُلُ مِنْهُ مِقْدَارَ أَرْبَعَ أَصَابِعَ… وَإِنَّ لَهُ أَطِيطٌ كَأَطِيطِ الرَّحْلِ الْجَدِيدِ إِذَا رُكِبَ مِنْ ثِقَلِهِ
(আল্লাহ বসার পর) কুরসির চার আঙুল পরিমাণ জায়গাও বাঁচেনি। …নতুন বাহনে চড়লে ভারের কারণে তা যেমন শব্দ করে, নিশ্চয়ই কুরসিরও সেরকম শব্দ রয়েছে।
হাদিসের মান
মুহতারাম ভাই হাদিসটি উল্লেখ করার পর লিখেছেন, ‘হাদিসটি ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল রহ.-ও বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন যে, এটা সহিহ হাদিস।’
এই মতটি উল্লেখ করার দ্বারা তিনি হয়তো সম্মানিত পাঠকবর্গকে এই ধারণা দিয়েছেন যে, হাদিসটি সহিহ। আর সহিহ হাদিসে আল্লাহ তাআলার শানে কোনো শব্দ প্রয়োগ করা হলে, কোনো মুসলমান অকাট্য দলিল ছাড়া কখনোই তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। কিন্তু শাস্ত্রজ্ঞ ইমামগণের বক্তব্যের আলোকে আমরা যাচাই করার চেষ্টা করব, হাদিসটি কি বাস্তবেই সহিহ? যদি সহিহ হয়, তাহলে এই শব্দ ব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞ ইমামগণ কেন আপত্তি করে গেলেন? তাহলে কি তারা হাদিস মানতেন না?
মুহতারাম ভাইয়ের কাছেও গ্রহণীয় ও বরণীয় মুহাদ্দিস শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানি রহ. তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ সিলসিলাতুল আহাদিসিয যয়িফা ওয়াল মাওজুআ গ্রন্থে (২/২৫৬-২৫৭, হাদিস, ৮৬৬) লেখেন :
وأما قعوده تعالى على العرش فليس فيه حديث يصح، ولا تلازم بينه وبين الاستواء عليه كما لا يخفى.
আল্লাহ তাআলা আরশে উপবিষ্ট হওয়ার ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস নেই। আর এটা তো স্পষ্ট বিষয় যে, তিনি আরশের ওপর ইসতিওয়া করা এবং তাতে বসার মধ্যে পারস্পরিক অপরিহার্যতার কোনো সম্পর্ক নেই।
এরপর শায়খ আলবানি রহ. লেখেন :
منكر. رواه أبو العلاء الحسن بن أحمد الهمداني في فتياله حول الصفات (100 / 1) من طريق الطبراني عن عبيد الله بن أبي زياد القطواني: حدثنا يحيى بن أبي بكير: حدثنا إسرائيل عن أبي إسحاق عن عبيد الله بن خليفة عن عمر بن الخطاب قال: أتت امرأة النبي صلى الله عليه وسلم فقالت: ادع الله أن يدخلني الجنة، فعظم الرب عز وجل، ثم قال: فذكره.
ورواه الضياء المقدسي في ” المختارة ” (1 / 59) من طريق الطبراني به، ومن طرق أخرى عن ابن أبي بكير به. وكذلك رواه أبو محمد الدشتي في ” كتاب إثبات الحد ” (134 – 135) من طريق الطبراني وغيره عن ابن أبي بكير به ولكنه قال: ” هذا حديث صحيح، رواته على شرط البخاري ومسلم “.
كذا قال: وهو خطأ بين مزدوج فليس الحديث بصحيح، ولا رواته على شرطهما، فإن عبد الله بن خليفة لم يوثقه غير ابن حبان، وتوثيقه لا يعتد به كما تقدم بيانه مرارا، ولذلك قال الذهبي في ابن خليفة هذا: ” لا يكاد يعرف “، فأنى للحديث الصحة؟ ! بل هو حديث منكر عندي…
وأما الله عز وجل فليس كمثله شيء جل جلاله، وتقدست أسماؤه، ولا إله غيره. (قال:) . ” الأطيط الواقع بذات العرش من جنس الأطيط الحاصل في الرحل، فذاك صفة للرحل وللعرش، ومعاذ الله أن نعده صفة لله عز وجل. ثم لفظ الأطيط لم يأت به نص ثابت “.
উপরিউক্ত দীর্ঘ বিশ্লেষণের সারকথা হলো, ‘এটি একটি মুনকার হাদিস। একজন এর ব্যাপারে বলেছেন, এটা নাকি সহিহ হাদিস; যার বর্ণনাকারীরা বুখারি ও মুসলিমের শর্তে উন্নীত। কিন্তু এটা জোড়াতালি দেওয়া সুস্পষ্ট ভুল কথা। এই হাদিসের বর্ণনাকারীরা বুখারি ও মুসলিমের শর্তে উন্নীত নয়। তাছাড়া হাদিসে যে প্রাণীর অনুরূপ শব্দের কথা বলা হয়েছে, এই শব্দ দ্বারা কোনো প্রমাণিত নস বিবৃত হয়নি।’
ইমাম ইবনুল জাওযি রহ. উপরিউক্ত হাদিসের মান বর্ণনা করতে গিয়ে লেখেন :
هذا حديث لا يصح عن رسول الله صلى الله عليه و سلم واسناده مضطرب جدا وعبدالله بن خليفه ليس من الصحابة فيكون الحديث الاول مرسلا وابن الحكم وعثمان لا يعرفان وتارة يرويه ابن خليفة عن عمر عن رسول الله صلى الله عليه و سلم وتارة يقفه على عمر وتارة يوقف على بن خليفة وتارة يأتي فما يفضل منه الا قدر اربعه اصابع وتارة يأتي فما يفضل منه مقدار اربعة اصابع وكل هذا تخليط من الرواة فلا يعول عليه
তার বক্তব্যের সারকথা হলো, এটি রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে প্রমাণিত কোনো বিশুদ্ধ হাদিস নয়। এর বর্ণনাসূত্রও বেশ স্ববিরোধী। এগুলো সবই বর্ণনাকারীদের পক্ষ থেকে উদ্ভূত বিভ্রান্তি। সুতরাং এর দিকে ভ্রূক্ষেপ করা হবে না।
সুতরাং বোঝা গেল, কেউ কেউ যদিও এই হাদিসটিকে সহিহ বলতে চেয়েছেন; কিন্তু মুহাদ্দিসগণের নীতি অনুসারে নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে এটি একটি অশুদ্ধ ও মুনকার বর্ণনা বলেই প্রতীয়মান হয়।
দ্বিতীয় হাদিস
মুহতারাম ভাই তার দাবি প্রমাণ করার জন্য দ্বিতীয়ত যে দলিল উল্লেখ করেন, তা ছিল এই, ‘ইমাম তাবারানি রহ. স্বীয় আল-মুজামুল কাবিরে বর্ণনা করেছেন :
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ زُهَيْرٍ التُّسْتَرِيُّ، حَدَّثَنَا الْعَلَاءُ بْنُ مَسْلَمَةَ، ثنا إِبْرَاهِيمُ الطَّالْقَانِيُّ، ثنا ابْنُ الْمُبَارَكِ، عَنْ سُفْيَانَ عَنِ ابْنِ حَرْبٍ، عَنْ ثَعْلَبَةَ بْنِ الْحَكَمِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لِلْعُلَمَاءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، إِذَا قَعَدَ عَلَى كُرْسِيِّهِ لِقَضَاءِ عِبَادِهِ: إِنِّي لَمْ أَجْعَلْ عِلْمِي، وحُكْمِي فِيكُمْ، إِلَّا وَأَنَا أُرِيدُ أَنْ أَغْفِرَ لَكُمْ، عَلَى مَا كَانَ فِيكُمْ، وَلَا أُبَالِي
‘সালাবা বিন হাকাম রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে যখন বান্দাদের বিচার করার জন্য কুরসিতে সমাসীন হবেন তখন তিনি আলিমদের লক্ষ করে বলবেন, আমি তোমাদের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আমার ইলম ও প্রজ্ঞা তোমাদের মধ্যে রেখেছিলাম। আর এতে আমি কারও পরোয়া করি না।’
হাদিসের মান
শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানি রহ. তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ সিলসিলাতুল আহাদিসিয যয়িফা ওয়াল মাওজুআ গ্রন্থে (২/২৫৭-২৫৮, হাদিস, ৮৬৭) উল্লেখিত হাদিসটি বর্ণনা করার পর তার বিশ্লেষণ করেন। আমরা তার বিশ্লেষণটি হুবহু উল্লেখ করছি :
موضوع بهذا التمام.
رواه الطبراني في ” المعجم الكبير ” (1 / 137 / 2) : حدثنا أحمد بن زهير التستري، قال: حدثنا العلاء بن مسلمة، قال: حدثنا إبراهيم الطالقاني، قال: حدثنا ابن المبارك عن سفيان عن سماك بن حرب عن ثعلبة بن الحكم مرفوعا.
ورواه أبو الحسن الحربي في ” جزء من حديثه ” (35 / 2) : حدثنا الهيثم بن خلف: حدثنا العلاء بن مسلمة أبو مسلمة أبو سالم: حدثنا إسماعيل بن المفضل، قال: أخبرنا عبد الله بن المبارك به.
قلت: وهذا سند موضوع فإن مداره على العلاء بن مسلمة بن أبي سالم، قال في ” الميزان “:
” قال الأزدي: لا تحل الرواية عنه، كان لا يبالي ما روى. وقال ابن طاهر: كان يضع الحديث، وقال ابن حبان: يروي الموضوعات عن الثقات “. وكذا في ” التهذيب “، فلم يوثقه أحمد ولذا قال الحافظ في ” التقريب “: ” متروك، ورماه ابن حبان بالوضع “.
وقد اختلف عليه في شيخه، فأحمد بن زهير سماه إبراهيم الطالقاني، والهيثم بن خلف سماه إسماعيل بن المفضل، وأيهما كان فإني لم أعرفهما.
ومع ظهور سقوط إسناد هذا الحديث، فقد تتابع كثير من العلماء على توثيق رجاله وتقوية إسناده، وهو مما يتعجب منه العاقل البصير في دينه، فهذا المنذري يقول في ” الترغيب ” (1 / 60) : ” رواه الطبراني في ” الكبير “، ورواته ثقات “.
ومثله وإن كان دونه خطأ قول الهيثمي في ” المجمع ” (1 / 26) : ” رواه الطبراني في ” الكبير ” ورجاله موثقون “. وذلك لأن قوله ” موثقون ” وإن كان فيه إشارة إلى أن في رجاله من وثق توثيقا غير معتبر مقبول، فهو صريح بأن ثمة من وثقه، وقد عرفت آنفا أنه متفق على تضعيفه!
وأبعد من هذين القولين عن الصواب قول الحافظ ابن كثير في ” تفسيره ” (3 / 141) : ” إسناده جيد “.
ونحوه قول السيوطي في ” اللآلي ” (1 / 221) : ” لا بأس به “، ثم حكى قول الهيثمي المتقدم. فهذا القول من ابن كثير والسيوطي نص في تقوية الحديث، وليس كذلك قول المنذري والهيثمي، أما قول الهيثمي فقد عرفت وجهه، وأما المنذري فقوله: ” رواته ثقات ” غاية ما فيه الإخبار عن أن سند الحديث فيه شرط واحد من شروط صحته، وهو عدالة الرواة وثقتهم، وهذا وحده لا يستلزم الصحة، لأنه لابد من اجتماع شروط الصحة كلها المذكورة في تعريف الحديث الصحيح سنده عند أهل الحديث.
والخلاصة أن الحديث موضوع بهذا السياق، وفيه لفظة منكرة جدا وهي قعود الله تبارك وتعالى على الكرسي، ولا أعرف هذه اللفظة في حديث صحيح، وخاصة أحاديث النزول وهي كثيرة جدا بل وهي متواترة كما قطع بذلك الحافظ الذهبي في ” العلو” (ص 53، 59) ، وذكر أنه ألف في ذلك جزءا.
وقد روي الحديث بدون هذه اللفظة من طرق أخرى كلها ضعيفة، وبعضها أشد ضعفا من بعض، فلابد من ذكرها لئلا يغتر بها أحد لكثرتها فيقول: بعضها يقوي بعضا! كيف وقد أورد بعضها ابن الجوزي في ” الموضوعات “؟! . اهـ.
এই বর্ণনাটি মাওজু (জাল)। আর এতে প্রচণ্ড আপত্তিকর একটি শব্দ রয়েছে, আর তা হলো ‘আল্লাহ তাআলা কুরসির ওপর উপবেশন করা’। কোনো সহিহ হাদিসে এই শব্দটি উল্লেখ হয়েছে বলে আমি জানি না। এই শব্দ ছাড়াও হাদিসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যার সবগুলো সূত্রই যয়িফ (দুর্বল)। একটি আরেকটির চাইতে অধিক দুর্বল। সুতরাং সেগুলো উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই, যাতে করে কেউ ধোঁকা খেয়ে এই কথা বলে না বসে যে, এর এক সূত্র অপর সূত্রকে শক্তিশালী করবে। আর তা কীভাবে সম্ভব! অথচ ইবনুল জাওযি রহ. তার ‘মাওজুআত’ গ্রন্থে এর কয়েকটি উল্লেখ করেছেন।
তৃতীয় হাদিস
মুহতারাম ভাই তার মতের পক্ষে তৃতীয় যে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন তা হলো, ‘ইমাম আবু বকর ইবনে আবি শাইবা রহ. বর্ণনা করেন :
أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ زَكَرِيَّا، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، عَنْ سَعْدِ بْنِ مَعْبَدٍ قَالَ: حَدَّثَتْنِي أَسْمَاءُ ابْنَةُ عُمَيْسٍ أَنَّ جَعْفَرًا جَاءَهَا إِذْ هُمْ بِالْحَبَشَةِ وَهُوَ يَبْكِي , فَقَالَتْ: مَا شَأْنُكَ؟ قَالَ: رَأَيْتُ فَتًى مُتْرَفًا مِنَ الْحَبَشَةِ جَسِيمًا مَرَّ عَلَى امْرَأَةٍ فَطَرَحَ دَقِيقًا كَانَ مَعَهَا , فَنَسَفَتْهُ الرِّيحُ , قَالَتْ: وَيْلٌ لَكَ يَوْمَ يَجْلِسُ الْمَلِكُ عَلَى الْكُرْسِيِّ فَيَأْخُذُ لِلْمَظْلُومِ مِنَ الظَّالِمِ
‘আসমা বিনতে উমাইস রা. বর্ণনা করেন, হাবশায় থাকাকালীন জাফর রা. কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কাছে আসলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে তোমার? তিনি (জাফর রা.) বললেন, একজন স্বাস্থ্যবান বিত্তশালী যুবককে একজন মহিলার পাশ দিয়ে যেতে দেখলাম। অতঃপর সে মহিলার কাছে থাকা ময়দা ফেলে দিলে তা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেল। তিনি (আসমা রা.) বললেন, দুর্ভাগ্য তোমার, যেদিন মহান রাজাধিরাজ কুরসির ওপর সমাসীন হবেন, অতঃপর মাজলুমের পক্ষ থেকে জালিমকে পাকড়াও করবেন।’
হাদিসের মান
পাঠক ওপরে শায়খ আলবানি রহ.-এর বক্তব্য পড়ে এসেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা আরশ বা কুরসির ওপর উপবেশন করা’র ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস নেই। তাই এই হাদিসটিও যে সহিহ নয়, তা শায়খের বক্তব্য থেকেই অনুমিত। হাদিসটির যয়িফ তিন ইল্লতের কারণে :
إسناده ضعيف لثلاث علل، وهي: عنعنة زكريا وهو مدلس، وسماعه من أبي إسحاق بعد الاختلاط، وجهالة ابن مَعْبَدٍ. وحذفه الألباني من “مختصر العلو” لنكارته. (رسالة ماجستير، كلية الدعوة وأصول الدين – جامعة أم القرى بمكة المكرمة، تحت إشراف: أ. د/ هشام بن إسماعيل الصيني)
ক. হাদিসের বর্ণনাকারী যাকারিয়া’র আনআনার কারণে। যাকারিয়া একজন মুদাল্লিস। তাই তার আনআনা হাদিসের মান দুর্বল করে দিয়েছে।
খ. যাকারিয়া এই হাদিসটি আবু ইসহাক থেকে শুনেছেন তার ইখতিলাতের পরে।
গ. হাদিসের আরেকজন বর্ণনাকারী ইবনু মা‘বাদ মাজহুল।
বর্ণনাটির এসব নাকারাতের কারণেই হয়তো শায়খ আলবানি রহ. তার সংকলিত মুখতাসারুল উলু থেকে হাদিসটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
আর এই সনদ বাদ দিয়ে যদি ভিন্ন সনদে হাদিসটি উল্লেখ করা হয়, তাতেও লাভ হবে না। কারণ, কোনো সনদ অনুসারেই ‘কুরসিতে উপবেশন করা’র কথাটি সহিহ নয়; বরং এটি শায। আর আকিদার এই মাসআলায় শায বর্ণনা গৃহীত হবে না।
চতুর্থ হাদিস
ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন :
حَدَّثَنِي أَبِي، نا وَكِيعٌ، بِحَدِيثِ إِسْرَائِيلَ عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ خَلِيفَةَ، عَنْ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: «إِذَا جَلَسَ الرَّبُّ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى الْكُرْسِيِّ» فَاقْشَعَرَّ رَجُلٌ سَمَّاهُ أَبِي عِنْدَ وَكِيعٍ فَغَضِبَ وَكِيعٌ وَقَالَ: أَدْرَكْنَا الْأَعْمَشَ وَسُفْيَانَ يُحَدِّثُونَ بِهَذِهِ الْأَحَادِيثِ لَا يُنْكِرُونَهَا
‘ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আল্লাহ তাআলা কুরসিতে উপবেশন করবেন…। এটা শুনে ইমাম অকি রহ.-এর দরসে এক ব্যক্তি কেঁপে উঠল। আমার পিতা আহমাদ রহ. তাঁর নামও বলেছেন। অকি রহ. (এটা দেখে) রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং বললেন, আমরা ইমাম আমাশ রহ., ইমাম সুফইয়ান রহ. প্রমূখ হাদিস শাস্ত্রবিদদের দেখেছি, তাঁরা এসব হাদিস (স্বাভাবিকভাবেই) বর্ণনা করতেন। এগুলোকে (কখনো) অস্বীকার করতেন না।’
হাদিসের মান
এই হাদিসের মান আমাদের পূর্বের আলোচনার আলোকেই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ে যাওয়ার কথা। এটি একটি অগ্রহণযোগ্য হাদিস; যা এক্ষেত্রে দলিলযোগ্য নয়। এই বর্ণনার ভাষ্য আদতে স্বতন্ত্র কিছু নয়। মুহতারাম ভাই এটাকে আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন হয়তো এর সঙ্গে সংযুক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করার জন্য। তো হাদিসই যখন মুনকার, তখন এর সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনাটি আমাদের আলোচনার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক। ওকি রহ.-এর প্রতিবাদের মূল কারণও ছিল হয়তো এই যে, হাদিস যদি সহিহ হয়, তা শুনে কারও উত্তেজিত হওয়া অনর্থক। তিনি হাদিসটিকে সহিহ ভেবেছিলেন। আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের হাদিস তারা পূর্বের যুগগুলোতে শুনতেন এবং বলতেন—সেই স্মৃতিও রোমন্থন করলেন। আমাদেরও কথা হলো, হাদিস সহিহ হলে এবং তার বক্তব্য অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলে তা মেনে নিতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু যেই শব্দের ব্যাপারে সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই, আকিদার সেনসিটিভ ইস্যুতে সে শব্দ প্রয়োগ করতে আমাদের ঢের আপত্তি রয়েছে। আপত্তির কারণ এক-দুটো নয়। সামনে ইনশাআল্লাহ এর বিস্তারিত আলোচনা আসবে।
দ্বিতীয় পর্ব
আমাদের লেখা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। যারা এসব লেখা পড়তে আগ্রহী নন, আমরা শুরুতেই তাদেরকে এ ব্যাপারে অনুৎসাহিত করেছি। কোনো বিষয়ের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সর্বসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করি না। তাই যাদের জন্য এই আলোচনা প্রয়োজনীয় নয়, তারা অনুগ্রহপূর্বক এই বিষয়ক পোস্টগুলো স্কিপ করে যাবেন। অযথা পোস্ট পড়ে নিচে এসে ‘কী দরকার ছিল’ টাইমের কমেন্ট করে বিরক্তির উদ্রেক করবেন না। দরকার আছে বলেই তো এত দীর্ঘ আলোচনা হচ্ছে। দরকার না থাকলে এত প্রয়োজনীয় কাজ ফেলে রেখে তো আর এটা নিয়ে পড়ে থাকার কোনো অর্থ ছিল না।
এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট করা দরকার, তিনি তো ‘ইসতিওয়া’ অর্থ ‘সমুন্নত হওয়া’ করেন; তবে ‘বসা’ ও ‘সমাসীন হওয়া’ অর্থকেও বাতিল বা গোমরাহি বলেন না। আর এটা তো স্রেফ তার অনুবাদ; আকিদা নয়।
আমরা বলব, ‘বসা’ বা ‘সমাসীন হওয়া’ অর্থ গ্রহণ করা স্পষ্ট ভুল, বাতিল বা গোমরাহি কি না—এ নিয়েই আমাদের আলোচনা। আমরা কোথাও বলিনি, মুহতারাম ভাই এই শব্দের অনুবাদে এটাকেই প্রাধান্য দেন অথবা তিনি এই আকিদা প্রচার করে বেড়ান। আমাদের কথা হলো, কুরআন মাজিদ প্রামাণিকতার বিচারে অকাট্য। কুরআন শুধু কিছু শব্দের নাম নয়; বরং শব্দ ও মর্ম উভয়ের সমষ্টির নামই কুরআন। যার কারণে এর শব্দে বিকৃতি ঘটানো যেমন কুফর, অর্থে বিকৃতি ঘটানোও কুফর। এ জন্যই তো যারা জিহাদের অপব্যাখ্যা করে, খতমে নবুওয়াতে বিকৃত মর্ম উপস্থাপন করে—যেমন, কাদিয়ানিরা—আমরা তাদেরকে মুসলিম নয়; বরং কাফিরই বলি।
এখন কথা হলো, কুরআনে যদি আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে কোনো সিফাত প্রয়োগ করা হয়, তাহলে অবশ্যই তা আমাদের আকিদারও অংশ হয়ে যায়। এই যে আপনারা যখন আকিদা যাচাইয়ের জন্য আপনাদের কোনো ভাইকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আল্লাহ কোথায়?’ সে বলে, ‘আল্লাহ আরশের ওপর সমুন্নত।’ এই কথা দ্বারা সে অনুবাদ করল নাকি আকিদা প্রকাশ করল? নিশ্চয়ই আকিদা প্রকাশ করল। আচ্ছা, এই আকিদা সে পেয়েছে কোথায়? আপনারাই বলবেন, কুরআন থেকে। আমি বলব, কুরআনে কি আরশের ওপর সমুন্নত হওয়ার কথা আছে নাকি তার ওপর ইসতিওয়া করার কথা আছে? আপনারাই বলবেন, এখানে ইসতিওয়া অর্থই সমুন্নত হওয়া। তার মানে, প্রথমে আপনারা আয়াতের অনুবাদ করেছেন। এরপর তার আলোকে আকিদা সাব্যস্ত করেছেন। আর স্বাভাবিকই হলো, একজন মুসলমান তার আকিদা গ্রহণ করবে কুরআন থেকে ও সহিহ সুন্নাহ থেকে।
তো এবার আসুন ‘সমাসীন হওয়া’ প্রসঙ্গে। যদি বলা হয়, এই অনুবাদ সঠিক; তা ভুল নয়, বাতিল নয়, তাহলে এর আলোকে প্রমাণিত হয়, আপনাদের প্রশ্ন ‘আল্লাহ কোথায়’-এর জবাবে আপনাদের কোনো ভাই যদি বলে, ‘তিনি আরশে সমাসীন’, তবে তা-ও অশুদ্ধ নয়; বরং কুরআনের আলোকেই যথার্থ। অর্থাৎ ‘সমুন্নত’ বললে উত্তম, তবে ‘সমাসীন’ বা ‘উপবিষ্ট’ বলারও সুযোগ রয়েছে; যেহেতু তা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। আর বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের অনেক সালাফি ভাই ‘আল্লাহ আরশে সমাসীন’-এ কথাটা দ্বিধাহীনভাবে বলেন ও প্রচার করেন। যদি তাদেরকে এই আকিদার উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তারা ‘ইসতিওয়া আলাল আরশ’ শীর্ষক আয়াতগুলো শুনিয়ে দেন। তো এবার বুঝলেন তো, এই অনুবাদকে বিশুদ্ধ বলা হলে তা কীভাবে আকিদাকে আক্রান্ত করে? আর এটা তো স্পষ্ট বিষয় যে, এই আয়াতগুলোতে কোনো আমল বর্ণিত হয়নি; বরং আকিদাই বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এর অনুবাদের ওপর ভিত্তি করেই আকিদা বেরিয়ে আসবে। আর সেই আকিদা লালন করার দ্বারাই একজন মুসলমানের পক্ষে এসব আয়াতকে আমলে পরিণত করা সম্ভব হবে। আকিদা লালন ছাড়া ভিন্ন কোনো উপায়ে এসব আয়াতকে আমলে পরিণত করা কীভাবে সম্ভব?
যাহোক, এটা একটা স্পষ্ট বিষয় ছিল; যা আলাদা করে স্পষ্ট করার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দুই পক্ষের কিছু অবুঝ ভাইয়ের কারণে স্পষ্ট করতে হলো। উল্লেখ্য, আমরা আমাদের পর্যালোচনা ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নেব। মুহতারাম ভাই আমাদের প্রথম পর্যালোচনার একটা অংশ নিয়ে দীর্ঘ বিশ্লেষণ করে তার ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। সেই লেখা আমাদের চোখে পড়েছে। ধারাবাহিকভাবে মূল পর্যালোচনা শেষ হওয়ার পর এজাতীয় পর্যালোচনার পর্যালোচনামূলক প্রতিটি লেখা নিয়েও আমরা ইনশাআল্লাহ রিভিউ করব; যেমনটা পূর্বে বিগত কয়েক বছর ধরে করে এসেছি। মূল আলোচনায় ছন্দপাত না ঘটানোর জন্য আপাতত প্রথম লেখাটির রিভিউকেই সমাপ্তির পথে এগিয়ে নেব। প্রাসঙ্গিক বা শাখাগত আলোচনায় জড়িয়ে মূল আলোচনা থেকে লাইনচ্যুত হব না ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে আমরা প্রথমে দেখাব, ‘ইসতিওয়া’র অনুবাদ হিসেবে ‘বসা’ বা ‘সমাসীন হওয়া’ শব্দ প্রয়োগ করা কোনোভাবেই সঠিক কি না? যদি সঠিক না হয়, তাহলে কেন সঠিক নয় আর এর অনুবাদপ্রসঙ্গে আমাদের করণীয় কী হবে?
পূর্বের পোস্টে আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল, ‘আল্লাহ তাআলা কুরসিতে বসা’র পক্ষে মুহতারাম ভাইয়ের উল্লেখিত দলিলসমূহের বিশ্লেষণ।’ আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো, ‘আল্লাহ তাআলা আরশে বসার ব্যাপারে উল্লেখিত দলিলসমূহের বিশ্লেষণ।’
এই দাবির পক্ষে মুহতারাম ভাই দশটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। যার প্রথম ছয়টি উক্তির নিসবত করা হয়েছে সালাফের দিকে। উল্লেখ্য, আমি সালাফ বলতে খাইরুল কুরুনকে বুঝে থাকি। খাইরুল কুরুনের যুগে যদি কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত থাকে, তাহলে তা মেনে নিতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই। সুতরাং আলোচ্য বিষয়ে তাদের থেকে যদি স্বীকৃত মতামত বর্ণিত থাকে, তাহলে অবশ্যই আমরা তা মেনে নেব। কিন্তু যদি তাদের নামে কোনো কিছু চালানো হয়, যা তাদের থেকে প্রমাণিত নয়, তাহলে আমরা তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করব। তো আমরা মুহতারাম ভাইয়ের আলোচনায় সালাফ থেকে ছয়টি উক্তি পেয়েছি এবং কাছাকাছি সময়ের আলিমদের থেকে আরও কিছু উক্তি পেয়েছি। পূর্বের পোস্টে আমরা দেখিয়েছি, ‘কুরআনে বা কোনো সহিহ হাদিসে আল্লাহর ব্যাপারে বসা বা সমাসীন হওয়া ইত্যাদি শব্দ বর্ণিত হয়নি।’ সুতরাং এ পোস্টে আমরা দেখব, খাইরুল কুরুন (সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়ি) থেকে এরকম কিছু বর্ণিত আছে কি না। যদি প্রথমটির মতো এটিও নাকচ হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তী দু-চারজন আলিমের বিচ্ছিন্ন মতামতের বিশ্লেষণ বোঝা পাঠকদের জন্য সহজ হবে।
প্রথম আসার
আলোচনার সুবিধার্থে আমরা প্রথমে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা.-এর আসারের তাহকিক উল্লেখ করব। মুহতারাম ভাই লেখেন, ‘ইমাম ইবনে কাইয়িম জাওজিয়া রহ. বলেন :
وَفِي تَفْسِيرِ السُّدِّيِّ عَنْ أَبِي مَالِكٍ وَأَبِي صَالِحٍ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى} [طه: 5] قَالَ: قَعَدَ.
‘তাফসিরে সুদ্দিতে আবু মালিক রহ. ও আবু সালিহ রহ. সূত্রে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত যে,الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى আয়াতটির অর্থ হলো, তিনি আরশে সমাসীন হলেন।’ (ইজতিমাউল জুয়ুশিল ইসলামিয়্যা : ২/২৫১, প্রকাশনী : মাতাবিউল ফারাজদাকিত তিজারিয়্যা, রিয়াদ)
আসারের মান
মুহতারাম ভাই আসারটি নিয়েছেন ‘ইজতিমাউল জুয়ুশিল ইসলামিয়্যা’ গ্রন্থ থেকে। আলোচ্য গ্রন্থের তাহকিক যারা করেছেন, সেসব মুহাক্কিকগণ এই আসারটি উল্লেখ করে এর মান কী বর্ণনা করেছেন, প্রথমে তা দেখা দরকার। আর এমনটা তো স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা নয় যে, মুহতারাম ভাই আসারটি উল্লেখ করেছেন; কিন্তু তার টীকায় এর মান কী লেখা হয়েছে, তার দিকে একবারও তার নজর পড়েনি। আলোচ্য গ্রন্থটির একাধিক সংস্করণ রয়েছে। دار عالم الفوائد – مكة المكرمة থেকে প্রকাশিত সংস্করণের মুহাক্কিক শায়খ زائد بن أحمد النشيري এই আসারের টীকায় লেখেন :
لم أقف عليه. والسند ضعيف.
এই আসারটির ব্যাপারে আমি অবগত হইনি। (অর্থাৎ, এটা খুঁজেই পাইনি)। আর সনদটি যয়িফ (দুর্বল)।
মুহতারাম ভাই আলোচ্য কিতাবের যেই সংস্করণ থেকে রেফারেন্স দিয়েছেন, এর মুহাক্কিক ড. আওয়াদ আবদুল্লাহর বক্তব্যে বিষয়টি আরও বিস্তৃতভাবে উল্লেখিত হয়েছে :
لقد بحثت عن تفسير السدي، فلم أعثر عليه. ثم بحثت عن هذا القول في تفسير ابن عباس وغيره من كتب التفسير، فلم أقف عليه. فلعله محرف عن صعد كما ورد عن ابن عباس.
আমি সুদ্দি রহ.-এর উক্ত তাফসির (ব্যাখ্যা) খোঁজ করেছি; কিন্তু তা খুঁজে পাইনি। এরপর তাফসিরে ইবনু আব্বাস রা. ও অন্যান্য তাফসিরের গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.-এর উক্তিটি খুঁজলাম। তা-ও পেলাম না। সম্ভবত এটি صعد শব্দ থেকে বিকৃত হয়ে হয়েছে; যেমনটা ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত রয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে ‘ইসতাওয়া’র ব্যাখ্যায় صعد বর্ণিত হয়েছে। صعد এবং قعد শব্দ দুটো খুব কাছাকাছি। শুধু প্রথম অক্ষরের পার্থক্য। সম্মানিত মুহাক্কিক আশঙ্কা ব্যক্ত করলেন, কোথাও যেহেতু এটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে সম্ভবত ‘সোয়াদ’ অক্ষরটি কোনোভাবে বিকৃত হয়ে তাফসিরে সুদ্দিতে ‘ক্বাফ’ হয়ে গেছে। এরপর তিনি صعد শব্দটি ইবনু আব্বাস রা. সূত্রে কোথায় কোথায় বর্ণিত হয়েছে, তার একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন।
তারচে আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মুহতারাম ভাই আসারটি বর্ণনা করেছেন সুদ্দি’র রেফারেন্সে। অথচ সুদ্দি একজন মাতরুক রাবি। তার বর্ণনা দলিলযোগ্য নয়। ইমাম বায়হাকি রহ. তার ‘আল-আসমা ওয়াস সিফাত’ (১/৫৭২) গ্রন্থে লেখেন :
وأبو صالح هذا والكلبي ومحمد بن مروان كلهم متروك عند أهل العلم بالحديث، لا يحتجون بشيء من رواياتهم لكثرة المناكير فيها، وظهور الكذب منهم في رواياتهم.
এই আবু সালেহ, কালবি ও মুহাম্মাদ ইবনু মারওয়ান (সুদ্দি)—এরা সবাই হাদিসশাস্ত্রের জ্ঞানের অধিকারী আলিমগণের দৃষ্টিতে মাতরুক (পরিত্যাজ্য)। তাদের কোনো বর্ণনা দ্বারা প্রমাণ পেশ করা যাবে না; কারণ, সেগুলোর মধ্যে প্রচুর মুনকার রেওয়ায়াত (বর্ণনা) রয়েছে এবং তাদের রেওয়ায়াতে তাদের থেকে বানোয়াট মিথ্যা প্রকাশিত রয়েছে।
সুদ্দি’র রেফারেন্সে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.-এর তাফসির উল্লেখ করা কোনো মুহাক্কিক আহলে ইলমের শান নয়। কারণ, সুদ্দি নিজে যেমন একজন জাল বর্ণনাকারী, যে সনদে সে তার এই তাফসির সংকলন করেছে তা-ও চূড়ান্ত পর্যায়ের ফালতু সনদ। ইমাম সুয়ুতি রহ. তাদরিবুর রাবি (১/১৮১) গ্রন্থে লেখেন :
وأما أوهى أسانيد ابن عباس مطلقا فالسدى الصغير محمد بن مروان عن الكلبي عن أبي صالح عنه قال شيخ الإسلام هذه سلسلة الكذب لا سلسلة الذهب
সাধারণভাবে ইবনু আব্বাস রা.-এর সবচে অমূলক সনদ হলো, মুহাম্মাদ ইবনে মারওয়ান সুদ্দি সূত্রে কালবি হয়ে আবু সালেহ থেকে ইবনু আব্বাস রা.-এর বর্ণনা। শাইখুল ইসলাম রহ. বলেন, এটা মিথ্যার বর্ণনাসূত্র; স্বর্ণের বর্ণনাসূত্র নয়।
উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে আল্লাহ তাআলা ব্যাপারে ‘বসা’ শব্দ বর্ণিত হয়নি। এটি তার নামে স্পষ্ট মিথ্যাচার। মুহতারাম ভাই আসারটি যেই গ্রন্থের রেফারেন্সে উদ্ধৃত করেছেন, সেই গ্রন্থের মুহাক্কিকরাই এর ওপর চরম আপত্তি করেছেন। যার দুটো নমুনা আমরা ওপরে উল্লেখ করেছি। এছাড়াও সাক্কাফ বলেন :
هذا كذب على ابن عباس، لا قيمة له.
এটা আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.-এর ওপর মিথ্যারোপ; যার কোনো বিবেচনা নেই।
সুতরাং এটাকে সাধারণ যয়িফ বলেও চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই; বরং এটি একটি মিথ্যা বর্ণনা। যা ইবনু আব্বাস রা.-এর নামে চালানো হয়েছে। আর মুহতারাম ভাইয়ের লেখায়ও অসতর্কতাবশত চলে এসেছে।
কেউ বলতে পারেন, তিনি তো এ প্রসঙ্গে ইমাম যাহাবি সূত্রে একটি বর্ণনাও উল্লেখ করেছেন। আমরা বলব, হাদিস ও আসার বিবেচিত হয় সনদ দ্বারা। যাহাবি এই আসারটিকে কোনো সনদে ইবনু আব্বাস রা. থেকে উদ্ধৃত করেননি। তিনি কেবল এ প্রসঙ্গে একজন ব্যক্তিত্বের অভিমত বর্ণনা করেছেন। শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের দলিলশূন্য অভিমতের কোনো মূল্য নেই। ‘সনদ দীনের অংশ। যদি সনদ না থাকত, যার যা ইচ্ছা তা বলত’। সুতরাং এই আসারটিকে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.-এর দিকে নিসবত করতে হলে অবশ্যই সহিহ সনদ উপস্থাপন করতে হবে; কিন্তু যা আদৌ সম্ভব নয়।
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় আসার
মুহতারাম ভাই তার মতের পক্ষে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. সূত্রে একটি আসার বর্ণনা করেছেন। তিনি লেখেন, আল্লামা উসমান বিন আব্দুল আজিজ তামিমি রহ. বলেন :
قال الحكم بن معبد في كتاب الرؤيا: ثنا موسى بن عبد الرحمن المسروقي، ثنا روح بن عبادة، عن حماد بن سلمة، عن عطاء بن السائب، عن الشعبي، عن عبد الله رضي الله عنه أنه قال: {الرحمن على العرش استوى}، فقال: جلس.
‘ইমাম শাবি রহ. সূত্রে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى এর অর্থ হলো, তিনি উপবেশন করলেন।’
আসারের মান
মুহতারাম ভাই তার উল্লেখ করা রেফারেন্স অনুসারে উপরিউক্ত আসারটি বর্ণনা করেছেন ‘ফাতহুল হামিদ’ গ্রন্থ থেকে। এই গ্রন্থের অনেকগুলো সংস্করণ রয়েছে। তিনি তার রেফারেন্স হিসেবে যে সংস্করণটি গ্রহণ করেছেন, তার বিবরণ নিজেই দিয়েছেন, ‘প্রকাশনী : দারু আলামিল ফাওয়াইদ, মক্কা’। আমরা সেই গ্রন্থটি খুলে দেখেছি। সেখানকার টীকায়ই গ্রন্থের সম্মানিত মুহাক্কিকদ্বয় এর মান বর্ণনা করে দিয়েছেন; হয়তো-বা অসতর্কতাবশত মুহতারাম ভাইয়ের নজরে তা পড়েনি। তারা লেখেন :
لم أعثر عليه في مظانه، وفي الإسناد الذي ساقه المصنف حماد بن سلمة، وهو ثقة اختلط بأخرة. ونقل ابن حجر في التهذيب (3/14) عن البيهقي قوله: أحد أئمة المسلمين، إلا أنه لما كبر ساء حفظه، لذا تركه البخاري. وأما مسلم فاجتهد فأخرج من حديثه عن ثابت ما سمع منه قبل تغيره، وما سوى حديثه عن ثابت لا يبلغ اثني عشر حديثا أخرجها في الشواهد.
এই আসারটি সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে পাইনি। আর লেখক যেই সনদে এটি উল্লেখ করেছেন, তাতে হাম্মাদ ইবনু সালামা নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। তিনি এমন একজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী, যার শেষজীবনে ‘ইখতিলাত’ (স্মৃতিভ্রম) হয়েছিল। ইবনু হাজার রহ. ‘আত-তাহযিব’ গ্রন্থে বায়হাকি রহ. থেকে উল্লেখ করেন, হাম্মাদ ইবনু সালামা মুসলমানদের একজন ইমাম। তবে যখন তিনি বৃদ্ধ হলেন, তার স্মরণশক্তি খারাপ হয়ে গেল। এ জন্য ইমাম বুখারি রহ. তাকে পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম মুসলিম রহ. পরিশ্রম করে সাবিত রহ. সূত্রে তার বর্ণিত হাদিসগুলো বের করে এনেছেন, যেগুলো তিনি তার অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার আগে তার থেকে শুনেছিলেন।…
মুহাক্কিকদ্বয়ের কথা এখানেই শেষ নয়। এরপরও তারা নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছেন, যার সারকথা হলো, হাম্মাদ এই আসারটি বর্ণনা করেছেন আতা ইবনুস সায়িব থেকে। শেষজীবনে আতা’র স্মরণশক্তিতেও সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এ জন্য শেষ সময়ে যারা তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, মুহাদ্দিসগণ সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন। হাম্মাদ কখন তার থেকে হাদিস শুনেছেন—এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারও মত এমনও রয়েছে যে, তিনি দু-বার তার থেকে হাদিস শুনেছেন। একবার সুস্থাবস্থায়, আরেকবার মতিভ্রম ঘটার পর। যদি এই মতকে শুদ্ধ ধরা হয়, তাহলেও এই বর্ণনাটি গ্রহণ করার সুযোগ থাকবে না। কারণ, হাম্মাদ আলোচ্য বর্ণনাটি কোন অবস্থায় শুনেছেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে; যা হাদিসের বিশুদ্ধতার পথে অন্তরায়।
এছাড়াও সনদে যে সমস্যা রয়েছে তা হলো, শা‘বি রহ. হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আবদুল্লাহ থেকে। এই আবদুল্লাহ কে? মুহতারাম ভাই ধরে নিয়েছেন, এই আবদুল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা.। যদি এটা মেনে নিই, তাহলে সমস্যা হলো, শা‘বি আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে হাদিস শোনেননি। তার মানে এটা ‘মুনকাতি’ (বিচ্ছিন্ন) সনদ। আর যদি বলা হয়, অন্য কোনো আবদুল্লাহ উদ্দেশ্য, তাহলে সেই আবদুল্লাহ কে? তার পরিচয় কী? মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে তার অবস্থান কেমন? সে এই মত কোথায় পেল? কার থেকে বর্ণনা করল? এজাতীয় অনেক প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যাবে। সব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর বেরিয়ে আসলেও লাভ নেই। কারণ, সনদের অন্যান্য অংশেও সমস্যা বিদ্যমান। তাছাড়া হাদিস ও আসারের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে এর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তৃতীয় ও চতুর্থ আসার
মুহতারাম ভাই হাসান বসরি ও ইকরিমা রহ.-এর আসার উল্লেখ করেন, ‘আল্লামা উসমান বিন আব্দুল আজিজ তামিমি রহ. বলেন :
قال الحكم بن معبد في كتاب الرؤية: حدثنا محمد بن حاتم، ثنا الفضل بن عباس، ثنا عبد الرحمن بن ثابت، عن يزيد بن هارون، عن عباد بن منصور، قال سألت الحسن وعكرمة، عن قوله {الرحمن على العرش استوى} قالا: جلس.
‘আব্বাদ বিন মানসুর রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হাসান বসরি রহ. ও ইকরামা রহ.-কে الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى এর অর্থ জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁরা উভয়ে উত্তরে বললেন, এর অর্থ হলো, তিনি সমাসীন হলেন।’
আসারের মান
পূর্বের আসারটির মতো মুহতারাম ভাই এই দুটো আসারও ‘ফাতহুল হামিদ’ গ্রন্থের রেফারেন্সে উল্লেখ করেছেন। এখানেও তিনি এই আসার দুটোর মান সম্পর্কে সম্মানিত মুহাক্কিকদ্বয় কী বলেছেন, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার কসরত করেননি। এই তাড়াহুড়ার রহস্য আমাদের বোধগম্য নয়। আর এটা তাহকিকের নীতিও নয়। আসারের টীকায় তারা লেখেন :
لم أعثر عليه في مظانه. وفي الإسناد الذي ساقه المصنف عبد الرحمن بن ثابت، ضعفه غير واحد من أهل العلم. قال العقيلي في الضعفاء (2/326): قال يحيى: عبد الرحمن بن ثابت بن ثوبان ضعيف. قلت: يكتب حديثه؟ قال: نعم على ضعفه. وقال ابن عدي في الكامل (4/281): له أحاديث صالحة، وكان رجلا صالحا، يكتب حديثه على ضعفه. ونقل الحافظ في التهذيب (6/150) عن الإمام أحمد قوله: أحاديثه مناكير، كان عابد أهل الشام. وتقدم كلام الحافظ في التقريب (ص 337): بأنه صدوق يخطئ وتغير بأخرة.
সম্ভাব্য গ্রন্থসমূহে আমরা এই বর্ণনাটি খুঁজে পাইনি। আর লেখক যেই সনদে এটি উল্লেখ করেছেন, তাতে আবদুর রহমান ইবনু সাবিত নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। অনেক আলিম তাকে যয়িফ (দুর্বল) বলে আখ্যায়িত করেছেন। উকায়লি রহ. লেখেন, ইয়াহইয়া (ইবনু মাঈন) বলেছেন, ‘আবদুর রহমান ইবনু সাবিত ইবনি সাওবান যয়িফ (দুর্বল)।’ আমি বললাম, তার হাদিস লেখা হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তার যয়িফ হওয়ার কথা উল্লেখ করার ভিত্তিতে লেখা হবে। ইবনু আদি বলেন, তার কিছু ভালো হাদিস আছে। যয়িফ হওয়ার কথা উল্লেখ করে তার হাদিস লেখা হবে। হাফিজ ইবনু হাজার রহ. ‘আত-তাহযিব’ গ্রন্থে ইমাম আহমাদ রহ.-এর অভিমত উদ্ধৃত করেন, ‘তার হাদিসগুলো মুনকার। সে শামবাসীর বুজুর্গ ব্যক্তি ছিল। ইতিপূর্বে ‘আত-তাকরিব’ গ্রন্ত থেকে হাফিজ রহ.-এর কথা বিগত হয়েছে যে, সে একজন সত্যবাদী, যে ভুল করে। শেষ জীবনে তার স্মৃতিভ্রম হয়েছিল।
প্রথম কথা হলো, এই আসারটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলিতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, এর একজন বর্ণনাকারী বিতর্কিত। যার দুর্বলতা সকলে স্বীকার করে নিয়েছেন। এমনকি ইমাম আহমাদ রহ. তার হাদিসসমূহকে মুনকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেই শব্দের অনুবাদ প্রমাণ করার জন্য এই আসারটি উল্লেখ করা হলো, তার ওপর মুসলমানদের আকিদা নির্ভর করে। আকিদার এ ধরনের সেনসিটিভ ইস্যুতে এমন দুর্বলতম বর্ণনা কখনো দলিলযোগ্য হয় না। উপরন্তু এর সমর্থনে না আছে কোনো আয়াত, না আছে কোনো হাদিস, না আছে কোনো সাহাবির বাণী। আর এটা তো ফাজায়িলের চ্যাপ্টার নয় যে, যয়িফকে দেখেও ছাড় দেওয়া হবে। তাছাড়া ফাজায়িলের ক্ষেত্রেও তো সাধারণ যয়িফে ছাড় চলে; বেশি যয়িফ হলে সেক্ষেত্রেও তো ছাড় নেই। আলোচ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ যয়িফ গ্রহণ করারও সুযোগ কোথায়! উপরন্তু এটা তো হাদিস নয়; দুজন তাবেয়ির আসার মাত্র।
পঞ্চম আসার
মুহতারাম ভাই মুজাহিদ রহ. সূত্রে একটি আসার উল্লেখ করেছেন। তিনি লেখেন, ‘ইমাম আবু বকর খাল্লাল রহ. বর্ণনা করেন :
عَنْ مُجَاهِدٍ: {عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا} [الإسراء: 79] قَالَ: «يُقْعِدُهُ مَعَهُ عَلَى الْعَرْشِ» ، قَالَ أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي طَالِبٍ: مَنْ رَدَّهُ فَقَدْ رَدَّ عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَمَنْ كَذَّبَ بِفَضِيلَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ كَفَرَ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ.
‘মুজাহিদ রহ. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর বাণী “আশা করা যায়, আপনার রব আপনাকে এক প্রশংসিত স্থানে উন্নীত করবেন।” [সুরা আল-ইসরা : ৭৯] এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁকে (নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে) নিজের সাথে আরশের ওপর বসাবেন। আবু বকর বিন আবু তালিব রহ. বলেন, যে এ কথাটি অস্বীকার করল সে (যেন) আল্লাহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল, আর যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ মর্যাদা অবিশ্বাস করল সে (যেন) আল্লাহর সাথে কুফরি করল।’
আসারের মান
মজার বিষয় হলো, এই বর্ণনার কথাগুলোই চরম আপত্তিজনক। আপত্তির অনেক কারণ রয়েছে। সব এখানে উল্লেখ করব না। ধারাবাহিক পর্যালোচনার পরবর্তী এক পর্বে এ প্রসঙ্গে সুদীর্ঘ আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ। এখানে শুধু কয়েকটি বিষয়ের দিকে সামান্য ইঙ্গিত করি :
ক. মুজাহিদ রহ. কে? তিনি কি কোনো নবি বা সাহাবি? কিছুই তো না। তিনি আয়াতের যে তাফসির করেছেন, তা কি রাসুলুল্লাহ ﷺ বা কোনো সাহাবির দিকে নিসবত করেছেন? না, তা-ও না। তাহলে একজন তাবেয়ির কথাকে অস্বীকার করলে কীভাবে মানুষ কাফির হতে পারে? অথচ এখানে তা-ই বলা হয়েছে।
খ. এই আসারের একজন বর্ণনাকারী হলো লাইস ইবনু আবি সুলায়ম। সে যয়িফ। যার কারণে এই আসারের সনদটিও এক্ষেত্রে দলিলযোগ্য নয়।
গ. কুরআনের যে আয়াতের তাফসির এতে উল্লেখিত হয়েছে, সেই আয়াতের শব্দাবলীই এই উদ্ভট তাফসিরকে প্রত্যাখ্যান করে। আয়াতের শব্দ হলো أَنْ يَبْعَثَكَ । এর অর্থ হয় পাঠানো, প্রেরণ করা, উন্নীত করা, প্রতিষ্ঠিত করা ইত্যাদি। কিন্তু ‘বসানো’ কখনো এর অর্থ হয় না। আয়াতের আরেকটি শব্দ হলো مَقَامًا । শব্দটি এসেছে ‘কিয়াম’ থেকে। যার অর্থ দাঁড়ানো; যা বসার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। আয়াতের একাধিক শব্দ সমর্থন করে না, এমন যয়িফ তাফসির গ্রহণ করার কি আদৌ কোনো সুযোগ আছে?
এছাড়াও এই আসারটি নিয়ে আরও কথা রয়েছে। পরবর্তীতে আমরা এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এখানে শায়খ আলবানি রহ.-এর একটা উদ্ধৃতি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক :
ومن العجائب التي يقف العقل تجاهها حائرا أن يفتي بعض العلماء من المتقدمين بأثر مجاهد هذا كما ذكره الذهبي (ص 100 – 101 و117 – 118) عن غير واحد منهم، بل غلا بعض المحدثين فقال: لوأن حالفا حلف بالطلاق ثلاثا أن الله يقعد محمدا صلى الله عليه وسلم على العرش واستفتاني، لقلت له: صدقت وبررت!
قال الذهبي رحمه الله: ” فأبصر – حفظك الله من الهوى – كيف آل الغلو بهذا المحدث إلى وجوب الأخذ بأثر منكر
যে আশ্চর্যজনক ব্যাপারটি বিবেককে অস্থির করে ছাড়ে, পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে কোনো কোনো আলিম মুজাহিদ রহ.-এর আসারের আলোকে ফাতওয়া দিয়েছেন, যেমনটি ইমাম যাহাবি কয়েকজনের ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন। কিছু মুহাদ্দিস তো আরও বাড়াবাড়ি করে বলেছে, কোনো কসমকারী যদি আল্লাহর নামে তিনবার কসমে করে বলে যে, আল্লাহ মুহাম্মাদ ﷺ-কে আরশে বসাবেন। এরপর আমার কাছে ফাতওয়া জিজ্ঞেস করে, তাহলে আমি বলব, তুমি সত্য ও যথার্থ বলেছ। যাহাবি রহ. বলেন, তুমি লক্ষ করো, আল্লাহ তোমাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে রক্ষা করুন, কীভাবে মুহাদ্দিসের বাড়াবাড়ি এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সে একটি মুনকার আসার গ্রহণ করাকে অপরিহার্য বানিয়ে ফেলছে।
ষষ্ঠ আসার
তিনি লেখেন, ‘ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন :
حَدَّثَنِي أَحْمَدُ بْنُ سَعِيدٍ أَبُو جَعْفَرٍ الدَّارِمِيُّ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبِي يَقُولُ: سَمِعْتُ خَارِجَةَ، يَقُولُ: ….وَهَلْ يَكُونُ الِاسْتِوَاءُ إِلَّا بِجُلُوسٍ.
‘খারিজা রহ. বলেন, الِاسْتِوَاءُ মানে তো উপবেশন করাই।’
আসারের মান
মুহতারাম ভাই এই আসারটি উল্লেখ করেছেন ‘খারিজা’ থেকে। এখানে আমাদেরকে সবচে বেশি আহত করেছে, তিনি স্বীয় মতের স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে গিয়ে ‘খারিজা’র মতো ব্যক্তিকে ইমাম নামে আখ্যায়িত করেছেন; যা পাঠকমাত্রকেই বিভ্রমে ফেলবে। মুহতারাম ভাইয়ের শব্দ হুবহু লক্ষ করুন, ‘ছয় : ইমাম খারিজা রহ.।’
মুহতারাম ভাই যেই রেফারেন্সে আসারটি উল্লেখ করেছেন, সেখানে সম্মানিত মুহাক্কিক টীকায় লিখেছেন :
أما هذا الذي يروى عن خارجة فليس إلا شذوذا من كذاب متروك يعبر عن معتقده هو. ومن هنا نقول: إن هذه العبارة أقرب إلى التجسيم وتشبيه الخالق بالمخلوق، وسلفنا الصاح من أشد الناس إنكارا على المشبهة والمجسمة.
খারিজা সূত্রে এই যে মতটি বর্ণিত হয়েছে, তা একজন ডাহা মিথ্যুক পরিত্যাজ্যা বর্ণনাকারীর বিচ্ছিন্ন উক্তি ছাড়া কিছু নয়; যে নিজেই তার আকিদা ব্যক্ত করে দিচ্ছে। এখান থেকেই আমরা বলব, এই বক্তব্য দেহবাদ এবং স্রষ্টাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্যদানের খুব নিকটবর্তী। অথচ আমাদের সালাফে সালিহিন মুশাববিহা ও মুজাসসিমা তথা সাদৃশ্যবাদী ও দেহবাদীর ওপর সবচে বেশি আপত্তি করতেন।
খারিজার পুরো নাম হলো ইবনু মুসআব ইবনু খারিজা দবয়ি খোরাসানি সারাখসি। সে একজন ভণ্ড, প্রতারক, হাদিস বানোয়াটকারী, মিথ্যুক ও পরিত্যাজ্য ছাড়া কিছু নয়। তার মতো ব্যক্তিকে স্রেফ মতের মিলের কারণে ‘ইমাম’ বানিয়ে উপস্থাপন করা কখনোই ইনসাফের পরিচয় নয়। মিথ্যুক খারিজার জীবনী জানতে দেখুন—আত-তাকরিব : ১/২১০; আদ-দুয়াফা লিন নাসায়ি : ৩৭; তারিখে ইবনি মায়িন : ২/১৪২; তাহযিবুল কামাল : ১/৩৪৯; মিযান : ১/৬২৫; তাহযিব : ৩/৭৬
চতুর্থ পর্ব
মুহতারাম ভাই তার লেখায় দাবি করেছেন, ‘ইসতিওয়া’ শব্দের অর্থ হিসেবে ‘সমাসীন হওয়া’ (বসা) শব্দটি চলনসই। আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে এই শব্দের ব্যবহার ভুল, নাজায়িয বা গোমরাহি নয়। তার এ দাবি মেনে নিলে এর স্বাভাবিক পরিণতি দাঁড়াচ্ছে, যারা নিজেদের আকিদা বয়ান করতে গিয়ে বলে, ‘আল্লাহ আরশের ওপর সমাসীন’, তাদের কথাকে শুধু সঠিকই নয়, বরং কুরআনসম্মত বলে মেনে নিতে হবে।
তো এই দাবির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার জন্য এমন একটি গুণ (বসা) সাব্যস্ত করা হচ্ছে, যা আল্লাহ কুরআনে নিজের জন্য সাব্যস্ত করেননি। কারণ, কুরআনের কোনো আয়াতে আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে ‘জুলুস’ বা ‘কুঊদ’ তথা বসা, সমাসীন হওয়া, অধিষ্ঠিত হওয়া ও উপবেশন করা ইত্যাদি শব্দ বিবৃত হয়নি। রাসুলুল্লাহ ﷺ হলেন কুরআনের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান মুফাসসির। তিনিও আল্লাহ তাআলার জন্য কোনো সহিহ হাদিসে এই গুণ সাব্যস্ত করেননি। সাহাবিগণ রা. থেকেও কোনো সহিহ আসারে আমরা আল্লাহ তাআলার জন্য এই গুণের বর্ণনা পাইনি। তাবেয়িন ও তাবে তাবেয়িনের কারও থেকে বর্ণিত কোনো সহিহ আসারেও আমরা আল্লাহ তাআলার জন্য এই গুণের উল্লেখ পাইনি।
মুহতারাম ভাই তার রচনায় এ প্রসঙ্গে কিছু হাদিস ও আসার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমরা তার সবগুলো বর্ণনারই বিশ্লেষণ পূর্বের পর্বগুলোতে সবিস্তারে উল্লেখ করেছি। এগুলোর মধ্যে একটা সহিহ বর্ণনাও আমরা পাইনি; যা এই দাবির পক্ষে প্রমাণ হতে পারে। অথচ আকিদার ক্ষেত্রে স্বীকৃত নীতি হলো :
نثبت لله ما أثبت لنفسه
আমরা আল্লাহর জন্য তা-ই সাব্যস্ত করব, যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন।
এই নীতির ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই। এতদ্সত্ত্বেও মুহতারাম ভাই আল্লাহ তাআলার জন্য এমন কিছু সাব্যস্ত করারও বৈধতা দিচ্ছেন, যা আল্লাহ নিজের জন্য সাব্যস্ত করেননি।
যেহেতু কুরআন, সহিহ হাদিস ও সালাফের (খাইরুল কুরুন) সহিহ আসারে কোথাও আল্লাহ তাআলার জন্য আরশে সমাসীন হওয়ার গুণ সাব্যস্ত করা হয়নি, তাহলে আমরা এটাকে বিদআত (নবোদ্ভাবিত) এবং কুরআনের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা বলতে পারি। যেহেতু এটা আমাদের কোনো মৌলিক রচনা নয়; বরং সেই ভাইয়ের রচনার পর্যালোচনা, তাই তার দলিলগুলো সামনে রেখেই আমরা আমাদের পর্যালোচনা উপস্থাপন করছি। তার লেখায় তিনি এই দাবির পক্ষে একটা সহিহ হাদিস বা আসারও দেখাতে পারেননি। সুতরাং আমাদের উপরিউক্ত সিদ্ধান্তকে তার ওপর জুলুম ভাবার কারণ নেই। হ্যাঁ, তিনি যদি সামনে আরও হাদিস ও আসার নিয়ে হাজির হন, তাহলে অবশ্যই আমরা সেগুলোরও রিভিউ করব ইনশাআল্লাহ।
মুহতারাম ভাই—তিনিই যে সর্বপ্রথম ‘ইসতিওয়া’র অনুবাদে সমাসীন হওয়া (বসা) শব্দ ব্যবহারকে বৈধ বলেছেন, বিষয়টি এমন নয়। বরং অনেক পূর্ব থেকেই এটি চলে আসছে। মুশাববিহা, কাররামিয়া এবং হাশাবিয়্যাহ নামক ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের কিছু লোক এই বিকৃত অনুবাদ করে আসছে। যেমন, চতুর্থ শতাব্দীর ইমাম আবু সাঈদ শাফেয়ি রহ. (মৃত্যু : ৩৭৮ হিজরি) উপরিউক্ত তিনটি গোষ্ঠীর ভ্রান্তির বর্ণনাপ্রসঙ্গে বলেন :
وأطلق بعضهم القول بأنه جالس على العرش مستقر عليه تعالى الله عن قولهم.
তাদের একদল তো এই কথাও বলে বসেছে যে, আল্লাহ তাআলা আরশের ওপর সমাসীন, তার ওপর স্থিত। তাদের এসব কথা থেকে আল্লাহ পবিত্র। {আল-গুনয়াহ ফি উসুলিদ দীন : ৭৩-৭৫}
ইমাম ফখরুদ্দীন রাজি রহ. (মৃত্যু : ৬০৬ হিজরি) লেখেন :
المسألة الثانية: المشبهة تعلقت بهذه الآية في أن معبودهم جالس على العرش وهذا باطل بالعقل والنقل من وجوه.
মুশাববিহারা এই আয়াত দ্বারা দলিল দিয়ে বলে যে, তাদের মাবুদ আরশের ওপর সমাসীন। অথচ এটা অনেক কারণে আকল ও নকল (কুরআন-হাদিস) দ্বারা সাব্যস্ত বাতিল কথা। {আত-তাফসিরুল কাবির : ২২/৫-৬}
আমাদের মুহতারাম ভাইয়ের দাবি ছিল, সমাসীন অর্থ করতে কোনো অসু্বিধা নেই। অসুবিধা হবে এর রূপরেখা ও ধরন নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিতে গেলে। অথচ ইমাম তাকিয়্যুদ্দীন সুবকি রহ. বলেন :
ومن أطلق القعود وقال إنه لم يرد صفات الأجسام قال شيئا لم تشهد به اللغة فيكون باطلا وهو كالمقر بالتجسيم المنكر له فيؤخذ بإقراره ولا يفيد إنكاره
যে ব্যক্তি সমাসীন হওয়া শব্দ প্রয়োগ করে বলবে, সে তো দেহবিশিষ্ট সত্তার গুণ উদ্দেশ্য নেয়নি—সে এমন কিছু বলল, ভাষা যার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় না। সুতরাং এটা বাতিল হবে। সে দেহবাদের স্বীকারোক্তি দিয়ে আবার তা অস্বীকার করছে। সুতরাং তার স্বীকারোক্তি গ্রহণ করা হবে। আর তার অস্বীকৃতি কোনো কাজে আসবে না। {আস-সাইফুস সাকিল : ৮৭}
আমাদের মুহতারাম ভাই লিখেছিলেন, ‘আমাদের সালাফ ও খালাফের মধ্য হতে যারা এমন অনুবাদ করেছেন, তাদের মারাত্মক কোনো ভুল হয়েছে বলেও আমরা মনে করি না। ভ্রান্তি বা ভুল তো তখনই হবে, যখন এর অন্তর্নিহিত অর্থ ও এর রূপরেখা কেমন হবে, তা জানার চেষ্টা করা হবে। যদি আকিদা বিকৃতির আশঙ্কায় এখানে এ অর্থ করা ভুলই হয়, তাহলে তো আল্লাহর জন্য হাত আছে, পা আছে, আঙুল আছে, চেহারা আছে; এসব কথা বলাও ভুল বলা হবে। তখন আপনাকে বলতে হবে, আল্লাহর জন্য يَدٌ (ইয়াদুন) আছে, قَدَمٌ (কাদামুন) আছে, أُصْبُوْعٌ (উসবুউন) আছে, وَجْهٌ (ওয়াজহুন) আছে; অথচ এখানে প্রায় সবাই-ই এগুলোর বাংলা অনুবাদ করে।’
প্রথম কথা হলো, সালাফ তথা খাইরুল কুরুনের কেউ এই অনুবাদ করেছেন বলে তিনি প্রমাণ দেখাতে পারেননি। যেগুলো দেখানোর কসরত করেছেন, তা একটাও প্রমাণিত নয়। সুতরাং এই শব্দের ব্যবহার এখানে সঠিক নয়। আর খালাফের বিচ্ছিন্ন অনুবাদ নিয়ে আমাদের আপাতত মাথাব্যথা নেই। তবে এ প্রসঙ্গেও পরে আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ। এখানে আমরা কথা বলব তার যুক্তিটি নিয়ে। যদিও তার দাবি প্রমাণের জন্য শুধু যুক্তি থাকাই যথেষ্ট নয়; এরপরও আমরা সর্বস্তরের পাঠকের কথা মাথায় রেখে এই যুক্তিরও পর্যালোচনা করব। এখানে তিনি যে কাজটি করেছেন, ‘বসা’কে অন্য কিছু বিষয়ের সঙ্গে তুলনা (কিয়াস) করেছেন। আমরা দেখব, এই তুলনাটি সঠিক কি না। আর সবগুলো শব্দই যেহেতু আরবি, তাই আমাদেরকে এই বিশ্লেষণটি করতে হবে আরবি ভাষার আলোকে। কারণ, আরবি ভাষা আরবদের ভাষা। আরবিতে হাত, পা ও চেহারা ইত্যাদি শব্দ দেহবিশিষ্ট ও দেহহীন সব ধরনের বস্তুর ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। কিন্তু বসা শব্দটি শুধুই দেহবিশিষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়; দেহহীন বস্তুর ক্ষেত্রে নয়। শায়খ আবদুল্লাহ হারারি আল-মাকালাতুস সুন্নিয়্যাহ (২১৯-২২১) গ্রন্থে এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন :
” قولهم إن استواء الله على العرش جلوس لكن لا كجلوسنا ويستشهدون لذلك بقول بعض الأئمة “لله وجه لا كوجوهنا ويد لا كأيدينا وعين لا كأعيننا“. والجواب عنه: أن الجلوس في لغة العرب لا يكون إلا من صفات الأجسام، فالعرب لا تطلق الجلوس إلا على اتصال جسم بجسم على أن يكون أحد الجسمين له نصفان نصف أعلى ونصف أسفل، وليس للجلوس في لغة العرب معنى إلا هذا، أما الوجه واليد والعين فليست كذلك.
এ কারণেই ইমাম ইবনুল জাওযি রহ. (মৃত্যু : ৫৯৭ হিজরি) বলেন :
الخالق سبحانه وتعالى لا يجوز أن يوصف بالجلوس على شئ… لأن هذه صفة الأجسام.
পূত-পবিত্র মহান স্রষ্টার ব্যাপারে এই গুণ বর্ণনা করা নাজায়িয যে, তিনি কোনো কিছুর ওপর বসেছেন। কারণ, এটা দেহবিশিষ্ট সত্তার গুণ। {আল-বাযুল আশহাব : ১২৬}
এখানে একটি বিষয় সবিশেষ উল্লেখ্য, আল্লাহ নিজে তার জন্য যে গুণ উল্লেখ করেননি, রাসুলুল্লাহ ﷺ-ও তাঁর পক্ষ থেকে ওহিপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর জন্য যে গুণ সাব্যস্ত করেননি, নিজেদের পক্ষ থেকে তা সাব্যস্ত করে কেবল শেষে এই কথা জুড়ে দিলেই তা বৈধতা পেয়ে যায় না যে, ‘তবে এটা আমাদের মতো নয়; বরং এর স্বরূপ অজ্ঞাত।’ উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বলে, ‘আল্লাহ তাআলার দেহ রয়েছে, তবে তা আমাদের দেহের মতো নয়’; তাহলে সে একজন গোমরাহ লোক ছাড়া কিছু নয়। অনেক ইমাম তো এমন ব্যক্তিকে তাকফিরও করেছে। ‘আমাদের মতো নয়’ বলেই যারা সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে চান, দেহবাদী সম্প্রদায় সম্পর্কে তাদের পড়াশোনার ঘাটতি রয়েছে। মহান ইমাম ইবনুল হুমাম রহ. (মৃত্যু : ৮৬১ হিজরি) ‘ফাতহুল কাদির’ গ্রন্থে লেখেন :
من قال الله جسم لا كالأجسام كفر
যে বলবে, আল্লাহ দেহ, তবে অন্যান্য দেহের মতো নয়—সে কাফির হয়ে যাবে। {ফাতহুল কাদির : ১/৪০৩}
শায়খ আবদুল গনি নাবুলুসি রহ. (মৃত্যু : ১১৪৩ হিজরি} লেখেন :
ومن اعتقد أن الله جسم قاعد فوق العرش فهو كافر وإن زعم أنه مسلم
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে, আল্লাহ দেহবান সত্তা, আরশের ওপর সমাসীন—সে কাফির, যদিও সে নিজেকে মুসলিম মনে করে। {আল-ফাতহুর রব্বানি : ১২৪}
এখানে একটি সংশয় কারও অন্তরে থেকে যেতে পারে। মুহতারাম ভাই তার রচনায় দুটো আরবি অভিধান এবং দুটো হাদিস উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, ‘ইসতিওয়া’ শব্দের একটি অর্থ ‘সমাসীন হওয়া’ও হয়। তিনি তার পরবর্তী লেখায় আল্লামা তাকি উসমানি হাফি.-এর উদ্ধৃতি দিয়েও বলেছেন, ‘ইসতিওয়া’ শব্দের অনেক অর্থের মধ্যে ‘বসা’ও একটি অর্থ আছে। এই বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা দরকার। আমরা তো কখনো বলিনি যে, শাব্দিকভাবে ‘ইসতিওয়া’ শব্দের একটি অর্থ সমাসীন হওয়া হয় না। শাব্দিকভাবে নিশ্চয়ই হয়। তিনি তো এর পক্ষে হাদিস আর ডিকশনারির হাওয়ালা দিয়েছেন; অথচ কুরআনের একাধিক আয়াতেও ইসতিওয়া শব্দটি বসা অর্থে এসেছে। এখন আপনি বলবেন, তাহলে তো কেল্লা ফতেহ। হয়েই তো গেল। অভিধানে যেহেতু আছে, তাহলে আর এটাকে অবৈধ বলার সুযোগ কোথায়!
আসলে এই সংশয়ে একমাত্র সেই ভাইয়েরাই ভুগতে পারে, যাদের মৌলিক আরবি অভিধানগ্রন্থাবলির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আরবিতে ‘ইসতিওয়া’র অর্থ শুধু এই চার-পাঁচটা নয়; বরং এর অর্থ রয়েছে ১৫টা। ইমাম ইবনুল আরাবি মালেকি রহ. (মৃত্যু : ৫৪৩ হিজরি) লেখেন :
وللاستواء في كلام العرب خمسة عشر معنى ما بين حقيقة ومجاز، منها ما يجوز على الله فيكون معنى الآية ومنها ما لا يجوز على الله بحال
মূল এবং রূপক অর্থ মিলিয়ে ‘ইসতিওয়া’ শব্দের ১৫টি অর্থ রয়েছে; যার কিছু অর্থ আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে গ্রহণ করা সম্ভব, আর কিছু অর্থ কোনো অবস্থায়ই গ্রহণ করা সম্ভব নয়। {আরিযাতুল আহওয়াযি : ১/৪৪২-৪৪৩}
আরবি অভিধান খুললে দেখবেন, একই শব্দ কার দিকে সম্পর্কিত করা হচ্ছে, সেই কর্তার বিবেচনায় তার অর্থের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। এ জন্য অভিধানে শুধু শব্দার্থই লেখা থাকে না; এর ব্যবহার এবং কোন ক্ষেত্রে কী অর্থ গ্রহণীয়, তা-ও লেখা থাকে। মুহতারাম ভাইয়ের তাহকিকের নীতি তখনই রক্ষিত হতো, যখন তিনি আরবি ভাষার কোনো গ্রহণযোগ্য অভিধান থেকে ‘ইসতিওয়া’ শব্দের নিসবত (সম্পর্ক) আল্লাহ তাআলার দিকে হলেও ‘সমাসীন হওয়া’ অর্থ গ্রহণ করা যায়, এর পক্ষে অন্তত একটা রেফারেন্স উল্লেখ করতেন। কিন্তু তিনি এই কসরত করেননি। আর বলাবাহুল্য, এটা না করা হলে ‘ইসতিওয়া’ শব্দ-সংবলিত হাজার হাজার উদাহরণ উপস্থাপন করাও অর্থহীন হয়ে যাবে। কারণ, তার দাবি আরবি ভাষার আলোকে প্রমাণিত হতে হবে; গায়ের জোর খাটিয়ে তো আর কোনোক্ষেত্রে দাবি প্রমাণ করার নিয়ম নেই।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
প্রিয় শায়েখ,
আপনি আমাদের একটু সহায়তা করুন। উলামায়ে দেওবন্দের আকিদাহ যে সঠিক তার জন্য একটা বই লিখুন।
এই ছোট্ট একটা অনুরো।
জাঝাকুমুল্লাহ।
শাইখ, আপনারা যেমন আল্লাহর শোনা, দেখা, ইত্যাদি গুণগুলোর অনুবাদ করেন, উনারা তেমন ইসতাওয়া এবং অন্যান্য গুণগুলোর অনুবাদ করেন। মূলত আল্লাহ এই সবগুলো গুণের ক্ষেত্রেই অতুলনীয়। তাই এখানে বাড়াবাড়ি কাম্য নয়।
জাযাকাল্লাহ ভাই!
পুরো পর্যালোচনাটাই ছিল দলিল ভিত্তিক, পরিতৃপ্তকারী।
তবে আরেকটি বিষয় রয়ে গেছে মনে হয়, তা হল يد، وجه এগুলোর অর্থ যখন করা যাচ্ছে না তখন আল্লাহ শোনেন, আল্লাহ দেখেন ইত্যাদি এগুলোর অর্থের ক্ষেত্রে করণীয় কী? তখন কীভাবে বলা হবে?