ছিপছাপ মধ্যম গড়নের শরীর। গৌরবর্ণ। অত্যুজ্জ্বল মুখাবয়ব; যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে অনুপম সৌন্দর্য ঔজ্জ্বল্য ও শুভ্রতা। তাতে পূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত শিশুর সারল্য ও মায়া। মায়াভরা চাহনি। অধরে এক চিলতে বাঁকা হাসির শুভ্র রেখা। সত্যিই অসাধারণ অনুপম এক মুখাবয়ব; স্বর্গীয় সৌন্দর্যের দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ। লাজুক স্বভাব। বয়স আর কত। বার কিবা তের; কৈশোর ছুঁইছুঁই।

সমাজের ঘৃণ্য দৃষ্টিতে আজ সে হীন, বড় অবহেলার পাত্র! কিন্তু বিশ্বাস করো হে জড়সভ্যতা, তার মায়াভরা চাহনি দৃষ্টে মন সাক্ষ্য দেয়, সে এক রাজপুত্র। অভাবের তাড়নায়, দারিদ্রের কষাঘাতে লাটিম খেলার এ বয়সেই তাকে নামতে হয়েছে কর্মে, রুজির সন্ধানে, দুমুঠো ভাতের প্রয়োজনে। বাবা-মা’র আদর-স্নেহ-সোহাগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে। কিন্তু তাদের মুখে হাসি ফোটাতেই বেছে নিয়েছে আজ সে এ পথ; নিক্ষেপ করেছে আঁধারের অতল গহ্বরে স্বপ্নিল ভবিষ্যৎ।

আজ তার ভূমিকা হোটেলের তুচ্ছ কর্মীর আদলে। সম্পদধারীরা তাই যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে তার সাথে। বয়স্ক সহকর্মীরাও যেন ঝাল মেটাতে সদা উদগ্রীব। প্রয়োজনে কিবা অপ্রয়োজনে, সময়ে আর অসময়ে শত নির্যাতন সয়ে যায় তার কোমল দেহ; শুভ্র গালে জোটে নির্দয় চড় আর শুনতে হয় অসভ্য গালাগাল। চড় খেয়ে রক্তিম বর্ণ ধারণ করে গাল, যেন কেউ তাতে নিংড়ে দিয়েছে বেদানার দানা। প্রহৃত হয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে চলে সে অবিরাম।

ডেকে যায় মা’কে অহর্নিশ। নোনা তপ্তাশ্রুর সরু ধারা বয়ে যায় চোখের দুধার থেকে, যেন কোন জলপ্রপাত। তার আর্তস্বর শুনে, চোখের অশ্রু দেখে মোটেও বিগলিত হয় না মানবতার খোলসধারী নিষ্ঠুর পাষাণদের হৃদয়; উল্টো হাসির হররা ছোটে তাদের মুখে। গগনবিদারী হাসির স্বরে চাপা পড়ে যায় তার কান্না। রাতের আধারে এ নাপাক হাতগুলো ক্ষুধার্ত বাঘের মত তার দিকে ধেয়ে আসে। ছিড়েফেড়ে খেতে চায় যেন তার কোমল দেহ। তাদের পাশবিক চাহিদার সামনে বারবার সে গুটিয়ে যায়; চুপসে যায় পুরোদমে। শাপ দেয় সে মানবাধিকারের ধ্বজাধারীদেরকে; শাপ দেয় হিংস্র মানবতাকে।

তার সাথে আমার কথা হয় অতি সামান্য। কথার ধারাকে দীর্ঘ করতে ইচ্ছে হয়; কিন্তু পারি না। এক অপরাধবোধ প্রবলভাবে চেপে ধরে আমাকে। ছেলেটি বড় মেধাবী, অসাধারণ ধী শক্তি ও বিরল কিছু প্রতিভার অধিকারী। স্কুলে যে কদিন যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তার, বড় ঈর্ষনীয় ছিলো সে। বরাবর প্রথম স্থান তার ভাগেই জুটতো; কেউ তা ছিনিয়ে নিতে পারেনি কখনো। ধনকুবেরের পরিশ্রমী সাফল্যপ্রয়াসী ছেলেরাও তার সাথে প্রতিযোগে নেমে ব্যর্থ হয়েছে।

স্কুলজীবনের সোনালি সেদিনগুলোর কথা মনে পড়লে তার কপোল বেয়ে অশ্রু ঝরে। কিছু সময়ের জন্য সে আনমনা হয়ে যায়। কাজে তখন ব্যত্যয় ঘটে। পরিণামে গালাগালের অঝোর বর্ষণ বয়ে যায় তার ওপরে। সে বলেছে, সোনালি সেই দিনগুলির কথা মনে পড়লে বড় ব্যথা অনুভূত হয় হৃদয়ে। স্মৃতিরা বারবার উঁকি দিয়ে যায় তার হৃদয়পটে। জীবনটা বিষিয়ে ওঠেছে তার। সইতে পারে না সে আর।

তার বয়সী অন্য ছেলেমেয়েরা বাবা-মা’য়ের হাত ধরে খেতে আসে। পরম আদরে তারা ওদের মুখে খাবার তুলে দেয়। সে আনমনে তাকিয়ে থাকে। কারো ডাকে ফের সম্বিত ফিরে পায়। আজ তার কেন এ করুণ পরিণতি? সে কোন অপরাধে অপরাপর শিশুদের ঝুটা পরিষ্কার করে, প্লেট গ্লাস ধুয়ে দেয়? এ প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে বেরায়। নিয়তির এ নির্মম পরিহাসে সে বড় বেদনার্ত হৃদয় নিয়ে ঘুরে ফিরে। প্রবোধ দেয় কোনক্রমে নিজেকে। তার আর ভালো লাগে না। বারবার ইচ্ছে জাগে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে- কবে হবে এ করুণ জীবননাটিকার যবনিকাপাত।

কিন্তু পারে না। কারণ, তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে অসহায় মা, ছোট্ট বোন। ভেসে ওঠে দৃষ্টিপটে অসুস্থ শয্যাশায়িনী মায়ের নিষ্পাপ পবিত্র মুখাবয়ব। সেই কতদিন হলো, মা পড়ে আছেন বিছানায়। চিকিৎসার সাধ্য নেই। পথ্যের ব্যবস্থা নেই। একমাত্র ছেলে সে। কীইবা করার আছে তার! বাবা তো মাটির কোলে ঘুমাচ্ছেন আরামে।

নাঈমের মত দিনাতিপাত করছে এ দেশের অসংখ্য শিশু। কেউ নেই যে ওদেরকে কোলে তুলে নিবে। ওদের মুখে হাসি ফোটাবে। ওদের যিন্দেগির দুঃখ ঘোচাবে। হায় মানবসভ্যতা, শত ধিক তোমায়! প্রতিদিন গড়ে ওঠছে কতশত সুরম্য প্রাসাদ। অপচয়ের নালায় ভেসে যাচ্ছে অবারিত সম্পদ। আর সামান্য কয়টি টাকার জন্য থমকে যাচ্ছে এসব পুষ্পকলির জীবন। হারিয়ে যাচ্ছে নিবিড় তমসায় না জানি কত সম্ভাবনা। ওরা যদি এখন অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়, গাঢ় তিমিরে ছেয়ে ফেলে গোটা দেশ, পৃথিবী তবে দোষের ভার পুরোটাই ওদের কাঁধে চাপানো কতটা ন্যায়সঙ্গত হবে?

হায়, কেউ কি নেই? কারো চৈতন্য কি জাগবে না? আর কতকাল কাটবে এভাবে ওদের জীবন? কতদিন আর ঘুমাবে ওরা পিচঢালা পথের দুধারে, স্টেশনের কোন পাশে, ঘাসের শ্যামল বিছানায়, ইটখণ্ডের ওপরে মাথা রেখে? রহম করো খোদা। সামর্থ্য দাও আমায়। চৈতন্য জাগাও বিশ্ব মানবতার। সৃষ্টির সেবায় যেন খুঁজে পাই তোমায় হে মহামহিম, হে আল্লাহ। কবুল করো আমায়।

Share This