প্রত্যেক যুগে অসংখ্য হকপন্থী জামাআত ইসলামের পক্ষে ও মানবতার কল্যাণে কাজ করে। বর্তমান সময়েও বিভিন্ন জামাআত এই মহান ব্রত পালন করে যাচ্ছেন। এই ধারা কিয়ামত পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ জারি থাকবে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে দীনি অসংখ্য জামাআতের মধ্য থেকে একটি জামাআত সবচে বেশি কোণঠাসা। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সেই জামাআত কোনটি? তাহলে নির্দ্বিধায় নিঃসঙ্কোচে এর উত্তর দিতে পারবে যে-কেউ। এই মাজলুম জামাআত হলো মুজাহিদদের জামাআত; যারা নিজেদের জীবন আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছে। যারা ইসলাম নামক বৃক্ষের গোড়ায় পানি নয়, বরং নিজেদের বুকের তপ্ত খুন ঢালতে চায়। যারা আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যারা তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করে এবং আপসকামিতা পরিহার করে শাশ্বত ইসলাম বিজয়ী করার স্বপ্ন দেখে। এই মুজাহিদদের সঙ্গে সাধারণভাবে তিন ধরনের আচরণ করা হয়। (১) সাধ্যমতো তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়। হোক তা দৈহিকভাবে, মানসিকভাবে, আর্থিকভাবে কিংবা অন্য যেকোনো উপায়ে। এমনকি তাদের মদদের জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করা বা নিদেনপক্ষে অন্তর থেকে তাদের সমর্থন করাও এর অন্তর্ভুক্ত। (২) তাদের বিরোধিতা করা হয়। বিরোধিতার যত সুযোগ ও উপায় আছে, সাধ্যমতো তার কোনোটিই বাদ দেওয়া হয় না। (৩) মাঝামাঝি অবস্থান। না তাদের সহযোগিতা আর না তাদের বিরোধিতা। এরা মূলত পরিণাম দেখার জন্য প্রতীক্ষারত। সমর্থকদের সমর্থন এবং বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধাচারণ দেখে এরা দোদুল্যমান। পরিশেষে বিজয় যাদের হবে, এরা তাদেরই দলে ভিড়বে—এই প্রত্যাশাই এদের চালিকা।

নিশ্চয়ই আল্লাহর পথের সৈনিকরা ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। অন্যদের মতো তাদেরও ভুলত্রুটি হবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্ন কিছু ভুলকে কেন্দ্র করে তাদের থেকে জনসাধারণের আস্থা ও নির্ভরতা সরানোর প্রয়াস পরিণামের বিচারে ভালো কিছু বয়ে আনে না। এর দ্বারা মূলত তাগুতগোষ্ঠী, ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর শত্রুরাই উপকৃত হয়। মুজাহিদদের ভুল-সংশোধনের নববি পদ্ধতি রয়েছে। নবির অনুসরণের দাবিদার এবং নববি ইলমের ধারক—হাদিসে যাদেরকে নবিগণের উত্তরাধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে—যারা, তাদের উচিত মুজাহিদদের ভুল-সংশোধনের ক্ষেত্রে নববি মানহাজ ও পদ্ধতি গ্রহণ করা; যাতে করে জীবনের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা যায়, সকল চ্যুতি ও স্খলন থেকে বাঁচা যায়। কারণ, এ যুগের মুজাহিদদের ভুল-ত্রুটি নতুন কোনো বিষয় নয়, খোদ সাহাবিদেরও জিহাদে ভুল-ত্রুটি হয়েছে। কিন্তু এ জন্য রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের পুরো জিহাদকে বাতিল আখ্যা দেননি, যতটুকু প্রাপ্য তারচে বেশি নিন্দা করেননি; বরং তিনি আদর্শিক পন্থায় তাদেরকে সতর্ক করেছেন, তাদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দিয়েছেন।

নীতির বুলি তো অনেকেই আওড়াতে পারে, কিন্তু খুব কম মানুষই সেগুলোকে কার্যে পরিণত করার সৎসাহস রাখে। এই যুগে মুজাহিদদের ঢালাও বিরোধিতা একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে। ইনসাফের সকল নীতিকথা যেখানে এসে উপেক্ষিত হয়ে যায়। মধ্যপন্থার ফেরিওয়ালারাও এখানে এসে ভারসাম্য ও মধ্যপন্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। অথচ আল্লাহ তাআলার নির্দেশ ছিল—‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন ইনসাফ পরিহার করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা ইনসাফ করো। এটাই তাকওয়ার নিকটতর।’[1]

পেছনে পড়ে থাকা যেসব ব্যক্তিরা বিচ্ছিন্ন কিছু ভুলত্রুটির কারণে জিহাদরত জামাআতগুলোর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে, প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সম্পূর্ণ উগ্র আচরণ করতে শুরু করে, তাদের উচিত নিজেদের এই পেছনে পড়ে থাকা, মুজাহিদদের অসহযোগিতা, তাগুতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ, উম্মাহকে জিহাদের ওপর তারবিয়াত না করা, জিহাদ ফরজ না-হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে প্রস্তুতিগ্রহণের সার্বক্ষণিক ফরজ ত্যাগ করার জন্য নিজেরাই নিজেদের আরও বেশি নিন্দা, ভৎসনা ও সমালোচনা করা। তবেই না সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে। অন্যথায় দ্বৈত নীতি অনুসরণের কারণে তারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে।

সিরাতের বিস্তৃত ভান্ডার থেকে আমরা এখানে মুজাহিদদের ভুল-সংশোধনের মাত্র তিনটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি।

মুজাহিদদের ভুল-সংশোধনের নববি মানহাজ

আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা.-এর বাহিনীর ভুল

ইমাম ইবনু হিশাম রহ. তার সিরাত গ্রন্থে বর্ণনা করেন :

রাসুলুল্লাহ ﷺ রজব মাসে আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা.-এর নেতৃত্বে প্রথম বদর অভিযান থেকে প্রত্যাগত আটজন মুহাজির সাহাবির সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী পাঠালেন। তিনি তাদের মধ্যে কোনো আনসারি সাহাবিকে অন্তর্ভুক্ত করলেন না। রাসুলুল্লাহ ﷺ আবদুল্লাহ বিন জাহাশকে একটি পত্র দিয়ে বললেন, দুই দিন পথ চলার পর পত্রখানা খুলে পড়বে; তার আগে নয়। চিঠি পরার পর তাতে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সে অনুসারে কাজ করবে এবং সঙ্গীদের কারও ওপর কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেবে না।’

দুই দিন ধরে পথ চলার পর আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা. চিঠি খুলে পড়লেন। তাতে লেখা ছিল—‘আমার এই চিঠি যখন তুমি পড়বে, ঠিক তখনই রওয়ানা হয়ে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলা নামক স্থানে গিয়ে যাত্রাবিরতি করবে। সেখানে কুরাইশদের জন্য ওত পেতে থাকবে এবং কোনো তথ্য পেলে আমাকে জানাবে।’

আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা. চিঠিখানা পড়েই বললেন, ‘আমি মেনে নিলাম ও অনুগত রইলাম।’ এরপর সঙ্গীদেরকে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাকে নাখলায় গিয়ে কুরাইশদের জন্য ওত পেতে থাকতে বলেছেন এবং কোনো খবর জানলে তা তাজে জানাতে বলেছেন। আর এ ব্যাপারে তোমাদের কারও ওপর বাধ্যতামূলক কোনো দায়িত্ব চাপাতে নিষেধ করেছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি শাহাদাত লাভে ইচ্ছুক থাকে, তবে সে যেন যায়। আর যে তা চায় না, সে যেন ফিরে যায়। তবে আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর আদেশ পালন করব।’

এ কথা বলার পর আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা.-এর সঙ্গে সবাই রওয়ানা হয়ে গেল। কেউই ফিরে গেল না। তিনি হিজাযে প্রবেশ করলেন। বাহরান নামক স্থানে সা‘দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রা. ও উতবা ইবনু গাজওয়ান রা. তাদের উট হারিয়ে ফেললেন। তারা দু-জন ওই উটকে অনুসরণ করে চলছিলেন। ফলে ওই উট খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে তারা আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা. থেকে পিছিয়ে পড়লেন। আর আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা. ও তার সঙ্গীগণ যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। চলতে চলতে তারা নাখলায় পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন।

এই সময় তাদের নিকট দিয়ে কুরাইশদের একটি কাফেলা কিসমিস ও চামড়া বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই সাথে কুরাইশদের অন্যান্য পণ্যদ্রব্যও ছিল। এই দলের মধ্যে আমর ইবনু হাদরামি, উসমান ইবনু আবদুল্লাহ ও তার ভাই নওফেল ইবনু আবদুল্লাহ এবং হাকাম ইবনু কাইসান ছিল। আবদুল্লাহ ইবনু জাহাশ রা.-এর দল তাদেরকে দেখে ঘাবড়ে গেল। কারণ, তারা তাদের খুব নিকটে পৌঁছে গিয়েছিল। উক্কাশা ইবনু মিহসান রা. তাদের কাছে চলে গেলেন। তার মাথা মুণ্ডানো ছিল। তাকে দেখে কুরাইশরা আশ্বস্ত হলো। বলল, ‘এরা স্থানীয় বাসিন্দা। এদের দিক থেকে কোনো ভয় নেই।’ ওদিকে মুসলমানরা কুরাইশদের ব্যাপারে পরামর্শে বসলেন। সেদিন ছিল রজব মাসের শেষ দিন।[2] সকলে মত প্রকাশ করলেন যে, আজকে কুরাইশদের এই কাফেলা ছেড়ে দিলে এরপরই তারা হারাম এলাকায় প্রবেশ করবে এবং আমাদের হাত থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। পক্ষান্তরে আজ যদি তাদেরকে হত্যা করা হয়, তাহলে নিষিদ্ধ মাসের মধ্যে রক্তপাত ঘটানোর দোষে দোষী হতে হবে। তাই তারা দ্বিধদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলেন এবং কুরাইশ কাফেলার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সংকোচ বোধ করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেললেন এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে একমত হলেন যে, যাকে যাকে পারা যায়, হত্যা করতে হবে এবং তাদের যার কাছে যা আছে, তা নিয়ে নিতে হবে। ওয়াকিদ ইবনু আবদুল্লাহ তামিমি আমর ইবনু হাদরামিকে বর্শার আঘাতে হত্যা করলেন। আর উসমান ইবনু আবদুল্লাহ ও হাকাম ইবনু কাইসানকে বন্দি করলেন। নওফেল ইবনু আবদুল্লাহ পালিয়ে আত্মরক্ষা করল। তাকে কিছুতেই ধরা সম্ভব হলো না। তারপর আবদুল্লাহ ইবনু জাহাশ রা. অবশিষ্ট লোক ও বন্দি দু-জনকে নিয়ে মদিনায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট উপস্থিত হলেন।

রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, ‘আমি তো তোমাদেরকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে বলিনি।’ তারপর তিনি কাফেলা ও বন্দিদের আটকে রাখলেন এবং তাদের সম্পদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর এ উক্তিতে আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা. সবার সামনে খাটো ও লা-জওয়াব হয়ে গেলেন। তার দলের লোকেরা ভাবলেন, তাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। মুসলমানরা এ কাজের জন্য তাদের তিরস্কার করলেন। ওদিকে কুরাইশরা বলতে লাগল, ‘মুহাম্মাদ ও তার সহচররা নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা লঙ্ঘন করেছে। তারা নিষদিদ্ধ মাসে রক্ত পাত ঘটিয়েছে, অন্যের সম্পদ হস্তগত করেছে এবং লোকজনকে বন্দি করেছে।’ মক্কায় যে কয়জন মুসলমান তখনো ছিল, তাদের একজন জবাব দিলো, ‘মুসলমানরা যা করেছে, শাবান মাসে করেছে।’[3]

এই প্রচারণা অভিযান যখন ব্যাপক আকার ধারণ করল তখন আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি আই আয়াত অবতীর্ণ করলেন—

‘তারা তোমাকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। তুমি বলো, এ মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া অন্যায়। তবে আল্লাহর কাছে তার চেয়েও বড় অন্যায় হলো আল্লাহর পথে থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখা, কুফর করা, মসজিদে হারামে যেতে বাধা দেওয়া এবং মসজিদে হারামের অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা। বস্তুত নির্যাতনের মাধ্যমে মানুষকে বিপথগামি করা হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ। তারা অবিরতভাবে তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, যাতে করে সাধ্যে কুলালে তোমাদেরকে ধর্মান্তরিত করতে পারে।’[4]

অর্থাৎ তোমরা যদি হারাম মাসে হত্যাকাণ্ড করেও থাকো, তবে তারা তো আল্লাহর পথে চলতে তোমাদেরকে বাধা দিয়েছে। সেই সাথে কুফরিও করেছে এবং মসজিদে হারামে তোমাদেরকে যেতে দেয়নি। আর তোমরা মসজিদুল হারামের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তোমাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা আল্লাহর কাছে তোমাদের একজন কাফিরকে হত্যা করার চাইতে মারাত্মক অপরাধ। আর তারা যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে ধর্মত্যাগে বাধ্য করত এবং কুফরি অবস্থায় ফিরিয়ে আনত, সেটা হত্যার চেয়েও জঘন্য কাজ। আর এই জঘন্যতম অন্যায় কাজ তারা তোমাদের সাথে অবিরতভাবেই করে চলেছে এবং তা থেকে ফিরছে না বা তাওবা করছে না।

কুরআনে যখন এই পথনির্দেশ এল এবং আল্লাহ মুসলমানদের ভীতি ও দুশ্চিন্তা দূর করে দিলেন, তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ আটক কাফেলা ও বন্দিদেরকে সরকারিভাবে গ্রহন করলেন। কুরাইশরা তার কাছে উসমান ও হাকামকে পণ্যের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বার্তা পাঠাল। রাসুলুল্লাহ ﷺ জবাবে তাদেরকে জানালেন, ‘আমাদের দুইজন লোক সা‘দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনু গাজওয়ান ফিরে না-আসা পর্যন্ত বন্দিদের মুক্তি দেবো না। কারণ, তোমাদের দ্বারা তাদের জীবন বিপন্ন হবার আশঙ্কা রয়েছে।’ এরপর শিগগিরই সা‘দ ও উতবা রা. ফিরে এলে রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে পণ্যের বিনিময়ে মুক্তি দিলেন। তবে বন্দিদ্বয়ের মধ্যে হাকাম ইবনু কাইসান ইসলাম গ্রহণ করে ও প্রকৃত মুসলিমে পরিণত হন। তারপর তিনি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছেই থেকে যান। পরে বীরে মাউনার ঘটনায় তিনি শহিদ হন। উসমান ইবনু আবদুল্লাহ মক্কা চলে যায় এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।[5]

উসামা রা.-এর ভুল

সহিহ বুখারিসহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, উসামা রা. বলেন :

بَعَثَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الحُرَقَةِ، فَصَبَّحْنَا القَوْمَ فَهَزَمْنَاهُمْ، وَلَحِقْتُ أَنَا وَرَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ رَجُلًا مِنْهُمْ، فَلَمَّا غَشِينَاهُ، قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ فَكَفَّ الأَنْصَارِيُّ فَطَعَنْتُهُ بِرُمْحِي حَتَّى قَتَلْتُهُ، فَلَمَّا قَدِمْنَا بَلَغَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: «يَا أُسَامَةُ، أَقَتَلْتَهُ بَعْدَ مَا قَالَ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ» قُلْتُ: كَانَ مُتَعَوِّذًا، فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا، حَتَّى تَمَنَّيْتُ أَنِّي لَمْ أَكُنْ أَسْلَمْتُ قَبْلَ ذَلِكَ اليَوْمِ

রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে হুরকা গোত্রের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আমরা প্রত্যুষে গোত্রটির ওপর আক্রমণ করি এবং তাদেরকে পরাজিত করি। এ সময়ে আনসারদের এক ব্যক্তি ও আমি তাদের (হুরকাদের) একজনের পিছু ধাওয়া করলাম। আমরা যখন তাকে ঘিরে ফেললাম তখন সে বলে উঠল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এ বাক্য শুনে আনসারি তার অস্ত্র সামলে নিলেন। কিন্তু আমি তাকে আমার বর্শা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে ফেললাম। আমরা মদিনায় ফেরার পর এ সংবাদ নবি ﷺ পর্যন্ত পৌঁছালে তিনি বললেন, হে উসামা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরেও তুমি তাকে হত্যা করেছ? আমি বললাম, সে তো জান বাঁচানোর জন্য কালিমা পড়েছিল। এর পরেও তিনি এ কথাটি ‘হে উসামা, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরেও তুমি তাকে হত্যা করেছ’ বারবার বলতে থাকলেন। এতে আমার মন চাচ্ছিল যে, হায়, যদি সেই দিনটির পূর্বে আমি ইসলামই গ্রহণ না করতাম![6]

অন্য বর্ণনায় এসেছে :

قَالَ: «مَنْ لَكَ بِلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟». فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّمَا قَالَهَا مَخَافَةَ السِّلَاحِ. قَالَ: «أَفَلَا شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ حَتَّى تَعْلَمَ مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ قَالَهَا أَمْ لَا؟ مَنْ لَكَ بِلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟» فَمَا زَالَ يَقُولُهَا حَتَّى وَدِدْتُ أَنِّي لَمْ أُسْلِمْ إِلَّا يَوْمَئِذٍ

রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, কিয়ামাতের দিন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তোমার বিরুদ্ধে বাদী হলে কে তোমার জন্য সুপারিশ করবে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, সে তো অস্ত্রের ভয়ে কালিমা পাঠ করেছে। তিনি বললেন, সে অস্ত্রের ভয়েই কালিমা পাঠ করেছে, তা কি তুমি তার অন্তর চিড়ে দেখেছ? কিয়ামাতের দিন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সামনে কে তোমাকে নাজাত দেবে? তিনি বারবার এ কথা বলতে থাকলেন। এমন কি আমার মনে হচ্ছিল, আমি যদি এ দিনটির পূর্বে মুসলিম না হতাম![7]

খালিদ রা.-এর ভুল

সহিহ বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে :

بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَالِدَ بْنَ الوَلِيدِ إِلَى بَنِي جَذِيمَةَ، فَدَعَاهُمْ إِلَى الإِسْلاَمِ، فَلَمْ يُحْسِنُوا أَنْ يَقُولُوا: أَسْلَمْنَا، فَجَعَلُوا يَقُولُونَ: صَبَأْنَا صَبَأْنَا، فَجَعَلَ خَالِدٌ يَقْتُلُ مِنْهُمْ وَيَأْسِرُ، وَدَفَعَ إِلَى كُلِّ رَجُلٍ مِنَّا أَسِيرَهُ، حَتَّى إِذَا كَانَ يَوْمٌ أَمَرَ خَالِدٌ أَنْ يَقْتُلَ كُلُّ رَجُلٍ مِنَّا أَسِيرَهُ، فَقُلْتُ: وَاللَّهِ لاَ أَقْتُلُ أَسِيرِي، وَلاَ يَقْتُلُ رَجُلٌ مِنْ أَصْحَابِي أَسِيرَهُ، حَتَّى قَدِمْنَا عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرْنَاهُ، فَرَفَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَهُ فَقَالَ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَبْرَأُ إِلَيْكَ مِمَّا صَنَعَ خَالِدٌ مَرَّتَيْنِ»

নবি ﷺ এক অভিযানে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রা.-কে বনি জাযিমার বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। (সেখানে পৌঁছে) খালিদ রা. তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু ‘আমরা ইসলাম কবুল করলাম’—এ কথাটি তারা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারছিল না। তাই তারা বলতে লাগল, আমরা স্বধর্ম ত্যাগ করলাম, আমরা স্বধর্ম ত্যাগ করলাম। তখন খালিদ তাদেরকে হত্যা ও বন্দি করতে থাকলেন এবং আমাদের প্রত্যেকের কাছে বন্দিদেরকে সোপর্দ করতে থাকলেন। অবশেষে একদিন তিনি আদেশ দিলেন, আমাদের সবাই যেন নিজ নিজ বন্দিকে হত্যা করে ফেলি। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আমার বন্দিকে হত্যা করব না। আর আমার সঙ্গীদের কেউই তার বন্দিকে হত্যা করবে না। অবশেষে আমরা নবি ﷺ-এর কাছে ফিরে আসলাম। আমরা তার কাছে এ ব্যাপারটি উল্লেখ করলাম। নবি ﷺ তখন দু-হাত তুলে বললেন, হে আল্লাহ, খালিদ যা করেছে আমি তার দায় থেকে মুক্ত হওয়ার কথা তোমার নিকট জ্ঞাপন করছি। এ কথাটি তিনি দু-বার বললেন।[8]

এছাড়াও উহুদ ও হুনায়নের যুদ্ধে মুজাহিদ সাহাবিদের ভুল সিদ্ধান্তের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর গৃহীত পদক্ষেপ ও কৃত আচরণও এর প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এভাবে নবিজীবনের বাঁকে বাঁকে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সেগুলোকে গ্রন্থের পাতা থেকে তুলে এনে জীবনে প্রয়োগ করা। নবি ﷺ-এর উত্তরসূরি শব্দের লাজ রক্ষা করা।


[1] সুরা মায়িদা :

[2] তাফসিরের ইবনু কাসিরের বর্ণনা অনুসারে সেই দিনটি ছিল জুমাদাল উখরা মাসের শেষ দিন বা রজব মাসের শুরুর দিন। আবদুল্লাহ বিন জাহাশ রা.-এর বাহিনী নিশ্চিত ছিলেন না, সেই দিনটি আসলে কোন দিন ছিল।

[3] এ কথা বলার পেছনে যুক্তি ছিল—রজব মাসের শেষ তারিখের সূর্যাস্তের পর শাবান মাস শুরু হয়েছিল।

[4] সুরা বাকারাহ :

[5] সিরাতে ইবনু হিশাম : সারিয়্যাতু আবদিল্লাহ ইবনি জাহাশ।

[6] সহিহ বুখারি : ৪২৬৯, ৬৮৭২; সহিহ মুসলিম : ১৫৯  

[7] সহিহ মুসলিম : ৯৬; সুনানে আবু দাউদ : ২৬৪৩

[8] সহিহ বুখারি : ৪৩৩৯

Share This