বিশ্বের সকল কুফরি পরাশক্তি ঐক্যবদ্ধ কেন? কেন হাদিসেও কুফরকে এক মিল্লাত বলা হয়েছে? বিধর্মীরাও উপাসনা করে, মুসলমানরাও উপাসনা করে। বিধর্মীরাও উপবাস পালন করে, মুসলমানরাও উপবাস পালন করে।বিধর্মীরাও উৎসবের আয়োজন করে, মুসলমানরাও বছরে দুদিন উৎসবের আয়োজন করে। বিধর্মীরাও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে, মুসলমানরাও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিধর্মীরাও জ্ঞানার্জন করে, মুসলমানরাও জ্ঞানার্জন করে। বিধর্মীরাও আত্মশুদ্ধির সাধনা করে, মুসলমানরাও আত্মশুদ্ধির সাধনা করে। বরং বিধর্মীদের অনেকে সন্ন্যাসী ও বৈরাগীও হয় আর ইসলাম ধর্মে সন্ন্যাসজীবন ও বৈরাগ্যসাধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এতদসত্ত্বেও সবাই কেন ইসলামকেই নিজেদের শত্রু বানিয়ে রেখেছে?

এর উত্তর সহজ। কারণ, ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত কিছু ইবাদতের নাম নয়। ইসলাম শুধু দাওয়াত, তালিম আর ইসলাহের নাম নয়। বরং ইসলাম এমনই এক শাশ্বত জীবনবিধান, যা শুধু নিজ পরিধিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েই সন্তুষ্ট হয় না; বরং যা অন্য সকল ধর্ম মতবাদ ও মতাদর্শের ওপর বিজয়ী হতে চায়। ইসলাম সমুন্নত ধর্ম। সে কখনো নিচু হয় না, কারও আদর্শের সামনে মাথা নত নোয়ায় না। কুরআনের ভাষায় আল্লাহ তার রাসুলকে পথনির্দেশ ও সত্য দীনসহ এ জন্য পাঠিয়েছেন যে, তিনি সকল ধর্ম মতবাদ ও মতাদর্শের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করে প্রকাশ করবেন; যদিও কাফির-মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।

কুরআন থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কাফির-মুশরিকরা ইসলামের বিজয়কে অপছন্দ করে। অন্যথায় নামাজ-রোজা নিয়েই তাদের মূল আপত্তি নয়। বরং শুয়াইব আ.-এর সম্প্রদায় তো স্পষ্টই বলেছে, হে শুয়াইব, তোমার নামাজ কি তোমাকে এই নির্দেশ দেয় যে, আমরা আমাদের বাপ-দাদার উপাস্যদের পরিত্যাগ করব এবং আমাদের সম্পদে যাচ্ছেতাই হস্তক্ষেপ করা থেকে তথা পুঁজিবাদী মানসিকতা লালন করা থেকে বিরত থাকব?

সুতরাং ইসলামের সঙ্গে জাহিলিয়্যাতের তখনই দ্বন্দ্ব বাঁধে, যখন ইসলাম গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়াতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীবাদ, পুঁজিবাদ থেকে শুরু করে সকল বাতিল মতবাদ ও কুফরি ধর্ম নিয়ে কথা বলে। সবকিছুকে পরাভূত করে নিজেকে বিজয়ীরূপে প্রকাশিত করার চেষ্টা করে। সবচে বড় জাহিলিয়্যাত হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা। এ কথা আমরা স্বীকার করি বা না করি, এটাই নির্দ্বিধ সত্য।

ইসলাম বিজয়ী হয় জিহাদ ও কিতালের মাধ্যমে। এ ছাড়াও কিছুক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাওয়াহ করার মাধ্যমে। আবু জাহলের প্রেতাত্মারা তাই এ দুটো বিষয়কে দমিয়ে দিতে চায়। মুসলমানদের থেকে এ দুয়ের চেতনা দূর করতে চায়। এ ছাড়া ইসলামের অন্য সব বিষয় তাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ নয়। হ্যাঁ, অন্যরাও কখন না আবার এই চেতনা লালন করা শুরু করে, সেই এক আশঙ্কা তো ভেতরে থাকেই। এ জন্য গোটা ইসলামকে মুছে ফেলতে পারলেই সবচে ভালো। অন্যথায় এই সময়ে অবশ্যকরণীয় হলো, মুসলিম উম্মাহ থেকে কিতালের চেতনা দূর করে ফেলা এবং অমুসলিমের সামনে ইসলামি হুকুমতের দাওয়াহর মানসিকতা মুছে ফেলা। এর মাধ্যমে বাঘের জাতিকে খুব সহজেই বেড়ালে পরিণত করা সম্ভব।

ওরা ওদের মিশনে সফল। এত বেশি সফল যে, কিতাল-বিরোধিতায় মুসলমানদের সকল ঘরানা ঐক্যবদ্ধ। কী মাজহাবি আর কী লা মাজহাবি, কী তাবলিগি আর কী পিরের মুরিদগোষ্ঠী, কী কওমি আর কী বেরেলবি, কী দেওবন্দি আর কী আলিয়াপন্থী, কী সুন্নি আর কী ওয়াহাবি, কী শিবির আর কী মাদখালি – এ প্রসঙ্গ আসলে সবাই এক ঘাটে পানি খায়। পৃথিবীর মধ্যে বর্তমানকালের একমাত্র ইজমায়ি মাসআল; যে ব্যাপারে ইজমা এতটাই সুদৃঢ় যে, কারওই কোনো মতবিরোধ নেই। হ্যাঁ, সব ঘরানায়ই কিছু মানুষ তো অবশ্যই রয়েছে, যারা শুধু তাত্ত্বিক কিতালকেই নয়, বরং প্রায়োগিক কিতালকেই ভালোবাসে। কিন্তু এদের সংখ্যা একেবারে অপ্রতুল। হাদিসেই বলা হয়েছে, শীঘ্রই ইসলাম গুরাবা হয়ে যাবে। হয়েছেও তা-ই। আর হাদিসের ঘোষণা মিথ্যা হবারও তো কোনো জো নেই।

বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আদতে হকপন্থীদের সংখ্যা কমছে। হকপন্থীরা গুরাবা হয়ে গেছে। চারিদিকে আজ মুরজিয়াদের জয়। তারাই হয়ে গেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর তারাই মূলধারা। এমনকি তাদের বিরোধিতাকারী প্রকৃত হকপন্থীদের বলা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন। অথচ হকের ওপর মাত্র একজন প্রতিষ্ঠিত থাকলে সেই একজনকেই বলা হয় একটি জাতি। যেমন কুরআনে ইবরাহিম আ.-কে বলা হয়েছে একটি উম্মাহ, একটি জাতি। অনেকটা ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’র মতো।

মুরজিয়াদের নিয়ে কুফরি পরাশক্তির কোনো মাথাব্যথা নেই। সব মাথাব্যথা গুরাবাদের নিয়ে। মুরজিয়ারা তো বরং তাদের দোসর। এদেরকে দিয়ে গুরাবাদেরকে সহজে শিকার করা যাবে। গুরাবাদের জন্য তাই এটা বড়ই সংকটময় মুহূর্ত। বাইরের শত্রু যতটা না ভয়ংকর, তারচে অনেকগুণ বেশি ভয়ংকর ভেতরের শত্রুরা। নিজেদের জ্ঞাতিভাইরা।

আপনার ঘরে আছে যে শত্রু
তারে আগে করো জয়,
ভাঙো সে দেয়াল
প্রদীপের আলো যাহা আগুলিয়া রয়।

মুসলমানরা বাঘ থেকে বেড়াল হবে আর বেড়ালরা ক্রমশ বাঘে পরিণত হবে। সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম নেই, এ কথা আমরা বলে সান্ত্বনা নিতে পারি। কিন্তু হাদিসের ঘোষণা অনুসারে সকল কাফির এক জাতি। আর তাদের সবার শত্রু হলো ইসলাম ও মুসলমান। যতদিন একজন মুসলমান জীবিত আছে, ততদিন তাদের শত্রুতা জারি থাকবে। হ্যাঁ, যেখানে ক্ষমতা পাবে, সেখানে শক্তি প্রয়োগ করবে। রক্তের স্যুপ বানিয়ে খাবে। আর যেখানে ক্ষমতা পাবে না, সেখানে সাধু বাবা সেজে ওম শান্তি’র জিগির তুলবে।

রক্ত নিয়ে মায়াকান্না অনেকেই দেখাবে। কিন্তু রক্তের প্রতিশোধ কেবল উম্মাহর সিংহরাই নেবে। বাকিরা যে কিছু করবে না, তা নয়। তারা এই ইস্যু নিয়ে কিছুদিন চিৎকার করে মাইক ফাঁটিয়ে পকেট ভারী করবে। কেউ এর প্রতিবাদে বিক্ষিপ্ত কিছু মিছিল-সমাবেশ করবে। দুদিন পর সবাই সব ভুলে বা অদৃষ্টের লিখন ভেবে নিজেদের কাজে মনোযোগী হবে। আগামী নির্বাচনের ভোটযুদ্ধে জয়ের পরিকল্পনা নেবে। তা ছাড়া খালি কলসি তো বেশি বাজবেই। এটাই যে তার বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে উম্মাহর সিংহরা নীরবে শিকার করবে টার্গেটকে এবং এর প্রতিশোধ নেবে নববি পন্থায়।

নবিজি সা. যেমন মিছিল-মিটিং আর মাইকে চিৎকার করে ঠিক ঠিক আদায় করেই ক্ষান্তি দিতেন না, উম্মাহর সিংহরাও তেমনি এসবে ক্ষান্তি দেয় না। তারা স্রেফ তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়; প্রয়োগে বিশ্বাসী। তত্ত্ববাজরা তর্ক নিয়ে থাকবে। প্রয়োগকারীরা যা প্রয়োগ করার, তা প্রয়োগ করবে। হ্যাঁ, তত্ত্ববাজরা নিজেদের তত্ত্বের জাল বিছিয়ে প্রয়োগকারীদের গতি ব্যাহত করার জন্য সময়ে সময়ে ভালো ভূমিকা রাখবে।

যারা এ নীতি কপচায় যে, আমরা কিতালবিরোধী নই। যদিও আমাদের মধ্যে কিছু লোক তাবলিগবিরোধী, কিছু আছে খানকাহবিরোধী। তবে কেউই কিতালবিরোধী না। সবাই কিতালের চেতনা লালনকারী। আমরা শুধু এ যুগের কিতালকারীদের পন্থাবিরোধী। নির্ধারিত পন্থাবিরোধী হওয়া আর মূল জিনিসের বিরোধী হওয়া তো এক কথা নয়।

আচ্ছা, বহুত আচ্ছি বাত। তো এ যুগে কিতালের রূপরেখা কী? দাজ্জাল ধ্বংস হওয়া অবধি তো বাতিল থাকবে। এখন ফিতনার যুগে তারা পূর্বের চাইতেও ঢের শক্তিশালী। আর কিয়ামাত পর্যন্তই কিতাল জারি থাকবে। তো ২০০ বছর আগে আপনাদের পূর্বপুরুষরা কিতাল করেছেন, এটা সবাই জানে। এরপর গত ২০০ বছরে, বিশেষ করে এই একবিংশ শতাব্দীতে আপনারা কী করেছেন বা কী করার পরিকল্পনা রাখেন, অনুগ্রহপূর্বক এটা জানান। আর কিতালের জন্য তো ই’দাদ ফরজ। কোথায় আপনাদের ই’দাদ, তা-ও দেখান। যারা খুরুজ করবে, তারা অবশ্যই ই’দাদও করবে। কুরআনেই এটা বলা হয়েছে। এর বিপরীতটাকে মুনাফিকদের স্বভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তো এত তত্ত্ব না কপচিয়ে প্রয়োগের কিছু রূপরেখা জাতিকে দেখালেই তো কেল্লাফতে হয়ে যায়।

না মানে, আমার কাছে রূপরেখা নেই বা আমি এভাবে ভাবিনি তো কী হয়েছে। ভেতরে জযবা আছে। কারও না কারও কাছে রূপরেখাও আছে।

কার কাছে আছে বলেন।

না মানে, আছে। থাকবে না কেন। এখনো সময় হয়নি। সময় হলে ঠিকই প্রকাশ করা হবে।

কখন সময় হবে?

এই তো যখন আমাদের ওপর কেউ হামলা করবে। (আমাদের জাতীয়াতাবাদ আক্রান্ত হবে। তার আগে মুসলমানরা সব মরে শেষ হয়ে যাক। তাতে আমাদের কী! আমরা তো এখনো পর্যন্ত সুখে আছি, শান্তিতে থাকতে পারছি। আর দেশে ইসলাম না থাকলেও আমাদের ব্যক্তিজীবনে তো আছে। গণতান্ত্রিক পন্থায় এগিয়ে এগিয়ে একসময় দেশেও আমরা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে ফেলব। আপনারাই তো আমাদের ভোটের বিরোধিতা করেন। নইলে তো সেই কবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মত নিয়ে আল্লাহর আইন পাশ করে ফেলতাম।)

নিজে কিছু করবেন না আর অন্যদেরও করতে দেবেন না, এটা তো ঠিক না।

ঠিক না কেন? আমরা কত কিছু করছি। দীনের কাজ কি ওই একটাই? তা ছাড়া এখন আমরা দুর্বল। এখনো মাক্কিযুগে আছি। তাই নফসের জিহাদ করছি। কোনোদিন সময় এলে অন্যকিছুও করব।

থাকেন ভাই আপনি আপনার তত্ত্ব নিয়ে। আপনার লেজ ধরে বসে থাকলে তত্ত্ব থেকে যাবে তত্ত্বেরই মধ্যে। তার কোনো প্রয়োগই হবে না। তত্ত্ব জীবনে উঠে আসবে না। আপনারা এমনই তত্ত্বপূজারী যে, আপনাদের মুজাহিদ কমিটি ও আমিরুল মুজাহিদিনের কাছেও হালজামানার কিতালের কোনো রূপরেখা নেই। বরং তারা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে থাকে। আপনাদের খিলাফাহ নামের দলগুলোর কাছেও নববি মানহাজের খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা ও খিলাফাহভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার যথার্থ রূপরেখা নেই। আপনারা আকাবির আকাবির করে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও আপনাদের মধ্যে নানুতবি বা শাইখুল হিন্দের দেখা নেই। আমরা প্রয়োগে বিশ্বাসী; কেবলই তত্ত্বে নয়। কোনোদিন যদি প্রয়োগ করে দেখাতে পারেন তাহলে এত ঢোল পেটানো লাগবে না। জাতি এমনিই আপনাদের মেনে নেবে। আর যতদিন তা হচ্ছে না, ততদিন নিজেদের চরকায় তেল দিন আর অন্যদেরকে অন্য কাজ করতে দিন। ইসলামের একমাত্র ডিলার সেজে নিজেও কাজ না করে আর মানুষকেও কাজ না করতে দিয়ে বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না।

আমরা অশান্তির ফেরিওয়ালা নই। শান্তি তো সবার পছন্দ। সুখ তো সবার কাম্য। দুনিয়া মুমিনের কারাগার, কাফিরের স্বর্গ। মুমিনরাও দুনিয়াকে স্বর্গ হিসেবে পেলে তাদের তো ভালো লাগারই কথা। শান্তির স্লোগানের আড়ালে সূক্ষ্মভাবে এ যুগের মাঠে-ময়দানের কিতাল-বিরোধিতা সংবলিত পোস্টগুলোতে শান্তিপ্রিয় ফেসবুকারদের উচ্ছসিত সাড়া দেখে আপনি বিষয়টা সহজেই অনুমান করতে পারবেন। আর অনুধাবন করতে পারবেন মহান প্রতিপালকের বাণীর সার্থকতা : ‘তোমাদের ওপর কিতালকে ফরজ করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়।’

আজকাল একটা বিষয় ভালোই লাগে। ময়দানের লড়াকুদের যেমন সবাই ভয় পায়, এমনকি আত্মীয়-পরিজন ও সাথি-সঙ্গীরাও তাদের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করে, একইভাবে ফেসবুকে কিতালের কথা বলে – এমন মানুষজনকেও অন্যরা নিদারুণ ভয় পায়। এমনকি তাদের পোস্টে লাইক-কমেন্ট করতেও বেশ শঙ্কাবোধ করে। ফেসবুকে ইবাদত, তাবলিগ, পির-মুরিদি, গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে শুরু করে সব বিষয়ের বাধাহীন আলোচনা হতে পারবে। শুধু এই এক অস্পৃশ্য (!) বিষয়ের আলোচনা করা শুধু জঘন্য অপরাধই নয়; বরং অমার্জনীয় অপরাধ।

সেইফ জোন আর ডেঞ্জার জোনের সবক আজকাল অনেকের মুখে শোনা যায়। রাসুলুল্লাহ সা. মক্কার জীবনে ডেঞ্জার জোনে ছিলেন। মদিনাও তো খুব বেশি সুরক্ষিত ছিল না। ইহুদি, মুনাফিক ও আরব মুশরিকগোষ্ঠীর দোসরদের উৎপাত ভালোরকমই ছিল। ৯ বছরে নিজে উপস্থিত থেকে যুদ্ধ করলেন ২৭টা। বাহিনী পাঠালেন আরও ৪৭টা। এরপরও তর্কের খাতিরে সেটাকে সেইফ জোন ধরে নিলাম। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই মক্কাকে সেইফ জোন বলার সুযোগ নেই। রাসুলুল্লাহ সা. কি মক্কায় ইসলামের কোনো বিধান গোপন করেছেন? মক্কায় থাকাকালেই তো তিনি প্রকাশ্যে বাইতুল্লাহ তাওয়াফকালে কুফফার নেতাদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন। অবর্ণনীয় নির্যাতনের মুখে থেকেও বাতিলের সঙ্গে কখনো আপস করেননি, সত্যকে কখনো গোপন করেননি, নাহি আনিল মুনকার একদিনের জন্যও পরিত্যাগ করেননি, পিঠ বাঁচাতে কোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান দাঁড় করাননি। কারণ তিনি শুধু নাবিয়্যুর রাহমাহই ছিলেন না; পাশাপাশি ছিলেন নাবিয়্যুস সাইফ ওয়াল মালহামাহ। স্রষ্টাও শুধু জান্নাত বানিয়েই ক্ষান্তি দেননি। কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন এবং তাদের জন্য, তারা চিরকাল বসবাস করার জন্য জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন।

আজ হেকমতের কথা বললে সবাই খুশি হয়। বাহ্বা দেয়। আপনি এ ক্ষেত্রে সবচে বেশি উল্লসিত হতে দেখবেন ইসলামিক ডেমোক্রেটিকদের আর তথাকথিত পিরদের মুরিদদের। এ যুগে কিতালের কথা শুনলে তাদের কলজে যেন পুড়ে যায়। হ্যাঁ, তাত্ত্বিক কিতালকে তারাও সমর্থন করে। এটা না করলে তো এই প্রজাতিকে মুসলমান বলারই সুযোগ ছিল না। তবে তারা এসবের প্রয়োগে বিশ্বাসী নয়। এদের চোখে কিতালের কথা যারাই বলে, তারাই আবেগী, অতি জযবাতি, অপরিণামদর্শী; বরং খারেজি, তাকফিরি।

ইসলামিক ডেমোক্রেটিক দলগুলো উম্মাহকে ভোটের রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই উপহার দেবার সক্ষমতা রাখে না। পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ার পর তারা সত্যের পক্ষে লড়াই করতে চায়; কিন্তু পরিস্থিতি কীভাবে অনুকূল হবে, এর যথার্থ কোনো বিশ্লেষণ তাদের কাছে নেই। এরা হেকমতের দোহাই দিয়ে একবার উসামার বাহিনীর বিরুদ্ধাচারণ করে, আরেকবার মাসউদ আজহারের বাহিনীর বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করে। এরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবে কিতালিদের সহযোগিতা প্রদান তো করেই না, উল্টো তাদের বিরোধিতা করাকে নিজেদের কর্তব্য মনে করে। অন্যদিকে এরাই আবার নিজেদেরকে নানুতবি ও শাইখুল হিন্দের সন্তান দাবি করে। মাসউদ আজহার আমাদের, মোল্লা আমাদের এগুলো বলে সময়ে সময়ে ক্রেডিট নেওয়ারও চেষ্টা করে। এরা দুর্বল বাতিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও শক্তিশালী বাতিলের বিরুদ্ধে না এরা কখনো অবস্থান নিয়েছে আর না কখনো সেই ইচ্ছা লালন করে।

যাহোক, এ কথাগুলো অধিকাংশের কাছেই ভালো লাগবে না। শান্তির বার্তা দিলে এক লক্ষ স্বাক্ষর আসা মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র। আর কোটি কোটি সমর্থন পাওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কিতালের পক্ষে বললে তা অধিকাংশজনেরই পছন্দ হবে না এবং না হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ খোদ স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে লক্ষ করে বলছেন : ‘তোমাদের ওপর কিতালকে ফরজ করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়।’

নবি প্রেরিত হওয়ার পর থেকে দাজ্জাল ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত কিতাল জারি থাকবে। এ কথা তারাও বলে। না বললে তো আর ইমানই থাকবে না। কিন্তু এই নব্য জাহিলিয়্যাতের যুগে কিতালের কোনো প্রায়োগিক রূপরেখা তাদের কাছে নেই। তাদের কাছে এর রূপরেখা চেয়েও লাভ নেই। কারণ, তারা শুধু ভোটের রাজনীতির পথই দেখাতে পারে, তারা শুধু হেকমতের নামে আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়া এবং বাতিলের সঙ্গে আপস করার শিক্ষাই দিতে পারে। তারা বাতিলের সঙ্গে আপসহীন মানসিকতা লালন করে হুসাইনের মতো নিজের ও নিজের পরিজনের রক্তে কারবালার ময়দানকে না কখনো রঞ্জিত করে আর না অন্যদের করতে দেয়। যুগে যুগে এদের কাজই হলো কিতালিদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া।

এসব হেকমতিয়ারদের মুখোশ যতদিন জাতির সামনে উন্মোচিত না হবে, ততদিন এ জাতি বিভ্রান্ত হতেই থাকবে। মুসলিম উম্মাহর কাপুরুষোচিত মানসিকতার জন্য একমাত্র দায়ি এসব অথর্ব কাণ্ডারিরা, তথাকথিত হেকমতিয়াররা।

চিত্র অল্পস্বল্প করে পাল্টাচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। হেকমতিয়ারদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা পড়ার জন্য আশা করি ‘মিল্লাতে ইবরাহিমের জাগরণ’, ‘ফিতনার বজ্রধ্বনি’ আর ‘সুরা ফাতিহার আলোকে ইসলামি আকিদা ও মানহাজ’ই যথেষ্ট। এরপরের ভূমিকা পালন করবে ‘চেতনার শিকড়’ ইনশাআল্লাহ। আমরা রহমানকে সন্তুষ্ট করার জন্য সরব রয়েছি। এবার দেখা যাক, তারা তাদের গুরু শয়তানকে সন্তুষ্ট করার জন্য কী ভূমিকা রাখে। কথা হবে কলমের ভাষায়…। Let’s begin the game…

যারা সমালোচনার নীতি খুব কপচায়, তারাও জানে, এই নীতিগুলো যে সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আবু জাহেলের সমালোচনা উসুলুন নাকদের নীতি মেনে হয় না। মুনাফিকদের সমালোচনায়ও প্রসিদ্ধ কায়দাকানুন চলে না। যুগের গাদ্দার ও চাটুকারদের প্রতি মানুষের ঘৃণা স্বভাবজাত। উলামায়ে সু’র খোল্লমখোলা সমালোচনা ও সরলমনা মুসলিমদের সামনে তাদের স্বরূপ উন্মোচন আমাদের নীতি ও মানহাজ।

যারা তাদের অনুসৃত উলামায়ে সু’র সমালোচনা শুনলে ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে যা তা বকতে থাকে, তারাই আবার নিজেদের অপছন্দনীয় আলিমদের ব্যাপারে একই নীতি প্রয়োগ করে।

শ্রী শ্রী মাহমুদ মাদানি বা মুরজিয়াগুরু ফরীদ উদ্দীনকে নিয়ে বললে যাদের গায়ে আগুন ধরে, তারাই আবার মাওলানা ইজহার ও সালমান নদবিদের নিয়ে অশ্রাব্য মন্তব্য করে। তখন পুরোদমে ভুলে যায় নিজেদের কপচানো নীতি। এ জাতির ডাবল স্টান্ডার্ডের বৈশিষ্ট্য প্রাচীন। তারা একমাত্র নিজেদেরকেই হকের ডিলার মনে করে। নিজেদের সব কাজকে বৈধ করার হিলা-তাবিল তাদের জানা আছে।

নিজের লোকের সমালোচনা হারাম, আর অন্যদের সমালোচনা আরাম – এটাই যখন মূলনীতি হয়ে দাঁড়ায় তখন তাদের কথায় কর্ণপাত করাই নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

উদারতা ভালো। উদার মানসিকতা প্রশংসনীয়। ইসলামের যতগুলো সেক্টর রয়েছে, সবগুলোতে সাধ্যমতো পদচারণা এবং আন্তরিক সহায়তা মহৎ গুণের পরিচায়ক। মধ্যমপন্থা ও পরিমিতিবোধ উপকারী। তবে এ ক্ষেত্রে একটা সীমারেখা রয়েছে। যেমন, উদারতার শিরোনামে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত থেকে সরা যাবে না। উদারতা প্রদর্শনার্থে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনুকরণ করা যাবে না। আমাদের মহান সালাফগণ নিঃসন্দেহে উদার ছিলেন। কিন্তু তারা কি কখনো ঐক্যের খাতিরে এবং উদারতার শিরোনামে মুসলমানদের বাতিল ফেরকাগুলোর সঙ্গে আপস করেছেন, তাদের সঙ্গে ঐক্যের বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেছেন, নাকি তারা বাতিলপন্থী মুসলিমদের সঙ্গেও আল-বারা প্রতিষ্ঠা করেছেন? কারণ, আল-বারা শুধু কাফিরদের জন্যই নয়; বরং তা বিদআতি ও বাতিলপন্থীদের জন্যও। হ্যাঁ, উভয়ের স্তর ও পরিমাণে, প্রয়োগ ও কর্তব্য নির্ধারণে পার্থক্য রয়েছে, তা ভিন্ন কথা।

কোনো ব্যাপারে মাঝামাঝি অবস্থানের নামই মধ্যমপন্থা নয়। যা হক, তা-ই মধ্যমপন্থা। কারণ, আল্লাহ তাআলা হককে প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত রেখেছেন। হকের মধ্যে বাড়াবাড়িও নেই, ছাড়াছাড়িও নেই। হক এবং বাতিলের মধ্যে মাঝামাঝি অবস্থানের সুযোগ নেই। নিরপেক্ষতা ভালো। কিন্তু তাই বলে ধর্ম ও আদর্শ বিকিয়ে, আকিদা ও মানহাজ পরিত্যাগ করে কোনো নিরপেক্ষতা সমর্থনযোগ্য নয়। আজকাল কেউ নরম সুরে মাঝামাঝি ধরনের একটা কথা বলে দিলেই সবাই সেটাকে মধ্যমপন্থা বলে ধরে নেয়, সেই কথাকে আর কুরআন-সুন্নাহর নিক্তিতে মেপে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে না। এটা উম্মাহর জন্য অশনি সংকেত বৈ কিছু নয়।

এক ব্যক্তি নিরপেক্ষ। তাই সে আসল নবির প্রতিও ইমান আনে না, আবার ভণ্ড নবির প্রতিও ইমানের ঘোষণা দেয় না। সে হক্কানি পিরকেও যে চোখে দেখে, বিদআতি পিরকেও একই চোখে দেখে। সে তালিব-তানজিমকে যে চোখে দেখে, দাওলাকেও ঠিক একই চোখে দেখে। সে এতাআতি ও উলামাপন্থী উভয় ধারার তাবলিগের প্রতি একই সুরে সমর্থন পেশ করে। সে বাতিলপন্থীদের প্রতিও ঠিক সেই ‘ওয়ালা’ লালন করে, যা সে লালন করে হকপন্থীদের প্রতি। তার ‘বারা’ একমাত্র কুফফারগোষ্ঠীর সঙ্গে সীমাবদ্ধ। জান্নাতি এক ফেরকা আর জাহান্নামি ৭২ ফেরকা – সর্বমোট এই ৭৩ ফেরকাকে একসঙ্গে নিয়ে সে চলতে চায়। সে উদারতা প্রদর্শনার্থে সবার কাছেই ধর্ণা দেয় এবং সবার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে। পারলে সাধ্যানুসারে সবাইকে সহযোগিতাও প্রদান করে। আজকাল নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা অনেকের কাছে এটাই। এমন নিরপেক্ষতাও ইসলামে নবোদ্ভাবিত; পূর্বে যার গ্রহণযোগ্য কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

হক-বাতিলের দ্বন্দ্বেও মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকে আলি-মুআবিয়া রা.-এর মধ্যকার লড়াইয়ে নিরপেক্ষ সাহাবিদের দিয়ে দলিল দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের অবস্থা দেখে ভেতরে আক্ষেপ জাগে, নিজের গলদ দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করানোর জন্য মানুষ কীভাবে সাহাবিদের বড় এক দলকে অবচেতনেই বাতিল বলে আখ্যা দিচ্ছে! শানে সাহাবার সঙ্গে গোস্তাখি করে নিজেকে পাক্কা মুসলিম হিসেবে পরিচিত করতে চাচ্ছে। সুবহানাকা হাযা বুহতানুন আযিম।

Share This