তাকলিদ কী ও কেনো

মূলঃ মাওলানা ইয়াহইয়া নোমানি

 

প্র্রতিটি মুসলমান বিনাবাক্যে সংশয়হীন চিত্তে এ কথা বিশ্বাস করে— ইসলাম ধর্মের ভিত্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের একনিষ্ঠ আনুগত্যের ওপর। ইসলাম শব্দের অর্থই হলো— ‘নিজেকে সমর্পণ করা’, ‘আল্লাহর সামনে পূর্ণ অবনত হওয়া’। আর আল্লাহর আনুগত্যের সম্ভাবিত একমাত্র পন্থা হলো— প্র্রকৃত ইমান ও বিশ্বাসের সাথে, দ্বিধাহীন চিত্তে বান্দা অনুগত হবে সেই মহান রাসুলের, যাকে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির কাছে প্র্রেরণই করেছেন তার দীন ও দীনের বিধিবিধান পৌঁছে দেয়ার জন্য।

এ বিষয়টিকে অন্য ভাষায় এভাবে বলা যায়— ইসলামের বুনিয়াদ স্রেফ আল্লাহর আনুগত্যের ওপর। আর সেই আনুগত্যের পন্থা হলো, মহান রাসুলের অনুসরণ।

মহাগ্রন্থ আলকোরআন এ বাস্তবতার ঘোষণা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. তার নবুওয়াতি যিন্দেগিতে এর দাওয়াত দিয়েছেন। ইসলামের মনীষীগণও প্রত্যেক যুগে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জনসাধারণকে বুঝিয়েছেন।

কোরআন বলছে, রাসুলের অনুসরণই আল্লাহর আনুগত্য—

مَّنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّهَ وَمَن تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا

যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর যারা (তার আনুগত্য থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমি (হে মুহাম্মাদ!) তোমাকে তাদের তত্ত্বাবধায়ক বানিয়ে পাঠাইনি (যে, তাদের কাজের দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর বর্তাবে)। [সুরা নিসা : ৮০]

কোথাও বলছে, রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্যই হলো, আল্লাহর হুকুমের অধীনে তার অনুসরণ করা।

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللّهِ

আমি যে-কোনো রাসুলকে একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসুল পেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে। [সুরা নিসা : ৬৪]

কোথাও অকাট্য ঘোষণা দিচ্ছে, কস্মিনকালেও এটা সম্ভবপর নয় যে, কোনো ব্যক্তি ইমানদার হবে আবার সে আল্লাহ ও তার রাসুলের হুকুম ও ফায়সালার সামনে নতি স্বীকার করতে দ্বিধা-সংকোচ করবে।

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا

আল্লাহ ও তার রাসুল যখন কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়সালা প্রদান করেন, তখন কোনো মুমিন নর-নারীর জন্য সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা থাকে না। যে আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্যতা করলো, সে তো সু¯পষ্ট গোমরাহিতে পতিত হলো। [সুরা আহযাব : ৩৬]

কোথাও এ হাকিকতকে এভাবে বর্ণনা করেছে, ইমানদারদেরকে যখন আল্লাহ ও তার রাসুলের ফায়সালার দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা নিঃসঙ্কোচে বলে ওঠে, আমরা নতশির।

إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَن يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

মুমিনদের উক্তি তো এই— যখন তাদের মধ্যে ফায়সালা করার জন্য আল্লাহ ও তার রাসুলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা (হুকুম) শুনলাম এবং মেনে নিলাম। আর তারাই সফলকাম। [সুরা নুর : ৫১]

আল্লাহ এবং তার রাসুলের এমন নিঃশর্ত অনুসরণের কথা পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে বিবৃত হয়েছে। এসব আয়াতের সারনির্যাস তা-ই, যা উপরিউক্ত আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আর তা এই যে, যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলকে হাকিম এবং ফায়সালাকারীরূপে না মানে, তাদের স্থলে অন্যদেরকে বিচারকরূপে অগ্রগণ্য ও উত্তম জ্ঞান করে তবে সে কাফির, জাহিলিয়াতের মতাবলাম্বী এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য বর্জনকারী। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,

وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানানুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির। সুরা মায়িদা : ৪৪।

এজন্যই রাসুলুল্লাহ সা. দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন,

لاَ طاعةَ لمخلوقٍ فيْ معصيةِ الخالقِ

খালিকের (স্রষ্টার) অবাধ্যতায় মাখলুকের (সৃষ্টির) কোনো প্রকার আনুগত্য করা যাবে না। [মুসনাদে আহমাদ : ১০৯৫]

‪‎শরিয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে তবে ইমামগণের তাকলিদ কেনো ?

 

যদি দীনের মধ্যে শুধু আল্লাহ এবং তার রাসুলের আনুগত্যের নির্দেশই দেয়া হয়, তবে তো স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তবে শরিয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে মাযহাবের ইমামগণের তাকলিদ কেনো? এ বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য প্রথমে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ রাখা উচিত।

 

ইসলামি শরিয়তের বিধিবিধান দু’প্রকার

এক: সেসব মাসআলা-মাসায়িল, যা আল্লাহ এবং তার রাসুল থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। তা বুঝতে গেলে সাধারণ বোধবিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিরও কোনোপ্রকার বিভ্রান্তি-সংশয় হয় না। তদুপরি সে বিষয়ে কোরআনের আয়াত ও হাদিসের শব্দাবলিতেও বাহ্যত কোনো বিরোধ কিবা সংঘর্ষ পরিলক্ষিত হয় না। দীনের এ প্রকারের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে উম্মাহর কোনো গ্রহণীয় মতবিরোধ নেই। এ ধরনের মাসআলা-মাসায়িলের ওপরই দীনের মূল ভিত্তি এবং এগুলোই ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান।

এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত বিষয়াদিতে কারো তাকলিদ করা নি®প্রয়োজন। প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তার রাসুলের সেসব বিধানাবলি অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করবে, যে ব্যাপারে সে অবগত।

দুই: সেসব মাসআলা-মাসায়িল, যেগুলোতে কোরআনের আয়াত ও হাদিসের শব্দাবলিতে একাধিক অর্থ গ্রহণের সুযোগ আল্লাহ ও তার রাসুলই রেখে দিয়েছেন। অথবা সেক্ষেত্রে হাদিসসমূহের বক্তব্যে বাহ্যত পার¯পরিক বিরোধ বা সংঘর্ষ পরিলক্ষিত হয়। এমন বিধানের সংখ্যা যদিও কম নয়, তবুও ইসলামে এগুলোর সে অবস্থান নেই, যে অবস্থান রয়েছে প্রথম প্রকারের বিধিবিধানের। আর সে কারণেই এসব মাসায়িলের ক্ষেত্রে সাহাবাযুগ থেকেই মতানৈক্য চলে আসছে।

ইবাদাত এবং লেনদেনের অসংখ্য মাসায়িলের মধ্যে কোরআন ও হাদিসের শব্দাবলির ইখতিলাফের ভিত্তিতে মাযহাবের ইমাম ও বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ আলিম-ফকিহগণের মধ্যে ইখতিলাফ চলে আসছে সেই কতোকাল ধরে। আজ অবধি কোনো এক সিদ্ধান্তের ওপর সকলের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভাবিত হয়নি।

এবার প্রশ্ন, যেখানে হাদিসসমূহের মধ্যে রয়েছে বাহ্য বিরোধ, বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট নয়— এমন সুরতে সাধারণ মানুষ কীভাবে আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করবে? কীভাবে শরিয়তের আলোকে জীবন পরিচালনা করবে?!

এই দ্বিতীয় প্রকার বিধানাবলির ক্ষেত্রে যেহেতু দলিলের আলোকে একাধিক সুরৎ গ্রহণের অবকাশ রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে ইমামগণেরও মতানৈক্য রয়েছে, সাধারণ কোনো মানুষ, কোরআন সুন্নাহ ফিকহে যার যথেষ্ট পরিমাণ জানাশোনা-বিজ্ঞতা নেই, তার ক্ষেত্রে স্বভাবতই স্বীকার্য যে, সে এমন যে-কোনো আলিমের মত অবলম্বন করবে, যার ইলম ও তাকওয়ার ওপর তার রয়েছে নিখাদ আস্থা ও ভরসা।

আর এটাই হলো তাকলিদ।

 

‪‎তাকলিদের স্বরূপ

 

মূলত তাকলিদের স্বরূপ হলো- “শরিয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে কোনো আলিমের মত এবং ফতোয়ার ওপর আমল করা। জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আমলকারী হয়তো সেসব বিধানের দলিল মোটেও জানে না। কিংবা দলিলের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও অপরাপর ইমামগণের মোকাবেলায় নিজ ইমামের মত-অভিমতের অগ্রগণ্যতার হেতু উপলব্ধিতে অক্ষম। তদুপরি আমলকারী নিজ ইমামের মতের বিপরীতে কোনো শরয়ি দলিলের ব্যাপারেও অবগত নয়, যার খেলাফ আমল করা নিন্দনীয় ও গুনাহ।”

পাঠক, অনুগ্রহপূর্বক উপরিউক্ত সংজ্ঞাটিতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিন। কেননা, তাকলিদের এ স্বরূপ পরিজ্ঞাত হলে অসংখ্য প্রশ্ন আপনাআপনিই দূর হয়ে যায়। আলিমগণ বলেন,

التقليدُ العملُ بقولِ منْ ليسَ قولهُ إحدى‌َ الحججِ بلاَ حجةٍ منهاَ (تيسير التحرير: ٤ / ٣٥٢)

যার কথা শরিয়তের কোনো দলিল নয়, দলিল ছাড়া তার ফতোয়া অনুযায়ী আমল করার নামই হলো তাকলিদ। [তাইসিরুত তাহরিরঃ ৪/৩৫২]

এবং আমলকারী এই আস্থা ও বোধের সাথে আমল করে, আমি যে আলিম ও মুজতাহিদের মতানুযায়ী আমল করছি, তিনি নিজ জ্ঞানের আলোকে শরিয়তের বিধানই বর্ণনা করেছেন (শরিয়তের খেলাফ তার নিজস্ব মত নয়)।

গভীর চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তি এ বাস্তবতা অনুধ্যান করতে সক্ষম যে, অধিকাংশ মুসলমানই আরবি ভাষা জানে না। যারা জানে সাধারণত তারাও শরয়ি জ্ঞানবিজ্ঞানে বিজ্ঞ নয়।  তাদের জন্য ইজতিহাদি মাসায়িলের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্যের এক পন্থা তো এই যে, কোনো বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ আলিমের মতানুযায়ী আমল করা। যেসব মাসায়িলের ক্ষেত্রে ইখতেলাফের অবকাশ নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রে তো অনুসৃত আলিম (নসের আলোকে) পূর্ণ আস্থার সাথে তাকে আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশিত বিধান এভাবে পৌঁছে দিবে, যাতে থাকবে না কোনো দ্বিধা-সংকোচ। আর যেসব মাসায়িলের ক্ষেত্রে ইখতিলাফের অবকাশ আছে, সেসবের ক্ষেত্রে নিজের বোধ বিবেচনা, উসুল মানহাজ ও মতের আলোকে মাসআলা বলবে এবং আমলকারী আস্থা ও নির্ভরতার কারণে তাকে শরিয়তের নির্দেশিত বিধান জ্ঞান করবে। এটি একটি সু¯পষ্ট সুস্পষ্ট বিষয় ও মানবপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রোজ্জ্বল বাস্তবতা। উম্মাহ সর্বদা এর ওপর আমল করে আসছে। যার বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসছে। সাধারণ মানুষ, হোক সে আহলে হাদিস কিবা চার মাযহাবের কোনো একটির অনুসারী, এমন তাকলিদ সবাই করে।

এই প্রোজ্জ্বল ও ধ্র“ব বাস্তবতার বিরুদ্ধে যারা দিনরাত প্রোপ্রাগান্ডা ছড়ায়, শহর নগর এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে যারা রকমারি ভঙ্গীতে উচ্চবাচ্য করে বেড়ায় যে, “দীনের উৎস শুধু কোরআন ও হাদিস। আমরা শুধু এ দুয়ের আনুগত্যের জন্যই আদিষ্ট হয়েছি।” “তাকলিদ মানে আল্লাহ ও রাসুলকে বাদ দিয়ে ইমামের অন্ধ অনুসরণ।” এগুলো এমনই নির্জল মিথ্যা ও অনর্থক উচ্চবাচ্য, যা শুধু ইনসাফবঞ্চিত কোনো মানুষের পক্ষেই বলা সম্ভব। এ বিষয়টা নিয়ে আমাদের কিতাব তাকলিদ আওর মাসলাকি ইখতিলাফ কি হাকিকত  বইয়ে বিস্তরভাবে আলোচনা করেছি। সেখানে সুস্পষ্টভাবে আমরা তুলে ধরেছি, তাকলিদের উদ্দেশ্য কখনও এটা নয় যে, আল্লাহ এবং তার রাসুলের আনুগত্য পরিহার করে কোনো বনি আদমের কথা মান্য করা। বরং তার উদ্দেশ্য শুধু মতবিরোধপূর্ণ মাসায়িলের ক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষ যেক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অক্ষম, কোনো ইমামের মতকে এ মানসে গ্রহণ করা যে, তিনি আল্লাহ এবং তার রাসুলের হুকুমই বর্ণনা করছেন।

তদ্রুপ তাকলিদকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য নিম্নবর্ণিত আয়াত ব্যবহার করা নিতান্তই সীমালঙ্ঘন বৈ কিছু নয়-

اتَّبِعُواْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلاَ تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِ أَوْلِيَاء

তোমরা অনুসরণ করো তা, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথিদের অনুসরণ করো না। [সুরা আ’রাফ : ৩]

কেননা এ আয়াতে দ্ব্যর্থহীনতার সাথে যে বিষয়টাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা হলো, আল্লাহর কিতাব এবং রাসুলের শরিয়ত বর্জন করে নিজেদের সেসব নেতৃবৃন্দের অনুসরণ করা, যারা মূর্তিপূজা ও কুফুরির নির্দেশ দেয়। (দ্রষ্টব্য— তাফসিরে তাবারি)

আমরা কোনো সাম্প্রদায়িকতার আহ্বায়ক নই। তর্কবিতর্ক ও ঝগড়াঝাটিতে লিপ্ত হয়ে উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকে (তা যে পক্ষের থেকেই হোক) আমরা বড় ক্ষতিকর জ্ঞান করি। যখন সত্যান্বেষার পরিবর্তে নিজের দল ও মতাবলম্বীদের পক্ষ অবলম্বন করে অযথা তর্কে জড়ানো এবং সরল সত্য ও ভুল কিবা মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে অন্যকে হেয় করার চেষ্টাই উদ্দেশ্যে পরিণত হয়, তখন সাম্পদায়িকতামূলক এহেন কর্মকাণ্ড মনমস্তিষ্ক থেকে মধ্যপন্থা ও নিয়ত থেকে ইনসাফকে সরিয়ে দেয়। এসব কাজ দীন ও মিল্লাতের জন্য নেহাত ক্ষতিকর তো বটেই, উপরন্তু‘ এর দ্বারা মানুষের মন-মানস কলঙ্কিত ও কালিমাগ্রস্ত হয়ে যায়, হৃদয়ের আলোক লীন হয়ে যায়। বড় আক্ষেপ, আমরা আজ এ দুর্দশায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছি!

আমরা এখানে অকুণ্ঠচিত্তে বলতে চাই, তাকলিদের স্বরূপ উন্মোচিত হওয়ার পরও (যার আলোচনা সবিস্তারে উল্লিখিত হয়েছে) যারা বলে, “তাকলিদে শখছির মধ্যে কেমন যেনো ইমামকে নবি মান্য করা হয়।” (দ্রষ্টব্য— আহনাফ আওর আহলে হাদিস কা ফারাক : ৮, জনাব মুহাম্মাদ জুনাঘরী প্রণীত) নিশ্চয়ই তাদের এমন বক্তব্য নির্জল মিথ্যা, নিরেট বেইনসাফি ও চরম সীমালঙ্ঘন। সুস্থ বিবেকধারী কেই বা উপরিউক্ত বক্তব্য প্রদানকারীকে সীমালঙ্ঘনকারী, অন্যায় পক্ষাবলাম্বী ও সংকীর্ণ চেতনাধারী আখ্যা দিবে না?!

 

তাকলিদের পরিধি

 

শরিয়তের কোন সব বিষয়ে তাকলিদ করা হবে? পূর্বোক্ত আলোচনায় প্রচ্ছন্নভাবে এর আলোচনা এসে গেছে। তাকলিদের পরিধি সীমিত। দীনের মৌলিক বিধিবিধান, যা দ্ব্যর্থহীন অকাট্য দলিলাদি দ্বারা সাব্যস্ত, তাতে তাকলিদ নিষ্প্রয়োজন। প্রত্যেক ব্যক্তিই উম্মাহর চিরাচরিত কর্মধারা, অকাট্য বর্ণনাসমূহ, উম্মাহর ঐকমত্য ও ইজমার আলোকে আল্লাহ এবং তার রাসুলের বিধানাবলির জ্ঞান লাভ করে থাকে। সে কারো তাকলিদ ব্যতিরেকেই এসব ক্ষেত্রে আমল করে যাবে, শরিয়তের নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালিত করবে।

এ সকল বিধিবিধান দীনের মূল এবং বুনিয়াদি অংশ। যেমন- আল্লাহর মহান সত্তা এবং তার নাম ও সিফাতের সাথে সম্পৃক্ত আকিদাসমূহ, আখিরাত জান্নাত জাহান্নামের আকিদা, রিসালাতের হাকিকত এবং রাসুলুল্লাহ সা. এর নিঃশর্ত অনুসরণ, ইবাদত তথা নামায যাকাত রোযা এবং হজের ফরযিয়্যাত, এগুলোর আরকান এবং মৌলিক ফরজসমূহ, রুহ ও আত্মার সাথে স¤পৃক্ত ইবাদতসমূহ, যা দীনের মগজ এবং রুহ; যেমন- আল্লাহর ভালোবাসা ও ভয়, তাকওয়া ধৈর্যশীলতা ভরসা অল্পেতুষ্টি দুনিয়াবৈরাগ্য অন্যকে অগ্রাধিকার সৃষ্টিকুলের কল্যাণকামনা প্রভৃতি আত্মার সাথে সম্পৃক্ত ইবাদতসমূহ, উত্তম চরিত্রের দীক্ষা; উত্তম চরিত্তের মানদণ্ড, মন্দ চরিত্রের পরিচয়, সত্যবাদিতা আমানতদারি অন্যকে অগ্রাধিকার ইহসান বিনয়নম্রতা সৃষ্টিকুলের কল্যাণকামনা প্রভৃতি। এগুলোর পূর্ণ প্ররিস্ফুট চিত্রই ইসলামি জীবনাচার। এর দ্বারা জীবন গঠন হয়, ব্যক্তিসত্তা পূর্র্ণতা পায়। আর এসবই ইসলামি জীবনবোধের আত্মা ও প্রাণ। এগুলো ও তার শাখাপ্রশাখার ক্ষেত্রে বলা হয়, এতে নেই উল্লেখযোগ্য কোনো মতভিন্নতার উপস্থিতি।

পক্ষান্তরে এর ব্যতিক্রম হচ্ছে সেসব মাসায়িল, পরিভাষায় যেগুলোকে বলা হয় “ইজতিহাদি মাসায়িল বা মুজতাহাদ ফিহি মাসায়িল”; যেসবের ক্ষেত্রে ছিলো স্বয়ং সাহাবিগণের মতভিন্নতা। আলিমগণের পরিভাষায় “ইজতিহাদি মাসায়িল” দ্বারা শুধু সেসব মাসায়িলকেই বোঝায় যেসবের ক্ষেত্রে রয়েছে একাধিক মত গ্রহণের অবকাশ। আর বিস্মৃত হবেন না, এ ধরনের মাসায়িলের ক্ষেত্রেই কেবল তাকলিদ করা হয়

ইলমে হাদিসের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম খতিবে বাগিদাদি রহ. বলেন,

أَمَّا الْأَحْكَامُ الشَّرْعِيَّةُ , فَضَرْبَانِ: أَحَدُهُمَا: يُعْلَمُ ضَرُورَةً مِنْ دِينِ الرَّسُولِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَالصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ , وَالزَّكَوَاتِ , وَصَوْمِ شَهْرِ رَمَضَانَ , وَالْحَجِّ , وَتَحْرِيمِ الزِّنَا وَشُرْبِ الْخَمْرِ , وَمَا أَشْبَهَ ذَلِكَ، فَهَذَا لَا يَجُوزُ التَّقْلِيدُ فِيهِ , لِأَنَّ النَّاسَ كُلَّهُمْ يَشْتَرِكُونَ فِي إِدْرَاكِهِ , وَالْعِلْمِ بِهِ , فَلَا مَعْنَى لِلتَّقْلِيدِ فِيهِ وَضَرْبٌ آخَرُ: لَا يُعْلَمُ إِلَّا بِالنَّظَرِ وَالِاسْتِدْلَالِ: كَفُرُوعِ الْعِبَادَاتِ , وَالْمُعَامَلَاتِ , وَالْفُرُوجِ , وَالْمُنَاكَحَاتِ , وَغَيْرِ ذَلِكَ مِنَ الْأَحْكَامِ , فَهَذَا يُسَوَّغُ فِيهِ التَّقْلِيدُ , بِدَلِيلِ قَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى: {فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ} [النحل: ৪৩] وَلِأَنَّا لَوْ مَنَعْنَا التَّقْلِيدَ فِي هَذِهِ الْمَسَائِلِ الَّتِي هِيَ مِنْ فُرُوعِ الدِّينِ لَاحْتَاجَ كُلُّ أَحَدٍ أَنْ يَتَعَلَّمَ ذَلِكَ , وَفِي إِيجَابِ ذَلِكَ قَطْعٌ عَنِ الْمَعَايِشِ , وَهَلَاكُ الْحَرْثِ وَالْمَاشِيَةِ , فَوَجَبَ أَنْ يَسْقُطَ

শরিয়তের বিধিবিধান দু’প্রকার: প্রথমত সেসব বিধানাবলি, যা দীনের সুনিশ্চিত অংশ ও মতভেদের ঊর্ধ্বে। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায, যাকাত, রমজানের রোযা, হজের ফরযিয়্যাত এবং ব্যভিচার মদ্যপানের হুরমত প্রভৃতি মতভেদের ঊর্ধ্বের মাসআলাসমূহ এগুলোর ক্ষেত্রে তাকলিদের কোনো বৈধতা নেই। (আর না এসব ক্ষেত্রে তাকলিদ করা হয়।) কেননা এগুলোর জ্ঞান এবং বোধ-উপলব্ধির ক্ষেত্রে সব মানুষই সমান। তাই এসবের ক্ষেত্রে তাকলিদ অর্থহীন।

দ্বিতীয়ত সেসব ইজতিহাদি মাসায়িল, যাতে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে প্রয়োজন গবেষণা ইসতিদলাল ইসতিমবাত। যেমন ইবাদত মুআমালাত মুআশারাত বিয়ে-শাদির শাখাগত শরয়ি বিধানাবলি। এসবের ক্ষেত্রে তাকলিদের বৈধতা অনস্বীকার্য। এর দলিল আল্লাহ তাআলার নির্দেশ— “অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে।” [সুরা নাহল : ৪৩]। কেননা যদি আমরা এ ধরনের শাখাগত মাসআলার ক্ষেত্রে তাকলিদ থেকে বারণ করি তবে তার আবশ্যিক পরিণতি হলো, সাধারণ মানুষ প্রত্যেকে দীনী জ্ঞানবিজ্ঞানে নিমগ্ন হয়ে তাতে বুৎপত্তি অর্জন করার প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়বে। (আর এর জন্য স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন পূর্ণ এক জীবন।) আর তা অপরিহার্য করা হলে তো জীবনজীবিকার অন্বেষা, কারবার-লেনদেন সব লীন হয়ে যাবে; ক্ষেত-খামার সব উজাড় হয়ে পড়ে থাকবে। তাই এ নির্দেশ না আসাটাই আবশ্যক।

 

“মুজতাহাদ ফিহি মাসায়িলের”র সরল পরিচয়

 

স্মতর্ব্য যে, চার মাযহাবের যে মতভিন্নতা তা শুধু সেসব মাসায়িলের ক্ষেত্রে যাতে রয়েছে শরিয়তের দৃষ্টিতে মতভিন্নতার অবকাশ। আর এ ধরনের মাসায়িলের ক্ষেত্রেই শুধু সাধারণ মানুষ কোনো ইমাম এবং ফকিহের তাকলিদ করে থাকে। এখন প্রশ্ন জাগে, কোন কোন মাসআলা “ইজতিহাদি মাসআলা” বলে পরিগণিত হবে, যার ক্ষেত্রে রয়েছে একাধিক মত ও পথ গ্রহণের অবকাশ?

এর সবচে বড় পরিচায়ক হলো, হকপন্থী আলিমগণ যেসব মাসআলায় একাধিক মত পোষণ করেছেন, যেসব মাসআলায় ইমামগণ ইখতিলাফ করেছেন এবং ভিন্ন মতের দলিলাদি সামনে আসার পরও আপন মতের ওপর স্থির থেকেছেন। এটাই এ বিষয়ের প্রোজ্জ্বল দলিল- এসব মাসায়িলের ক্ষেত্রে কোরআন হাদিসের দলিলের আলোকেই সকল মতের বিশুদ্ধতা সাব্যস্ত রয়েছে। এবার একেক ইমামের কাছে একেকটিকে অগ্রগণ্য মনে হয়েছে, আর অপরটিকে মনে হয়েছে তুলনামূলক দুর্বল।

এর একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। ইমাম শাফেয়ি রহ. এর মতানুযায়ী ইমামের পেছনে মুক্তাদির সুরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব। অথচ হানাফি, মালেকি, হাম্বলি মাযহাবের ইমামগণের মত হলো, মুক্তাদির জন্য সুরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব নয়। এবার নিরপেক্ষভাবে একটু অনুধ্যান করুন, যদি কোনো মাসআলার ক্ষেত্রে এক পক্ষের দলিল এমনই অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন হতো, যার বিপরীত মত নিরেট ভুল, তবি কীভাবে সম্ভবপর ছিলো যে, ইমামগণ সেক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করবেন! এ সকল মহান ইমামগণ কি -নাউযুবিল্লাহ- এমনই পাপিষ্ঠ ও খোদার ব্যাপারে অকুতোভয় ছিলেন যে, জেনেবুঝে উম্মাহর মধ্যে এক গলদ পথ ও পন্থা প্রবর্তন করতেন এবং লক্ষ কোটি মানুষের নামাজকে বরবাদ করতেন?!

কস্মিনকালেও এরূপ হওয়ার নয়! হাঁ, কোনো কমসমঝ আদমি বলে ওঠতে পারে, এমন কি হতে পারে না যে, ইমামগণ তখনও বিপরীত মতের দলিলের ব্যাপারে অবগত হননি। আমরা তাকে দুটো কথা বলবো।

প্রথম কথা, স্বল্প সংখ্যক মাসআলার ব্যাপারে এ কথা মেনে নেয়া যেতে পারে যে, তাঁদের কাছে তখনও বিপরীত মতের দলিলাদি পৌঁছেনি। কিন্তু শতসহস্র মাসআলার ব্যাপারে এমন ভাবা কীভাবে সম্ভব?! আর যদি এমনটাই হতো তবে গোটা উম্মত সেসব মহামনীষীদেরকে কেনোই বা নিজেদের ইমাম গণ্য করলো?! কিছু ভদ্রলোক বলে থাকেন, এ সকল ইমামদের হালত ছিলো এমন যে, তারা দশপনেরোটা নয়; বরং শতসহস্র মাসআলায় ভুল করেছেন। এমন মানুষ, শতসহস্র মাসআলায় যার ভুল হয়, তিনি তো মধ্যম পর্যায়ের কোনো আলিম হিসেবেও স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নন। গোটা উম্মাহর ফিকহ ও শরিয়তের সর্বজনস্বীকৃত ইমাম হওয়া তো দূরের কথা!

দ্বিতীয় কথা, তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেই, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেয়িসহ অন্য ইমামগণ আমরণ বিপরীত মতের দলিলাদি জানতে পারেননি! তবুও তো তাদের পর অতিক্রান্ত হয়েছে কতো কাল! প্রত্যেক পক্ষের আলিমগণ অপরক্ষের সামনে প্রকাশিত করেছেন নিজেদের সব দলিলাদি। সংকলিত হয়েছে হাদিসের সহস্রাধিক গ্রন্থ। প্রান্ত থেকে প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে তার নুসখাসমূহ। মাযহাবের ফকিহগণ নিজেদের মাসায়িল, দলিলাদি সব গ্রন্থবদ্ধ করেছেন সেই কবে। এরপর কীভাবে এ আপত্তি গৃহীত হতে পারে যে, ইমামের পেছনে মুক্তাদির ফাতিহা পাঠ ওয়াজিব হওয়া না হওয়ার কোনো দলিল অদ্যাবধি সুপ্ত রয়ে গেছে?! কোনো মত যদি সুনিশ্চিতভাবে সঠিক এবং অপর মত নিরেট ভুলই হতো, তবে পরবর্তী উত্তরসূরীগণ, যাদের মধ্যে ছিলো অগণন দীপ্ত জ্ঞানের সব্যসাচী, অবশ্যই পূর্বের মত পরিহার করে সঠিক রায় গ্রহণ করে নিতেন অবলিলায়। কিন্তু আমরা দেখছি, হাজারো লাখো ফকিহ এখনও সেই পূর্বের মত ধারণ করে আছেন দৃঢ়ভাবে। তবে কি তারা সবাই আল্লাহ এবং তার রাসুলের এমনই ঘোর দুশমন এবং কপট যে, জেনেবুঝে সত্য পরিস্ফুট হওয়ার পরও উম্মাহকে বিভ্রান্ত করে চলছেন অহর্নিশ?!

যদি আল্লাহর তাওফিকে মস্তিষ্কের সুস্থতা ও নিরপেক্ষতা কারো কপালে জোটে, তবে এ একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট, যার দ্বারা সে মেনে নিবে উন্মোচিত হৃদয়ে পরিতৃপ্তির সাথে, চার মাযহাবের যে মতভিন্নতা তা সাধারণত এমন ইজতিহাদি মাসায়িলের ক্ষেত্রেই, যাতে রয়েছে একাধিক মত গ্রহণের অবকাশ। ব্যক্তি তাই চার মাযহাবের যেকোনো মাযহাবেরই তাকলিদ করুক, নিঃসন্দেহে সে সত্য পথের দীপ্ত পথী।

 

‪তাকলিদ মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির অপরিহার্য দাবি

 

ইমাম খতিবে বাগদাদির উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিভাত হয়— তাকলিদ প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের জন্য অপরিহার্য, অত্যাবশ্যকীয়। কেননা, এ ধরনের মতভেদপূর্ণ মাসায়িলের ক্ষেত্রে বিজ্ঞতা অর্জন করা, নিজে নিজে কোনো এক মতকে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করা নেহাত দুরূহ; বরং অসাধ্যপ্রায়। এর জন্য প্রয়োজন শরিয়তের জ্ঞানবিজ্ঞানে বিজ্ঞতা অর্জনের মানসে পুরোপুরি আত্মনিমগ্নতা। এক জীবন শুধু তার অর্জনে ব্যয়িত হলেও সে পর্যায়ে উপনীত হতে পারে খুব কম ইলম অন্বেষীই। সাধারণ জনতা না এ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম, আর না শরিয়ত তাদেরকে তার নির্দেশ দিয়েছে। তাই মানুষের স্বভাবপ্রকৃতিই এ কথার দাবিদার— সে অনুমতিপ্রাপ্ত হবে কোনো ইমাম ও ফকিহের তাকলিদ করে, তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শরিয়তের রাহে জীবন পরিচালনা করার।

 

‪তাকলিদ অস্বীকারের দাবিকারীরাও তাকলিদ করে যায় অবচেতনে

 

এ তো এক প্রোজ্জ্বল ও ধ্র“ব সত্য যে, যারা দিনরাত তাকলিদ অস্বীকারের দাওয়া ফেরি করে বেরায়, তারা কোনো উপায়েই এ কথা অস্বীকার করতে পারবে না যে, তাদের জনসাধারণ, বরং অধিকাংশ দীনী বিদ্যাধারীও মূলত সার্বিকভাবে দলিল না জেনেই নিজেদের আলিমগণের তাকলিদ করে যায় অবলিলায়। যদি তারা বলে যে, না, কিছুতেই এমন নয়। আলিমগণ তো সাধারণ মানুষকে বিধানের সাথে দলিলও অবগত করে। তাহলে বলবো, এ কথা ডাহা মিথ্যা। কেননা, সব আলিম সদাসর্বদা গুরুত্বের সাথে দলিল বলে বেরান না। তদুপরি এ সকল মতভেদপূর্ণ মাসায়িলের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের দলিল বোঝার সাধ্য কোথায়?! কোনো মাসআলায় অন্তত এ দরজার ইলম অর্জন করা যে, কোনো এক মতের অগ্রগণ্যতার ব্যাপারে অন্তরাত্মা প্রশান্ত হয়ে যাবে, অকপটভাবে হৃদয় মেনে নিবে অপর মতের দুর্বলতা— এ তো দীর্ঘকাল নিরবচ্ছিন্ন ইলম অর্জন, ব্যাপক অধ্যয়ন, সূক্ষ্মদর্শী দৃষ্টি লাভের পরেই সম্ভবপর হতে পারে। এছাড়া কোনো সাধারণ ব্যক্তিকে দলিল বলার দ্বারা তার তো বিলকুল ইলম অর্জিত হয় না। সর্বোচ্চ যা হয়, তার এ আস্থা সৃষ্টি হয়— যে ইমাম ও আলিমের কথা আমি মান্য করছি, তিনি প্রকৃতপ্রক্ষে আমাকে আল্লাহ এবং তার রাসুলের বিধান জানাচ্ছেন, তার ব্যক্তিগত মতামত নয়। আর আমি এটাকে শরিয়ত জ্ঞান করে এর ওপর আমল করে যাবো।

আর এটাই হলো তাকলিদ।

 

সমগ্র বিশ্ববাসী, যারা মুসলমান, এ পন্থার আলোকেই আল্লাহর দীন এবং রাসুলের শরিয়তের ওপর আমল করে যাচ্ছে। আহলে হাদিস ভাইদের আমলও এর থেকে ভিন্ন নয়। তাই এ বুলি নিখাদ ধোঁকা বৈ কিছু নয়— “আহলে হাদিস তাকলিদ করে না। তারা কেবল কোরআন সুন্নাহ অনুসরণ করে।” মুসলমান, সে আহলে হাদিস হোক কিবা মাযহাব চতুষ্টয়ের কোনোটির অনুসারী, সকলেই নিজেদের আলিমগণের তাকলিদ করে রাতদিন অবিরাম।

 

‪তাকলিদ প্রসঙ্গে কোরআন কী বলে?

 

বহুসংখ্যক আলিম তাকলিদের অত্যাবশ্যকতার ব্যাপারে নিম্নের আয়াত দ্বারা দলিল পেশ করে থাকেন—

فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ

অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমাদের জানা না থাকে। [সুরা নাহল : ৪৩]

যেসব আলিমগণ এ আয়াত থেকে তাকলিদের ওয়জিব হওয়ার বিধান আহরণ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম— প্রসিদ্ধ মালেকি আলিম হাফিযুল হাদিস ইবনু আব্দিল বার রহ.। (দ্রষ্টব্য— জামিউ বায়ানিল ইলমি : ২ / ১১৫) যার ব্যাপারে এ গলদ ধারণা বড় ব্যাপক, তিনি তাকলিদের বৈধতা অস্বীকার করেছেন। তাছাড়াও নিকট অতীতে প্রসিদ্ধ সাউদি আলিম শায়খ ইবনে উসাইমিন রহ. ও এই আয়াত থেকে সাধারণ মানুষের জন্য তাকলিদ ফরজ হওয়ার বিধান আহরণ করেছেন। (দ্রষ্টব্য— আলউসুল মিন ইলমিল উসুল : ১ / ৮৭)

 

‪‎সাহাবাযুগেও মুকাল্লিদদের সংখ্যাই ছিলো বেশি

 

পূর্বোক্ত আলোচনার দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়েছে যে, তাকলিদ মূলত দীনের শাখাগত মাসায়িলের ক্ষেত্রে গবেষণা ইজতিহাদ ইসতিমবাতের সামর্থ্য রাখে না— এমন ব্যক্তিদের জন্য ইজতিহাদি মাসায়িলের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ আলিমের ফতোয়াকে দলিল (জেনে বা) না জেনেই মান্য করা। এটা একটি স্পষ্ট বিষয় ও বনি আদমের জন্য প্রকৃতিগতভাবেই প্রয়োজন। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যার ব্যত্যয় ঘটলে জীবন ধারণ হবে দুরূহ, আর না তখন সম্ভব হবে জনসাধারণের পক্ষে শরিয়ত মান্য করা। আর তাই আমরা দেখি, সাহাবাযুগ থেকেই উম্মাহর মাঝে এ ধারার প্রচলন ঘটেছে। সাধারণ সাহাবিরা আলিম সাহাবিদের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করতেন আর আলিম সাহাবিগণ কোরআন হাদিসের দলিলাদি উল্লেখ না করে শুধু ফতোয়া ও মাসআলা বলে দিতেন। আর যেহেতু সর্বসাধারণ ইজতিহাদি ইখতিলাফি মাসায়িলের দলিল অনুধ্যান করতে অক্ষম, তাই তারা সেসব আলিমগণের ওপর আস্থা রেখে তাদের ফতোয়া ও মাসায়িল মেনে নিতেন অকুণ্ঠচিত্তে। সাহাবিগণের ফিকহি প্রশ্নাবলি ও তার শরয়ি সমাধানের বড় ভান্ডার হাদিসের গ্রন্থাদি, যেমন “মুয়াত্তা ইমাম মালিক”, “কিতাবুল আসার”, “মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা” প্রভৃতিতে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব কিতাবে দৃষ্টিপাত করলে আপনি দেখবেন, তার প্রায় অর্ধেক মাসায়িলই এমন, যাতে আলিম সাহাবা দলিলের উল্লেখ ছাড়াই শুধু ফতোয়া বলে দিয়েছেন। আর তাকলিদের স্বরূপ তো এটাই। আমরা এখানে তার দুয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি।

 

১. সহিহ বুখারিতে হযরত আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলছেন—

أتانا معاذ بن جبل باليمن معلما و أميرا، فسألناه عن رجل توفي و ترك ابنته و أخته، فأعطى الابنة النصف و الأخت النصف. ( صحيح البخاري : ٦٧٣٤)

(রাসুলের পক্ষ থেকে) মু’আয ইবনে জাবাল রা. আমাদের কাছে আসলেন শিক্ষক ও গভর্নর হিসেবে। আমরা তার কাছে উত্তরাধিকারের এ মাসআলা জিজ্ঞেস করলাম, এক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে। সে রেখে গেছে এক মেয়ে ও এক বোন। এখন মিরাছ কীভাবে বণ্টিত হবে? তিনি তখন ফতোয়া দিলেন, উভয়কে অর্ধেক অর্ধেক করা দেয়া হবে।

দেখুন, না প্রশ্নকারীরা তার কাছে দলিল জানতে চেয়েছে আর না ফকিহ সাহাবি মু’আয ইবনে জাবাল রা. তাদেরকে দলিল বলার কোনো প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। অথচ সাধারণ মানুষেরা দলিল না জেনেই তার কথা মান্য করেছে। এটাই তাকলিদ। সাহাবা তাকলিদ করতেন, করাতেন।

২. হযরত সালিম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. আপন পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের ব্যাপারে বর্ণনা করেন, তাকে প্রশ্ন করা হলো, এক ব্যক্তি অন্য আরেকজনের কাছে কিছু সম্পদ পায়। প্ররিশোধের তারিখও নির্দিষ্ট। এবার পাওনাদার যদি প্রাপ্য সম্পদ থেকে কিছু অংশ এ শর্তে মাফ করে দেয় যে, নির্দিষ্ট তারিখ আসার আগেই পাওনা পরিশোধ করে দিতে হবে, তবে এর কী বিধান? আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. নিষেধ করলেন এবং এটাকে নাজায়িয স্থির করলেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক : ১৩৫২]

এখানেও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. শুধু ফতোয়াই দিলেন। দলিল বললেন না। প্রশ্নকারীরাও জানার আগ্রহ দেখালো না। এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর, সাহাবাযুগে আলিম সাহাবিগণ দলিল উল্লেখ ব্যতিরেকেই শুধু ফতোয়া প্রদান করেছেন। আর এ-ই তো তাকলিদ। যদি দলিল না জেনে কারো কথা মান্য করা (তাকলিদ করা) হারাম হতো, কিবা কোনো কোনো নির্বোধ গণ্ডমূর্খের ভাষ্যমতো শিরক হতো, তবে তো তার কোনোই অবকাশ ছিলো না যে, সাহাবা শুধু মাসআলা বলবেন, উল্লেখ করবেন না কোরআন হাদিসের দলিলাদি।

 

‪‎সাহাবাযুগে নির্দিষ্ট মাযহাবের তাকলিদ

 

হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি রহ. লিখেন, সাহাবাযুগেই এই ন্যায়ানুগ প্রজ্ঞাপূর্ণ সিলসিলার গোড়াপত্তন হয়েছে- প্রত্যেক এলাকার লোকেরা নিজেদের এলাকার আলিম কিবা প্রচলিত মাযহাবের তাকলিদ করে জীবন পরিচলনা করতেন। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা : বাবুক ফারাক বাইনা আহলিল হাদিস ওয়া আহলির রায়।

উম্মত এই সুন্নাতে রাশেদা (ছহিহ তরিকা) মহান সাহাবা, তাবেয়িন ও সালাফে সালেহিনের উত্তরাধিকারেই লাভ করেছে যে, এক এলাকায় সাধারণত এক মাযহাবই ব্যাপক হয়ে থাকে। যার বিস্তারিত আলোচনা তাকলিদ আওর মাসলাকে ইখতিলাফ কি হাকিকত কিতাবে আলোচিত হয়েছে। ফকিহদের বাণী ও মতামত এবং সালাফের ফিকহি উত্তরাধিকারের ওপর যার সামান্য দৃষ্টিপ্রাতেরও ফুরসত মিলেছে, এমন ধ্র“ব সত্যকে কস্মিনকালেও অস্বীকার সে করতে পারবে না। এর নেই সুযোগই কোনে।

যেমন বুখারি শরিফের এক বর্ণনায় এসেছে, এক মাসআলায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও মদিনার আলিম সাহাবি যায়দ বিন সাবিত রা. এর ইখতিলাফ ছিলো। মদিনাবাসীরা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর কাছে ঘটনাক্রমে সে মাসআলা জিজ্ঞেস করে বসলেন। তিনি আপন মত অনুযায়ী তার শরয়ি সমাধান বললেন। মুসলিম শরিফের বর্ণনায় একথাও আছে, হাওয়ালাস্বরূপ তিনি রাসুলের হাদিসও পেশ করলেন। কিন্তু মদিনাবাসীরা সাফ সাফ বলে দিলেন,

لا ناخذ بقولك و ندع قول زيد ) صحيح البخاري : ١٨٥٧)

আমরা যায়দ বিন সাবিতের মত ছেড়ে আপনার মত গ্রহণ করতে পারি না। [সহিহ বুখারিঃ ১৮৫৭]

অবশেষে মদিনাবাসীরা যায়দ বিন সাবিত রা. এর সাথে সে বিষয়ে আলোচনা করলেন। রেওয়ায়াতের তাহকিকও হলো তখন। পরিশেষে যখন বিশ্লেষণের আলোকে প্রমাণিত হলো, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর মতই বিশুদ্ধ তখন যায়দ বিন সাবিত রা. সহ মদিনাবাসীরা নিজেদের মত থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন।

 

[حدثنا أبو النعمان، حدثنا حماد، عن أيوب، عن عكرمة : أن أهل المدينة سألوا ابن عباس -رضي الله عنهما- عن امرأة طافت ثم حاضت، قال لهم تنفر. قالوا لا نأخذ بقولك وندع قول زيد. قال إذا قدمتم المدينة فسلوا. فقدموا المدينة فسألوا، فكان فيمن سألوا أم سليم، فذكرت حديث صفية. رواه خالد وقتادة عن عكرمة.

ইকরিমা রহ. থেকে বর্ণিত, মদিনাবাসীরা ইবনে আব্বাস রা. কে এক মহিলা স¤পর্কে মাসআলা জিজ্ঞেস করলো, হজে এসে তাওয়াফের পরে যার ঋতুস্রাব শুরু হয়েছে। (সে কি অপেক্ষা করবে নাকি ফিরে যাবে?) ইবনে আব্বাস রা. মাসআলা বললেন, সে ফিরে যাবে। তখন তারা বলে বসলো, আমরা যায়দ বিন সাবিত রা. এর মত ছেড়ে আপনার মত গ্রহণ করতে পারি না। ইবনে আব্বাস রা. তখন বলল্রন, যখন মদিনায় প্রত্যাবর্তন করবে, তখন এই মাসআলা জিজ্ঞেস করে দেখো। (ফিরে গিয়ে তারা এই মাসআলা জিজ্ঞেস করলো।) যাদেরকে তারা জিজ্ঞেস করলো, তাদের মাঝে ছিলেন উমে সুলাইম রা.। তিনি তখন সাফিয়্যা রা এর হাদিস বর্ণনা করেন।

উপরিউক্ত বর্ণনার আলোকে তিনটি বিষয় প্রতিভাত হয়—

 

১. নিজের ইমাম এবং অনুসৃত আলিমের মতের খেলাফ যদি অন্য কোনো আলিম ফতোয়া দেন এবং দলিলস্বরূপ হাদিস উল্লেখ করেন তবে তার যথাযথ তাহকিক করা উচিত। যদি অন্য আলিমের মতই বিলকুল সাফ এবং বিশুদ্ধ প্রমাণিত হয় (যেমন উল্লিখিত মাসআলায় হয়েছে, যায়দ বিন সাবিত রা. এর এ বিষয়ের হাদিসটি জানা ছিলো না আর আব্দুল্লাহ ইববে আব্বাস রা. এর ফতোয়াই ছিলো বিশুদ্ধ।) তবে অবশ্যই এমন হবে, সেই আলিম নিজ মত থেকে প্রত্যাবর্তন করবেন। মাযহাব চতুষ্টয়ে এমনই হয়েছে। কিছু কিছু মাসআলায় পরবর্তী আলিমগণ উপলব্ধি করেছেন, সেগুলোর ক্ষেত্রে নিজেদের ইমামের মতের ভিত্তি ছিলো কোনো ভুল অনুধ্যানের ওপর, তারা সেসব ক্ষেত্রে পরিহার করেছেন নিজেদের ইমামের মত; মাযহাবের জন্য বেছে নিয়েছেন অপর বিশুদ্ধতম মত।

 

‪‎ইজতিহাদি মাসায়িলের ক্ষেত্রে কাউকে আপন ইমামের তাকলিদ করতে বাধা প্রদান করা যাবে না

 

২. দ্বিতীয় যে বিষয়টি উপরিউক্ত ঘটনার আলোকে প্রতীয়মান হয়— কোনো মাসআলার এক দিক যদি দ্ব্যর্থহীনভাবে সুস্পষ্ট আকারে প্রমাণিত না হয়, অর্থাৎ জনসাধারণের কিছু অংশ যে আলিমের তাকলিদ করছে তিনি অপরপক্ষের দলিল জানা সত্ত্বেও নিজ দলিলকেই শক্তিশালী ও ফতোয়াকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জ্ঞান করছেন, তার বাহ্য ও পরিষ্কার ফলাফল হলো, শরিয়তের দৃষ্টিতে উভয় মতের অবকাশই রয়েছে সে মাসআলায়। এমন ছুরতে সাধারণ বুঝমান মানুষও এ কথা বলতে পারে না যে, অমুক ইমামের সাধারণ মুকাল্লিদদের নিজেদের অজ্ঞতা ও শরয়ি দলিলাদির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলির জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ইমামের কথা ও মত পরিহার করা উচিত। (প্রকাশিতব্য যে, আমাদের এ কথা সেসব মাসায়িলের ক্ষেত্রেই প্র্রযোজ্য উম্মাতের সালাফে সালেহিন; বিশেষত সাহাবা এবং অনুসৃত ইমামগণের যেগুলোর ক্ষেত্রে মতভিন্নতা রয়েছে। সুস্পষ্ট বেদ’আত ও অকাট্য ভুল মত, যার ব্যাপারে সাহাবা এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের অনুসৃত ইমামগণের বিলকুল ইখতিলাফ নেই তাতো নিঃসন্দেহে প্ররিত্যাজ্য।)

আমলের এ প্রদ্ধতি ও ধারাবাহিকতা প্রত্যেক যুগের ইমাম ও আলিমগণের মাঝেই অনুসৃত। তারা ইখতিলাফি ফিকহি মাসায়িলের ক্ষেত্রে আপন মতকে অগ্রাধিকার দিতেন। নিজেদের কিতাবাদিতে, ইলমি মজলিসগুলোতে নিজেদের দলিলাদি বর্ণনা করতেন; সেগুলোকে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করতেন। অন্যান্য ইমামদের মতকে দুর্বল আখ্যা দিতেন; দুর্বলতার কারণও স্পষ্ট করতেন। কিন্তু কখনোও অন্য ইমামের মুকাল্লিদ ও অনুসারীদেরকে একথা বলতেন না, তোমরা কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী! তোমাদের উচিত নিজেদের ইমামের মাযহাব পরিহার করা!! (স্মতর্ব্য যে, ইলমে ফিকহের পরিভাষায় “আম” তথা সাধারণ মানুষ বলাই হয় এমন মানুষকে, যার মধ্যে নেই ইজতিহাদের যোগ্যতা।) এখন যদি কেউ চার মাযহাবের অনুসারীদের ওপর এ বিধান আরোপ করে যে, তোমরা তোমাদের ইমাম ও আলিমগণের তাকলিদ বর্জন করো। তারা তো কোরআন-সুন্নাহর খেলাফ ফতোয়া দেন, মাসায়িল বলেন। আমি যা বলি তাই চূড়ান্ত— সত্য, কোরআন-সুন্নাহর অনুকূল। (যখন তাদের মাযহাবের আলিমগণই একথা বলে থাকেন, আমরা যেসব ফতোয়া প্র্রদান করি সব দলিলেরই ভিত্তিতে) তখন এর উদ্দেশ্য এছাড়া আর কি-ই-বা হতে পারে যে, তারা লোকদেরকে কোরআন-সুন্নাহর নাম দিয়ে, এর খোলস লাগিয়ে নিজেদের তাকলিদের দিকে আহ্বান করছে, ফেরি করে বেরাচ্ছে সর্বত্র এর দাওয়া!!

এ ধরনের লোকদেরকে আদবের সাথে করজোড় করে অনুরোধ করা উচিত, খোদার ওয়াস্তে ভাই আমাদেরকে ক্ষমা করো। আমরা বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ ইমামগণের তাকলিদকে তুমি এবং তোমাদের কিবা অমুক আর তমুকের তাকদি করা থেকে শ্রেয় জ্ঞান করি। কেননা, আমরা জনসাধারণদের জন্য ফিকহি মতানৈক্যপূর্র্ণ মাসায়িলের ক্ষেত্রে শরিয়তের ওপর চলার একটাই পথ। আর তা হলো গ্রহণযোগ্য কোনো ইমামের মত-অভিমতের ওপর আস্থা রেখে তার তাকলিদ ও অনুকরণ করে যাবো। তোমরা অপেক্ষা আহলে সুন্নাত ওয়াল মাযহাবের সালাফ মাযহাব চতুষ্টয়ের ইমামগণের ওপর আমাদের আস্থা ও নির্ভরতা অজস্রগুণ বেশি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এটাই সাহাবা তাবেয়িনের, সালাফে সালেহিন ইমামগণের, মুহাদ্দিস ফকিহগণের, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আলিমগণের পছন্দনীয় পথ। সালাফে সালেহিনের যুগেও আমরা দেখি এ প্র্রজ্ঞাপূর্র্ণ ব্যাপকতা ও উদারতা। সালাফের যুগে আমরা লক্ষ করি, প্রত্যেক বসতির বাসিন্দারা নিজেদের ফিকহি মাযহাবের অনুসরণ করতেন। ইমামগণ কখনোও তাদেরকে অনুসৃত আলিমগণের তাকলিদ থেকে বাধা প্রদান করেননি, কিবা করেননি কোনো প্রকার বারণ। আমরা সামনে তার উজ্জ্বল কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবো, ইনশাআল্লাহ।

 

‪সাহাবাযুগেও ছিলো তাকলিদের প্রচলন

 

৩. তৃতীয় যে বিষয়টি উপরিউক্ত ঘটনার আলোকে প্রতীয়মান হয়- সাহাবাযুগেই ছিলো তাকলিদ, বরং তাকলিদে শখছির প্রচলন। মদিনাবাসী অকপটভাবে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে বলে দিলেন, আমরা যায়দ বিন সাবিত রা. এর কথাই মান্য করবো। গ্রহণ করবো না আদৌ আপনার মত।

 

‪‎ইবনে উসাইমিন রহ.ও সাহাবিগণের তাকলিদের কথা স্বীকার করতেন

 

তাকলিদ প্রাকৃতিকভাবে এমনই আবশ্যকীয় একটি বিষয়, যার অস্তিত্ব ছিলো প্রতিটি যুগে, প্রতিটি সময়ে। এ কথার স্বীকৃতি দিয়েছেন প্রত্যেক ইনসাফপছন্দ এবং হাকিকতজ্ঞাত ইলমধারী। শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহ. এর সিলসিলার প্রসিদ্ধ আলিমে রব্বানি শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আলউসাইমিন রহ. (সৌদি আরবের আলিমগণের দৃষ্টিতে যার অবস্থান ইবনে বায রহ. এর পরে সবার শীর্ষে।) স্পষ্ট ভাষায় বলছেন,

التقليد في الواقع حاصل من عهد الصحابة -رضي ادله عنهم- و لا شك إن من الناس في عهد الصحابة و إلى عهدنا هذا من لا يستطيع الوصول إلى الحكم بنفسه لجهله و قصوره، و وظيفة هذا أن يسأل اهل العلم، و سؤال اهل العلم يستلزم الأخذ بما قالوا، و هو التقليد. (فتاوى نور على الدرب: ٢ / ٢٢٠)

হাকিকত হলো, তাকলিদের অস্তিত্ব সাহাবাযুগ থেকে। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, সাহাবাযুগে এমন অনেক মানুষ ছিলো, যারা খোদ শরয়ি বিধান উদঘাটনে সক্ষম ছিলো না। কেননা তারা ছিলো না ইলমের ধারকবাহক। তাদের দায়িত্বভুক্ত ছিলো, তারা আলিমগণকে মাসআলা জিজ্ঞেস করে আমল করতেন। আর এই হলো তাকলিদ।

 

‪‎সাহাবাযুগে তাকলিদে শখছির আরেকটি দৃষ্টান্ত

 

সাহাবাযুগেই প্রাওয়া যায় তাকলিদে শখছির অগণন দৃষ্টান্ত। ব্যাপকভাবে সাধারণ সাহাবিরা শুধু একজন আলিম সাহাবির মত এবং পথকে অবলম্বন করতেন, অন্যান্যদের মতকে গ্রহণ করতেন না ইজতিহাদি মাসায়িলের ক্ষেত্রে।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. ছিলেন কুফানগরীর সবচে বিদগ্ধ আলিম। সে সময়ের কথা, একদিন হযরত আবু মুসা আশ’আরি রা. কে লোকেরা উত্তরাধিকারের একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলো। তিনি মাসআলার সমাধান বললেন। উল্লেখ করলেন না মাসআলার কোনো দলিল। তবে এতোটুকু বললেন, তোমরা ইবনে মাসউদ রা. কেও জিজ্ঞেস করো। আশা করি তিনিও এমনটিই বলবেন। লোকেরা আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এর কাছে গেলো। তিনি বললেন, আমি যদি আবু মুসা আশ’আরির অনুকূল ফতোয়া দেই তবে তো আমি নিশ্চিতরূপে গোমরাহ হয়ে যাবো। আমি এ মাসআলার সে সমাধানই বলবো যা বলেছিলেন প্রিয় রাসুল সা.। এ মাসআলায় তো রাসুলের সুস্পষ্ট হাদিস বর্ণিত আছে। এরপর তিনি হাদিসের আলোকে মাসআলার সমাধান দিলেন। লোকেরা ফিরে এসে আবু মুসা আশ’আরি রা. কে ঘটনার বৃত্তান্ত জানালেন। তখন তিনি যা বললেন তাই এখানে লক্ষণীয়-

لا تسألوني عن شيئ ما دام هذا الحبر فيكم. (الجامع الصحيح للبخاري : ٦٧٣٦ ؛ السنن الكبرى للبيهقي : ٦ / ٢٢٩)

যতোদিন এ মহান ইমাম থাকবেন তোমাদের মাঝে আমাকে কখনোও কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে না।

হযরত আবু মুসা আশ’আরী রা. এর এ কথার উদ্দেশ্য তো এই— কুফাবাসীর উচিত অন্য সবার মতপথ পরিহার করে একমাত্র ইবনে মাসউদ রা. এর কথামতো আমল করা।

Share This