মানুষের আস্থার জায়গা নষ্ট করবেন না


এই নীতি কি আসলে মানা হয়? এমনকি যারা এই নীতি বেশি কপচায়, তারাও কি আদৌ এটা মানে?

প্রথমে আমরা এর কিছু দৃষ্টান্ত দিই। দৃষ্টান্ত শুধুই বোঝার জন্য। এমন নয় যে, যাদের দিয়ে দৃষ্টান্ত দিচ্ছি, আমি তাদের সবার অনুসারী বা তাদেরকে ভালোবাসি।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া, হাফিজ ইবনুল কায়্যিম, ইমামুদ দাওয়াহ মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল ওয়াহহাব নাজদি, শাইখ সায়্যিদ কুতুব। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের আস্থা, নির্ভরতা ও ভালোবাসার জায়গা। কিন্তু আমরা কি এই জায়গাগুলো নষ্ট করি না? তাদের সমালোচনা করি না? আমাদের চুনোপুঁটিদের কথা বাদ, অনেক রাঘববোয়ালও তাদের শানে মারাত্মক ধরনের আক্রমণ করে বসেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে। এ ক্ষেত্রে কি সেই নীতি প্রযোজ্য হওয়ার কথা ছিল না?

শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি, শাইখ বিন বাজ, শাইখ উসাইমিন প্রমুখ কি কোটি কোটি মানুষের আস্থার জায়গা নন? প্রথমজনকে তো এ দেশীয় আমজনতা পুরো বাতিলপন্থীই মনে করে। তারা এই ধারণা পেয়েছে বিপুল পরিমাণ আলিমের থেকেই। তো এই নীতি এখানে কীভাবে রক্ষিত হলো? আর পরবর্তী দুজনের খোল্লমখোলা সমালোচনা করেছেন শাইখ আবু মুহাম্মাদ আইমান (হাফিজাহুল্লাহ) পর্যন্ত। তোমরা যারা এই নীতি কপচাও যে, মানহাজিরা পৃথিবীর কোনো আলিমেরই সমালোচনা করে না, তার দ্বারা কিতালের যতই ক্ষতি হোক না কেন, তারা উপরিউক্ত শাইখদ্বয়ের ব্যাপারে মানহাজের ইমামের বক্তব্যটাই শুধু পড়ে দেখো। অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। আর যারা সালাফের মানহাজ মনে করে শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথা, তারা যে তাদের তাসাওউফ রিলেটেড দু-চারটা বই বাদে জীবনে আর কিছুই পড়ে দেখেনি, তা সহজেই অনুমেয়। অন্যথায় এই অজ্ঞতাপ্রসূত মন্তব্য করার কথা নয়।

শাইখ আবু হামজা উসামা, শাইখ আবু মুহাম্মাদ আইমান, মাওলানা আসিম উমর পৃথিবীর কত লক্ষ-কোটি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসার জায়গা। তোমরা কথায় কথায় কেন তাদেরকে আঘাত করো? বা সরাসরি তাদেরকে না করলেও যারা হুবহু তাদের কথা উদ্ধৃত করে, বর্ণনা করে বা নিজস্ব উপস্থাপনায় প্রচার করে, তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করো? এ ক্ষেত্রে কোথায় যায় তোমাদের সেই নীতি? মাওলানা যোবায়ের সাহেব যা কিছু প্রচার করেন, তা তো তার নিজস্ব মতামত নয়; বরং তা-ই উপরিউক্ত শাইখদের মতামত। তোমরা নিজেদের শাইখদের বাঁচাতে গিয়ে অন্যদের শাইখদের ওপর কেন হামলে পড়ো?

মাওলানা মওদুদি, ড. জাকির নায়েকদের উদাহরণ আর না-ই বা টানলাম। শাইখ ইউসুফ কারজাবিকে নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করলে তোমরা পরমতসহিষ্ণুতার বাণী নিয়ে তেড়ে আসো। তোমরা যখন সায়্যিদ কুতুব, হাসান আল বান্না, আবুল আ’লা মওদুদি, জাকির নায়েক প্রমুখদের টুটি চেপে ধরো তখন তোমাদের ক্ষেত্রে কোন নীতি প্রযোজ্য হওয়া উচিত?

যদি বলা হয়, উপরিউক্ত ব্যক্তিদের ওপর আস্থা রাখা সংগত নয় বিধায় তাদের ক্ষেত্রে আমরা এরূপ আচরণ করি তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, আস্থা রাখার প্রকৃত মাপকাঠি কী? তোমার ঘরানার লোক হলেই তার ওপর আস্থা রাখা যাবে আর অন্য ঘরানার হলে পরিত্যাজ্য হবে, বিষয়টা কি এরূপ? প্রত্যেক দলের আচরণ দেখলে বিষয়টা এরকমই মনে হয়। তবে এটা তো কোনো মাপকাঠি হতে পারে না। আর যদি মাপকাঠি বাস্তবে কুরআন-সুন্নাহই হয় তাহলে একই আচরণ নিজেদের লোকদের ব্যাপারে কেন করা হয় না?

মওদুদিবাদের স্বরূপ উন্মোচন নামে দেশে যত অনুষ্ঠান হয়, ড. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে যত চেঁচামেচি ঝাড়া হয়, তার সিকিভাগও কি নিজেদের বিপথগামী লোকদের নিয়ে করা হয়? ভারতীয় মাহমুদ মাদানি বা দেশীয় ফউমা’র স্বরূপ উন্মোচন অনুষ্ঠান এ দেশে কি আদৌ ভাবা যায়? দায়ি ড. জাকির নায়েক ভুল কথা বলার কারণে বিতর্কিত ঠিকই হয়, কিন্তু দায়ি মাওলানা তারেক জামিল অসংখ্য ভুল কথার কারণেও মোটেও বিতর্কিত হয় না। কওমিদের মধ্যে যারা বামপন্থী, সেকুলার, মুরজিয়া, মাদখালি, ব্যক্তিপূজারী, ডেমোক্রেটিক, জাতীয়তাবাদী, মুলহিদ ও জিন্দিক – তাদের নিয়ে কেন কথাবার্তা হয় না? উল্টো তারা জন্মসূত্রেই হয়ে থাকে ‘আস্থার জায়গা’। তাদের নিয়ে কেউ সমালোচনার সুর উচ্চকিত করলে উল্টো তারা হয়ে যায় বিতর্কিত। কিন্তু কেন? আমি তো মনে করি, কেউ যদি ফউমা’র বিরোধিতা করে আর মাহমুদ মাদানির সাফাই গায় তাহলে সে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডে রয়েছে। একইভাবে বিদেশী সাদ নিয়ে ওয়াজাহাত করে, কিন্তু দেশীয় বরেণ্য অনুসরণীয় পর্যায়ে থাকা অসংখ্য দায়ি, প্রসিদ্ধ কতিপয় পির ও বক্তা ‘সাদ’-এর ব্যাপারে আজীবন নীরবতা অবলম্বন করে তাহলে সে উম্মাহর সঙ্গে একজন খেয়ানতকারী বৈ কিছু নয়।

তো ভাই, তুমি যদি এই নীতি আংশিক মানো তাহলে অন্যকে আংশিক মানার জন্য তিরস্কার করতে পারো না। কারণ, এটা কোনো ইনসাফের কথা নয়। আর তুমি যদি ভাবো, তোমার মাপকাঠি অনুসারে যে আস্থার জায়গা হবে, তার সমালোচনা করা যাবে না; অন্যদের যাবে তাহলে শোনো, একই ভাবনা লালন করার অধিকার কিন্তু অন্যরাও রাখে। এ আকাশ কেবল তোমার একারই নয় যে, সব তারা তোমাদের দখলে যাবে। সুতরাং হয়তো ইনসাফকারী হও, নতুবা এসব অসার ধোঁয়াশাচ্ছাদিত নীতি কপচানো বন্ধ করো।

সমালোচনা শুধু উপকার আর উপকার


বিভিন্ন মিডিয়া তারকা ও প্রসিদ্ধিলোভীকে দেখেছি, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সমালোচিত হয়। কারণ, আলোচনার দ্বারা যা কিছু হাসিল হয়, সমালোচনার দ্বারা তারচে কয়েকগুণ বেশি হাসিল হয়। খ্যাতি, প্রসিদ্ধি কোনো কিছুতে তখন কমতি থাকে না। আর ওদের যেহেতু কোনো শাশ্বত আদর্শ নেই, তাই সমালোচনায়ও ওদের কিছু খোয়া যায় না। ওদের প্রয়োজন জাস্ট প্রসিদ্ধি, সেটা তারা পেয়েই যায়।

তা ছাড়া সমালোচনা যদি দালিলিক ও গ্রহণীয় হয় তাহলে তাতে আপনার উপকারই বটে। এ জন্যই উমর রা. বলতেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে দয়া করুন, যে আমাদেরকে আমাদের দোষ দেখিয়ে দেয়।’ মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তাই সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে নিলে এতে আপনার সংশোধন সহজ হবে। ইমাম গাজালি রহ. আত্মশুদ্ধির যে চারটি পন্থার কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো শত্রুর দ্বারা আত্মশুদ্ধি করা। আর তা এভাবে যে, শত্রু সমালোচনায় কোনো ত্রুটি করে না। সুতরাং তার সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে নিলে আপনি সকল দোষ থেকেই মুক্ত হয়ে উঠতে পারবেন।

সমালোচনার আরেকটি উপকার হলো, এর কারণে আশা করা যায়, আপনি অহংকার থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। কারও সমালোচনা মোটেও না হলে অহংকার তার ভেতরে খুব সহজেই শিকড় গেঁড়ে নেয়।

আর সমালোচনা যদি কেবলই ভেতরের বিদ্বেষের প্রকাশ হয় তাহলে তাতে কিছু গালাগাল, ট্যাগ, খারাপ ভাষা, অভব্যতা, ট্রল, আর কিছু অসার আপত্তি ছাড়া কিছু থাকবে না। অবশ্য ট্রলবাজরা ট্রল ছাড়া আর পারেই বা কী! তাদের ভাণ্ডারে আর আছেই বা কী! সমালোচকরা আপনার সহিহ কথারও গলদ তাবিল বের করবে; যদিও তাদের ভালোবাসার লোকদের গলদ কথারও সহিহ তাবিল করতে তারা সিদ্ধহস্ত। কখনো আগপরের কথা বাদ দিয়ে অর্থ বিকৃত করে ফেলবে। তাদের অনেক সমালোচনা কেবলই অনুমাননির্ভর ও শ্রুতিনির্ভর। তারা পৃথিবীর সব কাজ বাদ দিয়ে কেবলই একজনের দোষচর্চা নিয়ে পড়ে থাকে। তারা অন্যকে যে অভিযোগে অভিযুক্ত করে, নিজেরাও একই প্রক্রিয়ায় তার প্রতিবাদ করে। এটা কেমন যেন ধর্ষণের প্রতিবাদে ধর্ষককে ধর্ষণ করার মতো।

এসব সমালোচনা আপনার জন্য উপকারী। কারণ, এতে খুব সহজে আপনার শত্রু-মিত্র নির্ণীত হবে। আপনিও তাদের চিনতে পারবেন, আপনার অনুসারীদের চোখেও তারা থাকবে চিহ্নিত। এভাবে সস্তা সমালোচনা করে তারা যখন গ্রহণযোগ্যতা হারাবে তখন তাদের কোনো কিছুরই আর মূল্য থাকবে না। এটা তাদের ক্ষেত্রে হবে হিতে বিপরীত। অন্যকে বিতর্কিত করতে গিয়ে তারা নিজেরাই হয়ে যাবে বিতর্কিত। আর বাঁচালদের যে কেউ গোনায় ধরে না, এটা তো স্পষ্ট বিষয়।

তা ছাড়া এর আরেকটি উপকার হলো, সমালোচনা দেখা সত্ত্বেও যারা আপনাকে ভালোবাসবে, সেই ভালোবাসা হবে প্রকৃত ভালোবাসা, নিখাদ ও লৌকিকতামুক্ত ভালোবাসা, গভীর ও সুদৃঢ় ভালোবাসা। শুরু থেকেই যে এসব দেখে আপনাকে ভালোবাসে, সে ভালোবাসায় স্থায়িত্বও থাকে। আর যে ভালোবাসা হয় কেবলই সুধারণার ভিত্তিতে, কোনোপ্রকার সমালোচনা না দেখে, তা হয় কচু পাতার পানির মতো। যেকোনো সময় সামান্য নাড়া লাগলেই তা পড়ে যায়। এমনিও সাধারণত অফলাইনের ভালোবাসা হয় অক্ষয় অব্যয়; অপরদিকে অনলাইনের ভালোবাসা প্রকৃতিগতভাবেই হ্যাংলা, দুর্বল ও কচু পাতার জল সদৃশ।

তবে অনলাইন সমালোচকদের উচিত সমালোচিতের আইডি ম্যানশন করে সমালোচনা করা। এতে উভয়ের উপকার। সমালোচকের উপকার হলো, পাঠক আইডি ঘুরে তার সমালোচনার যথার্থতা যাচাই করতে পারবে। তার ধারণা নিশ্চয়তার পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারবে। তবে সমালোচকরা এই কাজটা সাধারণত করতে চায় না। তারা ইঙ্গিতে কাজ সারতে চায়। কারণ, তাদের অধিকাংশ সমালোচনাই হয় আগপর বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্ন কথা নিয়ে বা সহিহ কথার গলদ তাবিল বের করে। এককথায় তা হয় ‘যাকে দেখতে পারি না, তার চলন বাঁকা’র মতো। এখন পাঠক যদি তা যাচাই করতে যায় তাহলে আশঙ্কা আছে, সে এই ছলনা ও দাগাবাজি ধরে ফেলবে এবং হিতে বিপরীত হবে। এখন অনেকে তার কথাকে ওহি মনে করে ইমান আনলেও তখন আইডি ঘুরে তারা হাকিকত জেনে ফেলবে। ফলে কেটে যাবে অন্ধত্বের ঘোর। উন্মোচিত হবে সমালোচকের সুন্দর মুখোশের আড়ালের কুশ্রী চেহারা।

আর এই ম্যানশনে সমালোচিতের সেরূপ উপকার হবে, যেরূপ উপকার হয়েছিল মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা.-এর। মক্কাবাসীরা তার নাম ম্যানশন করে হজের উদ্দেশ্যে আগত নতুন মানুষদের সামনে বিভিন্ন ট্যাগে ট্যাগান্বিত করে তার সমালোচনা উপস্থাপন করতে লাগল। এতে মানুষের ভেতর কৌতূহল সৃষ্টি হলো। কারণ, মূলনীতি হলো, মানুষ ওই জিনিসে ব্যাপক আগ্রহী থাকে, যা থেকে তা নিষেধ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। এতে বরং ইসলামের উপকার হলো। রাসুলুল্লাহ সা.-এর ফলোয়ার বৃদ্ধি পেল। যাচাই করে অনেক মানুষ মক্কাবাসীর বিদ্বেষ টের পেল, তাদের অসারতা বুঝে ফেলল আর পাশাপাশি ইসলাম ও ইসলামের নবির হক্কানিয়াত উপলব্ধি করল।

তো সমালোচকরা নিজেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত জোরপূর্বক অন্যদের ওপর না চাপিয়ে আইডি ম্যানশন করে বিচারের দায় পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলেই ভালো। পাঠক সব লেখাজোঁকা পড়ে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে নিজেই উপযুক্ত ও যথার্থ সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। আর সবার রুচি কখনোই এক হয় না। সুতরাং সবার সিদ্ধান্তও কোনোদিন এক হওয়ার কথা নয়। এ কবিতা তো স্বতঃসিদ্ধ : ‘ওয়া লিন্নাসি ফি-মা ইয়া’শাকুনা মাযাহিবু’। সুতরাং মানুষকে তাদের ‘মাযহাব’ নির্বাচন করতে দেওয়াই সবচে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। আপনি সত্য হলে তারা আপনাকে গ্রহণ করবে। আর আপনি মিথ্যা হলে তারা আপনাকে বর্জন করবে। আমার তো মনে হয় না, অসৎ দুরাচারী ও কাপুরুষ ছাড়া আর কেউ এ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করবে। তারা দ্বিমত পোষণ করবে এ কারণে যে, বাস্তবে তারা এই কাজ করতে গেলে লোকে তাদের স্বরূপ জেনে যাবে। তখন পাছে না আবার এর জন্য তাদেরকে ঝাটার বাড়ি খেতে হয় বা জুতোর মালা গলায় বহন করতে হয়।

সমালোচনার ডাবল স্টান্ডার্ড

সবক্ষেত্রে আংশিকতা দ্বারা সামগ্রিকতা প্রমাণ হয় না। এরপর আবার শাখার সমালোচনা দ্বারা মূলের ত্রুটি প্রমাণিত হয় না। বিবেচনাবোধের পার্থক্যের কারণে প্রায়শই বিধানে ভিন্নতা আসে।

যেমন, ফিকহের মাসআলা হলো, কেউ যদি কোনো আলিমকে আলিম হিসেবে গালি দেয় তাহলে তার ইমান চলে যাবে। তবে কেউ যদি কোনো আলিমকে ব্যক্তি হিসেবে গালি দেয়, সেই আলিম ব্যক্তির ব্যক্তিগত যেকোনো সমস্যার কারণে তাহলে এটা কুফর হবে না; বরং সাধারণ গালির হুকুমেই আসবে। আচ্ছা, এই পার্থক্য কেন করা হচ্ছে? কারণ, দুটো গালিতে দুটো দিক বিবেচ্য। প্রথমটাতে বিবেচ্য ছিল ইলমের প্রতি তাচ্ছিল্য। আর ইলমকে তাচ্ছিল্য করলে তা প্রকারান্তরে ইলমের উৎস আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে তাচ্ছিল্য করা হয়। পক্ষান্তরে দ্বিতীয়টাতে ইলম বিবেচ্য ছিল না; বরং ব্যক্তির ব্যক্তিগত দোষ-ত্রুটি বিবেচ্য ছিল। তাই এটা কুফরকে অপরিহার্য করছে না।

পৃথিবীতে যারা কওমি মাদরাসায় পড়ে, তাদের সবার অবস্থা কি একরকম? উত্তর নিশ্চয়ই ‘না’ হওয়ার কথা। অধিকাংশের অবস্থা প্রশংসনীয় হলেও কিছু নামধারী তালিবে ইলম এমন পাওয়া যাবে, যারা বিভিন্ন কুকর্মে লিপ্ত। এখন কেউ যদি এই ‘আংশিকতা’ দ্বারা ‘সামগ্রিকতা’র ওপর বিধান আরোপ করতে চায় তবে তা কি কখনো সংগত হবে? বিচ্ছিন্ন কারও কর্ম দ্বারা প্রমাণ দেখিয়ে সবাইকে যদি গালাগাল করতে চায় তবে তা কি সমর্থনযোগ্য হবে? নিশ্চয়ই না। কারণ, বিচ্ছিন্ন উদাহরণ প্রমাণ হয় না। আর সবক্ষেত্রে আংশিকতা দ্বারা সামগ্রিকতার উদাহরণ চলে না। এ ক্ষেত্রে ভাত রান্নার সময় দু-চারটা চাল টিপে দেখার দৃষ্টান্ত টানলে তা হবে ‘কিয়াস মাআল ফারিক’ তথা ভিন্ন জিনিসের সঙ্গে তুলনা’র পর্যায়ভুক্ত। একই কথা সব দলের ক্ষেত্রেই। যদিও কিছু মানুষ এগুলোকেই প্রমাণ বানাতে চায়। সেকুলার ও নাস্তিকরা কওমি মাদরাসার এমন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে পুঁজি বানিয়ে মাঝে মাঝেই বড় বড় বিবৃতি ঝাড়তে শুরু করে।

তো তিনটা মূলনীতি নিয়ে কথা চলছিল। (১) সবক্ষেত্রে আংশিকতা দ্বারা সামগ্রিকতা প্রমাণ করা যায় না। (২) শাখার সমালোচনা মূলের ত্রুটি প্রমাণ করে না। (৩) বিবেচনাবোধের পার্থক্যের কারণে প্রায়শই বিধানে ভিন্নতা আসে।

৩-এর দৃষ্টান্ত উল্লেখিত হয়েছে দ্বিতীয় প্যারায়। ১-এর দৃষ্টান্ত উল্লেখিত হয়েছে তৃতীয় প্যারায়। এবার আসি ২-এর দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে। কেউ যদি আমরা যারা মুসলমান আছি, আমাদের কাউকে, কোনো দলকে, অধিকাংশজনকে তার সমালোচনার লক্ষ্যস্থল বানায়। যেমন, কেউ বলল, এই যুগের মুসলমানদের নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটেছে। তাহলে এর দ্বারা কি ইসলামের মূল তথা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবমাননা হবে? এর দ্বারা কি ইসলামধর্মকে খাটো করা হবে? উত্তর নিশ্চয়ই ‘না’ হওয়ার কথা। কারণ, শাখার সমালোচনা মূলের ত্রুটি প্রমাণ করে না। আমরা হলাম শাখা। আমাদের ত্রুটি মূলের ত্রুটিকে অপরিহার্য করে না।

আশা করি, উপরিউক্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। এ জন্যই মাওলানা সাদ বা তার অনুসারীদের কারণে কেউ গোটা তাবলিগকে বা সকল তাবলিগিকে মন্দ বলে না। ফউমা’র কারণে সব কওমি আলিমকে গালাগাল করে না। দু-চারটা অসৎ শাইখের কারণে সকল হক্কানি শাইখকে খারাপ ভাবে না। প্রভৃতি।

আচ্ছা, এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। যারা কিতালের কথা বলে, তাদেরকে উলামাবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করার একটা কসরত অনেক চেতনাজীবী করে থাকে। কিন্তু কেন? এখানে এসে কি তবে আর কোনো মূলনীতি প্রযোজ্য হয় না, যেগুলো নিজেদের ক্ষেত্রে অহরহ হয়ে থাকে? অথচ এখানে কিন্তু অনেকগুলো বিষয় রয়েছে :

(ক) সব কিতালপন্থীই কি আলিমদের সমালোচনা করে? যদি উত্তর ‘না’ হয় (আর উত্তর না-ই হওয়ার কথা। কারণ, এর ব্যতিক্রম উত্তর দিয়ে কেউ তার পক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারবে না। সবমিলিয়ে সমালোচকের সংখ্যা কয়জন? তা মোট সংখ্যার কত পার্সেন্ট?) তো এটাকে পুঁজি করে সবার ওপর ঢালাও ট্যাগ আরোপ কীভাবে বৈধ হয়? এখানে এসে কেন বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যেটা নিজেদের ক্ষেত্রে কখনোই করা হয় না; বরং বিচ্ছিন্নতার কথা বলে সর্বদা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়?

(খ) কিতালপন্থীরা কি সব আলিমের সমালোচনা করে? উত্তর নিশ্চয়ই ‘না’ হবে। কারণ, যদি ধরে নিই, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে এক কোটি আলিম আছে তবে তাদের কয়জনের সমালোচনা এই কিতালপন্থীরা করেছে? সর্বোচ্চ ১০০ হবে কি? আচ্ছা, যদি ১০০ই হয় তাহলে এই সংখ্যাটা মোট সংখ্যার কত পার্সেন্ট? এখানে কেন আংশিকতা দ্বারা সামগ্রিকতা প্রমাণের কসরত চালানো হয়?

(গ) কিতালপন্থীরা যাদের সমালোচনা করে, কোন বিবেচনার ভিত্তিতে তারা তাদের সমালোচনা করে? বিবেচনা কি এটা হয় যে, তারা ইলম শিখেছে? নাকি বিবেচনা হয় তাদের থেকে প্রকাশিত কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে বিরোধপূর্ণ কথা ও কাজ? যদি বিবেচনা দ্বিতীয়টার হয় তাহলে সেটা কি সমালোচনাকে অপরিহার্য করে না? তো এই ক্ষেত্রে মূলনীতি অনুযায়ী দোষী হবে কে? সমালোচক নাকি সমালোচিত? কারণ, এখানে সমালোচনাটা ক্রিয়া নয়; বরং প্রতিক্রিয়া। যে কারণে সমালোচক সমালোচনা করল, সেই কারণটা যদি না পাওয়া যেত তাহলে কি এই সমালোচনা হতো? এখানে দায়ী তো সমালোচিত নিজেই। তার কর্মের ফলই তো সে ভোগ করছে এখন।

(ঘ) যদি ঢালাও সমালোচনাকে দলিল বানিয়ে বলা হয়, তারা সব আলিমের সমালোচনা করে তাহলে বাস্তবতা এটাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কারণ, তারা অধিকাংশ আলিমের প্রতি, বরং গুটিকয়েক বাদে প্রায় সব আলিমের প্রতি ওয়ালা (সম্প্রীতি) লালন করে। এমনকি তারা নিজেরাও আলিমদের তত্ত্বাবধানে চলে। আলিমগণ কর্তৃক পরিচালিত শরয়ি বোর্ডের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছাড়া তারা কোনো পদক্ষেপই ফেলে না। তারা ব্যক্তি দ্বারা হক মাপে না; বরং হক দ্বারা ব্যক্তি মাপে। যার কারণে অজানা অচেনা মানুষকেও তারা ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেয়, তাদের ফাতওয়ার অনুসরণ করে। আবার চেনাজানা মানুষের ভুল-বিচ্যুতিগুলোকেও এড়িয়ে চলে। কারণ, মূলনীতি হলো, পদস্খলনের ক্ষেত্রে কেউ অনুসরণীয় থাকে না।

আর দ্বিতীয় বিষয় হলো, ঢালাও সমালোচনা তো আপনারাও করেন। কখনো বাঙালি জাতির নাম ধরে, কখনো এই যুগের মুসলমানদের কথা বলে, কখনো এই সময়ের সব আলিম/বক্তা/দায়ি/শিক্ষকের প্রসঙ্গ টেনে তখন এটা কি সকলের সমালোচনা হয় না? উত্তর বলবেন, না হয় না। যদি বলা হয়, কেন? উত্তরে বলবেন, তুমি ভাই সমালোচনার ইল্লত (Cause) দেখো। এই ইল্লত যাদের মধ্যে পাওয়া যাবে, সমালোচনা তাদের ওপর প্রয়োগ হবে। যাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না, তাদের ওপর প্রয়োগ হবে না। সুতরাং নিজে পণ্ডিতি করে অমুক আর তমুক হজরতদের কাঁধে নিয়ে প্রয়োগ করো না। কারণ, তাদের মধ্যে ইল্লত অনুপস্থিত। দালালাতুল হাল (অবস্থার দাবি) বা দালালাতুল উরফ (প্রচলিত অবস্থার দাবি)-এর কারণে এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুসতাসনা হয়ে যাবে, মূল বিধানের বাইরে থাকবে।

আমরাও আপনাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলব, ‘মা কানা জাওয়াবুকুম, ফা হুওয়া জাওয়াবুনা।’ আপনারা নিজেদের ব্যাপারে যে উত্তর দিয়েছেন, আমাদের ব্যাপারেও একই উত্তর প্রযোজ্য। কিন্তু এখানে এসে কেন যেন আপনারা ডাবল স্টান্ডার্ডের পরিচয় দেন।

(ঙ) সমালোচনার প্রকাশ সবার মধ্যে লক্ষ করা যায়। আপনারাও কি সমালোচনা কম করেন? আপনারা যাদের সমালোচনা করেন, কেন করেন? আপনাদের সমালোচনা তো বড়দেরও ছাড়ে না। কখনো বেফাক প্রসঙ্গে, কখনো হাইয়া প্রসঙ্গে, কখনো শোকরানা মাহফিল প্রসঙ্গে, কখনো লক্ষ স্বাক্ষরের ফাতওয়া প্রসঙ্গে, কখনো নদীর ওপারের শাইখের প্রসঙ্গে আপনারা প্রচুর সমালোচনা ঝাড়েন, ট্রল করেন। আচ্ছা, তা বৈধ হয় কেন? আপনাদের জন্য কি স্বতন্ত্র শরিয়াহ রয়েছে? উত্তর যদি ‘না’ হয় তাহলে নিজের জন্য যা বৈধ মনে করেন, অন্যদের জন্য তা কেন অবৈধ ঘোষণা করেন? হ্যাঁ, বাকি থাকল বিবেচনাবোধের পার্থক্য। আপনার মানদণ্ড আলাদা, আর অন্যজনের মানদণ্ড আলাদা। আপনার বিবেচনায় অমুক সমালোচনার যোগ্য, আর অন্যজনের বিবেচনায় তমুক সমালোচনার যোগ্য। এই যা। তো আপনি নিজে যদি আংশিকতার কারণে সামগ্রিকতার সমালোচক হিসেবে চিহ্নিত না হন তাহলে অন্যকে কেন এই ট্যাগে ট্যাগান্বিত করতে চান?

হ্যাঁ, এটা বলতে পারেন, অন্যজন যেই বিবেচনার কারণে তমুকের সমালোচনা করছে, সেটা সহিহ নয়। তার বিবেচনায় বা মানদণ্ডে এই এই ত্রুটি বা অসারতা রয়ে গেছে। সুতরাং তার বিবেচনা বা মানদণ্ড পালটানো উচিত। কিন্তু এই সততা ও ইনসাফের পরিচয় না দিয়ে এবং সকল মূলনীতি লঙ্ঘন করে আপনারা কেন ইয়া বড় বড় ট্যাগের বস্তা নিয়ে বসে যান? ‘তুমি করলে পাপ, আমি করলে মাফ’ – এটা তো কোনো ইনসাফের কথা নয়? কুরআনের ভাষায় আমরা আপনাদেরকে বলব, ‘আ ফালা তা’কিলুন’? আপনারা কি বিবেক খাটাবেন না? ‘আ ফালা তাযাক্কারুন’? আপনারা কি শিক্ষা গ্রহণ করবেন না? ‘আ ফালা তুবসিরুন’? আপনারা কি (দেখেও) দেখবেন না?

Share This