দাওয়াহ ও নকদ (সমালোচনা) আলাদা বিষয়। দাওয়াহর ভাষা সাধারণত নরম হয়ে থাকে। দাওয়াহয় হিকমাহ ও সুন্দর উপদেশ থাকে। দাওয়াহর উপস্থাপনা ও শব্দচয়ন হয় হৃদয়গ্রাহী ও চিত্তাকর্ষক। পক্ষান্তরে নকদের ভাষা হয় কঠোর। নকদের ভাষা কতটা কঠোর হয়, তা জানার জন্য ‘জার্‌হ ও তাদিল’ শাস্ত্রে নজর বুলানোই যথেষ্ট, যেখানে হাদিসের বর্ণনাকারীদের অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনাকারীর ব্যাপারে ‘দাজ্জাল’ ‘কাযযাব’ শব্দগুলোর প্রয়োগ তো অহরহই চোখে পড়ে। অনেক সময় তো সন্তান পর্যন্ত বাবাকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতে ছাড়ে না। হ্যাঁ, নকদের ক্ষেত্রে কারও শব্দপ্রয়োগ অন্যদের থেকে তুলনামূলক নম্র হয়। যেমন, ইমাম বুখারি রহ. কারও ব্যাপারে ‘জার্‌হ’ করলেও সাধারণত হালকা শব্দ ব্যবহার করতেন। ‘দাজ্জাল’, ‘কাযযাব’ শব্দগুলো তার মুখে শোনা যায় না। তবে তাই বলে তিনি শক্ত ভাষায় নকদকারীদের বিরুদ্ধেও বলেছেন বলে আমার জানা নেই। এটা তার ব্যক্তিগত অভিরুচি মাত্র।

নকদ কোনো গিবত নয়; বরং তা নাসিহাহ। বর্তমানে ওয়াজাহাতি মজলিসসমূহে সাদ সাহেবের গিবত করা হয় না; বরং নকদ করা হয়। গিবত হারাম আর নকদ অনেক সময় জরুরি হয়ে থাকে। নকদ শুনলেই কেউ বেয়াদব হয়ে যায় না। ইমাম মালিক রহ. তো শিশু-বয়সেই শুবা রহ.-এর মুখ থেকে কঠোর ভাষায় নকদ শুনেছেন। কিন্তু কার হিম্মত আছে তাকে বেয়াদব বলার! হ্যাঁ, কারও যদি বদহজম হয়, তার কথা ভিন্ন। অন্যথায় পৃথিবীতে যত আলিম আছে, সহিহ বুখারির পাতায় পাতায় ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর শানে অসম্মানজনক শব্দপ্রয়োগ দেখে, ইমাম আবু দাউদের মন্তব্য পড়ে বা সহিহ মুসলিমের ভূমিকার দরস নিয়ে তারা সবাই বেয়াদব হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, সকলের জানা আছে, কার থেকে কতটুকু গ্রহণ করতে হবে আর কোন সব বিষয় বর্জন করতে হবে। এতটুকু কমনসেন্স না হলে সে আলিম অভিধা পাওয়ারই তো উপযুক্ত নয়।

এক হলো সমালোচনা, আরেক হলো আত্মসমালোচনা। প্রথমটি ব্যাপক, দ্বিতীয়টি বিশিষ্ট। সমালোচনার তুলনায় আত্মসমালোচনা গ্রহণ করা সহজ। কারণ, বাইরের লোক বললে তা অনেক সময় প্রেস্টিজ ও ইগোর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নিজেদের লোক তো বলতেই পারে—এমন একটা মনোভাব সাধারণত কাজ করে। যার কারণে বাইরের লোকের হালকা ভাষা গ্রহণ করা কঠিন হলেও নিজেদের লোকদের ভারী ভাষা গ্রহণ করা তুলনামূলক সহজ। কারণ, প্রত্যেকেই ভাবে, সমালোচক এখানে ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা দ্বেষ থেকে কাজটা করছে না; করছে ভালোবাসা ও কল্যাণকামিতা থেকেই।

আমাদের অঙ্গনে নকদের ক্ষেত্রে কঠোর ভাষা ব্যবহার করার রীতি বেশ প্রাচীন। তাজাল্লিয়াতে সফদর বইটা তো এখন বঙ্গানুবাদ হয়ে এসেছে। তার পাতায় পাতায় নকদের ভাষা দেখা যেতে পারে। দেশীয় বক্তাদের অধিকাংশই কঠোর ভাষায় নকদ করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ মাওলানা ওলিপুরি, মাওলানা ফরাজি, মাওলানা জুনায়েদ হাবিব, মাওলানা মতিউর রহমান মাদানি, মাওলানা আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদি প্রমুখদের নকদের ভাষা শুনে দেখা যেতে পারে। কুয়াকাটার মাওলানা তো তার সমালোচনাকারীদের সময়ে সময়ে ‘বেইমান’, ‘মুনাফিক’, ‘আহাম্মক’, ‘বেয়াদব, ‘মূর্খ’ ইত্যাদি শব্দপ্রয়োগ করে ধুয়ে দেন। এগুলো যে বদ্ধ কামরায় করেন, তা নয়; বরং জনসমক্ষেই এসব করা হয়। এতদ্‌সত্ত্বেও বড়দের পক্ষ থেকে এগুলোর খোল্লমখোলা প্রতিবাদ কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

কখনো নকদের সঙ্গে দাওয়াহর মিশ্রণ ঘটানো হয়। পরিণামের বিচারে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট। এর সবচে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মাওলানা আবদুল মালেক হাফি.। আহলে হাদিস ভাইদের ক্ষেত্রে তার নকদের মধ্যে দাওয়াহর মিশ্রণও চোখে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, ‘উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা’ বইটি দেখা যেতে পারে। যদিও মানহাজিদের ব্যাপারে তাদের শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে এই মূলনীতির কিছুটা ব্যত্যয় দেখা যায়। অবশ্য সবক্ষেত্রে সব মূলনীতি চর্চিত হতে হবে—এটাও কোনো জরুরি বিষয় নয়।

কুরআন ও হাদিসেও আমরা এই ‘উসলুব’ তথা পদ্ধতির দেখা পাই। দাওয়াহর ক্ষেত্রে নরম ভাষা। যেমন, আল্লাহ তাআলা মুসা আ.-কে ফিরআউনের কাছে দাওয়াহ নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিলেন—‘তোমরা তার সঙ্গে নম্র কথা বলো’। অপরদিকে নকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়—‘নিশ্চয়ই তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তারচেও অধম’, ‘নিশ্চয়ই মুশরিকরা নাপাক’, ‘খারেজিরা জাহান্নামিদের কুকুর’, ‘কাদারিয়্যাহ হলো এই উম্মাহর মাজুসি’ প্রভৃতি। এমনকি সিরাতের ভাণ্ডারে তো সিদ্দিকে আকবরের মতো নরম মেজাজের মানুষকেও নবি সা.-এর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে দেখে উত্তেজিত হয়ে বলতে শোনা যায়—‘লাত দেবীর যোনী চুষে খা’। এই কঠিন প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলায় রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে ‘নাহি আনিল মুনকার’ করেননি; অথচ তার ওপর অসৎ কাজ হলে বারণ করা ফরজ ছিল। কারণ, তার নীরবতাকে শরিয়তে মৌন অনুমোদন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মুনাফিক, মুলহিদ, জিন্দিক, উলামায়ে সু, গোমরাহ দায়ি প্রমুখদের বিরুদ্ধে যে নকদ হবে—তা সাধারণত কঠোর ভাষায়ই হবে। হ্যাঁ, কেউ যদি নকদের সঙ্গে দাওয়াহর মিশ্রণ ঘটায়, তবে তা ভিন্ন কথা কিন্তু সাধারণ পন্থা ওটাই। এখন কেউ যদি এর ওপর আপত্তি তোলে এবং নকদের ভাষা ও দাওয়াহর ভাষা অভিন্ন হওয়াকে ফরজ হিসেবে উপস্থাপন করে, তবে তা ন্যায়ানুগ আচরণ বলে মনে হয় না। আর পৃথিবীতে সবার রুচি ও বিবেচনাবোধ এক হবে না—এটাই স্বাভাবিক। তবে কারও উপস্থাপনা যথাযথ না হলেও স্রেফ এ কারণেই মূল বিষয়কে অস্বীকার করা যায় না।

Share This