যারা রবি ঠাকুরকে কাফির বলে, তারা কখনো কি তার বুক চিড়ে দেখেছে? তার ভেতরে সুপ্ত তাওহিদ ছিল কি না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে তাকে তাকফির করা হচ্ছে? যদি বলা হয়, আমরা বাহ্যিক অবস্থার ভিত্তিতে তাকফির করছি তাহলে প্রশ্ন আসবে, তার ভেতরে তাকফিরের কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি না, তা কি যাচাই করে দেখা হয়েছে? উদাহরণস্বরূপ, তার ভেতর অজ্ঞতা ছিল কি না বা কোনো তাবিল ছিল কি না – তাকফিরকারীরা কি এসব ব্যাপারে পূর্বেই নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে? বলা হবে, এসবের তো প্রয়োজন নেই। কারণ, সে তো নিজেকে কখনো মুসলিম দাবি করেনি, বরং সে প্রকাশ্য অমুসলিম।

আচ্ছা, তার ব্যাপার বাদ দিলাম। ড. কামাল থেকে শুরু করে শাহবাগের যাদেরকে বলির পাঠা বানানো হয়েছে, তারা কি নিজেদেরকে সরাসরি অমুসলিম দাবি করেছে? যদি বলা হয়, অমুসলিম দাবি করেনি তো কী হয়েছে, তাদের মুখে তো কুফরি কথাবার্তা উচ্চারিত হয়েছে।
তখন বলা হবে, একই ধরনের কুফরি কথাবার্তা তো আপনাদের শাসকদের থেকেও প্রকাশ পেয়েছে। সেসব ব্যাপারে কুফরের ফাতওয়া জারি করলেন না যে! এরপর জিজ্ঞেস করা হবে, আচ্ছা, সেই কুফরি কথাবার্তাগুলোর পেছনে অজ্ঞতা বা তাবিল কার্যকর রয়েছে কি না, তা কি আপনি খতিয়ে দেখেছেন? তাদের অন্তরের অবস্থা যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছেন? এ পর্যায়ে এসে কথক রেগে যাবে এবং ‘নাস্তিক’, ‘বেইমান’, ‘দালাল’ ইত্যাদি বলে ট্যাগাট্যাগি শুরু করবে।

কথা হলো, বাঙালি জাতির পিতা কি স্পষ্ট ভাষায় চার সুস্পষ্ট কুফরি মতবাদের প্রতি তার বিশ্বাস স্থাপনের কথা ঘোষণা দেননি? তার তত্ত্বাবধানেই কি কুফরি সংবিধান রচিত হয়নি? তিনি কি তা বাস্তবায়নে তৎপর হননি? তাহলে তার ব্যাপারে ফাতওয়া জারি করা হয় না কেন? মুফতিরা এখানে এসে কেন নীরব বা ডাবল স্টান্ডার্ডবাজিতে আক্রান্ত? অবশ্য শক্তের ভক্ত নরমের যম বলে একটা কথা আছে। রবি ঠাকুর, ড. কামাল বা শাহবাগিরা সরাসরি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নয়, তাই তাদের ব্যাপারে ফাতওয়া চলে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের ব্যাপারে এসে ফাতওয়া নীরব হয়ে যায়। এ মাসআলাটিই মুফতিদের কাছে লিখিত জিজ্ঞেস করা হোক। তারা তো নিজেদেরকে ফাতওয়ার ঠিকাদারের স্থানে আসীন করেছেন। তাদের দায়িত্ব কোনোকিছু গোপন না করে স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেওয়া। কারণ, ইলম গোপন করা হারাম ও কবিরা গোনাহ। কিন্তু দেখা যাক, এর জবাব কারও থেকে পাওয়া যায় কি না? আর গেলেও কী যায়? ডাবল স্ট্যান্ডার্ডবাজি নাকি সৎসাহসের বহিঃপ্রকাশ?

কিছু মানুষ মূলনীতি শেখায়, ইমারাহ প্রতিষ্ঠার আগে সর্বপ্রকার কিতাল হারাম। যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, আচ্ছা বলুন তো, ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে? তখন দুধরনের উত্তর আসবে : (১) গণতান্ত্রিক পন্থায়, (২) দাওয়াহর মাধ্যমে। প্রথমটির অসারতা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, গণতান্ত্রিক পন্থায় হাকিমিয়্যাহ থাকবে জনগণের; আল্লাহর নয়। জমিয়ত, খেলাফত, নেজামে ইসলাম পার্টি বা ইআবা যদি এ পন্থায় ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করে ফেলেও তবুও তা ইসলামসম্মত হবে না। কারণ, তখন তো তাওহিদ প্রতিষ্ঠিত হবে না। বরং হাকিমিয়্যাহর ক্ষেত্রে তাওহিদের পরিবর্তে স্পষ্ট শিরক প্রতিষ্ঠিত থাকবে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র পরিবর্তে লা ইলাহা ইল্লান্নাস’র বাস্তবায়ন থাকবে। খাঁটি গণতান্ত্রিকরা তো হাকিমিয়্যাহকে কুফর (অস্বীকার) করে। আর ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিকরা এ ক্ষেত্রে শিরক করে। আর এ জন্য সবকিছু নিয়ে আলোচনা করলেও তারা স্পষ্টভাবে হাকিমিয়্যাহ ইস্যু নিয়ে খুব বেশি ক্লিয়ারকাট আলোচনা করে না।

দ্বিতীয় দলকে জিজ্ঞাসা করা হবে, আপনারা কাদেরকে দাওয়াহ করবেন? তারা বলবে, ক্ষমতাসীনদেরকে। যদি বলা হয়, গত অর্ধ শতাব্দীতে কি এই দাওয়াহ করেছেন? তারা বলবে, হ্যাঁ, করেছি তো। ব্লাংকেটের নিচে শুয়ে আমরা বিভিন্ন ইসলামি পত্রিকা ও বইপত্রে আকারে-ইঙ্গিতে বলেছি।

জিজ্ঞাসা, আচ্ছা, এগুলো কি তাদের গোচরে পৌঁছেছে? বলবে, ওয়া মা আলাইনা ইল্লাল বালাগুল মুবিন। আমরা আমাদের দায়িত্বের খাতিরে লেখার কাজ লিখে দিয়েছি। এখন কার কাছে পৌঁছল আর কার কাছে পৌঁছল না, কে মানল আর কে মানল না, তা তো আমাদের দেখার বিষয় নয়।

জিজ্ঞাসা, আল্লাহ তো আপনাদের ওপর শুধু ইমারাহর দাওয়াহ করা নয়, বরং ইমারাহ প্রতিষ্ঠা করা ফরজ করেছেন। তো এই ফরজ দায়িত্ব পালন করছেন কি? বলা হবে, আরে অন্ধ কোথাকার, আমরা কি দীনি কাজ করছি না? আমরা আর কয়টা করব? কর্মবণ্টন নীতি অনুসরণ করে আমরা একটা অংশ নিয়ে রয়েছি। বাকিগুলো অন্যরা করবে।

জিজ্ঞাসা, আচ্ছা, তাহলে কিতালিদের নিয়ে আপনাদের এত আপত্তি কেন? তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার শাইখ-মাশায়িখদের খুঁজেন কেন? কর্মবণ্টন নীতি আপনারা মানতে পারলে তারাও কি পারবে না? তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে ভাগ যখন করছেনই, নামাজ রোজা হজ সবই কেন আদায় করছেন? এগুলোকে ভাগ ভাগ করে নিলে কেমন হয়? বলবে, পাগল কোথাকার, এ দুটো এক হলো নাকি? দেখেছ, এরা নামাজ আর ইমারাহকে এক বানিয়ে ফেলেছে। এরা নামাজকে তাচ্ছিল্য করেছে। এরা তো পুরোদস্তুর গোমরাহ।

জিজ্ঞাসা, আচ্ছা, আপনাদের যদি উদ্দেশ্য হয় দাওয়াহ বিল লিসানের মাধ্যমে ইমারাহ প্রতিষ্ঠা তাহলে যারা দাওয়াহ বিস সাইফের মাধ্যমে ইমারাহ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদের ওপর আপত্তি করেন কেন? আরে ধুর, মুসলিম শাসকদের ওপর সাইফ ধারণ করা বৈধ নয়।

আচ্ছা, তবে আপনি মেনে নিচ্ছেন যে, ক্ষমতাসীনরা আপনাদের শাসক? আপনারা কি তাদেরকে বাইয়াত দিয়েছেন? বাইয়াত না দিলে শাসক হলো কীভাবে?

দুধরনের উত্তর : (১) না মেনে উপায় কী? আমরা এ দেশে জন্মগ্রহণ করার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এ দেশের সবকিছুকে মেনে নিয়েছি। কোনো দেশের নাগরিক হলে সেই দেশের সঙ্গে অলিখিত একটা চুক্তি হয়ে যায়। মৌন অনুমোদনের মাধ্যমে এ কাজগুলো সম্পাদিত হয়। 
(২) ভোটই এক ধরনের বাইয়াত/শাহাদাহ। কাউকে ভোট দিলে তার প্রতি বাইয়াত/শাহাদাহ দেওয়া হয়ে যায়।

১-এর ওপর আপত্তি, আচ্ছা, কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করাটা তো নিতান্ত কাকতালীয় ব্যাপার। এতে কারও ইচ্ছার কোনো দখল থাকে না। এরপরও এখানে যদি মৌন অনুমোদনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের শাসনব্যবস্থা প্রত্যেকের ওপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তাহলে যারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে স্বেচ্ছায় তাবলিগের মেহনত করে, তাদের ওপরও কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাওলানা সাদের ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে না? আপনি কুফরের ধ্বজাধারীকে মেনে নিতে পারেন, গোমরাহির ধ্বজাধারীকে মেনে নিতে পারেন না? অথচ গোমরাহি কুফরের চাইতে হালকা। তবে কি এখানেও শক্তের ভক্ত নরমের যম নীতি কার্যকর রয়েছে?

২-এর ওপর আপত্তি, ভোট যদি বাইয়াত হয় তাহলে সেটা কিসের ওপর বাইয়াত? যদি শাহাদাহ হয় তাহলে কিসের ব্যাপারে শাহাদাহ? হাকিমিয়্যাহর ব্যাপারে শিরকের? নাকি…?

তুই একটা সাদপন্থী, আকাবিরবিদ্বেষী, গোমরাহ, অতি জযবাতি, মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন ইত্যাদি ইত্যাদি…।
হুম, এতক্ষণ এরই অপেক্ষায় ছিলাম। ট্যাগাট্যাগি তারাই করে, যারা নৈতিকভাবে পরাজিত থাকে।

Share This