আল্লাহর তাআলার অস্তিত্বের স্বীকৃতির বিষয়টা মানুষের ফিতরাত এবং প্রকৃতির মাঝেই প্রোথিত করে দেয়া হয়েছে। কোনো মানুষ সত্যানুসন্ধিৎসা নিয়ে এই পৃথিবী এবং তার নিখুঁত পরিচালনা নিয়ে ভাবলে সে এসবের একজন পরিচালকের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। এজন্যই তো আরবের বেদুইন পর্যন্ত আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ প্রসঙ্গে বলে উঠেছে-
البعرة تدل على البعير .. والأثر يدل على المسير .. فسماء ذات أبراج .. وأرض ذات فجاج .. ألا تدل على العليم الخبير ..

কাইস ইবনে সাঈদা রা.ও জাহেলি যুগে উট নিয়ে বাজারে গিয়ে ঘোষণা করতেন-
“أيها الناس .. اسمعوا وعوا .. من عاش مات .. ومن مات فات .. وكل ما هو آت آت .. ليل داج .. ونهار ساج .. وأرض ذات فجاج .. وسماء ذات أبراج .. ونجوم تزهر .. وبحار تزخر .. أفلا يدل ذلك على الله الواحد القهار؟!.”.

এজন্যই তো কবি বলেন-
وفي كل شيء له آية *تدل على أنه واحد

আল্লাহ তাআলার কুদরত হলো, তার অস্তিত্বের বিষয়টা একেবারে সুস্পষ্ট এবং মানুষের প্রকৃতির মাঝে প্রোথিত থাকলেও তার বিস্তারিত স্বরূপ, যা তিনি নিজে বর্ণনা করেননি, তা নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হলে মানুষ ভাবতে ভাবতে উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেলেও কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না। আকলের সাহায্যে আল্লাহর স্বরূপ উদঘাটিত করতে চাইলে হতাশা এবং নিরাশা ছাড়ে শেষাবধি আর কিছু জোটে না।

এজন্য আল্লাহ সম্পর্কে নসে (আয়াতে এবং হাদিসে) যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, এর বাইরে কিছু জানতে চাওয়াটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। যতোটুকু জানা প্রয়োজন, তা আল্লাহই জানিয়ে দিয়েছেন। আর যা তিনি জানাননি, তা জানা জরুরি নয় এবং আমাদের জন্য তাতে কোনো কল্যাণ নিহিত নেই বলেই জানাননি। সুতরাই সেই অজানা বিষয়গুলো জানার জন্য প্রয়াস গ্রহণ করা অযথা সময়ক্ষেপণ ছাড়া কিছু নয়।

বরং এ ধরনের বিষয়ে আকলের ঘোড়া দৌড়ানো মানুষকে হেদায়াতের পথ থেকে সরিয়ে দেয়, তার গোমরাহির কারণ হয়। সুরা আলে ইমরানের ৬-৭ আয়াতে গভীরভাবে লক্ষ করলে বিষয়টা সুস্পষ্টভাবে অনুমিত হওয়ার কথা।

যারা শুধু আকলের সাহায্যে আল্লাহর স্বরূপ নিয়ে বিস্তারিতভাবে জানার প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে, তারাই বিভ্রান্ত হয়েছে, ইতিহাস আজ তাদেরকে মুআত্তিলা, মুশাববিহা, মুজাসসিমা ইত্যাদি নামে চিনে।

আচ্ছা, তাহলে যেসব আয়াতে আল্লাহর জন্য ‘সিফাতে ইয়াদ’, ‘সিফাতে আইন’, ‘সিফাতে ওয়াজহ’, ‘সিফাতে ইসতিওয়া’ সাব্যস্ত করা হয়েছে (উল্লেখ্য, এভাবে বলা যে- ”যেসব আয়াতে আল্লাহর জন্য হাত, চোখ, চেহারা, উপবিষ্ট হওয়া ইত্যাদি সাব্যস্ত করা হয়েছে” বেআদবি এবং অজ্ঞতা। আকিদা নিয়ে বাংলায় যারা লিখেছেন প্রায় সবাই-ই এই ভুলটা করেছেন। আল্লাহর ক্ষেত্রে ইয়াদ শব্দের অর্থ যে হাত এ কথা আপনাকে কে বললো? প্রথমে হাত বলছেন, পরে আবার বলছেন সেই হাত অবশ্য আমাদের মতো নয় ইত্যাদি ব্যাখ্যায় যাওয়ারই বা কী দরকার? আল্লাহ তার জন্য সিফাতে ইয়াদ সাব্যস্ত করেছেন। এবার সেই সিফাতে ইয়াদ আসলে কী- এর ইলম বান্দাকে দেয়া হয়নি। তা আল্লাহই জানেন। ওয়া মা উ’তিতুম মিনাল ইলমি ইল্লা কালিলা।) সেসব আয়াতের কী ব্যাখ্যা?

হাঁ, এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ অসংখ্য দার্শনিক আপত্তি-অভিযোগের স্বীকার হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে আল্লাহ তাআলার সিফাতকেই অস্বীকার করে বসেছে। পরিভাষায় এদেরকেই ”মুআত্তিলা” বলা হয়; আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর দৃষ্টিতে যারা ভ্রান্ত ফেরকা।

কেউ আবার এসব আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলার জন্য বান্দাদের মতো হাত, চোখ, চেহারা ইত্যাদি সাব্যস্ত করেছে। তারাও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর দৃষ্টিতে পথভ্রষ্ট ফেরকা। পরিভাষায় তারাই মুশাববিহা বা মুজাসসিমা।

তাহলে এসব আয়াতের ব্যাখ্যা কী?

 

আল্লাহর সিফাতের মাসআলায় আলিমগণের অবস্থান

 

আমরা ওপরে আলোচনা করে এসেছি যে, ‘মুশাববিহা’ (মুজাসসিমা) এবং ‘মু’আত্তিলা’ উভয় গোষ্ঠীই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর দৃষ্টিতে গোমরাহ। সেখানে আমরা তাদের পরিচয়ও উল্লেখ করেছি। এক্ষেত্রে হকপন্থী আলিমগণের অবস্থান কী তা-ই আজকের লেখার আলোচ্য বিষয়। নিচের আলোচনা পুরোটা আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি দা. বা. র আলোচনা থেকে গৃহীত। [দেখুন— মাকালাতুল উসমানিঃ ১ম খণ্ড]

পবিত্র কোরআনে যে-সব আয়াতে আল্লাহ তা’আলার জন্য সিফাতে ইয়াদ (শাব্দিক অর্থ— হাত), সিফাতে আইন (শাব্দিক অর্থ— চোখ), সিফাতে ওয়াজহ (শাব্দিক অর্থ— চেহারা) ইত্যাদি সাব্যস্ত করা হয়েছে, (আরো সহজে বলতে চাইলে— “আল্লাহ কোথায়” জাতীয় প্রশ্নে) —এর ব্যাখ্যায় আলিমগণ চারটি পন্থা অবলম্বন করেছেন—

১. অধিকাংশ সালাফের দৃষ্টিভঙ্গি— এ ধরনের নসগুলো মুতাশাবিহের অন্তর্ভুক্ত, যার প্রকৃত অর্থ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সুতরাং এসব নসের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা ও কোনো নির্দিষ্ট অর্থ গ্রহণ না করাটাই উচিত। এর ব্যাখ্যার সন্ধানে ডুব দেয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই। আমরা এর ওপর ইজমালি ইমান (ইমানে মুজমাল) রাখবো, অর্থাৎ আল্লাহ যা বলেছেন তা সত্য এবং এর অর্থ তিনিই জানেন। আমরা বিশ্বাস করবো, আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যবান হওয়া থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। আমরা এ নসগুলোর এমন অর্থ নেবো না, যা সৃষ্টির সাথে আল্লাহ তা’আলার সাদৃশ্য দাবি করে। বরং আমরা এর সুনির্দিষ্ট কোনো অর্থ করবো না। এর অর্থ আল্লাহ তা’আলার ইলমে ন্যস্ত করবো। সুরা আলে ইমরানের আয়াত- ৭ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে¬—

“তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমার ওপর এমন কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যার অনেক আয়াত ‘মুহকাম’, তা-ই কিতাবের মূল অংশ আর কিছু আয়াত ‘মুতাশাবিহ’। যাদের অন্তরে সত্য লঙ্ঘন প্রবণতা-বক্রতা রয়েছে, তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার মানসে কিতাবের ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতগুলোর পেছনে পড়ে। অথচ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ এসবের ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী, তারা বলে— ‘আনরা এর প্রতি ইমান রাখি। সব আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত’। বোধশক্তির অধিকারীরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।”

২. সালাফদের কারো কারো দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো— আমরা বিশ্বাস করব এ সব নসের দ্বারা আল্লাহ তা’আলা তার প্রকৃত অর্থই উদ্দেশ্য নিয়েছেন। তবে সৃষ্টির দিকে নিসবত হলে এ শব্দগুলোর যে অর্থ হয়, আল্লাহ তা’আলার দিকে নিসবত হলে এ শব্দগুলোর অর্থ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। “কোনো কিছুই আল্লাহর সদৃশ নয়’’। [সুরা শুরা— ১১] হাঁ, আল্লাহ তা’আলারও হাত, চোখ ইত্যাদি রয়েছে, তবে আল্লাহর এই গুণগুলোর সাথে সৃষ্টির হাত, চোখের কোনোই মিল নেই। এগুলোর আকৃতি কেমন— তা জানার কোনোই পথ নেই। একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই তা জানেন।

প্রথম ফরিকের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, কোনো ধরনের শাব্দিক অর্থ গ্রহণ না করে প্রথমেই এই নসগুলোর অর্থ আল্লাহর তা’আলার ইলমে ন্যস্ত করা। আর দ্বিতীয় ফরিক প্রথমে শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ গ্রহণ করেছেন। এরপর তার রূপ ও আকৃতির জ্ঞান আল্লাহ তা’আলার ইলমে ন্যস্ত করেছেন। তবে উভয় ফরিকই মনে করেন, সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার এসব গুণাবলির কোনো প্রকার সাদৃশ্য নেই। এসব নসের ব্যাখ্যায় প্রচলিত কোনো অর্থ গ্রহণের অবকাশ নেই।

৩. সালাফের মুষ্টিমেয় এবং খালাফের অনেক আলিম এসব নসের ব্যাখ্যা করেন। তারা এগুলোকে রূপক অর্থে গ্রহণ করেন। তবে তারাও সৃষতির সাথে স্রষ্টার গুণের কোনো সাদৃশ্য গণ্য করেন না। তারা (ইয়াদ) ‘হাত’ দ্বারা শব্দের রূপক অর্থ— শক্তি উদ্দেশ্য নেন। (ইস্তেওয়া) ‘উপবেশন’কে অধিকারী হওয়া, সক্ষমতা লাভ করা ইত্যাদি অর্থে গ্রহণ করেন।

৪. কিছু সংখ্যক আলিম উপরিউক্ত উভয় পন্থার মাঝে সমন্বয় করেন— অর্থাৎ, আরবি ভাষার রীতি ও বাকধারা অনুযায়ী যদি সহজেই তা ব্যাখ্যা করা যায়, তবে তারা ব্যাখ্যা করেন। আর যদি স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করা না যায়, তবে তারা নসের অর্থ আল্লাহ তা’আলার ইলমেই ন্যস্ত করেন।

বাস্তব কথা হল, আল্লাহ তা’আলাকে সৃষ্টির সাথে সবধরনের সাদৃশ্য থেকে পবিত্র ঘোষণা করে উপরিউক্ত চার পন্থা যে-কোনোটাই গ্রহণ করা হলে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে চলনসই। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে কোনোটাকেই পাইকারিভাবে ভুল ও ভ্রান্ত বলার অবকাশ নেই। পন্থা বিভিন্ন হলেও আদতে আকিদায় ভিন্নতা নেই। কেননা আকিদা হলো— আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। একই আকিদা প্রকাশের ভাষা কেবল ভিন্ন ভিন্ন। যদিও সবচে নিরাপদ প্রথম মাযহাব, যা অধিকাংশ আকাবির-আসলাফের মানহাজ। অন্যান্যগুলোকেও ভুল বা ভ্রান্ত বলার সুযোগ নেই।

তবে তিক্ত বাস্তবতা হলো, এই মাসআলার ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থান চরম সীমালঙহন করেছে। এমনকি এই চার মাযহাবের অনুসারীরা পরস্পর পরস্পরকে গালমন্দ করেছে, গোমরাহ বলে অভিহিত করেছে, ‘মুশাববিহা’ ‘মুআততিলা’ আখ্যা দিয়েছে। নিজেরাও এতো পরিমাণ বাড়াবাড়ি করেছে ও তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে যে, নিজেদের মাযহাবের সীমারেখা অতিক্রম করে বাতিল ফিরকার ত্রি-সীমানায় পৌঁছে গেছে।

যেমন আমরা একটু আগে দেখিয়ে এসেছি, প্রথম এবং দ্বিতীয় মাযহাবের মাঝে মৌলিকভাবে তেমন পার্থক্য নেই। প্রাথমিক যুগগুলোতে এমনভাবেই চলেছে। অথচ পরবর্তীতে বিবাদ-বিতর্ক বেড়ে এর অনুসারীদের মুখ থেকে এমন এমন কথা-মন্তব্য বেরিয়েছে, যা শুনলে শরীর শিউরে ওঠে। দ্বিতীয় মাযহাবকে তাশবিহ-তাজসিম বলে অভিহিত করা হয়েছে আর প্রথম মাযহাবের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তা হচ্ছে তা’তিল। যা ছিলো অধিকাংশ সালাফের মাযহাব তাকেই দ্বিতীয় মাযহাব (তাবিল) এর থেকেও নিকৃষ্টতর বলে অভিহিত করা হয়েছে।

উপরিউক্ত চারওটা মাযহাব আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহরই মাযহাব; যার ওপর সাহাবা-তাবেয়িন চলে গেছেন। সুতরাং সবগুলোই হক। কোনোটাকে ভুল বলার অবকাশ নেই। আমার কাছে যেটাকে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে হয়, আমি সেটাকে গ্রহণ করবো। কিন্তু বিপরীত মাযহাবগুলোর ব্যাপারেও যথাযোগ্য শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখবো। আজকাল তো দেখা যায়, দীনের মৌলিক জ্ঞানই নেই, দু-চার কট্টর লেখকের কিতাব পড়েই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর অন্যান্য সব মাযহাবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে, সভ্যতা বর্জন করে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করে বসে। আর সাধারণ মানুষদের ব্যাপারে আর কী বলবো, উম্মাহর বিদগ্ধ আলিমগণের কেউও কখনো কখনো সীমালঙ্ঘন করে এমন কথা বলে বসেন, যা হাজারো বরং লাখো মানুষের গোমরাহির কারণ হয়ে যায়।

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনু তাইমিয়া রহ. তার লেখায় বলছেন— “তাফবিয (ওপরে বর্ণিত প্রথম মাযহাব, যা অধিকাংশ সাহাবা-তাবেয়িনের মাযহাব) বেদআতি মুলহিদদের বক্তব্যের থেকেও নিকৃষ্টতর”। [দারউ তাআরুজিল আকলি ওয়ান নাকলিঃ ১/২০৫]

শুধু এই এক জায়গায়ই নয়, আরো অনেক জায়গায়ই তার এমন বক্তব্য-মন্তব্য পাওয়া যাবে। আল্লাহ শায়খ রহ. কে জান্নাতের উঁচু মর্যাদায় আসীন করুন। তার এবং তার অনুসারী আরো অনেক আলিমদের এমন কিছু কিছু বক্তব্য-অভিমত হাজারো মানুষের বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে এবং হচ্ছে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে হেদায়াত দান করুন। সিরাতে মুসতাকিমের ওপর অবিচল রাখুন। প্রান্তিকতা থেকে বেঁচে ভারসাম্যের সাথে যিন্দেগি গুজরান করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Share This