ফেরেশতা এবং প্রাণীর মাঝামাঝি এক সৃষ্টি হলো মানবজাতি। মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতিতে বড় নিপুণভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মাবলাম্বী এই দুই সৃষ্টির গুনাগুণ ও বৈশিষ্ট্যের মিশেল ঘটেছে। তাই মানবীয় প্রকৃতিতে ফেরেশতার গুনাগুণ যেমনভাবে পরিস্ফুট, তেমনি তার মাঝে প্রাণীর বৈশিষ্ট্যও সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত। কেননা মানবজাতিকে যে মহান লক্ষ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সম্পাদনের জন্য ফেরেশতাকুল যোগ্য-উপযুক্ত ছিলো না আর প্রাণীকুলকেও সেই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়নি। মানবজাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে মহান আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য, দীন এবং কোরআনের আমানত বহন করার জন্য আর স্রষ্টার ইবাদত-আনুগত্যের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করার জন্য। {দ্রষ্টব্য— সুরা বাকারাঃ ৩০; সুরা আহযাবঃ ৭২; সুরা যারিয়াতঃ ৫৬-৫৭}

মানুষ আত্মা এবং দেহের সমন্বয়ে গঠিত। আত্মা তাকে মূলের দিকে আকর্ষণ করে, সৃষ্টির লক্ষ্য তার স্মরণে আনে এবং তাকে নশ্বর পৃথিবীর মোহ থেকে দূরে থেকে অবিনশ্বর জীবন গঠনের প্রতি মনোনিবেশ করতে দৃপ্তকণ্ঠে আহ্বান করে। যখন এই আত্মিক শক্তি প্রবল হয়, তখন মানুষ পার্থিব জীবনের মায়াজাল ছেড়ে চিরস্থায়ী জীবনের প্রস্তুতিমূলক কাজকর্মে তৃপ্তিবোধ করে, বান্দা তখন তার রবের ইবাদতে খুঁজে পায় চিত্তের প্রশান্তি। এমনকি এই শক্তি যখন একেবারে পূর্ণতায় পৌঁছে, তখন মানুষ আর পানাহারেরও প্রয়োজনবোধ করে না। এজন্যই তো লাগাতার বহুদিন পর্যন্ত রাসুল সা. না খেয়েও দিনাতিপাত করেছেন। সাহাবিদের জিজ্ঞাসার জবাবে বলেছেন, আমি রাতযাপন করি এমতাবস্থায় যে, আমার প্রভু আমাকে পানাহার করান। {বুখারি, মুসলিম}

আর মৃত্তিকা থেকে সৃষ্ট দেহ মানুষকে পৃথিবীর দিকে আকর্ষণ করে, তার মন-মননকে দৃশ্য দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে। যখন মানুষের আত্মিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সে প্রাণীর মতো দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে। ভুলে যায় সে নিজ স্রষ্টাকে। প্রভুর নির্দেশনা অমান্য করে করে নিজেকে ক্রমাগত ধাবিত করে জাহান্নামের দিকে। {দ্রষ্টব্য— সুরা মুহাম্মাদঃ ১২; সুরা আরাফঃ ১৭৫-১৭৬}

আল্লাহ তাআলা রোজার বিধান দিয়েছেন, যাতে মানবীয় প্রকৃতিতে ফেরেশতার বৈশিষ্ট্য ও আত্মার শক্তি প্রবল হয়। তাই মানুষও রোজা অবস্থায় ফেরেশতাদের মতো পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকে। এর মাধ্যমে তার ভেতরের শক্তি সুদৃঢ় হয়, প্রবৃত্তি পরাজিত হয়, বান্দা তার রবের নৈকট্য অর্জন করতে সমর্থ হয়। এজন্য অন্যান্য সকল আসমানি ধর্মেও রোজার বিধান ছিলো।
পবিত্র কোরআনে যে আয়াতে রোজার বিধান দেয়া হয়েছে, সেখানে এর তিনটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে।

১. যেনো তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো, নফস ও শয়তানের ধোঁকা থেকে প্রতিরক্ষার শক্তি অর্জন করতে পারো।
২. আল্লাহ তোমাদেরকে যে হেদায়াত দিয়েছেন, এর ওপর যেনো তাঁর বড়ত্ব ও পবিত্রতা ঘোষণা করো।
৩. যেনো তোমরা শোকরগুযার বান্দা হও।

রোজার এই তিন লক্ষ্য যখন অর্জিত হয়, তখনই তা পূর্ণাঙ্গ রোজা বলে সাব্যস্ত হয়। অন্যথায় তা শুধুই উপবাস ও অহেতুক কষ্ট বরণ করা ছাড়া কিছুই নয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, অনেক রোজাদার এমন, ক্ষুধা ছাড়া যাদের রোজার আর কোনো প্রাপ্তি নেই। {সুনানে ইবনে মাজাহ} শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। রোজা তো অনর্থক ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকার নাম। {মুস্তাদরাকে হাকিম; বায়হাকি} যে ব্যক্তি গুনাহের কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে পারে না, আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই এমন ব্যক্তির (অহেতুক) পানাহার থেকে বিরত থাকার। {বুখারি}

আজ থেকে ১৪১৪ বছর আগে রমজান মাসে হেরা গুহায় যে সুদীর্ঘ ইবাদত ও উপবাস যাপনের পর রাসুলুল্লাহ সা. এর ওপর আসমানি ওহি ও পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়, তারই স্মরণে মুসলমানদের সওম সাধনার জন্য রমজান মাস নির্ধারিত হয়। রমজান মাস মহান ও বরকতময় মাস। রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। তারাবিহ কিয়ামুল লাইল ও ইতিকাফের মাস। যে মাসে অবতীর্ণ হয়েছে আলকোরআন। যে মাসে রয়েছে পুণ্যময় রজনী লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই মহান মাসের বরকত লাভের তাওফিক দান করুন। রোজার সকল গুনাগুণ ও ফযিলত অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Share This