দর্শন কী?

অনেকেই ভাবেন, দর্শন হলো এমন কঠিন কোনো বিষয়, যার বোধ-উপলব্ধি বিশেষ কিছু আকল ছাড়া সাধারণ কারো মাথায় ধরে না। এর জন্য বড় বড় আকলের প্রয়োজন; তদুপরি এই দর্শনের আবার কোনো ফলাফল নেই। পুরোটাই অযথা ও গর্হিত। বিশেষত আলিমদের তো উচিত, এর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলা। অনেকে মন্তব্যও করেন, দার্শনিকরা তাদের মেধাকে অন্য কোনো কাজে ব্যয় করলে তা হয়তো কোনো ভালো ফলাফল বয়ে আনতো।

দর্শন (philosophy) জ্ঞানের অন্যতম প্রাচীন একটি শাখা। ফিলোসফি শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন গ্রিক চিন্তাবিদ ও গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দের দিকে শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। পিথাগোরাস নিজেকে প্রাজ্ঞ ভাবতেন না, বরং প্রজ্ঞার অনুরাগী ভাবতেন। তিনিই ফিলোসফি শব্দটি ব্যবহার করেন love of wisdom তথা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ অর্থে। দর্শনের সংজ্ঞা হিসেবে এই বিষয়টিকেই গ্রহণ করা যায়। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে দর্শন জ্ঞানের এমন একটি ধারা, যা মানুষের কীভাবে জীবন নির্বাহ করা উচিত (Ethics-নীতিবিদ্যা); কোন ধরনের বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাদের প্রকৃতি কী (Metaphysics-অধিবিদ্যা); প্রকৃত জ্ঞান বলতে কোন জিনিসটিকে বোঝায় এবং কারণ প্রদর্শনের সঠিক নীতিগুলো কি কী (Logic-যুক্তিবিদ্যা); এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে।

এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, দর্শনের সাথে মূল সম্পর্ক হচ্ছে প্রজ্ঞার, আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসার। জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা এক জিনিস নয়। ঘটনা ও তথ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ও নির্ভুল ধারণা থেকে জ্ঞান লাভ করা যায়, কিন্তু দার্শনিক কেবল তথ্যগত জ্ঞানের উপর নির্ভর করেন না।

(যিনি দর্শন চর্চা করেন তাকেই দার্শনিক বলা হয়, যদিও শাব্দিক অর্থের বিচারে যে-কেউ তার আকলকে কোনো বস্তুর স্বরূপ, মৌলিকতা ও অপরাপর বস্তুর সাথে তার সম্পর্কে কী তা উদঘাটন করার কাজে লাগায়, তাকেই দার্শনিক বলা যায়। শাব্দিক অর্থের বিচারে মধ্যম আকলের অধিকারী প্রায় সব মানুষই দার্শনিক বলে পরিগণিত হবে। শাব্দিক অর্থকে অবলম্বন করে এই নির্বুদ্ধিতায় অবশ্য কেউ আক্রান্ত হবে না, যদিও শরিয়তের পরিভাষা “জিহাদে”র ক্ষেত্রে এই কাজটা করতে সে কী প্রতিযোগিতারে বাবা! আলিম আর জালিম কেউই এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। কঠিন পারফোম্যান্স! কার থেকে কে এগোতে পারে- চলছে এর প্রতিযোগ। এগিয়ে যাওয়ার ধারা হোয়াইট হাউজ-জাতিসংঘ ভেদ করেও এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক নজরুলের ওই পঙ্কতির মতো- “দ্যুলোক ভুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন আরশ ছেদিয়া”। সে ছেদ করতে চেয়েছে খোদার আসন, আর এরা ভেদ করে ডেমোক্র্যাসি এবং ক্যাপিটালিজমের গডদের বাসভবন।)

দর্শনের প্রধান কাম্য বিষয় প্রজ্ঞা। তিনি ছবির ভেতরের ছবির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। প্রজ্ঞার অনুসন্ধান ও চর্চার মাধ্যমেই দর্শন বিকাশ লাভ করে। পিথাগোরাস সারা জীবন প্রজ্ঞার সাধনা করেছেন, কখনও জ্ঞানের গরিমা অনুভব করেননি। এজন্য তিনি দার্শনিক হিসেবে বিদগ্ধ। দর্শনের জন্য যে প্রজ্ঞা কাম্য তার মধ্যে রয়েছে- অন্তর্দৃষ্টি, দৃষ্টিভঙ্গির অভ্রান্ততা, বিচারের ভারসাম্য ও বিশ্লেষণের সামঞ্জস্য।

এরিস্টটলের বক্তব্য অনুযায়ী কৌতূহল ও অস্থিরতা থেকেই দর্শনের উৎপত্তি। প্রাগৈতিহাসিক যুগে তিনটি প্রশ্ন মানুষকে তাড়া করে ফিরেছে- কেনো? কোত্থেকে? এবং কোথায়? এর উত্তর সন্ধানেই খুলেছে দর্শনের দুয়ার। ধীরে ধীরে কৌতূহলও বেড়েছে আর একে একে উন্মোচিত হয়েছে জ্ঞানের অসংখ্য পথ।

 

দর্শনের মৌলিক বিষয়

পৃথিবীর যেকোনো মতাদর্শ পাঁচটি জিনিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। এ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে দর্শনের ভিন্নতার কারণে মতাদর্শও বিভিন্ন হয়। ফিলোসোফি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই মৌলিক পাঁচটি বিষয় নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করতে হয়। এই পাঁচটি মৌলিক বিষয় না বুঝলে কোনো মতাদর্শের আগপাছ বোঝা সম্ভবপর হয় না।

বিষয় পাঁচটি হলো-

  • Metaphysics (মেটাফিজিক্স- অধিবিদ্যা, সত্তার প্রকৃতি ও জ্ঞান সংক্রান্ত দর্শন), ইলমি পরিভাষায় যাকে আমরা “মা বা’দাত তবিয়াত/তবইয়্যাত” নামে চিনি।
  • Epistemology (এপিস্টেমোলোজি- জ্ঞানতত্ত্ব, প্রকৃতি ও পরিধি সংশ্লিষ্ট দর্শনেরশাখা), ইলমি পরিভাষায় যাকে আমরা “ইলমিয়্যাত” নামে চিনি।
  • Ethics (এথিকস- নীতিবিদ্যা, নৈতিক নীতিমালার পদ্ধতি, জীবন-বিধান), ইলমি পরিভাষায় যাকে আমরা “আখলাকিয়্যাত” নামে চিনি।
  • Axiology (একজিওলোজি- the study of the nature of value and valuation, and of the kinds of things that are valuable.) ইলমি পরিভাষায় যাকে আমরা “আকদারিয়্যাত” বা “ইলমুল আকদার” নামে চিনি।
  • Aesthetics (এসথেটিক- নন্দনতত্ত্ব, কান্তবিদ্যা, সৌন্দর্যতত্ত্ব), ইলমি পরিভাষায় যাকে আমরা “জামালিয়্যাত” নামে চিনি।

এই হলো দর্শনের সেই পাঁচটি মৌলিক বিষয়, যার ভিন্নতার কারণে মতাদর্শও বিভিন্ন হয়। দর্শনের ভিন্নতার কারণে কর্মেও ভিন্নতা পরিদৃষ্ট হয়। এই বিষয়গুলোতেদর্শনের ভিন্নতা থাকলে কাজে-কর্মে বাহ্যত মিল দেখা গেলেও আদতে থাকে প্রচুর ভিন্নতা। যেমন একজন মুসলমান জিহাদ করলে তার মেটাফিজিক্সে থাকে স্রষ্টার স্বীকৃতি, থাকে পরকাল-কেয়ামতের বিশ্বাস, থাকে স্রষ্টার নির্দেশিত বিধানাবলী পালনের চেতনা ইত্যাদি। কিন্তু একই ধরনের কাজ যদি কোনো অমুসলিম করে তবে তার মেটাফিজিক্সে থাকবে ভিন্ন কিছু; যদিও বাহ্যত উভয়টির মাঝে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।

 

মেটাফিজিক্স কী? (মা বাদাত তবিয়াত)

এমন সব বস্তু নিয়ে আলোচনা করা, যার অস্তিত্ব পঞ্চ ইন্দিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না। যেমন- রুহ কী? সৃষ্টির স্থায়িত্ব কী? স্রষ্টা কে? আখিরাত কী? হাকিকতে আ’লা কে? হাকিকতের পারস্পরিক তারতিব কী? হাকিকতের মাকছাদ কী? ইত্যাদি। এসব বিষয়ের আলোচনাকেই মেটাফিজিক্স বা মা বা’দাত তবিয়াতের আলোচনা বলা হয়। ফালসাফার এ এক মৌলিক পরিভাষা (Term)।

((আরেক ভাষায়- الميتافيزيقيا او ما بعد الطبيعة شُعبة من الفلسفة تبحث في ماهيّة الأشياء وعلّة العلل أي القوة المحرِّكة لهذا العالم. فقد تبدَّى للإنسان منذ القِدم أن الكون بمخلوقاته المتعددة وعناصره المادية لم يُوجد بذاته، وأن وراءه قوة مطلقة هي التي أوجدته وهي التي تسيِّره. ومع الأيام أخذ الإنسان يفكِّر في هذه القوة العُلوية تفكيراً فلسفياً، وعن هذا التفكير الفلسفي نشأت الميتافيزيقيا.))

মেটাফিজিক্সের মৌলিক শাখা তিনটি-

  • Cosmology (তারতিবে হাকিকত, বিশ্বতত্ত্ব)
  • Ontology (হাকিকত ফি নাফসিহি, অস্তিত্বের স্বরূপ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব)
  • Teleology (মাকছাদে হাকিকত)

 

কসমোলজির আলোচনা

প্রতিটা মানুষই হাকিকতের (স্বরূপ, বাস্তবতা) কোনো না কোনো তারতিব দেয়। এমন হয় না যে, সে সব হাকিকতকে একই শ্রেণীভুক্ত গণ্য করে। অবচেতনে হলেও তার মস্তিষ্কে হাকিকতের এক ধরনের তারতিব বদ্ধমূল থাকে। যেমন মুসলমানের কাছে হাকিকতের তারতিব এমন- প্রথমে আল্লাহ তাআলার সত্তা, এরপর নবিজি সা., এরপর অন্যান্য নবিগণ- এভাবে। কাল মার্কসের দৃষ্টিতে যেমন সব হাকিকতই হলো পদার্থ-মাদ্দাহ। হাকিকতে আ’লাও মাদ্দাহ, হাকিকতে আদনাও মাদ্দাহ। তবে পার্থক্য এই যে, যে মাদ্দাহ ক্রিয়াশীল (যেমন এক মানুষ থেকে সৃষ্টি হয় আরেক মানুষের) তার মর্যাদা বেশি। তো এই হাকিকতের তারতিবকেই পরিভাষায় Cosmology বলা হয়।

কোনো বিধর্মী কমিউনিস্ট যখন ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন সে মুলত তার মস্তিষ্কে প্রোথিত তারতিবকে পরিবর্তন করে নতুন তারতিব দিতে অস্বীকৃতি জানায়। হাকিকতে আ’লা হলেন আল্লাহ। এবার তার স্থলে অন্য কাউকে হাকিকতে আ’লা আখ্যা দেয়াটাই শিরক, যার গুনাহ তওবা ছাড়া আল্লাহ কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।

হাকিকতের তারতিবে ভিন্নতার কারণে মানুষের চিন্তা-চেতনা দর্শন-নীতি সব বিভিন্ন হয়। যেমন মুসলমানদের কাছে হাকিকতে আ’লা হলেন আল্লাহ, তাই তারা তাদের সব কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই প্রাধান্য দিবে। কিন্তু পাশ্চাত্যপন্থীদের কাছে হাকিকতে আ”লা হলো ইনসানিয়্যাত তথা মনুষ্যত্ব। এজন্য তারা স্রষ্টার নির্দেশনা থেকে বিমুখ হয়ে মানুষের জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আলোকেই গ্রহণ করবে সব সিদ্ধান্ত। ইসলামি ভাবধারা এবং অনৈসলামিক চিন্তা-চেতনার মাঝে মৌলিক পার্থক্য সৃষ্টি করে এই কসমোলোজি।

কোনো জিনিসকে কসমোলোজিক্যাল অর্ডার দেয়ার জন্য জরুরি হলো, প্রথমে আপনাকে এ কথার সাক্ষ্য দিতে হবে যে, আপনি সুনিশ্চিতভাবে জানেন, আপনি যে বিষয়গুলোর মাঝে তারতিব দিচ্ছেন সেগুলোর হাকিকত কী। একটা উদাহরণের মাধ্যমে আমরা বিষয়টা স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি।

আপনি আগুন, পানি, মাটি এবং বাতাস এই চারটি জিনিসের মাঝে তারতিব দিতে চান। অর্থাৎ একটাকে আরেকটার তুলনায় শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করতে চান। এখন আপনাকে প্রথমে এই চারওটি বস্তুর হাকিকত সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে জানতে হবে। আর তা জানার পরেই আপনি এগুলোর মাঝে কোনো তারতিব দিতে পারবেন। বস্তুর হাকিকত সম্পর্কে জানাকে Ontology বলে। কোনো বস্তুর হাকিকত কী তা সুনিশ্চিতভাবে কোনো মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে হাঁ, এটা সম্ভব যে, এক Order অপর Order থেকে আ’লা Superior হবে। যেমন ধরুন, এরিস্টটল উল্লিখিত চারটি বস্তুর মাঝে এভাবে তারতিব দেন-

  • আগুন
  • বাতাস
  • পানি
  • মাটি

এরিস্টটলের বাস্তবতার ধারণার ভিত্তিমূল ছিলো এই যে, আমাদের এই পৃথিবী চারটি উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত। যদি এদেরকে স্থিতি অবস্থায় থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয় তবে এরা চারটি স্তরে নিজেদেরকে বিন্যাস করে নেয়। তিনি যুক্তি দেন যে, পানি বাতাসের মধ্য দিয়ে পতিত হয় ( বা বাতাস পানির মধ্য দিয়ে বুদবুদের মাধ্যমে উপরে ভেসে উঠে), মাটি পানি এবং বাতাস দুটোর মধ্য দিয়েই পতিত হয় এবং আগুন সবচেয়ে উঁচু স্তরে অবস্থিত কেননা তা বাতাস ভেদ করে উপরের দিকে উঠে যায়। এই যুক্তি অনুযায়ী, বৃষ্টি নিচের দিকে পড়ে কারণ এটা তার সঠিক অবস্থান বাতাসের নিচে পৌঁছতে চেষ্টা করে। আগুনের শিখা ঊর্ধ্বমুখী হয় তার অন্য তিন উপাদানের উপরে অবস্থানের কারণেই।

এরিস্টটল এভাবে এনালাইসিস করে তার মাঝে তারতিব দিয়েছেন। প্রায় ১৫০০ বছর এভাবেই তা সারা পৃথিবীতে প্রচলিত ছিলো। পরবর্তীতে এর অসারতা প্রমাণিত হয়। হাকিকতের ইলমই যখন নেই, তার মাঝে তারতিব কীভাবে বিশুদ্ধ হতে পারে!

যে সূত্র থেকে হাকিকতে জ্ঞান অর্জন করা হবে, তারতিবও সেই সূত্রের আলোকেই দিতে হবে। অন্যথায় শেষাবধি নসিবে বিভ্রান্তিই জুটবে। এজন্য আপনি যদি সাইন্স থেকে বস্তুর হাকিকত গ্রহণ করেন, তবে তারতিবও তার আলোকেই দিতে হবে। যদি এরিস্টটল-প্লেটোর দর্শন থেকে নেন, তবে তারতিবও তারই আলোকে। অন্যথায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন এবং আপত্তির পর আপত্তি উত্থাপিত হতেই থাকবে। চূড়ান্ত সমাধানে কিছুতেই পৌঁছতে পারবেন না।

এজন্য কোরআন থেকে বস্তুর হাকিকত গ্রহণ করলে তারতিবও কোরআনের নির্দেশনার আলোকেই দিতে হবে। কোরআন থেকে হাকিকত নিয়ে সাইন্সের আলোকে তারতিব দিলে কিবা সাইন্স থেকে হাকিকত নিয়ে কোরআনের আলোকে তারতিব দিলে বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একই সূত্র থেকে Cosmology এবং Ontology দুটোই হলে দেখবেন অন্তর কীভাবে প্রশান্ত হয়। কোনো প্রকার বিভ্রান্তিও আর থাকবে না।

 

অনটোলজির আলোচনা

হাকিকত এনালাইসিস করার পর মূল হাকিকত অনুধাবন করার নাম Ontology (অনটোলজি- অস্তিত্বের স্বরূপবিষয়ক সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব)। এই Ontology র আলোচ্য বিষয় হলো- মানুষের বাস্তবতা কী, রুহের স্বরূপ কী, স্থায়িত্ব কী, স্রষ্টা কী ইত্যাদি। Ontology র জ্ঞান যে আপনার থেকে বেশি রাখে, সে এটাক করে দুই মিনিটের মধ্যে আপনার কসমোলজি (হাকিকতের তারতিব ও বিন্যাস) বদলে দিতে পারবে। অনটোলজি এবং কসমোলজি দুটো বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অনটোলজি যেমন হবে, তার আলোকেই কসমোলজি হবে। এজন্যই আমরা আগের লেখায় বলে এসেছি, অনটোলজি যে সূত্র থেকে আসবে, কসমোলজির জ্ঞানও সেই একই সূত্র থেকে আহরণ করতে হবে। আগের লেখায় উদাহরণ সহ বিষয়টা আলোচনা করা হয়েছে। কসমোলজির জন্য অনটোলজি অপরিহার্য। কেননা যার সামান্য আকল আছে, তারও এ কথা বুঝতে বেগ পেতে হবে না- নফসে হাকিকতের ইলমই যদি অর্জিত না হয়, তবে হাকিকতকে তারতিব দেয়া, তার মাঝে পারস্পরিক বিন্যাস রচনা করা কীভাবে সম্ভব! নফসে হাকিকতের ইলম আপনার থেকে কারো বেশি থাকলে আপনার দেয়া তারতিবকে সে দুই মিনিটেই ভুল প্রমাণিত করে নয়া তারতিব মানতে আপনাকে বাধ্য করতে পারবে।

 

টেলিয়োলজির আলোচনা

মেটাফিজিক্সের তৃতীয় শাখা হলো (Teleology) টেলিয়োলজি (পরমকারণাবাদ- পৃথিবীর সবকিছু একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে, বিশেষ পরিকল্পনামাফিক সৃষ্টি হয়েছে এমন বিশ্বাস বা মতবাদ)। টেলিয়োলজিতে হাকিকতের মাকছাদ বা Final Cause সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এরিস্টটল মনে করতেন, চারটি ইল্লত (Cause) পাওয়া গেলেই কেবল কোনো হাকিকত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। চারটির কোনো একটি যদি না পাওয়া যায়, তবে কোনো হাকিকত অস্তিত্বলাভ করতে পারে না। ইল্লত চারটি (Four Causes) হলো-

  • ইল্লতে সুরিয়্যাহ (formal cause)- কেউ কোনো বস্তু নির্মাণ বা তৈরি করতে চাইলে প্রথমে মস্তিষ্কে তার একটা চিত্র অঙ্কিত হবে। হাকিকতের এই তাছাওউরের (চিত্রায়নের) নামই ইল্লতে সুরিয়্যাহ।
  • ইল্লতে গাইয়্যাহ (final cause)- কোনো জিনিস তৈরি করতে চাইলে আবশ্যিকভাবেই তার কোনো লক্ষ্য থাকবে। লক্ষ্যহীন হবে না। এটাকেই Final Cause বা মাকছাদে হাকিকত বলে। এই Final Cause নিয়ে আলোচনা করাকেই পরিভাষায় (Teleology) টেলিয়োলজি বা পরমকারণাবাদ বলা হয়।
  • ইল্লতে ফায়িলিয়্যাহ (efficient or moving cause)- বস্তুটি অস্তিত্বলাভ করার জন্য অবশ্যই কোনো নির্মাতা বা কর্তা লাগবে।
  • ইল্লতে মাদ্দিয়্যাহ (material cause)- বস্তুর হাকিকত অস্তিত্বলাভ করার জন্য যেসকল মেটারিয়াল বা উপাদানের প্রয়োজন তাও অপরিহার্যভাবে থাকতে হবে। এই চারওটি বস্তু যদি থাকে- Matter Form Agent এবং End / Purpose, তখনই কেবল কোনো হাকিকত অস্তিত্ব লাভ করতে পারে; অন্যথায় নয়। একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি। যেমন ধরুন একটা মোবাইল বাস্তবজগতে আপনার হাতে আছে। এবার আপনি এই মোবাইলটার দিকেই লক্ষ করুন। দেখবেন ওপরের চারওটি জিনিস এর মাঝে বিদ্যমান। মোবাইলটার ডিজাইন এমন কেনো? কারণ শুরুতে এর যে (Form) নকশা এবং চিত্রায়ণ করা হয়েছে, তা এমন ছিলো। মোবাইলে এতো এতো পরিষেবা কেনো? কারণ এটাকে স্মার্ট ডিভাইস হিসেবে এই ধরনের ক্রেতাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে? এর তৈরির পেছনে লক্ষ্যই (End / Purpose; Final Cause) ছিলো নির্দিষ্ট ক্রেতাদের প্রয়োজন পূরণ করা। মোবাইলটা মূল উপাদান থেকে এই আকৃতি কীভাবে ধারণ করলো এবং কেনো করলো? কারণ এক বা একাধিক নির্মাতা (Agent) তাদের কৃত নকশা অনুযায়ী জিনিসটাকে এভাবে নির্মাণ করেছে। মোবাইলটা কালো/সাদা কেনো? কারণ এটাকে যে (Matter) উপাদান থেকে তৈরি করা হয়েছে, তার রং এমন। মেটাফিজিক্সে (মা বা’দাত তবিয়াত বা অধিবিদ্যায়) উপরিউক্ত তিনটি বিষয় নিয়েই মৌলিকভাবে আলোচনা করা হয়।

 

ইসলামের ওপর পাশ্চাত্যপন্থীদের অভিযোগ ও আমাদের নির্বুদ্ধিতাঃ একটি সরল মূল্যায়ন

ইসলামের ওপর প্রাচ্যবিদ ও পাশ্চাত্যপন্থীদের অভিযোগের তো অন্ত নেই। নমুনাস্বরূপ কয়েকটি লক্ষ করুন।

১. ইসলামের দণ্ডবিধি বড় ভয়ানক। মধ্যযুগের বর্বরতা। মানবতার অবমূল্যায়ন। মানবাধিকার লঙ্ঘন।

২. ইসলামের পর্দার বিধান সম্পূর্ণ অমানবিক বিধান। নারীর অধিকার খর্ব করা। ইসলাম নারীকে করেছে অবরোধবাসিনী। বেগম রোকেয়ার মতো মহান নারী মুক্তির অগ্রদূতরা না থাকলে ইসলাম নারীদেরকে বাকহীন প্রাণীর মতোই করে রাখতো।

৩. প্রত্যেকের রয়েছে স্ব ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা (যদিও তারাই আবার মুসলমান নামক ”প্রাণীদেরকে” সেই অধিকারটুকুও দিতে চায় না)। ধর্ম সবার ব্যক্তিগত বিষয়। যার যে ধর্ম ভালো লাগে, সে সেই ধর্ম পালন করবে। ইসলাম দিয়েছে মুরতাদদেরকে হত্যা করার নির্দেশ। এ যে মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

৪. পুরুষ ও নারীর মাঝে ইসলাম রচনা করেছে বৈষম্যের দেয়াল। পদে পদে নারীদেরকে ঠকিয়েছে। তাদের অধিকার খর্ব করেছে। তালাকের অধিকার দিয়েছে শুধু পুরুষকে। নারীকে এই অধিকার থেকে করেছে বঞ্চিত। চার বিয়ের অধিকার দিয়েছে শুধুই পুরুষকে। উত্তরাধিকার সম্পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের মাঝে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিরাট বৈষম্যের দেয়াল।

৫. সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি খুব সংকীর্ণ। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমাদের অঙ্গনের যারা পাশ্চাত্যপন্থীদের এ ধরনের অভিযোগ-আপত্তি খণ্ডন করেন, তাদের সবার ধারাটাই মোটামুটি একধরনের। একটি দৃষ্টান্ত লক্ষ করুন-

ইসলামের ওপর তারা যে আপত্তিগুলো করে, প্রথমে সেই আপত্তিকে আপত্তি হিসেবে মেনে নিয়ে এরপর তার উত্তর প্রদান করা হয়। ইসলাম উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক সম্পদ প্রাপ্তির অধিকার দিয়েছে।

(উল্লেখ্য, এটা সবক্ষেত্রে নয়, বরং সমস্তরের পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে, যেমন ভাই-বোন। অন্যথায় উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর জন্য সবচে বেশি বরাদ্দ, পুরো সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ। এবং সম্পদের উত্তরাধিকারীদের যে তালিকা কোরআন-সুন্নাহয় উল্লিখিত হয়েছে, তাদের আট শ্রেণীই নারী। মাত্র চার শ্রেণী পুরুষ।

এমন সুরতও আছে, যেখানে নারী সম্পদ পায়, অথচ তার বরাবরের আরেকজন পুরুষ উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে সিকিভাগও পায় না। বিষয়টা কারো কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই। ওদের অভিযোগ শুনতে শুনতে ইসলামের নির্দেশনাই ভুলে বসি।)

এবার এর যৌক্তিকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, সম্পদ উপার্জনের দায়িত্ব পুরুষের। নারীকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। বিয়ে পর্যন্ত সে বাবা বা বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে থাকে। এরপর স্বামীর। তার মৃত্যুর পরও ছেলেদের কাঁধে তার দেখভালের দায়িত্ব অর্পিত হয়। তার খরচের কোনো খাত না থাকা সত্ত্বেও ইসলাম তাকে দিয়েছে মোহরের অধিকার। দিয়েছে উত্তরাধিকার থেকে ছেলের তুলনায় অর্ধেক সম্পদ পাওয়ার অধিকার। তাহলে বাহ্যত কম দেখা গেলেও ইসলাম নারীকে দিয়েছে বেশি। এখানে বরং কম দিয়েও সমতা রক্ষা হয়নি। বরং ছেলের যে পরিমাণ খরচ, তাকে তো আরো বেশি দরকার ছিলো। সে হিসেবে এটা ইসলামের ইনসাফ।

আপনি যদি ইতিহাস ঘাটেন, তবে দেখবেন, ইসলামের ওপর এ ধরনের আপত্তির ধারা শুরু হয়েছে সপ্তাদশ শতাব্দীর পরে। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এ ধরনের আপত্তি খুঁজে পাওয়াটা দুরূহপ্রায়। সপ্তাদশ শতাব্দীর পরে যখন পাশ্চাত্য দর্শন উৎকর্ষ লাভ করে, তখন এ ধরনের নিত্যনতুন আপত্তির ধারা শুরু হয়।

অন্যান্য অধিকাংশ ধর্ম তো আকিদা এবং ইবাদতের বাইরে সাধারণত তার অনুসারীদেরকে বিধান ও নির্দেশনা দেয় না, তাই তাদের ওপর আপত্তির তীরও বর্ষিত হয়নি। দুয়েক ধর্ম, যাদের ধর্মীয় বিধান ও নির্দেশনা উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এ ধরনের অভিযোগের শিকার হয়েছে, তারা এ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজনমাফিক স্ব স্ব ধর্মের সংস্কার করে নিয়েছে।

যেখানে এসে ধর্ম ও দর্শন সংঘাতের রূপ নিয়েছে, সেখান থেকে পরম যতনে ধর্মকেই সরিয়ে দিয়েছে। তাই তো ধর্ম হয়ে গেছে চার্চের আর রাষ্ট্র বেরিয়ে গেছে চার্চের হস্তক্ষেপ থেকে।

রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করা হয়েছে মূলত সেই চেতনা থেকে। ইসলামের সাথে রাষ্ট্রের সংঘর্ষ ছিলো না ঠিক, কিন্তু আমাদের দেশের এসব অথর্ব আধুনিকমনস্কদের তো মাথায় আলাদা ঘিলু নেই, পাশ্চাত্য থেকে যা পায়, তার বুলি আওড়িয়ে আর নিজ নিজ পরিমণ্ডলে তা বাস্তবয়ন করেই তারা আমোদ-উল্লাসে মেতে ওঠে আর নিজেদেরকে স্বপ্নের ভেলায় চড়িয়ে মেঘের রাজ্যে ভেসে বেড়ায়। পশ্চিম থেকে আসা সব মলমূত্রই এদের নিত্যদিনের আহার।

মানুষ যখন নিজের মেটাফিজিক্সকে ছেড়ে দেয়, তখন তার বিপরীত পক্ষের বিরুদ্ধে লম্বা লম্বা প্রবন্ধ-বক্তৃতা অর্থহীন হয়ে যায়। সে অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কার বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং কেনো করছে?! নিজের মেটাফিজিক্স ছেড়ে যখন অভিযোগকারীদের মেটাফিজিক্স থেকেই তাদের অভিযোগ-আপত্তিগুলোকে দেখা হবে, তখন সেসব অভিযোগের উত্তর প্রদান করা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু হবে না। কারণ সে তখন কিসের পক্ষে লড়াই করছে? সে তো প্রথমে তাদের কসমোলজি (হাকিকতের তারতিব ও বিন্যাস) মেনেই এসেছে। এখন তবে নিজের ধর্মকে বাঁচানোর জন্য হাকিকতের নতিজা অস্বীকার কেনো করছে? এটা তো পাগলামি। নিজের মাঝেই সুস্পষ্ট সংঘাত।

অবস্থাটা এমন, সে স্বীকার করছে অমুক কুমারী মেয়েকে আমি র‍্যাপ করেছি কিন্তু এখন তার গর্ভে আসা সন্তানের ব্যাপারে বলছে, না, ঐ বাচ্চা কিছুতেই আমার নয়। মেয়েটার জীবনে একমাত্র পুরুষ হিসেবে যখন সে-ই উপগত হয়েছে, তখন গর্ভে আসা সন্তান তার না হয়ে আর কার হবে?! প্রথম বিষয়টাকে স্বীকার করে, তার নতিজাকে অস্বীকার করাটা নির্বুদ্ধিতা ও পাগলামি নয়তো কী?!

ওপরের সবগুলো অভিযোগের দিকে আরেকবার লক্ষ করুন। দেখবেন অভিযোগের শ্রেণী ভিন্ন হলেও মূলকথা এক। অর্থাৎ মানবাধিকার লঙ্ঘন; আর মানবাধিকার হলো প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সকলের সমানাধিকার। আচ্ছা, মানুষের অধিকার কী? হাঁ, সিরিজের আগের লেখাগুলো পড়ে থাকলে বিষয়টা আপনার সামনে স্পষ্ট থাকার কথা। মানুষের অধিকার কী এ কথা তো তখনই স্পষ্ট হবে, যখন নিশ্চিতভাবে জানা যাবে, মানুষ আসলে কী? মানুষ কি আবদ (গোলাম) নাকি Human Being?

মুসলমানরা তাদের মেটাফিজিক্স অনুযায়ী মানুষকে আবদ হিসেবে গণ্য করে। তাদের অনটোলজি যেহেতু মানুষ আবদ, তাই কসমোলজিও আবদ হিসেবেই হয়।

আর পাশ্চাত্যপন্থীরা মানুষকে Human Being মনে করে। তাই তারা মানুষের যে অধিকারের কথা বলে, তাও এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে, মানুষ Human Being।

আর এ কথা তো সূর্যালোকের মতো পরিষ্কার যে, আবদের বিধান এবং অধিকার আর Human Being এর বিধান এবং অধিকারের মাঝে বিস্তর পার্থক্য থাকবে। (এ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী লেখায় আসবে ইনশাআল্লাহ)।

মুসলমান মানুষকে আবদ গণ্য করে তার ওপর একধরনের বিধান আরোপ করে, পাশ্চাত্যপন্থীরা তখন মানুষের হাকিকত Human Being গণ্য করে অভিযোগের বস্তা নিয়ে ছুটে আসে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে আকাশবাতাস কাঁপিয়ে তুলে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে সবকিছু উষ্ণ করে বসে। আর আমরা মৌলবিরাও এবার তাদের মেটাফিজিক্স মেনেই অভিযোগ খণ্ডনের প্রয়াসে বসে যাই। অথচ ভুলেও একবারও মুলের দিকে তাকাই না। উসুলে ইখতিলাফ থাকলে ফুরুয়ে ভিন্নতা তো থাকবেই। বিপরীত পক্ষের উসুল মেনে নিয়ে ফুরুয়ে মতবিরোধ করা ও তাদেরকে গালমন্দ করা সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয়।

পাশ্চাত্যের অভিযোগ-আপত্তি অনুধাবন করার জন্য আগে গোড়ায় তাকাতে হবে। তাদের মেটাফিজিক্স বুঝতে হবে। তাদের পরিভাষাগুলো বুঝতে হবে। সেগুলোর হাকিকত অনুধাবন করতে হবে। এরপর তাদের আপত্তির জবাব দিতে হবে। তখন তারাও নিশ্চুপ হয়ে সব কথা মেনে নিতে বাধ্য হবে।

পাশ্চাত্যের পরিভাষা-আপত্তিগুলো তাদের মেটাফিজিক্সের আলোকে অনুধাবন না করে নিজ ধর্মের পক্ষ হয়ে সেগুলোর মূল্যায়ন করতে গেলে সে চেতনে বা অবচেতনে ইসলামকে খ্রিস্টবাদের আজকের পরিণতিতে উপনীত করার প্রয়াসে রত। আদতে তার সব চেষ্টাই কোনো সুফল বয়ে আনবে না।

পাশ্চাত্যপন্থীদের অভিযোগের অন্যতম দুটো ভিত্তি হলো, তারা ভালো-মন্দ, ভুল-শুদ্ধ নিরূপণের মাপকাঠি নির্ধারিত করেছে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সকলের সমানাধিকারকে। এবার এই মাপকাঠিতে যা টিকে, তাকে তারা সহিহ বলে মেনে নেয়। যা কিছু এই মাপকাঠিতে টিকে না, তার বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগ ভাইরাল করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়।

নারীদেরকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম তার সমস্তরের পুরুষের তুলনায় অর্ধেক দিয়েছে, এটা সকলের সমানাধিকারের যে মাপকাঠি তারা নির্ধারণ করেছে, এতে টিকেনি। তাই এখন এর বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা। ব্যক্তিস্বাধীনতাও একটা মাপকাঠি। এবার ইসলামের সবগুলো বিধানের দিকে একবার উড়ন্ত দৃষ্টি বুলায়। মুরতাদকে হত্যা করার বিধান এবং এ জাতীয় আরো কিছু বিধানকে ব্যক্তিস্বাধীনতার চরম লঙ্ঘন মনে হয়। এবার এর বিরুদ্ধেও শুরু হয় প্রচারণা। বিদেশীরা শুরু করে। এরপর আমাদের দেশের মোটা মাথার লোকগুলো ইংরেজি থেকে সেসব লুফে নিয়ে বুক ফুলিয়ে মিডিয়ায় লিখতে থাকে, বলতে থাকে। আরবি-উর্দু মাধ্যম থেকে উত্তর সংগ্রহ করে আমাদের বন্ধুরাও সেসবের জবাব রচনা করতে থাকে। আস্তিক বনাম নাস্তিক নামের ফেসবুক গ্রুপটা ঘুরে আসলেই বিষয়টা আপনার ভালো করে বোধগম্য হয়ে যাবে।

এখানে প্রয়োজন তাদের প্রতিটি অভিযোগ খুঁজে খুঁজে জবাব দেয়া নয়। বরং তাদের মেটাফিজিক্সে আঘাত করা।

ভালো-মন্দ, ভুল-শুদ্ধ নিরূপণের জন্য তারা যে মাপকাঠি তৈরি করেছে- ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সকলের সমানাধিকার প্রথমে এই মাপকাঠির মূল্যায়ন করা (জায়েযা লে’না)। আদতেই কি ঐ দুটো বিষয় ভালো-মন্দ, ভুল-শুদ্ধ নিরূপণের মাপকাঠি হওয়ার যোগ্যতা রাখে?

এর ওপর ভিত্তি করেই তাদের আপত্তির পর আপত্তি করাটা কি সাজে? শাস্ত্রীয়ভাবে এই একটি মৌলিক বিষয়ের সঠিক বিশ্লেষণ ও উত্তর বেরিয়ে এলেই মুহূর্তের মধ্যে তাদের শত অভিযোগের সমাধি রচিত হয়ে যাবে।

(এটা শুধু উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা। বিস্তারিত আলোচনা সামনেও চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কেউ না বুঝলে সমস্যা নেই। তবে গলদ ফাহমি হলে সেটা আশঙ্কার বিষয়।)

আর উসুল (মূল) ঠিক রেখে, বরং তা নিজে মেনে নিয়ে ফুরু (শাখা) নিয়ে আমরণ মারামারি ও লড়াই করে গেলেও যুদ্ধ শেষ হবে না। আপত্তির পর আপত্তি আসতেই থাকবে। আপনি নিবৃত্ত হলেও তারা নিবৃত্ত হবে না। আর আপনার অবহেলা এবং নিবৃত্ত হয়ে যাওয়া আরো হাজারো মানুষের গোমরাহির কারণ হবে। আজও ইসলামকে যদি যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, তবে মানুষ অবশ্যই তা গ্রহণ করবে। ইসলামের জয় হবেই। জয়তু শাশ্বত ইসলাম।

 

 

Share This