মানত সংক্রান্ত কয়েকটি জরুরি জ্ঞাতব্য বিষয়

 

কোনো মানত সহিহ হওয়ার জন্য এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে তা মানত হিসেবে ধর্তব্য হওয়ার জন্য কয়েকটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছে। নিচে সংক্ষিপ্তভাবে আমরা সেই বিষয়গুলো উল্লেখ করার প্রয়াস পাবো।

১. মানতকৃত বিষয়টি মৌলিক ইবাদত হতে হবে, অন্য কোনো ইবাদতের ভূমিকা বা সহায়ক নয়। যেমন— নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি মৌলিক ইবাদত; কিন্তু উজু করা, রোজার নিয়ত করা, হজ আদায়ের উদ্দেশ্যে সফর করা, যাকাত প্রদানের মানসে খাদ্য-বস্ত্র ক্রয় করা ইত্যাদি মৌলিক ইবাদত নয়; বরং পূর্বোক্ত ইবাদতসমূহের ভূমিকা ও সহায়ক।

২. মানত সহিহ হওয়ার জন্য মানতকৃত বিষয়ের শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু পারিভাষিক ওয়াজিব বা ফরজে আইন হতে হবে। মানতকৃত বিষয়ের শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু যদি ফরজে আইন বা পারিভাষিক ওয়াজিব না হয়ে থাকে, তাহলে মানত সহিহ হবে না। যেমন কেউ যদি মাদরাসায় পড়ার বা পড়ানোর মানত করে, কিবা মসজিদে প্রবেশের মানত করে, অথবা রাস্তা-ব্রিজ নির্মাণের মানত করে, কিবা কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার মানত করে ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার মানত শরিয়তের দৃষ্টিতে মানত হিসেবে ধর্তব্য হবে না। (মানত হিসেবে ধর্তব্য না হলেই যে তা আর করা যাবে না— এমন তো নয়।)

মানতকৃত বিষয়টির শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু যদি পারিভাষিক ওয়াজিব বা ফরজে আইন হয়ে থাকে, তখনই মানত সহিহ হবে। যেমন কেউ শাওয়ালের ছয় রোজা রাখার মানত করলো, তার এই মানত সহিহ হয়ে যাবে; যেহেতু শাওয়ালের ছয় রোজার শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু ফরজে আইন রয়েছে, আর তা হলো রমযানের রোজা। রোজা, নামাজ, সদকা, ইতিকাফ, ওয়াকফ, তাওয়াফ, দাসমুক্তি, কোরআন তেলাওয়াত, দুরুদ পাঠ, তাসবিহ আদায় ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানত সহিহ হবে।

৩. মানতের ক্ষেত্রে মনের নিয়তের বিবেচনা করা হয় না; বরং মুখে উচ্চারিত শব্দের বিবেচনা করা হয়। ভুলেও যদি কোনো কিছুর মানত মুখে উচ্চারণ করে বসে, তাহলেও তা পূর্ণ করা অপরিহার্য হয়ে যায়। বিয়ে, তালাক, কসম এবং মানতের ক্ষেত্রে ভুল বা দুষ্টুমির কোনো বিবেচনা নেই। ভুলে বা দুষ্টুমি করে কোনো কিছু বললেও তা অবধারিত হয়ে যায়।

৪. মানত শর্তযুক্ত হতে পারে, আবার শর্তহীনও হতে পারে। শর্তহীন মানত, যেমন আমি এ বছর শাওয়ালের ছয় রোজা রাখবো। আর শর্তযুক্ত মানত, যেমন আমার ছেলে যদি সুস্থ হয়, তাহলে আমি এতো টাকা সদকা করবো।

৫. মানতের ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি পূর্ণ করা জরুরি। অতিরিক্ত যে গুণ ও বৈশিষ্ট্য তার সাথে যুক্ত করা হয়ে থাকে, তা পূর্ণ করা জরুরি নয়। যেমন কেউ মানত করলো, আমি পাঁচশ টাকার এই নোটটা অমুক গরিব ব্যক্তিটিকে অমুক স্থানে বসে সদকা করবো, অথবা আমি বাইতুল মুকাররম মসজিদের দক্ষিণ প্রান্তে একটি ফ্যান ছেড়ে ও দুটো বাতি জ্বালিয়ে ছয় রাকাত নামাজ আদায় করবো, তাহলে তার জন্য উপরিউক্ত গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো পূর্ণ করা অপরিহার্য হবে না; বরং তার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ সদকা যে কোনো নোট দিয়ে যে কোনো গরিবকে আদায় করে দেয়া এবং যে কোনো জায়গায় বসে ছয় রাকাত নামাজ আদায় করাই যথেষ্ট।

তেমনি কেউ যদি মানত করে যে, আমি ধনীকে সদকা করবো, তাহলে গরিবকে সদকা করাই অপরিহার্য হবে। তবে সে যদি “ইবনুস সাবিল” উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। তখন “ইবনুস সাবিল”কে সদকা করা অপরিহার্য হবে। কেননা ধনী ব্যক্তি সদকার খাত নয়, গরিব এবং “ইবনুস সাবিল” সদকার খাত। ধনীকে সদকা করা হলে তা “হিবা” তথা হাদিয়া হয়ে যায়, সদকা থাকে না।

{“ইবনুস সাবিল” হলো এমন ব্যক্তি, দেশে যার অনেক অর্থসম্পদ রয়েছে; কিন্তু সে এখন সফরে রয়েছে। এখন তার হাতে রাহাখরচ নেই। সে একজন অসহায় মানুষে পরিণত হয়েছে।}

৬. মানত সহিহ হওয়ার জন্য মানতকৃত বিষয়টি মৌলিকভাবে হারাম হতে পারবে না। ইমাম তাহাবি রহ. বলেন, “কেউ যদি মানত করে যে, আমি অমুককে হত্যা করে ফেলবো, তাহলে তা মানত হবে না, বরং কসম হিসেবে ধর্তব্য হবে এবং তার ওপর সেই কসম ভঙ্গ করা ও তার কাফফারা আদায় করা অপরিহার্য হবে।” তাই কেউ যদি ইদের দিন রোযা রাখার মানত করে, তাহলে তার মানত সহিহ হয়ে যাবে। কেননা ইদের দিন রোজা রাখা মৌলিকভাবে হারাম নয়; বরং প্রাসঙ্গিক কারণে হারাম। তবে এক্ষেত্রে সে ইদের দিন রোজা না রেখে পরবর্তীতে অন্য কোনো দিন রাখবে। এক্ষেত্রে তার রোজার মানত সহিহ হবে এবং সে যে বিশেষণ তার সাথে যুক্ত করেছে, তা অবিবেচিত হবে। একান্ত কেউ যদি মানত পূরণ করার জন্য ইদের দিনই রোজা রাখে, তাহলে সে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে; যদিও এর কারণে সে গুনাহগার হবে।

ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, কেউ যদি মানত করে যে, আমি উজু ছাড়া দুই রাকাত নামাজ পড়বো, তাহলে তার মানত সহিহ হয়ে যাবে। ইমাম মুহাম্মাদ রহ. তার সঙ্গে ইখতিলাফ করেছেন। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. মানত সহিহ হওয়ার ফতোয়া দেয়ার অর্থ এ নয় যে, তাকে এখন উজু ছাড়াই দুই রাকাত নামাজ আদায় করার অনুমতি দেয়া হবে; বরং তাকে উজু করেই নামাজ পড়তে বলা হবে। কেননা মূলনীতি হলো, কোনো বিধান অপরিহার্য করে নেয়ার দ্বারা তার শর্তসমূহও অপরিহার্য করে নেয়া হয়। তো উজু হচ্ছে নামাজের শর্ত। এজন্য যখন সে নামাজের মানত করেছে, তখন আদতে সে তার সকল শর্তকেও নিজের ওপর অপরিহার্য করে নিয়েছে। এজন্য তার পরবর্তী কথা— “উজু ছাড়া” অনর্থক শব্দ হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমনিভাবে কেউ যদি মানত করে যে, আমি কেরাত ছাড়া নামাজ আদায় করবো, তাহলে তার ওপর কেরাতসহ নামাজ আদায় করাই অপরিহার্য হবে। কেউ যদি এক বা তিন রাকাত নামাজ আদায় করার মানত করে, তাহলে তার ওপর দুই এবং চার রাকাত নামাজ আদায় করা অপরিহার্য হবে।

৭. মানতের ক্ষেত্রে আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, মানত করার আগে মানতকৃত বিষয়টি তার ওপর অপরিহার্য থাকতে পারবে না। যদি কেউ এমন কিছুর মানত করে, যা পূর্ব থেকেই তার ওপর অপরিহার্য, তাহলে তাকে তার মানতও পূরণ করতে হবে এবং যা পূর্ব থেকে অপরিহার্য, তাও স্বতন্ত্রভাবে আদায় করতে হবে। যেমন কারো ওপর কোরবানি ওয়াজিব, এখন সে মানত করলো যে, আমার ছেলে যদি সুস্থ হয়, তাহলে আমি একটি গরু কোরবানি করবো। তো যখন তার ছেলে সুস্থ হবে, তখন তাকে স্বাভাবিক কোরবানিও করতে হবে এবং মানতের কারণে আরেকটি স্বতন্ত্র ওয়াজিব কোরবানিও আদায় করতে হবে। একই কথা হজ নামাজ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও। তবে হাঁ, কোরবানির দিনগুলোতে কেউ যদি শর্তহীনভাবে কোরবানির মানত করে (যেমন, আমি মানত করলাম, আমি একটি গরু কোরবানি করবো; সাথে কারো সুস্থতা বা সফলতার শর্ত যুক্ত করলো না) আর এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হয়, ওয়াজিব কোরবানির সংবাদ প্রদান, তাহলে এর দ্বারা তার ওপর স্বতন্ত্রভাবে মানতের কোরবানি অপরিহার্য হবে না। তবে যদি সংবাদ প্রদান উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে, বরং আলাদাভাবে মানত করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তার ওপর দুটো কোরবানি ওয়াজিব হবে। কোরবানির দিনগুলোর ক্ষেত্রে এই কথা। কোরবানির দিন শুরু হবার আগে কেউ যদি মানত করে, সেক্ষেত্রে তা সংবাদ প্রদান হিসেবে ধরা হবে না। কারণ সংবাদ প্রদান তো হয় ওয়াজিব হওয়ার পরে। আর কোরবানি তো ওয়াজিব হয় ইদের দিন শুরু হলে, তার পূর্বে নয়।

৮. অন্যের মালিকানাধীন বস্তুর ক্ষেত্রে মানত করলে মানত সহিহ হয় না। তেমনিভাবে নিজের মালিকানার অতিরিক্ত বস্তুর মানত করলেও তা সহিহ হয় না। যেমন কেউ যদি মানত করে যে, আমি একহাজার টাকা সদকা করবো আর তার মালিকানায় থাকে পাঁচশ টাকা, তাহলে তার ওপর পাঁচশ টাকা সদকা করা অপরিহার্য হবে; একহাজার টাকা নয়।

৯. অসাধ্য-অসম্ভব বিষয়ের মানত শরিয়তের দৃষ্টিতে মানত হিসেবে ধর্তব্য হয় না। অসাধ্য ও অসম্ভব হওয়ার দুই অর্থ— এক. প্রাকৃতিকভাবে বিষয়টি অসম্ভব। যেমন গতকালের রোজা বা ইতিকাফের মানত। দুই. শরিয়তের দৃষ্টিতে অসম্ভব। যেমন ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ের রোজা রাখার মানত।

১০. মানত হওয়ার জন্য মুখে উচ্চারণ করা শর্ত। অন্তরের নিয়ত ও সংকল্পের দ্বারা মানত হয় না। মুখ দিয়ে যা উচ্চারণ করা হবে, শুধু তা-ই ধর্তব্য হবে। যদি অন্তরে এক জিনিস থাকে আর মুখে ভুলবশত অন্য কিছু উচ্চারণ করে বসে, তাহলে উচ্চারণকৃত বিষয়ই তার ওপর অপরিহার্য হবে।

১১. নাবালিগের মানত ধর্তব্য হয় না। সুতরাং নাবালিগ অবস্থায় কোনো মানত করলে বালিগ হওয়ার পর তা পূরণ করা অপরিহার্য হবে না।

১২. আল্লাহর নামে মানত করা জায়িয আর গাইরুল্লাহর নামে মানত করা হারাম ও শিরক।

১৩. ধনী লোকদের জন্য মানতের বস্তু খাওয়া এবং গ্রহণ করা জায়িয নেই; যেমনিভাবে তাদের জন্য যাকাত ও সদকাতুল ফিতর জায়িয নেই। যারা সাইয়িদ, তাদের জন্যও মানতের বস্তু জায়িয নেই।

১৪. শর্তযুক্ত মানতের ক্ষেত্রে শর্ত পাওয়া যাওয়ার পরই কেবল মানত পূরণ করা অপরিহার্য হয়; তার পূর্বে নয়। এমনকি কেউ যদি শর্ত পাওয়া যাওয়ার আগে মানত আদায় করে দেয়, তাহলে তা মানত হিসেবে আদায় হয় না। যেমন উদাহরণস্বরূপ কেউ মানত করলো, যদি অমুক অপ্সরীকে আমি বিয়ে করতে পারি, তাহলে আমি তিনটি রোজা রাখবো। এখন সে যদি মেয়েটিকে বিয়ে করার আগেই সেই তিনটি রোজা রেখে ফেলে, তাহলে এর দ্বারা তার মানত পূরণ হবে না; বরং তা সাধারণ নফল রোজা হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে নসিবে থাকলে বিয়ের পর পুনরায় তাকে তিনটি মানতের ওয়াজিব রোজা রাখতে হবে।

১৫. মানত করার পর তা পূরণ করার ক্ষেত্রে অযথা বিলম্ব করা অনুচিত। কেননা মানত পূরণ করার পূর্বে কারো মৃত্যু এসে গেলে এজন্য সে গুনাহগার হবে।

১৬. কেউ যদি কোরআন তেলাওয়াত করার মানত করে, তাহলে তার মানত সহিহ হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যদি অন্যকে দিয়ে কোরআন পড়ানোর বা খতম করানোর মানত করে, তাহলে সেই মানত সহিহ হবে না। একই কথা রোজা, নামাজ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে। নিজে করার মানত করলে তা শুদ্ধ হবে। অন্যকে দিয়ে করানোর মানত করলে শুদ্ধ হবে না।

১৭. কেউ যদি অত্যাধিক পরিমাণ নফল নামাজ বা অন্য কোনো ইবাদত করার মানত করে, তাহলে তার জন্য কৃত মানত পূরণ করা ওয়াজিব। এক ব্যক্তি সত্তর হাজার রাকাত নফল নামাজ পড়ার মানত করে বসলো। তার এক প্রশ্নের জবাবে আল্লামা আবদুর রহিম লাজপুরি রহ. বলেন, নফল নামাজের মানতে্র ক্ষেত্রে নির্ধারিত রাকাত সংখ্যা অনুসারে দৈনিক রাতদিন মিলিয়ে যতো রাকাত নফল আদায় করা সম্ভব, তা আদায় করতে হবে। তা আদায় করার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা নেই। তবে দ্রুত তা সম্পাদন করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। এর জন্য কাফফারা বা অন্য কোনো বিকল্প নেই।

আরেক ব্যক্তি মানত করলো যে, অমুক কাজটি হয়ে গেলে আমি আজীবন প্রতি শুক্রবার রোজা রাখবো। তার প্রশ্নের জবাবে শায়খ রহ. বলেন, তার জন্য প্রতি শুক্রবার রোজা রাখা অপরিহার্য। অন্য দিন রোজা রাখার দ্বারা মানত আদায় হবে না। একান্ত কোনো শুক্রবার রোজা না রাখতে পারলে পরবর্তীতে তা কাজা করা জরুরি। বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর যদি তার পক্ষে আর রোজা রাখা সম্ভবপর না হয়, তাহলে তাকে প্রতি শুক্রবারের রোজার জন্য একেকটি ফিদয়া আদায় করতে হবে। অসচ্ছল হওয়ার কারণে ফিদয়া আদায়ের সামর্থ্য না থাকলে আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করবে।

১৮. মানত করার পর মানতকৃত বিষয় পূরণ করা জরুরি। রোজা রাখার মানত করে রোজার ফিদয়া দেয়া যথেষ্ট নয়। লাগাতার নির্দিষ্ট মেয়াদী রোজা রাখার মানত করলে সেই নির্দিষ্ট মেয়াদে রোজা লাগাতার রাখা জরুরি। আর মানতের সময় লাগাতার রাখার কথা উল্লেখ না করে থাকলে, তা বিরতির সাথেও রাখা যায়; লাগাতার রাখা জরুরি নয়।

১৯. মসজিদ নির্মাণের মানত করলে মানত সহিহ হবে না। কেননা মসজিদ নির্মাণ যদিও ওয়াজিব; কিন্তু তা মৌলিক ইবাদত নয়। তেমনি কেউ যদি তাবলিগে যাওয়ার মানত করে, তাহলে সেই মানতও সহিহ হয় না এবং তার জন্য মানতের কারণে তাবলিগে যাওয়া অপরিহার্য হয় না। এর আলোচনা পূর্বের পোস্টে বিগত হয়েছে।

২০. পশু জবাইয়ের মানত করলে পশুও জবাই করা যায় এবং তার মূল্যও সদকা করা যায়। তবে কোরবানির মানত করলে মানতকৃত পশুকেই কোরবানি করতে হয়।

২১. কসম এবং মানতের শব্দের ক্ষেত্রে ‘উরফ’ তথা সমাজে প্রচলিত শব্দের বিবেচনা করা হয়। সুতরাং উরফে যে সকল শব্দকে মানতের শব্দ মনে করা হয়, সেগুলোর দ্বারা মানত হবে। এজন্য মানতের শব্দ দ্বারা কোনো কথা বলা হলে পরবর্তীতে এই যুক্তি গ্রহণীয় হবে না যে, তা দ্বারা আমার মানত উদ্দেশ্য ছিলো না। মানত হওয়ার জন্য সরাসরি মানত শব্দ বা এমন কোনো শব্দ ব্যবহৃত হতে হবে, উরফে যার দ্বারা নিজের ওপর কোনো কিছুকে অপরিহার্য করে নেয়া উদ্দেশ্য হয়, তার দ্বারা ওয়াদা বোঝায় না। অবশ্য শর্তযুক্ত মানতের ক্ষেত্রে তেমন শব্দ না হলেও তা মানত হয়ে যায়; যেহেতু শর্তযুক্ত মানতের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত শর্ত পাওয়া গেলে নিজের ওপর সেই দায় অবধারিত করে নেয়াটাই সাধারণত উরফে উদ্দেশ্য হয়। যেমন, কেউ বললো, আমার মা যদি আইসিইউ থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন, তাহলে আমি এ বছর হজ আদায় করবো। এখন তার মা যদি সুস্থ হয়ে ফিরে আসে, তাহলে তার জন্য কৃত মানত পূরণ করা ওয়াজিব।

২২. আল্লামা যফর আহমদ উসমানি রহ. বলেন, কেউ যদি কোনো পশু সদকা করার মানত করে, তাহলে তাকে এমন পশু সদকা করতে হবে, যা কোরবানির ক্ষেত্রে বিবেচ্য। অর্থাৎ ছাগল হলে একবছর বয়সী ছাগল আর গরু হলে দু’বছর বয়সী গরু।

২৩. হযরত বলেন, কেউ যদি মসজিদে টাকা দেয়ার মানত করে আর এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হয় মসজিদকে ‘হিবার মাধ্যমে মালিক বানিয়ে দেয়া, তাহলে তার মানত সহিহ হবে না। অবশ্য সতর্কতার দাবি হবে, সেই পরিমাণ টাকা মসজিদে দান করা। আর যদি এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হয়, সেই টাকা দিয়ে কোনো বস্তু ক্রয় করে মসজিদে ওয়াকফ করা, তাহলে তার মানত সহিহ হয়ে যাবে এবং তার জন্য কৃত মানত পূরণ করা ওয়াজিব হবে। কেননা মসজিদে টাকা দেয়া কোনো মৌলিক ইবাদত নয়। পক্ষান্তরে ওয়াকফ মৌলিক ইবাদত। উল্লেখ্য, তেমনি মসজিদ নির্মাণের মানত করাও সহিহ নয়।

২৪. ইসালে সাওয়াবের মানত সহিহ নয়। কেউ যদি মানত করে যে, আমার অমুক কাজটি হয়ে গেলে আমি এই পরিমাণ দুস্থ ব্যক্তিকে খাইয়ে অথবা এই পরিমাণ অর্থ সদকা করে অমুক মৃত ব্যক্তির নামে ইসালে সাওয়াব করবো, তাহলে তার জন্য ইসালে সাওয়াব করা অপরিহার্য হবে না। কেননা ইসালে সাওয়াবের শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু ফরজে আইন বা পারিভাষিক ওয়াজিব নয়। আর এখানে যে সদকা রয়েছে, তা মানতের মূল বিষয় নয়, বরং প্রাসঙ্গিক বিষয়। এখানে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো ইসালে সাওয়াব, সদকা নয়।

২৫. মাজারে পীরদের ব্যাপারে শিরকি আকিদা নিয়ে তাদের নামে যে সকল পশু মানত করা হয়, তা খাওয়া সম্পূর্ণ হারাম; যদিও তা আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা হয়ে থাকে।

২৬. কেউ যদি মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে সদকা বা অন্য কিছুর মানত করে, তাহলে এর দ্বারা যদিও সে গুনাহগার হবে, কিন্তু তার জন্য কৃত মানত পূরণ করা ওয়াজিব হবে। আর গরিব ব্যক্তিদের জন্য সেই মানতের দান-সদকা গ্রহণ করাও জায়িয হবে।

২৭. মানতকৃত পশু কোরবানি করার আগে যদি মারা যায়, তাহলে এর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। মানতকৃত পশু কোরবানি করার আগে যদি সে বাচ্চা প্রসব করে, তাহলে সেই বাচ্চাকেও কোরবানি করতে হবে।

২৮. সবশেষে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় উল্লেখ করছি। গাইরুল্লাহর নামে কসম করা জায়িয নেই। তবে কোথাও যদি কসম উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে, বরং বাক্যের সৌন্দর্য বর্ধন উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে গাইরুল্লাহর নামেও কসম করা জায়িয। যেমন আরবরা প্রায়ই বলে থাকে, “লা উমরি”। কোরআনে যে গাইরুল্লাহর নামে অসংখ্য জায়গায় কসম করা হয়েছে, তার একটি ব্যাখ্যা এটাও যে, সেখানে কসম উদ্দেশ্য নয়; বরং বাক্যের সৌন্দর্য বর্ধন উদ্দেশ্য। কথাটা আরবি ভাষার ক্ষেত্রে অধিক খাটে। কারণ বাংলায় বাক্যের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কসম শব্দ ব্যবহার করার ব্যাপক প্রচলন নেই।

 

সমাজে প্রচলিত তিনটি ভুল

 

১. আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত মসজিদে টাকা দেয়ার মানত করে থাকে। কিন্তু মাসআলা হলো, মসজিদে টাকা দেয়ার মানত করলে মানত হয় না। হাঁ, কারো যদি এই উদ্দেশ্য থাকে যে, তিনি তার টাকা দিয়ে মসজিদের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস কিনে তাতে ওয়াকফ করবেন, তাহলে মানত শুদ্ধ হবে। তবে আমার জানামতে এই উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ মানত করে না বা মানত করার পরেও ওয়াকফের পন্থা গ্রহণ করে না। আমার পরিবারের সদস্যদেরকেও দেখেছি, ঘরে কোনো অসুখবিসুখ হলে মানত করেন এবং জুমআর দিন মসজিদের দানবক্সে মানতের সদকা দান করেন। হাঁ, কেউ যদি মসজিদে দান করার মানত করে, তাহলে যদিও তার মানত সহিহ হবে না; কিন্তু সতর্কতার দাবি হবে, মসজিদে সেই পরিমাণ টাকা দান করে দেয়া।

২. মানত করার জন্য মুখে উচ্চারণ করা জরুরি। অন্তরের নিয়ত দ্বারা মানত হয় না। কিন্তু আমাদের দেশের অনেকেই অন্তরে অন্তরে মানত করেন। যেমনিভাবে শুধু নিয়ত করার দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামাজ বা রোজা আদায় হয়ে যায় না, তেমনি শুধু নিয়তের দ্বারা মানতও হবে না, যাবত না মুখে উচ্চারণ করা হয়।

৩. মানত দু’ভাবে করা যায়। শর্তযুক্ত মানতও করা যায়, শর্তমুক্ত মানতও করা যায়। শর্তমুক্ত মানত যেমন— আমি মানত করছি, আমি এবার শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখবো/আমি নিজের ওপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা অবধারিত করলাম। আর শর্তযুক্ত মানত যেমন— আল্লাহ যদি আমাকে সুস্থ করেন/আমাকে অমুক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার তাওফিক দান করেন, তাহলে আমি এতোদিন রোজা রাখবো/এতো পারা কোরআন পড়বো/এতো টাকা সদকা করবো।

শর্তমুক্ত মানত করার প্রচলন এ দেশে তেমন নেই। অথচ শর্তমুক্ত মানত করে কোনো ইবাদত করলে দু’সাওয়াব— ইবাদতের সাওয়াব এবং মানত পূরণের সাওয়াব পাওয়া যায়। অবশ্য এটাও স্মরণ রাখা উচিত যে, মানত করার দ্বারা মানতকৃত বিষয়টি ওয়াজিব হয়ে যায়। তাই এভাবে মানত করলে শুধু সে বিষয়েরই মানত করা উচিত, যা আদায় করা সম্ভব হবে এবং তখনই করা উচিত, যখন তা আদায়ের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবার শঙ্কা না থাকবে।

আর শর্তযুক্ত মানত করা একটি অনুচিত কাজ। কেননা শর্তযুক্ত মানতে বিষয়টা এমন হয়ে থাকে— আল্লাহ, যদি তুমি আমার লক্ষ্য পূরণ করো, তাহলে আমি এই ইবাদত করবো। আর যদি তা না করো, তাহলে কিন্তু আমার এই ইবাদত তুমি পাবে না। শায়খ উসমানি রহ. এর ভাষায়— কেমন যেনো আল্লাহর সাথে সওদাবাজি করা হচ্ছে। এই প্রকারের মানত কোনো পূণ্যের কাজ নয়। হাঁ, এর কারণে অবশেষে যে ইবাদত করা হয়, তা অবশ্য কিছু সওয়াব বয়ে আনে। তবে এরচে বহুগুণ উত্তম, শর্তযুক্ত মানত না করে সরাসরি আল্লাহর রাস্তায় সদকা করে দেয়া বা অন্য কোনো ইবাদত সম্পন্ন করে ফেলা। এর বরকতে আল্লাহ তাআলা ইনশাআল্লাহ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূর্ণ করবেন, বিপদ-আপদ দূর করবেন।

হাদিসে এসেছে—

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদেরকে মানত করতে নিষেধ করলেন। তিনি তখন বলেছেন, মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৫)

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা মানত করবে না। কেননা মানত তাকদিরের কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। এর দ্বারা শুধু কৃপণ ব্যক্তি থেকে সম্পদ বের হয়। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৯, সুনান তিরমিজি, সুনান নাসায়ি)

তিনি আরো বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মহান আল্লাহ যে জিনিসকে আদম সন্তানের জন্য নির্ধারণ করেননি, মানত সেটি তার নিকটবর্তী করে না। বরং তাকদীরে যা আছে মানত তা-ই নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়, যা সে খরচ করতে চায়নি। (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩৩১)

 

প্রসঙ্গ: শর্তযুক্ত মানত 

 

শর্তযুক্ত মানত দু’ধরনের হতে পারে—

১. মানতকারী মানতের সাথে এমন শর্ত যুক্ত করেছে, যা পূরণের প্রত্যাশা সে রাখে। যেমন সে মানত করলো যে, আল্লাহ যদি আমাকে অমুক প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য করেন, তাহলে আমি দশ রাকাত নফল নামাজ আদায় করবো। এখানে দশ রাকাত নফল নামাজকে সে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার শর্তের সাথে যুক্ত করেছে। আর স্পষ্ট যে, এটা এমন শর্ত, যা পূরণ হওয়ার প্রত্যাশা সে রাখে।

২. মানতের সাথে সে এমন শর্ত যুক্ত করেছে, যা পূরণ হওয়ার প্রত্যাশা আদৌ সে রাখে না। যেমন সে মানত করলো যে, আল্লাহ যদি এই মিশনটি শেষ করার আগে আমাকে কোনো দুর্ঘটনায় ফেলেন, তাহলে আমি লাগাতার চার মাস রোজা রাখবো। তেমনি কোনো ভালো মানুষ মানত করলো যে, আমার দ্বারা যদি কখনো কোনো কবিরা গুনাহ হয়ে যায়, তাহলে আমি প্রতিটি গুনাহের জন্য নফল সদকা করবো। এখানে লাগাতার চার মাস রোজা রাখা এবং নফল সদকা করাকে মানতকারী এমন শর্তের সাথে যুক্ত করেছে, যা সংঘটিত হওয়াটা তার প্রত্যাশা নয়।

প্রথম প্রকার মানতের ক্ষেত্রে মানতকারীর জন্য শর্ত পূরণ হওয়ার পর তার কৃত মানত পূরণ করা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে মানত পূরণ না করে কাফফারা দেয়া যথেষ্ট নয়। যতো কষ্টই হোক, তাকে তার মানত পূরণ করতেই হবে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকারের মানতের ক্ষেত্রে মানতকারী শর্ত পূরণ হওয়ার পর তার কৃত মানতও পূরণ করতে পারে, আবার চাইলে কাফফারাও আদায় করতে পারে। এককথায়, প্রথম প্রকার মানতের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সামনে একটাই অপশন, আর তা হলো কৃত মানত পূরণ করা আর দ্বিতীয় প্রকার মানতের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সামনে দু’টো অপশন। এবার সে দু’টোর মধ্য থেকে যে-কোনোটাকে গ্রহণ করতে পারে।

এই মাসআলাটি ইমাম আবু হানিফা রহ. থেকে বর্ণিত। আল্লামা শামির ভাষ্যানুযায়ী ইন্তিকালের মাত্র সাতদিন পূর্বে তিনি এই অভিমত প্রদান করেছেন। হিদায়া গ্রন্থে রয়েছে, এটি ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এরও মত এবং এটাই বিশুদ্ধ মত। মাযহাবের মুতুন-প্রণেতাগণও এই অভিমত গ্রহণ করেছেন। ইমাম শাফেয়ি রহ. এরও মাযহাব এটা। ফাতহুল কাদির গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই মতটি ‘নাদিরুর রিওয়ায়াহ’, তবে মুহাক্কিকগণ এই মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। উল্লেখ্য, এই মাসআলা বর্ণনার ক্ষেত্রে আলবাহরুর রায়িক গ্রন্থে তাসামুহ হয়েছে। আল্লামা শুরুমবুলালি রহ. তুহফাতুত তাহরির গ্রন্থে আল্লামা ইবনু নুজায়মের সেই তাসামুহটি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন।

Share This