এক.

ইমান এবং ইসলামের বিপরীত জিনিস হলো, কুফর। কুফর শব্দের শাব্দিক অর্থ লুকানো, অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। পারিভাষিক অর্থ হলো, ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’-সর্বজনবিদিত বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয়কে অস্বীকার করা।

‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ বলা হয় সে সকল বিষয়কে, যা সন্দেহাতীতভাবে যুগপরম্পরায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং উম্মতের সাধারণ দ্বীনদার শ্রেণীও যে সকল বিষয়কে নবীজীর শিক্ষা বলে জানে। আলিমগণের পরিভাষায় এ ধরনের বিষয়কে ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ বলা হয়। যেমন, আল্লাহ একমাত্র মাবুদ, তার কোনো শরীক নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল। কেয়ামত ও আখেরাত সত্য। কোরআন আল্লাহ তাআলার নাযিল করা কিতাব। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ। পবিত্র মক্কা নগরীর কাবাঘর হলো মুসলমানদের কেবলা ইত্যাদি। এগুলো এমন বিষয়, ইসলাম ও তার নবি সম্পর্কে যার সামান্য জানাশোনা আছে, সে-ই নিশ্চিতভাবে জানে যে, নবিজি উম্মতকে এসকল জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন। এতে সন্দেহ পোষণের কোনো অবকাশ নেই। তো মুসলমান হওয়ার জন্য এজাতীয় বিষয়ের অস্বীকার থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। কেননা এ ধরনের বিষয় অস্বীকার করার অর্থ হলো সরাসরি নবীজীর তালীম ও হেদায়াতকে অস্বীকার করা। যার পর ইসলামের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই আর থাকে না।

সাধারণভাবে কুফরকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়, যেগুলো কুফরের মৌলিক প্রকার।

১. কুফরে ইনকারঃ ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’কে অন্তরেও বিশ্বাস না করা, মুখেও স্বীকারোক্তি প্রদান না করা। যেমনটা সাধারণ কাফিরদের অবস্থা।

২. কুফরে জুহুদঃ অন্তরে ‘জরুরিয়াতে দ্বীনে’র প্রতি বিশ্বাস রাখা, কিন্তু মুখে তার স্বীকারোক্তি না দেয়া। ইবলিস-শয়তানের কুফর এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। রাসুলের যুগের অনেক আহলে কিতাবের অবস্থাও ছিলো এমন।

৩. কুফরে ইনাদঃ অন্তরে ‘জরুরিয়াতে দ্বীনের’ প্রতি বিশ্বাস রাখে, মুখেও স্বীকার করে; কিন্তু অন্য কোনো কুফরি ধর্ম মতবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে না, বরং ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা কুফরি মতবাদকেও সঠিক মনে করে। রাসুলুল্লাহ সা. এর চাচা আবু তালিবের অবস্থাও এমন ছিলো। বর্তমান সময়ে যারা কুফরি তন্ত্রে-মন্ত্রে, বাদ-মতবাদে বিশ্বাসী, তাদের কুফরও এই পর্যায়ভুক্ত।

৪. কুফরে নিফাকঃ অন্তরে ‘জরুরিয়াতে দ্বীনে’র প্রতি বিশ্বাস রাখে না, কিন্তু কোনো হেকমত-মাসলাহাত বা দুনিয়াবি স্বার্থসিদ্ধির মানসে মুখে ইমানের ঘোষণা দেয়। এমন কাফিরকে মুনাফিক বলা হয়। মুনাফিক সাধারণ কাফিরের চেয়ে বহুগুণে নিকৃষ্ট।

৫. কুফরে যানদাকাহ বা কুফরে ইলহাদঃ এটা গোপন কুফর। কেননা এই পাপে পাপী বাহ্যত সকল ‘জরুরিয়াতে দ্বীনে’র প্রতি ইমান প্রকাশ করে, তার বাহ্যিক সুরত-লেবাস দেখলে তাকে মুমিন-মুসলিম, এমনকি মৌলবিও মনে হয়। কিন্তু সে ‘জরুরিয়াতে দ্বীনে’র অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয়ের এমন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে, যা দ্বীনের অকাট্য ব্যাখ্যা, সেই বিষয়ের স্বীকৃত দ্বীনি ব্যাখ্যার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। কাদিয়ানিদেরকে মুলহিদ-যিন্দিক-কাফির বলার পেছনে অন্যতম কারণ এটাও। বর্তমানকালে এই কুফরের চর্চা খুব ব্যাপক।

শায়খ তাহির মাসউদ দা. বা. বলেন, শায়খ আব্দুল হাফিজ মক্কি রহ. ও আমাদের দেওবন্দি আকাবিরগণও তা সমর্থন করেন (এ বিষয়ে আকাবিরের অভিমত ও দলিলসমৃদ্ধ বিস্তর আলোচনা পরে আসবে), যে ব্যক্তি অনৈসলামি আইনকানুন বিধানসংবিধানকে ইসলামি আইনকানুন ও বিধানসংবিধানের থেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করবে, সেই ব্যক্তি ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি ইসলামের আইনকানুনের খেলাফ অন্য কিছুর প্রবক্তা হবে, সেও কাফির। {আকায়িদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতঃ ৬১-৬২}

জাওয়াহির গ্রন্থে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি সর্বস্বীকৃত কোনো হারাম বিষয়ের হারাম হওয়াকে অস্বীকার করবে অথবা তাতে সন্দেহ পোষণ করবে, এক্ষেত্রে উভয়টি সমান, যেমন— মদ ব্যভিচার সমকামিতা সুদের নিষিদ্ধতাকে অস্বীকার করা, কিংবা কেউ যদি দাবি করে যে, সগিরা-কবিরা গুনাহগুলো হালাল, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। {শরহুল ফিকহিল আকবারঃ ১৮৭-১৮৮}

তেমনিভাবে দ্বীনের কোনো বিষয় নিয়ে বিদ্রূপ করাও কুফর। যারা কাফির, তাদেরকে মুসলিম বলে অভিহিত করা মারাত্মক অন্যায়। কাফিরদের ক্ষেত্রে ইসলামি পন্থায় জানাযা-কাফন-দাফনের বিধান নেই। যারা চেতনে-অবচেতনে এই কাজগুলো করেন, তারা চরম অন্যায় কর্মে ও স্রষ্টার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়েন।

 

দুই.

বিগত পোস্টে আমরা জরুরিয়াতে দ্বীনের পরিচয় সম্পর্কে আলোচনা করেছি। সেখানে বলা হয়েছে, ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ বলা হয় সে সকল বিষয়কে, যা সন্দেহাতীতভাবে যুগপরম্পরায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং উম্মতের সাধারণ দ্বীনদার শ্রেণীও যে সকল বিষয়কে নবীজীর শিক্ষা বলে জানে। আলিমগণের পরিভাষায় এ ধরনের বিষয়কে ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ বলা হয়।

এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়। আল্লামা কাশ্মীরি রহ. বলেন, “ব্যাপক প্রসিদ্ধির মাপকাঠি হলো, জনসাধারণের সকল শ্রেণির মধ্যে সেই দ্বীনি বিষয়াবলির জ্ঞান প্রসিদ্ধি লাভ করা। সে ব্যাপারে প্রত্যেক শ্রেণির প্রতিটি ব্যক্তির জ্ঞান থাকা জরুরি নয়। তেমনিভাবে জনসাধারণের সেই শ্রেণিরও জানা জরুরি নয়, যারা দ্বীন এবং দ্বীনি বিষয়াবলির প্রতি কখনো ভ্রুক্ষেপই করে না। বরং জনসাধারণের এমন প্রত্যেক শ্রেণির মধ্যে তার জ্ঞান প্রসার লাভ করা জরুরি, যারা দ্বীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে; চাই তারা আলিম হোক, কিবা অ-আলিম।

ইমানের বিপরীত জিনিস হলো কুফর। অন্ধকার চেনার জন্য আলোর ব্যাপারে ধারণা থাকতে হয়। এজন্য কুফরকে ভালো করে বুঝতে হলে আগে যথাযথভাবে ইমানের পরিচয় লাভ করতে হবে। আল্লামা কাশ্মীরি রহ. বলেন, “ইমান অন্তরের আমল। যেমনটা ইমাম বুখারি রহ. তার সহিহ গ্রন্থে “ইন্নাল মা’রিফাতা ফি’লুল কালব” (পরিচয়-বিশ্বাস অন্তরের কাজ) বলার দ্বারা বুঝিয়েছেন। দ্বীনের প্রতিটি হুকুম অন্তরে গ্রহণ করা এবং তার ওপর আমল করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ইমানের জন্য অপরিহার্য।” অর্থাৎ কোনো জিনিসের সুনিশ্চিত পরিচয় জ্ঞান ও বিশ্বাসের নামই ইমান নয়, বরং অন্তর থেকে তা গ্রহণ করা, তার ওপর আমল করার সুদৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করাও ইমানের জন্য অপরিহার্য।

একই কথা হাফিজ ইবনে হাজার রহ. ও বলেছেন। ফাতহুল বারি গ্রন্থে (৮/৭৪) তিনি বলেন, “নাজরানবাসীদের ঘটনা থেকে যে বিধানগুলো উদ্ঘাটিত হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো, কোনো কাফির মুসলমান হওয়ার জন্য শুধু তার নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি প্রদান যথেষ্ট নয়। বরং যতোক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের সকল বিধানকে নিজের ওপর অবধারিত করে না নিবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত সে মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে না।” হাফিজ ইবনুল কায়্যিম রহ. যাদুল মাআদ গ্রন্থে এ বিষয়ে আরো সবিস্তারে আলোচনা করেছেন।

তো ইমানের অর্থ দাঁড়াচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সা. থেকে প্রমাণিত সকল আকিদা-বিধানকে সত্য বলে স্বীকার করা, অন্তর দ্বারা বিশ্বাস করা। রাসুলুল্লাহ সা. এর আনীত শরিয়তের সকল বিধানকে গ্রহণ করা, নিজের ওপর অবধারিত করে নেয়া। ইসলাম ছাড়া অন্য সকল কিছু থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং দৃপ্তকণ্ঠে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া।

‘জরুরিয়্যাতে দ্বীনে’র অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি বিষয় ফরজ হতে হবে, এমনটা জরুরি নয়। বরং কোনো সুন্নত বিষয়ও ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীনে’র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যে সুন্নত বিধানের জ্ঞান সকলের আছে, সাধারণ-অসাধারণ সকলে যার ব্যাপারে জানে, তাও ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীনে’র অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, মেসওয়াক।

তবে ফরজ বিধান এবং ফরজ নয় এমন বিধানের মাঝে একটি পার্থক্য আছে। ফরজ বিধানের ফরজিয়্যাত (ফরজ হওয়াকে) অস্বীকার করলেই কাফির হয়ে যাবে, মূল বিধানটাকে অস্বীকার করলে তো হবেই। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে কেউ যদি নফল সুন্নত বা অন্য কিছু বলে, ফরজিয়্যাত অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। আর যদি এমন বলে যে, ইসলামে নামাজের বিধান নেই, অর্থাৎ সে মূল বিধানকে অস্বীকার করে, তাহলে তো কাফির হবেই। অর্থাৎ ফরজের ক্ষেত্রে মূল বিধানকে অস্বীকার করাও কুফর আবার ফরজের ফরজিয়্যাত অস্বীকার করাও কুফর। আর ওয়াজিব সুন্নত ইত্যাদির ক্ষেত্রে শুধু মূল বিধান অস্বীকার করা কুফর। যেমন কেউ যদি বিতির নামাজকে অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। তবে সে যদি বিতির নামাজকে স্বীকার করে, তবে তার ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করে, বিতিরকে সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ বলে, তাহলে সে কাফির হবে না।

কোনো কোনো মাযহাবে তো ফরজ আর সুন্নতের মাঝে ওয়াজিব নামে কোনো প্রকারের অস্তিত্বই নেই। হানাফি ফকিহদের মতে ফরজ সুন্নতের মাঝে একটি প্রকার হলো ওয়াজিব। তো ওয়াজিব বিধানের ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করা যদি কুফর হতো, তাহলে তো অন্য মাযহাবের সকল অনুসারীরাই কাফির হয়ে যেতো।

মিসওয়াক একটি সুন্নত বিধান। কিন্তু তা ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীনে’র অন্তর্ভুক্ত। তাই কেউ যদি মিসওয়াকের বিধানকে অস্বীকার করে, মিসওয়াককে ইসলামের বিধান মনে না করে বন্যতা বা অন্য কিছু বলে অভিহিত করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। যারা ইসলামের হুদুদ-কিসাসকে অস্বীকার করে বা যারা জিহাদের বিধানকে অস্বীকার করে, তারা সকলেই কাফির। স্মতর্ব্য যে, বিগত পোস্টে আমরা বলে এসেছি, ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীনে’র অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয়কে উম্মাহর সর্বসম্মত ব্যাখ্যার খেলাফ ভিন্ন কিছু ব্যাখ্যা করাও কুফর।

উল্লেখ্য, জিহাদের বিধানকে অস্বীকার করা কুফর। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে জিহাদ ফরজ কি না, এ নিয়ে যদি মতবিরোধ হয়, তাহলে যারা ফরজ নয় এ মর্মে ফতোয়া দিবেন, তাদের ব্যাপারে কিন্তু আবার সেই কুফরের বিধান প্রযোজ্য নয়। ইসলামে জিহাদের বিধান নেই বা জিহাদের বিধান রহিত হয়ে গেছে – এ জাতীয় আকিদা কুফর। কিন্তু কোনো ভূখণ্ডের ব্যাপারে বিধান বর্ণনা করা একটি ইজতিহাদি বিষয়। আর ইজতিহাদি বিষয়ে দলিলের আলোকে ভিন্নমত পোষণের অবকাশ তো অবশ্যই রয়েছে। এ বিষয়টা খুব ভালো করে বুঝে রাখা দরকার। নইলে অনেক সময় অবচেতনে বিভ্রান্তি হয়।

উপরিউক্ত আলোচনাকে হানাফি ফকিহদের উসুলের আলোকে বিচার করলে এক্ষেত্রে আরো ব্যাপকতা পাওয়া যায়। কোনো অকাট্য সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত বিষয়ের অস্বীকারকেই তারা কুফর মনে করেন, চাই তা আকিদার অন্তর্ভুক্ত বিষয় হোক কিবা আমলের অন্তর্গত, যদিও তা ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীনে’র অধীনে না আসে। {মুসায়ারাহ, আল্লামা ইবনুল হুমাম, পৃ. ২০৮}। এ বিষয়ে দাদাউস্তাদ মুফতিয়ে আযম পাকিস্তান মুফতি ওলি হাসান টুংকি রহ. এবং আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রহ. এর অতি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যও পররবর্তী কোনো পর্বে উল্লেখিত হবে ইনশাআল্লাহ।

কোনো বিষয় অকাট্য হওয়ার জন্য তা তাওয়াতুরের সাথে প্রমাণিত হতে হয়। তাওয়াতুর তিন প্রকার।

১. সনদের বিচারে তাওয়াতুর। অর্থাৎ কোনো বর্ণনার সনদে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই পরিমাণ নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী বিদ্যমান রয়েছে, যাদের ব্যাপারে এ কথা ভাবাই যায় না যে, তারা সকলে কোনো মিথ্যে বর্ণনার ব্যাপারে ঐকমত্য করেছেন।

২. তাওয়াতুরে তাবাকাহ। অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুসলমানদের মধ্যে কোনো আকিদা, কোনো আমলের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে চলে আসা। যেমন আমরা যে কোরআন পড়ছি, হুবহু তা-ই যে রাসুলুল্লাহ সা. এর ওপর নাযিল হয়েছে, এ বিষয়টা এই প্রকার তাওয়াতুর দ্বারা প্রমাণিত। এরকম আরো অসংখ্য বিষয় রয়েছে।

৩. তাওয়াতুরে আমল বা তাওয়াতুরে তাওয়ারুস। প্রত্যেক যুগের মুসলমানরা দ্বীনের যেসব প্রমাণিত বিধানের ওপর আমল করে আসছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম সর্বত্র তা প্রচলিত রয়েছে, তা-ই তাওয়াতুরে আমল বা তাওয়াতুরে তাওয়ারুস। যেমন বিশ রাকাত তারাবিহ।

কিছু মানুষের ধারণা, আমাদের শরিয়তে তাওয়াতুরের মাধ্যমে প্রমাণিত বিধানের সংখ্যা কম। তাদের এই ধারণা নিতান্ত ভুল। তারা মূলত প্রথম প্রকার তাওয়াতুরকেই শুধু তাওয়াতুর মনে করে। বাকি দুই প্রকার তাওয়াতুরের ব্যাপারে তাদের জ্ঞান নেই। ইসলামে তাওয়াতুরের মাধ্যমে প্রমাণিত বিধানের সংখ্যা অগণিত। কোনো অকাট্য ও সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত বিধানকে অস্বীকার করার দ্বারাই হানাফিদের উসুল অনুযায়ী ব্যক্তি কাফির হয়ে যায়। দলিলের বিচারে হানাফিদের উসুল বেশ সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আল্লাহ চাইলে পরবর্তী কোনো লেখায় আসবে।

তিন.

যে সকল কাজ আল্লাহ এবং তার রাসুলকে অস্বীকার করার নামান্তর, সেগুলোতে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা ব্যক্তি কাফির হয়ে যায়; যেমন— ফেরাউনের মতো নিজেকে প্রভু দাবি করা কিংবা মুসায়লামা কাযযাব, আসওয়াদ আনসির মতো নিজেকে নবি দাবি করা।

যে সকল কাজ আল্লাহ এবং তার রাসুলের কোনো সিফাতকে অস্বীকার করার নামান্তর, সেগুলোতে লিপ্ত হওয়ার দ্বারাও ব্যক্তি কাফির হয়ে যায়; যেমন— আল্লাহ তাআলার সিফাত হলো, তিনি ইলাহ ও মা’বুদ। তো তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সেজদা করার দ্বারা ব্যক্তি কাফির হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সা. এর সিফাত, তিনি হলেন শেষ নবি। এখন তার পর অন্য কেউ যদি নিজেকে গোলাম আহমদ কাদিয়ানির মতো যিল্লি নবি-ছায়া নবি দাবি করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে।

আল্লাহ যা কিছু হালাল করেছেন, সেগুলোকে হারাম মনে করা কিংবা আল্লাহ যা কিছু হারাম করেছেন, সেগুলোকে হালাল মনে করার দ্বারাও ব্যক্তি কাফির হয়ে যায়। এককথায় শরিয়তের সুনিশ্চিত ও অকাট্য কোনো বিধানকে অস্বীকার করার দ্বারা মুমিন মুরতাদ হয়ে যায়।

যে সকল হারাম কাজ আল্লাহ এবং তার রাসুলকে বা আল্লাহ এবং তার রাসুলের কোনো সিফাতকে অস্বীকার করার নামান্তর নয়, কেউ যদি এমন কোনো কাজকে হারাম মনে করে তাতে লিপ্ত হয়, তাহলে এর দ্বারা ব্যক্তি সর্বোচ্চ ফাসিক হতে পারে, কাফির নয়। ভ্রান্ত খারেজি-মু’তাযিলা গোষ্ঠী এমন ব্যক্তিকেও কাফির বলে। তারা আমলকে ইমানের অপরিহার্য অঙ্গ মনে করে। কবিরা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার দ্বারাই যে-কেউ তাদের দৃষ্টিতে কাফির হয়ে যায়। তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মত এমন নয়। তাদের দৃষ্টিতে আমল ইমানের পরিপূরক অঙ্গ, আমল ইমানের অপরিহার্য ও মৌলিক অঙ্গের অন্তর্ভুক্ত নয়।

তবে কেউ যদি কোনো হারাম কাজকে হালাল মনে করে করে আর এর পেছনে শরয়ি কোনো কারণ না থাকে, তাহলে সে কাফির হয়ে যায়। বিশেষ কোনো প্রতিবন্ধক না থাকলে তাকে মুরতাদ-কাফির হিসেবেই ঘোষণা করা হয়। যেমন ব্যভিচার, সমকামিতা, মদপান, সুদ ইত্যাদি অপরাধ অকাট্য হারাম। কেউ যদি এই কাজগুলোকে হারাম মনে করে করে, তাহলে তার ওপর কুফরের বিধান আরোপিত হবে না। কিন্তু কেউ যদি এই কাজগুলোকে হালাল মনে করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে।

ইমান আনার জন্য ইসলামের সকল আকিদা-বিধানের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, সকল বিধানকে নিজের ওপর অবধারিত করে নিতে হয়। কিন্তু ইমানভঙ্গের জন্য ইসলামের সকল আকিদা-বিধানকে অস্বীকার করতে হয় না। বরং যে কোনো একটি অকাট্য ও সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত বিষয়ের অস্বীকারই ইমানভঙ্গের জন্য যথেষ্ট। যেমন উযু করার জন্য অনেকগুলো অঙ্গ ধুতে হয়, সবগুলো ফরজ যথাযথভাবে আদায় করতে হয়। কিন্তু উযু ভঙ্গ হওয়ার জন্য সবগুলো বিষয় পাওয়া যাওয়া মোটেও জরুরি নয়। বরং উযু ভঙ্গকারী যে কোনো একটি বিষয়ই উযুকে ভেঙ্গে দেয়।

কেউ যদি আল্লাহ তাআলার অস্তিস্বকে স্বীকার করে, কিন্তু তার কোনো একটি গুণকে অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা, রিযিকদাতা। তেমনি আল্লাহর একটি সিফাত হলো, তিনি বিধানদাতা। কেউ যদি উপরিউক্ত সিফাতগুলোর কোনো একটি সিফাতকে অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। এজন্যই আকাবিরে দেওবন্দ কর্তৃক সত্যায়িত কিতাব ‘আকায়িদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ -এ গ্রন্থকার আল্লামা শাহ তাহির মাসউদ দা. বা. লেখেন, “ইসলাম চোরের জন্য হাত কাটার দণ্ড দিয়েছে। এখন কেউ যদি চোরের শাস্তি জেল জরিমানা বা অন্য কিছু ঘোষণা করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে।”

আল্লাহ তাআলার বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা না করার অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলাকে বিধানদাতা হিসেবে স্বীকার না করা। যে-কেউ আল্লাহ তাআলার সিফাতকে অস্বীকার করবে, সে কাফির হয়ে যাবে। এ বিষয়টা আর সাধারণ কবিরা গুনাহ এক নয়। চুরি করার দ্বারা ব্যক্তি ফাসিক হলেও কাফির হয় না, যদি না সে চুরিকে হালাল মনে করে। কিন্তু উপরিউক্ত কাজের দ্বারা ব্যক্তি ফাসিক নয়, কাফির হয়ে যায়। যেহেতু তা প্রকারান্তরে আল্লাহ তাআলাকে বিধানদাতা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার নামান্তর।

ইসলামের হদ-কিসাসকে অস্বীকার করা, সেগুলোকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে অভিহিত করা, মানবরচিত বিধানকে রবের দেয়া বিধানের থেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা সুস্পষ্ট কুফর, যাতে কোনো শিথিলতার অবকাশ নেই। শিথিলতাবশত কারো ওপর হদ-কিসাস প্রয়োগ না করা এক জিনিস আর হদ-কিসাসের আইনকে পাল্টিয়ে কোরআন-সুন্নাহর সাথে সংঘর্ষিক আইন পাশ করা ভিন্ন জিনিস। কোনো কাওম যদি অবহেলাবশত ইসলামের দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন না করে, অপরাধীদেরকে শাস্তি না দিয়ে এমনি ছেড়ে রাখে, তাদের এই কাজটা অপরাধ হলেও কুফর নয়। কিন্তু কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন বাস্তবায়ন করা, মদ-জুয়ার বৈধতা দেয়া, সুদ অবধারিত করা, পারস্পরিক সম্মতিতে সংঘটিত ব্যভিচারকে হালাল ঘোষণা করা, ভাস্কর্য নির্মাণ ও সমকামিতার পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং তার পক্ষে অনুমতি ঘোষণা করা, আল্লাহর আইন-বিধানকে উঠিয়ে দিয়ে মানবরচিত আইন-বিধানের অনুমোদন দেয়া কোনো ফিসক নয়, বরং সুস্পষ্ট কুফর।

কাউকে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সেজদা করা শিরক। এখন কেউ যদি কোনো গির্জা মন্দির বা মাজারের খাদিম পদে দায়িত্বগ্রহন করে এরপর দিনরাত ইবাদতের উদ্দেশ্যে মূর্তি বা মাজারওয়ালাকে সেজদা করতে থাকে, তার ব্যাপারে এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই যে, হয়তো সে মাযুর-অপারগ। কেননা সে সেই কাজ গ্রহণ করতে বাধ্য ছিলো না। কোনো ব্যক্তি যদি মুকরাহ তথা বাধ্য ও মা’যুর-অপারগ হয়, তার বিষয়ে মাসআলা ভিন্ন কিছু দাঁড়ায়। তার ওযর-অপারগতাকে আমলে নেয়া হয়। কিন্তু শাসনভার বা বিচারকার্যের দায়ভার কাঁধে নেয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক। সেখানে চাকরি করাটাও একটি ঐচ্ছিক ব্যাপার। তাছাড়া তাদের দৈনন্দিন আচরিত রীতি থেকেও তাদের মনোভাব ও মানসিকতা স্পষ্ট। এ সবকিছুর পরও তাদেরকে মাযুর-অপারগ বলে ফতোয়া দেয়াটা অনেক মুশকিল। আল্লাহর আইন উঠিয়ে দিয়ে মানবরচিত আইনকে জায়গা দেয়া যেমন কুফর, তেমনি মানবরচিত আইন অনুযায়ী প্রত্যহ শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করাও কুফর।

কেউ কেউ বলেন, কারো মাঝে নিরানব্বইটি কুফর পাওয়া গেলে আর একটি ইমান প্রমাণকারী বিষয় পাওয়া গেলে তাকে কাফির নয়, মুমিন বলে ফতোয়া দেয়া হবে। কিছু মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণাকে খণ্ডন করে থানবি রহ. বলেন, “নিরানব্বইটি তো দূরের কথা, সুনিশ্চিতভাবে একটি অকাট্য কুফর পাওয়া গেলেই ব্যক্তিকে কাফির বলে ফতোয়া দেয়া হবে। হাঁ, সেই একটা কুফরের বিষয়টা যদি অকাট্য ও শতভাগ সুনিশ্চিত না হয়, বরং তাতে দুর্বল হলেও কোনো তাবিল-ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে, তাহলে ব্যক্তিকে তাকফির করা হবে না। শতভাগ সুনিশ্চিতভাবে কুফর প্রমাণিত হলেই কেবল ব্যক্তিকে তাকফির করা হবে।”

চার. 

তাকফির তিন ধরনের—

১. তাকফিরুন নস। অর্থাৎ কোরআন-সুন্নাহয় যাকে বা যাদেরকে স্পষ্টভাবে কাফির বলা হয়েছে, তাদেরকে কাফির মনে করা অপরিহার্য। যদি কেউ তাদেরকে কাফির মনে না করে বা তাকফিরের ব্যাপারে সংশয় পোষণ করে, তাহলে তার ইমানই শঙ্কটাপন্ন হয়ে যাবে। যেমন পবিত্র কোরআন ইহুদি খ্রিস্টান আবু লাহাব ফেরাউন হামানকে কাফির ঘোষণা করেছে। মক্কার মুশরিকরা, যারা আল্লাহকে স্বীকার করলেও সরাসরি আল্লাহর ইবাদত না করে মাজারপূজারীদের মাজারপূজার মতো তাদের পাথরের উপাস্যদের উপাসনা করতো, তাদেরকেও কাফির বলে ঘোষণা করেছে। এখন প্রতিটি মুমিনের জন্য কোরআন-সুন্নাহয় যাদেরকে সুস্পষ্টভাবে তাকফির করা হয়েছে, তাদেরকে কাফির মনে করা জরুরি।

২. তাকফিরুল ইজতিহাদ। অর্থাৎ ইজতিহাদের ভিত্তিতে কাফির ঘোষণা করা। ইজতিহাদও দলিলের ভিত্তিতে হয়। ইজতিহাদের ক্ষেত্রে দলিলের আলোকে ভিন্নমত পোষণেরও সুযোগ থাকে। তো ইজতিহাদের ভিত্তিতে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তাকফির করা হয়, তাহলে যারা তাকফির করেছেন, তাদেরকে খারেজি-তাকফিরি বলার কোনো সুযোগ নেই। তেমনি দলিলের ভিত্তিতে যারা সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তাকফির করা থেকে বিরত থেকেছেন, তাদেরকেও মুরজিয়া বলার সুযোগ নেই। এরপরও কেউ যদি এমনটা করে, তবে তা হবে চরমপন্থা ও আদাবুল ইখতিলাফের চরম লঙ্ঘন; যার কারণে ব্যক্তি নিন্দা ও তিরস্কারের যোগ্য হয়ে যায়। তবে ইজতিহাদ হতে হবে দলিলের ভিত্তিতে। আদতে যা দলিল নয়, তাকে দলিল বলে চালিয়ে দেয়া হলে, পরিভাষায় তাকে ‘শুবহা’ বলা হয়, দলিল নয়। নইলে খারেজি-মু’তাযিলারাও তো কোনো না কোনো দলিল দিয়েই তাদের মাযহাব-মতবাদ চালায়।

৩. তাকফিরুল মুআইয়ান। অর্থাৎ ইজতিহাদের আলোকে নির্দিষ্ট কাউকে তাকফির করা। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সতর্কতা কাম্য। কেননা কাউকে কাফির বলা হলে তার পরিণামও অতি মন্দ; এমনকি তার বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে যায়, স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক ব্যভিচার হিসেবে গণ্য হয়। ব্যক্তিবিশেষের তাকফিরের পূর্বে দুটো বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চিত হতে হয়— তাকফিরের সকল শর্ত পাওয়া যাওয়া এবং তাকফিরের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকা। তাকফিরুল মুআইয়ান বড় স্পর্শকাতর একটি বিষয়।

তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি— উভয়টি দ্বীনের জন্য, উম্মাহর জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ। কাযি ইয়ায রহ. শরহুশ শিফা গ্রন্থে বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করেছেন। মুফতি শফি রহ. জাওয়াহিরুল ফিকহ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। সেখানে কুফর-তাকফির বিষয়ে হযরতের দুটি আলাদা রিসালা রয়েছে। আলোচ্যবিষয়ে আল্লামা কাশ্মীরি রহ. এর ইকফারুল মুলহিদিন গ্রন্থটি অতুলনীয়।

পাঁচ.

উম্মাহর ইমামগণের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, কোনো মুসলিমকে কাফির বলা, তেমনি কোনো কাফিরকে মুসলিম বলা— উভয়টিই ভয়ানক ফিতনা এবং দ্বীনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

যারা মুসলিমদেরকে কাফির বলে, তারা তাকফিরি গোষ্ঠী আর যারা কাফিরদেরকেও মুসলিম বলে, তারা মুরজিয়া গোষ্ঠী। মৌলিক কাফিরকে তো কেউ কস্মিনকালেও মুসলিম বলবে না। তবে যারা মুরতাদ, তাদেরকেও মুসলিম মনে করাটাই মুরজিয়া মতবাদ।

কাউকে কাফির বলতে হলে অনেক সতর্কতা ও গবেষণার প্রয়োজন। কিন্তু এর অর্থ তো এ নয় যে, পৃথিবীর কোনো মুলহিদকেও কোনোকালে কাফির বলা যাবে না। তাকফিরনীতিতে মাত্রাতিরিক্ত সতর্কতার নামে মুরজিয়া মতবাদের উদ্ভব আর একই নীতিতে চূড়ান্ত শীথিলতা থেকে খারেজি-তাকফিরি মতবাদের সূচনা। কোনো মুসলিমকে কাফির বলা যতোটা অন্যায়, কোনো মুরতাদকে মুসলিম বলা এবং তার ওপর ইসলামের বিধিবিধান আরোপ করা তারচে বেশি অন্যায়। হকপন্থী আলিমরা কাউকে কাফির বানায় না। তারা শুধু যে কাফির, তার কুফরের বিষয়টা বর্ণনা করে। মুরজিয়াদের নীতি হলো, যে কালিমা পড়েছে, সে আবার কাফির হয় কীভাবে? হাঁ, যদি সে মুখে স্পষ্ট বলে, আমি আল্লাহকে মানি না, আমি রাসুল দ্বীন শরিয়তকে অস্বীকার করি, তাহলে তাকে কাফির বলা যেতে পারে। এর আগে কিছুতেই নয়।

কারো কাজ কুফর হলেই ব্যক্তি কাফির হয়ে যায় না, যেমনিভাবে কেউ ইরজায় লিপ্ত হলেই মুরজিয়া হয়ে যায় না। মিথ্যা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ‌ করা, গালিগালাজ করা, আমানতের খেয়ানত করা— এগুলো নিফাক। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, কেউ মিথ্যে বললেই তাকে মুনাফিক বলা হবে। হাদিসে এসেছে, “যে-কেউ ইচ্ছাকৃত নামায পরিত্যাগ করলো, সে কুফরি করলো।” এখন এর আলোকে সকল বেনামাযিকে কাফির বলা কি হাদিসের শিক্ষা? অনেক কাজ এমন আছে, যে কাজগুলো মুমিনের কাজ নয়, কাফিরের কাজ; কিন্তু সেই কাজগুলোতে লিপ্ত হলেই ব্যক্তি কাফির হয়ে যায় না। হাজ্জাজ তো কতো সাহাবিকেও হত্যা করেছে। সাহাবিকে হত্যা করা কি কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে? এতোদসত্ত্বেও হাজ্জাজকে কি কেউ কাফির বলেছে?

হাঁ, যে কাজগুলো আল্লাহ এবং তার রাসুলকে অথবা আল্লাহ এবং তার রাসুলের সিফাতকে অস্বীকার করার নামান্তর, সেগুলো করার দ্বারা ব্যক্তি কাফির হয়ে যায়। কাদিয়ানি আল্লাহ এবং তার রাসুলকে অস্বীকার করতো না। সে শুধু রাসুলকে সর্বশেষ নবি মানতো না। সে বলতো, রাসুলের দ্বারা নবুওয়াতের সমাপ্তি হয়নি। রাসুলের পরের ছায়া নবি (যিল্লি নবি) সে। এজন্য কাদিয়ানিকে কাফির ঘোষণা করা হয়েছিলো। হাঁ, তার মাঝে আরো অনেক ইলহাদ ছিলো। যেমন, সে জিহাদ পরিভাষার বিকৃতি সাধন করেছিলো। অবশ্য এই কাজ তো এখন কতেক মৌলবিও করে। কিন্তু একই কাজ হুজুর নয় এমন ব্যক্তি করলে তিনি কাফির ফতোয়া পান আর সেই কাজ কোনো মৌলবি করলে শান্তির দাঁড়কাক সম্মানে ভূষিত হন।

যারা শরিয়তকে প্রত্যাখ্যান করে, যারা ইসলামের একাধিক বিধানকে অস্বীকার করে, যারা ইসলামের সার্বিক রূপের মধ্যে পরিমার্জন করে, যারা হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম ঘোষণা করে, যারা কুফরি মতবাদের প্রতি ইমান রাখে— তাদেরকে মুসলিম মনে করা, তাদের জন্য দোয়া করা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্ক স্থাপন করা যদি মুরজিয়া মতবাদের অংশ না হয়, তাহলে কাদিয়ানিকে বড় আল্লামা স্বীকার করাও মুরজিয়া মতবাদের অংশ নয়। বেরেলবিদেরও তাহলে বেদআত ছাড়া আর কোনো অপরাধ নেই। আসওয়াদ আনসি মুসায়লামা কাযযাবদের মতো মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদারদের ব্যাপারেও এ কথা বলা যায়, হয়তো তাদের কোনো ওযর ছিলো। তাদের সাথে আলোচনা না করে কীভাবে তাদেরকে কাফির বলা যায়! যারা নিজেরা হরহামেশা ইসলামের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করে, যারা নেচে নেচে ইসলামের পিঠে লাথি মারে, যারা খোল্লমখোলা কুফরি মতবাদের প্রতি ইমান প্রকাশ করে ও ইসলামকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ঘোষণা করে, তাদের ব্যাপারেও এ কথা বলা যে, তারা মা’যুর, তারা চাইলেও শরিয়াহ কায়েম করতে সক্ষম নয়, তারা যে খাঁটি ইমানদার এতে কোনো সন্দেহ নেই— এগুলো যদি ইরজা (মুরজিয়া মতবাদ) না হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে বলো, ইরজা কোন রূপকথার গল্প?!

ব্যক্তিবিশেষের তাকফির প্রসঙ্গ বাদই দিলাম, নির্দিষ্ট ধারা ও মতবাদকে তাকফির করতেও কেনো বুক কাঁপে? কেনো কুফরি মতবাদকেও ইসলামাইজেশন করার ভূত মাথায় চাপে? জাতীয়তাবাদ ডেমোক্র্যাসি সেক্যুলারিজমের প্রতি যদি এতো দরদ থাকে, তাহলে মওদুদি মতবাদের ওপর এতো কেনো আক্রোশ? বেচারা মওদুদিকে মুরতাদ-বেদ্বীনদের থেকেও বেশি হেয় করা যাদের আদর্শ, তারা কোন দুনিয়ার ‘আলওয়ালা ওয়াল বারা’য় বিশ্বাসী? জাকির নায়েক কাফির, মওদুদি কাফির— এসব কথা যারা হরহামেশা বলে বেড়ায়, প্রকাশ্য রিদ্দাহয় লিপ্ত ব্যক্তিকে তাকফির করতে তাদের কেনো এতো বুক কাঁপে?

হাঁ, মুরজিয়ারাও খারেজি হয়ে যায় একটা সময়। যখন তাদের স্বার্থে আঘাত আসে, যখন তাদের অস্তিত্ব চাপের মুখে পড়ে, তখন তারাও খারেজি-তাকফিরি হয়ে যায়। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, যারা হকের ওপর রয়েছে, তাদেরকে ট্যাগ লাগানোর ক্ষেত্রেও মুরজিয়ারা খারেজিদের মতো আচরণ করে। আরে, আব্দুল্লাহ বিনা উবাই নামাযও পড়তো, রোযাও রাখতো, হজও করতো, জিহাদেও যেতো, ভালো আলিমও ছিলো— এতোকিছুর পরও তাকে মুনাফিকদের সর্দার অভিহিত করা তোমাদের দ্বিমুখী নীতিকে কলঙ্কিত করে আর তোমাদের অজ্ঞতা-স্বার্থসিদ্ধির মানসিকতাকে পরিস্ফুট করে। তুমি তো অন্যদেরকে বড় মূর্খ ভাবছো, অথচ তুমি নিজে যে কী অতল ভ্রষ্টতা ও নিবিড় অজ্ঞতায় পড়ে আছো— তার বোধটুকুও তোমার নেই। আরে ও পাঞ্জেরি, রাত পোহাবার কতো দেরি বলো, হে পাঞ্জেরি!

ছয়. 

শয়তানের কুফরের ব্যাপারে কখনো ভেবে দেখেছেন কি?

ইবলিস কাফির, চিরঅভিশপ্ত, বিতাড়িত। কে না জানে! সে যে অনেক বড় আলিম-জ্ঞানী ছিলো তাও প্রায় সবার জানা। কিন্তু কেনো কাফির হলো সে? কীভাবে? তার আকিদা তো বলতে গেলে বিশুদ্ধই ছিলো। তার ভেতরে তাওহিদও শতভাগ ছিলো। সে তো বলছেই- আল্লাহ, আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন দ্বারা। ইলমও ছিলো, আকিদাও বিশুদ্ধ ছিলো, তবে বিতাড়িত-চিরঅভিশপ্ত কেনো হলো? কারণ সে আল্লাহর নির্দেশ ও বিধানের সামনে যুক্তি ছুড়ে দিয়েছে। অহংকার প্রদর্শন করেছে। আল্লাহর নির্দেশকে প্রকাশ্যে দম্ভের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে। “আমি কি তাকে সিজদা করবো, যাকে সৃষ্টি করেছেন আপনি মাটি থেকে?!” ব্যস, এতোটুকুই। আর কোনো অপরাধ তো তার ছিলো না। হলো পথভ্রষ্ট। জাহান্নামকে তার ও তার অনুসারীদের দ্বারা পূর্ণ করবেন- এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহামহিম আল্লাহ তাকে সেখান থেকে চিরকালের জন্য বহিষ্কার করে দিলেন।

কোনো অপরাধ সংঘটিত হলেই তো আমরা শয়তানকে দায়ি করি। শয়তানই যদি সবকিছুর হোতা হতো, তবে শয়তানকে কে ধোঁকা দিয়ে বিতাড়িত করলো? শয়তানের থেকেও বড় শত্রুর নাম- নফস। তাই তো রমজানে বেচারা শয়তান বন্দি থাকলেও গুনাহের প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যায় না। হাঁ, কিছুটা লোপ তো পায়ই। আমরা শয়তানকে দুশমন ঠিকই ভাবি। তবে নফসকে তেমন কিছু মনে করি না। তাই নফসের পাগলা ঘোড়াকে সর্বদা লাগামহীন ছেঁড়ে রাখি। পরিণতিতে সে আমাদেরকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। এই নফস কারো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসে গেলে শয়তান কিছুতেই তাকে বিচ্যুত করতে পারবে না ইনশা’আল্লাহ।

দুঃখের বিষয়- ইবলিসের আকিদা বিশুদ্ধ থেকেও সে কাফির। আর আমাদের মৌলবিদের একশ্রেণি গলদ আকিদা নিয়ে, শরিয়তের অপব্যাখ্যা করেও পাক্কা মুমিন। মুলহিদ-যিন্দিক উপাধি লাগা তো দূরের কথা, উপরন্তু হয়ে যান দূরদর্শী বিদগ্ধ আলিমে দীন।

সাত.

শব্দ তো ভেতরের আকিদাকে প্রকাশ করে। আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে শব্দের গায়ে। কেউ যদি বলে, মহামান্য ফেরাউন মাননীয় হামানের সাথে মহান যাদু দেখার জন্য প্রাসাদ থেকে বেরোলেন অথবা মাননীয় শয়তানের নির্দেশে মহামান্য আবু জাহল মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মহান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন – এ ধরনের বাক্য হয়তো বিশেষ প্রেক্ষাপটে উপহাস এবং তাচ্ছিল্য ধারণ করবে, নতুবা ফেরাউন হামান মালউন শয়তান আবু জাহল ও হারাম কাজের প্রতি কথকের অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করবে। শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সচেতনতা অপরিহার্য একটি বিষয়। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” – কয়েকটি শব্দ ব্যক্তির ইমানের সাক্ষ্য বহন করে, তেমনি “আমি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতিয়তাবাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছি” একগুচ্ছ বাক্য ব্যক্তির সুপ্ত নিফাক ও ইলহাদ প্রকাশ করে এবং তা তার কুফরের স্বীকারোক্তি হিসেবে ধর্তব্য হতে পারে। হেকমত এবং মাসলাহাত কখনো কুফর শিরক ও খোদাদ্রোহের প্রতি শ্রদ্ধা আস্থা ও ভালোবাসা প্রকাশের অনুমতি দেয় না। 

আট.

মুনাফিকদের ব্যাপারে আমাদের সমাজে আলোচনা হয় না বললেই চলে। মসজিদের মিম্বার থেকেও প্রায়শই আমরা শুনি সুন্নাত-মুস্তাহাব পর্যায়ের বিষয়গুলোর আলোচনা। অবশ্যই তাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার অবস্থান নিশ্চয়ই শরিয়তের মৌলিক বিষয়গুলোর পরে। তাই একই বয়ান শুনতে শুনতে মানুষ বার্ধক্যে পৌঁছে যায়, অথচ শরিয়তের মৌলিক অনেক বিষয়ই তার অজানা রয়ে যায়। মুনাফিক প্রসঙ্গেও যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞানার্জন করা ও জনসাধারণকে তা অবগত করা অত্যন্ত জরুরি। কেনো?!

আল্লামা ইবনুল কায়্যিমের মাদারিজুস সালিকিন কিতাবের একটি ইবারত এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক-
كاد القرآن أن يكون كله في شأنهم.
মনে হয়- পুরো কোরআন বুঝি মুনাফিকদের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছে।
[মাদারিজুস সালিকিন- ১/৩৫৮]

মদিনায় অবতীর্ণ সুরাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে যে কেউ একথা বলতে বাধ্য হবে, এসব সুরার বিস্তর অংশ জুড়ে প্রতিভাত হয়েছে এই মুনাফিক গোষ্ঠীর আলোচনা। আল্লাহ তাআলা খুলে খুলে তাদের স্বরূপ, তাদের গুনাগুণ, তাদের অপকৌশল ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। সুরা বাকারায় তাদের অন্তরের ব্যাধি ও মুমিনদের সাথে দাগাবাজির বর্ণনা দিয়েছেন। সুরা আলে ইমরান তাদের অস্থিরতা ও মুমিনদেরকে যুদ্ধে যেতে বারণ করার কথা, সুরা নিসায় আল্লাহ ও তার রাসুলের ফায়সালা থেকে বিমুখ হওয়ার কথা, সুরা মায়িদায় কাফির গোষ্ঠীর সাথে তাদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের (আলওয়ালা/মুওয়ালাত- এর) কথা, সুরা আনফালে আল্লাহ তার দীনকে বিজয়ী করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাদের সংশয় পোষণের কথা, সুরা তাওবায় তাদের জিহাদ থেকে পলায়ন করা, মুমিনদেরকে দোষারোপ করা এবং তাদের ওপর অপবাদ আরোপের কথা, সুরা হজে তাদের অবিচলতার স্বল্পতার কথা, সুরা নুরে দীনের যে অংশটুকু তাদের মন:পুত হয় শুধু তা গ্রহণ করার কথা, সুরা আনকাবুতে তাদের অধৈর্যের কথা, সুরা আহযাবে আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কথা, সুরা মুহাম্মাদে তাদের ভীরুতার কথা, সুরা ফাতহে আল্লাহর ব্যাপারে তাদের মন্দ ধারণার কথা, সুরা হাদিদে তাদের পার্থিব সাধ-স্বপ্নে প্রবঞ্চিত হয়ে যাওয়ার কথা, সুরা মুজাদালায় তাদের মিথ্যা শপথ করার কথা, সুরা হাশরে তাদের দুর্বল হয়ে যাওয়া মিত্রের লাঞ্ছনা বরণের কথা, সুরা মুনাফিকুনে আল্লাহ ও তার রাসুলের সাথে তাদের বেয়াদবির কথা, সুরা তাহরিমে তাদের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বনের কথা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে মহাপবিত্র আলকোরআনে।

পুরো সতেরোটি সুরা জুড়ে তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সবিস্তারে তাদের গুনাগুণের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আমি তো উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি দিক উল্লেখ করলাম মাত্র। গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে এবং আরো ভালো করে লক্ষ করলে আপনি আলকোরআনের পাতায় পাতায় তাদের বর্ণনা দেখতে পাবেন। আলকোরআন তো কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের জন্য হেদায়াত। শুধু সাহাবাযুগের সাথে তা বিশেষিত নয়। তবে মুনাফিকদের আলোচনা এতো সবিস্তারে কেনো করা হলো?

আল্লাহ বলছেন-
((وكذلك نفصل الآيات ولتستبين سبيل المجرمين)).
এভাবেই আমি বিশদভাবে আয়াতসমূহকে উল্লেখ করি, যাতে অপরাধীদের অবস্থান ও পথ সুস্পষ্ট হয়ে যায়।
((هم العدو فاحذرهم))
ওরাই (মুনাফিকরাই) শত্রু। তাই ওদের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো।

মুনাফিকদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সাহাবিগণ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তিরস্কার করে বলেন-
((فما لكم في المنافقين فئتين والله أركسهم بما كسبوا))
হলো কী তোমাদের! মুনাফিকদের ব্যাপারে তোমরা দু’ভাগে বিভক্ত! অথচ আল্লাহ তাদেরকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন তাদের কৃতকর্মের কারণে।
আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিচ্ছেন-
((يا أيها النبي جاهد الكفار والمنافقين واغلظ عليهم))
হে নবি, কাফির এবং মুনাফিকদের সাথে লড়াই চালিয়ে যান। ওদের ব্যাপারে কঠোর থাকুন।
((ولا تطع الكافرين والمنافقين))
কাফির এবং মুনাফিক গোষ্ঠীর আনুগত্য করবেন না।
রাসুলুল্লাহ সা. বলছেন-
((إن أخوف ما أخاف على أمتي من بعدي منافق عليم اللسان)). صححه الهيثمي.
আমার পরে আমার উম্মতের ব্যাপারে যে বিষয়গুলোকে ভয় হয় তার মধ্যে ভয়ংকরতম হচ্ছে বাকপটু মুনাফিক। [মুসনাদে আহমদ]

কেননা এ প্রকারের মুনাফিক, তার বাকপটুতা দ্বারা হককে বাতিলে পরিণত করে এবং বাতিলকে সহজেই হকের আবরণ পরিয়ে জনসমক্ষে উপস্থাপন করে। নিফাক যেহেতু অন্তরের বিষয়, তাই বাহ্যিক শুভ্র লেবাস-পোশাক দেখে মানুষও তাকে বড় আলিম ভেবে ভুল করে বসে। যার ফলে তার ভক্ত-অনুসারীদের দুনিয়া-আখিরাত সবই বরবাদ হয়ে যায়। সে তার বক্তব্যকে কোরআনের আয়াত ও হাদিস দিয়ে সুসজ্জিত করে উপস্থাপন করে। তার চমকপ্রদ জালে মানুষ খুব দ্রুতই ফেঁসে যায়। সাধারণ মানুষের পক্ষে তো আর তার অপকৌশল এবং আয়াত-হাদিসের অপব্যাখ্যা বোঝাটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তারা ব্যক্তি থেকেই হক গ্রহণ করে। হকের আলোকে ব্যক্তির প্রতিটি কথা মাপার যোগ্যতা তারা পাবে কোথায়! বাকপটু বিদগ্ধ মুনাফিকদের অপপ্রয়াসের স্বরূপ আল্লামা ইবনুল কায়্যিমের ভাষায়-
(وكم عموا عيون موارده بآرائهم ليدفنوها ويقطعوها)

পরিশেষে আলিম পাঠকদের জন্য তাঁর পুরো বক্তব্য উদ্ধৃত করে আজকের পর্বের ইতি টানছি-
قال ابن القيم: (فإن بلية الإسلام بهم (بالمنافقين) شديدة جدا لأنهم منسوبون إليه وإلى نصرته وموالاته وهم أعداؤه في الحقيقة، يخرجون عداوته في كل قالب يظن الجاهل أنه علم وإصلاح وهو غاية الجهل والإفساد. فلِلَّه كم من معقل للإسلام قد هدموه! وكم من حصن له قد قلعوا أساسه وخربوه! وكم من علم له قد طمسوه! وكم من لواء له مرفوع قد وضعوه! وكم ضربوا بمعاول الشبه فى أصول غراسه ليقلعوها! وكم عموا عيون موارده بآرائهم ليدفنوها ويقطعوها! فلا يزال الإسلام وأهله منهم فى محنة وبلية. ولا يزال يطرقه من شبههم سرية بعد سرية. ويزعمون أنهم بذلك مصلحون! ألا إنهم هم المفسدون ولكن لا يشعرون) (مدارج السالكين-الجزء الأول ص347-348)

নয়. 

রাসুলুল্লাহ সা.এর ওফাতের পরে বাহ্যত মুনাফিক চেনার কোনো উপায় বাকি থাকেনি। নিফাক তো অন্তরের বিষয় আর অন্তরের খবর তো আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আল্লাহ তাআলা ওহি মারফত রাসুলুল্লাহ সা.কেও মুনাফিকদের ব্যাপারে জানিয়েছিলেন। হাদিসে কিছু আমলকে নিফাক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু কেউ এসব আমল করলেই সুনিশ্চিতভাবে তাকে মুনাফিক বলা যাবে না। যেমন মুনাফিকদের একটা আলামত হলো— যখন কথা বলবে মিথ্যা বলবে। এবার দেখুন— এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা সমাজে কতো! এই কাজগুলো মুনাফিকের কাজ, মুমিনের কাজ নয়। তাই বলে কেউ তা করলেই ইমানহারা হয়ে মুনাফিকের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে না। বিষয়টির জঘন্যতা ও ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য সেটাকে নিফাক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহর ওফাতের পরে যেহেতু ওহি আসার ধারা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে, তাই ভেতরে কুফর ও নিফাক লালনকারী মুনাফিক চেনার পথও রুদ্ধ হয়ে আছে। হাঁ, কেউ যদি এমন আমলে লিপ্ত থাকে, যা তার ভেতরে লুকায়িত কুফর ও নিফাকের প্রমাণ বহন করে তার কথা ভিন্ন। তাই মুনাফিকের একটি প্রকার চিণ্‌হিত করা এখনও সম্ভব। তা কীভাবে এবং তারা কারা?

ইমাম মালিক রহ. বলেন—
المنافق في عهد رسول الله هو الزنديق اليوم.
রাসুলুল্লাহর যুগের মুনাফিকই আজকের যিন্দিক।
[দ্রষ্টব্য— তাফসিরে ইবনে কাসির, সুরা বাকারা- ১০ আয়াতের তাফসির এবং উমদাতুল কারি]

অর্থাৎ— রাসুলুল্লাহর ওফাতের পরে যখন কারো অন্তরে সুপ্ত কুফর এবং নিফাক জানা অসম্ভব হয়ে পড়লো, তখন নিফাকের একটা প্রকারই বাকি থাকলো, যা পাওয়া গেলে ব্যক্তিকে সুনিশ্চিতভাবে মুনাফিক বলা যায়। আর তা হলো— ইলহাদএবং যানদাকা

ইলহাদ-যানদাকা কী?

ইসলামের দাবিদার এবং শরিয়তের অনুসারী হয়েও কোনো কুফরি আকিদা রাখা অথবা যরুরিয়্যাতে দীনের কোনো বিষয়ে উম্মাহর ইজমায়ি (সর্বসম্মত) ব্যাখ্যার পরিবর্তে নতুন কোনো ব্যাখ্যা দেয়া, অপর ভাষায়— বাতিল তাওয়িল করে শরিয়তের কোনো বিধানের অপব্যাখ্যা করা।

উল্লেখ্য— বাতিল তাওয়িল মূলত তাওয়িল নয়, বরং তা তাহরিফ।
এ-দু’য়ের পার্থক্য সবিস্তারে জানতে মুফতি শফি রহ. রচিত ”ইমান ও কুফর” গ্রন্থটি দেখতে পারেন।

মুনাফিক মূলত আলাদা কিছু নয়। বাস্তবে ভাগ দুটোই— ইমান এবং কুফর। কুফরের নিম্নতর স্তরের নাম হলো নিফাক। এই মুনাফিকরা জাহান্নামের সবচে নিম্নস্তরে বাস করবে। সাধারণ কাফিরদের থেকেও তাদের শাস্তি সুকঠিন হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়— বর্তমান সময়ে ইসলামের দাবিদার ও শরিয়তের অনুসারী মানুষদের অবস্থা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে যে কোনো বোদ্ধা বোধহয় একথা বলতে বাধ্য হবেন— ইলহাদের বাজার এখন অনেক গরম। মুলহিদ ও যিন্দিকের সংখ্যা একেবারে কম নয়। কারো ভেতরে ইলহাদ থাকলে তার কালিমা এবং নামায, তার লেবাস ও পোশাক, তার ভক্ত ও অনুরক্ত— কেউ এবং কোনোটাই তাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচাতে পারবে না। তওবা নসিবে না জোটলে জাহান্নামই হবে তার চিরস্থায়ী আবাসস্থল।

Share This