ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিকদের ইসলাম :

১. সমগ্র পৃথিবীর মুসলিম এক জাতি। দেশভিত্তিক জাতীয়তা ইসলামসম্মত নয়। যার কারণে মুসলমানদের নিয়ে ভাবলে গোটা মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে ভাবা উচিত। শুধু নিজ দেশের মুসলিমদের নিয়ে ভাবা ও বাকি সবাইকে ভুলে থাকা জাতীয়তাবাদী মানসিকতার পরিচায়ক। যেহেতু গণতন্ত্রের মূলনীতি অনুসারে জনগণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস, তাই গণতান্ত্রিকরা এই উৎস থেকে ক্ষমতা আহরণ করতে চায়। এরপর সেই রাষ্ট্রের জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে চায়।

২. গোটা পৃথিবী এখন একটা গ্রামের মতো। এক্ষেত্রে গ্লোবাল ভিলেজ শব্দটা বেশ পরিচিত। পুরো পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। যুগের হোবল আমেরিকা এই পৃথিবীর প্রভু সেজে আছে। চীন ও ভারতসহ আরও কিছু রাষ্ট্রও নির্দিষ্ট পরিসরে সাপের মাথা’র ভূমিকা পালন করছে। এমতাবস্থায় আলাদাভাবে পৃথিবীর কোনো একটা দেশের মধ্যে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা সীমাবদ্ধ রাখা অতীতের চেয়েও অধিক নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। কারণ, এই অবস্থায় নির্দিষ্ট একটা সীমা ও সীমানার বাইরে দীন কায়েম করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মুরসি বা জিয়াউল হকরা এই সীমা অতিক্রম করতে গেলে তাদেরকে আর বাঁচতে দেওয়া হয় না। এরদোগানরাও যতটুকু করেছে, এর বাইরে খুব বেশিদূর যাওয়া তাদের জন্য সম্ভব নয়। এ যুগে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে উন্নতি করা নয়; বরং পায়ে দাসত্বের শৃঙ্খল লাগিয়ে নেওয়া।

৩. রাষ্ট্রে বিভিন্ন হারাম কাজের সয়লাব দেখা যায়। কিন্তু সমস্যার মূল তো হলো একেবারে গোড়ায়। ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিকরা দিবাস্বপ্নের মতো করে কখনো যদি ক্ষমতা পেয়েও যায়, তারা কি পারবে সিস্টেমকে আমুল পরিবর্তন করতে? তারা কি পারবে সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত চার কুফরি মূলনীতি রদবদল করতে? তারা কি পারবে ‘হাকিমিয়্যাহ’ একমাত্র আল্লাহকে দিতে? তারা কি পারবে কুরআন ও সুন্নাহর বিচারব্যবস্থা জারি করতে? তারা কি পারবে সর্বস্তরের জনগণের সমমর্যাদা দূর করে মুমিনদের সঙ্গে ‘আল-ওয়ালা’ এবং কুফফারের সঙ্গে ‘আল-বারা’ কায়েম করতে? তারা কি পারবে ‘কুফর বিত তাগুত’ তথা আন্তর্জাতিক তাগুতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন করতে? তারা কি পারবে ই’দাদ এবং আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক কিতালের মাজলুম ফরজ ফিরিয়ে আনতে? তারা কি পারবে পার্শ্ববর্তী মাজলুম মুসলমান জাতিগোষ্ঠীর প্রতি প্রকাশ্য সহযোগিতা দিতে? তারা কি পারবে মৌলিক ক্ষেত্রগুলোতে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম বাস্তবায়িত করতে? তারা কি পারবে বিচারালয় ও মন্ত্রণালয় পুরোপুরি আলিম ও ফকিহদের দ্বারা পরিচালিত করতে? তারা কি পারবে কুরআনকে টেনেটুনে যুগের অনুগামী না করে যুগকে কুরআনের অনুগামী করতে? দেশে দেশে তাদের বাপদাদারা কোনোকালে পেরেছে কি? আধুনিক গণতন্ত্রের উত্থানের পরে তাদের তত্ত্ব কখনো কোথাও বাস্তবতার চেহারা দেখেছে কি?

৪. কোনো ইসলামপন্থী সরকার গণতান্ত্রিক পন্থায় নিজ দেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম বাস্তবায়িত করলে সাপের মাথারা কি বসে বসে আঙুল চুষবে? তারা তো কোনোভাবেই এই সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে দেবে না। এমনকি সরকারপ্রধান গুপ্তহত্যা বা গুমের শিকার হওয়ার শঙ্কাও একেবারে অমূলক নয়। ইতিহাসে এর প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর সাধারণ জনগণ সবাই যদি তাদের সাপোর্টও দেয়, যদিও বাহ্যদৃষ্টিতে এটা অসম্ভব, তাহলেও গোটা দেশের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধের পরিণাম কী হবে? এরকম জনভূমি-পরিবেষ্টিত দেশে লাগাতার বোমা হামলা ও আকাশপথ থেকে বর্ষিত বিস্ফোরকের নির্মম আঘাতে এটা কি আরেক সিরিয়ায় পরিণত হবে না? আমেরিকা বা ভারতের ওয়ার অন টেররের মোকাবিলা করার সদিচ্ছা বা শক্তি কোনোটিই কি এদের আছে? এরা শাপলা চত্বরেই গোটা জাতিকে অজানা ভবিষ্যতের সামনে ফেলে শিয়ালের মতো রাতের আঁধারে আত্মগোপনের চাদর গায়ে জড়াতে পারে। সারাজীবন কিতালের বিরোধিতা করে শেষাবধি এরাই কিতালের পথে হাঁটবে, এটা ভাবলেও তো খিলখিলিয়ে হাসি পায়। আদৌ কি তা সম্ভব? ই’দাদ বর্জনকারী ও তাগুতকে অদৃশ্য বাইয়াত প্রদানকারী জাতি কিতাল করবে বিশ্বের পরাশক্তিদের বিপক্ষে, এটাও কি কোনোদিন বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে?

৫. গণতান্ত্রিকরা মূল কুফরগুলোকে আপন অবস্থায় রেখে যদি শাখাগত কিছু সংশোধনের কাজ চালায় এবং এভাবেই জীবন কাটায়, তাহলে এটা কখনোই ইসলামি ইমারাহ নয়। গাছের শিকড় উৎপাটিত অবস্থায় রেখে ডালে ডালে পানি সিঞ্চন করে ফল-ফুলের আশা করা বোকামি বৈ কী! এ তো কেমন যেন সোনার হরিণ বা আলেয়ার আলো। আর তারা যদি গণঅভ্যুত্থান/গণবিপ্লব ঘটিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম কায়েমের ঘোষণা দিয়েই বসে আর সরকারি বাহিনীগুলোকে মুজাহিদ বাহিনীতে রূপান্তরিত করে ফেলে, তাহলে দেশে সৃষ্টি হবে যুদ্ধবিগ্রহের পরিস্থিতি। কৌশলে গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর আশঙ্কাও ফেলে দেওয়া যায় না। আর গুপ্তহত্যা, গুম, খুন, গ্রেফতার ইত্যাদি তো আছেই। ইসলাম এসেছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। অকস্মাৎ দেশ চলে যাবে এমন অশান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখে, যা সামাল দেওয়ার শক্তি তাদের নেই। উপরন্তু এখানকার মুসলমানদের কোনো সেইফ জোন না থাকায় তাদের প্রাণহানির আশঙ্কাই প্রবল। তিন দিকে ভারত আর একদিকে বঙ্গোপসাগর রেখে তবে কি কবরস্থানে ইসলাম কায়েম করা হবে? আফগান ছিল সাম্রাজ্যবাদের গোরস্থান, আর এটা কি হবে বাংলাদেশি মুসলিমদের সমাধিস্থান? উপরন্তু দেশের সশস্ত্র বাহিনী বা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো তো দাদাদের অদৃশ্য ইশারায় পরিচালিত হয়। এরা আপনার পক্ষ হয়ে কিতালে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এটাই বা আপনি কীভাবে ভাবলেন? যেহেতু এদের মানসজগৎ ইসলামের আদলে গড়ে ওঠেনি, তাই প্রথমে এরাই অন্যদের ইঙ্গিতে আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, আপনার ওপর তাদের জমানো শক্তি প্রয়োগ করবে, বাহ্যদৃষ্টিতে এর সম্ভাবনাই তো প্রবল মনে হয়। তো সে সময় আপনারা কি সরকারি বাসভবন ছেড়ে কোনোপ্রকার পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া রাতারাতি গেরিলা কমান্ডো বাহিনীতে রূপান্তরিত হবেন? এরপর ক্ষমতা দখলকারী শাসকদের বিরুদ্ধে কিতাল করবেন?

৬. একটা খিলাফাহরাষ্ট্রের কথা বাদই দিলাম, একটা ইমারাহরাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হয় এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় তা কীভাবে সম্ভব, এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তরই তো এসকল গণতন্ত্রপূজারীদের কাছ থেকে কখনো মেলে না। হয়তো-বা তারা নিজেরাও এর সম্ভাব্যতা ও রূপরেখা সম্পর্কে কিছুই জানে না।

Share This