মানুষ কেন যে নিজের ব্যাপারে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রাখে, আমার বুঝে আসে না। আলিম হবে সত্য প্রকাশে অকুতোভয়। যার স্বার্থেই আঘাত লাগুক না কেন, আলিম হক কথা বলবেই। এরপরও যারা অন্যদের ভুল ধরতে সিদ্ধহস্ত, নিজেরা কেন সেসব ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেন না? সবাইকে কেন একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে রাখা হয়?

এই পৃথিবীতে কেউই কারও মতো নয়। হাজারো মতভিন্নতা নিয়ে মানুষ ঠিকই এগিয়ে চলছে। শাইখ কারজাবি এত এত উদ্ভট ফাতওয়া দিয়ে চলছেন, আরও কত শাইখ মডার্নিজমের প্রসার ঘটাচ্ছেন, সেগুলো নিয়ে সাইনবোর্ডধারীদের বিবৃতি দেখা যায় না। এ দেশীয় মুলহিদদের নিয়েও তারা প্রকাশ্যে জনসমক্ষে মন্তব্য করেন না। একরকম আড়াল করে রাখেন নিজেদেরকে। বিভিন্ন পিরের সীমালঙ্ঘন নিয়েও মুখ খোলেন না। রাষ্ট্র, সংবিধান, আইনকানুনের ব্যাপারে তারা নির্লজ্জের মতো নীরব থাকেন। যা বললে পেট বা পিঠের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, হিকমাতের দোহাই দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা না বলে থাকেন। হ্যাঁ, তারা সব আক্রোশ ঝাড়েন শুধু মানহাজিদের বিরুদ্ধে। তবে কি ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ নীতি এ ক্ষেত্রে কার্যকর? আর ভুল ধরলেই তো কাজ শেষ হয়ে যায় না। সঠিকটাও প্রামাণিকভাবে দেখিয়ে দিতে হয়। কিন্তু এটা তো হতে দেখা যায় না।

যারা নিজেদের নফসের পরিশুদ্ধি করেছে এবং যারা কিতাল ফি সাবিলিল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে এমন সুগভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেন, যা পৃথিবীতে আর কেউ পায় না। হেকমতিরা দিনভর অহং প্রদর্শন করলেও, কিছু মুখস্থ বুলি আওড়ালেও তাদের জ্ঞান যে সুগভীর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তা সময়ে সময়ে প্রকাশ পেয়ে যায়। মধ্যপন্থার শিরোনামের আড়ালে তাদের প্রান্তিক চিন্তা সবার চোখে ধরা দেয়। কাশ্মীরি রহ. বড় সুন্দর বলেছেন, অনেক আয়াত ও হাদিসের ব্যাখ্যা মুফাসসির ও মুহাদ্দিসদের চাইতে সুফিরা বড় সুন্দর করে পেশ করেছে।

মূর্খরা যদি একবার ইকফারুল মুলহিদিন পড়ে দেখত তাহলে কাশ্মীরি রহ.-কে তাকফিরি বলত। তাকবিয়াতুল ঈমান পড়লে শাহ ইসমাইল শহিদকে ওয়াহাবি/সালাফি বলত। নদবি রহ.-এর মানহাজ রিলেটেড কিতাবগুলো পড়লে তাকে মানহাজি বলত। মনজুর নুমানি, ইউসুফ লুধিয়ানবি, রশিদ আহমদ লুধিয়ানবি ও যুবায়ের আহমাদ সিদ্দিকিকে ভালো করে পড়লে বা সামিউল হক হক্কানি, শাইখ আবদুল্লাহ শহিদ, গাজি আবদুর রশিদ শহিদ, গাজি আবদুল আজিজ প্রমুখকে ভালো করে জানলে তাদেরকে অতি জযবাতি বলত।

মানুষ কথায় না পারলে তেড়ে আসে। সময় তো কম হলো না। এতকাল বসে তারা দালিলিক আলোচনায় না গিয়ে পেরেছে শুধু অহং প্রদর্শন করতে আর গালাগালি ও তাচ্ছিল্য করতে। অথচ এরচে কম কথায় তারা দালিলিক আলোচনা সেরে ফেলতে পারত। তারা এখন গোটা অনলাইনের বিরুদ্ধেই সরব। অথচ বেচারা অনলাইন কী দোষ করল! কেউ যদি অনলাইনে তাদের আর্টিকেল বা ম্যাগাজিন পড়ে তাহলে সে হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে আর কেউ যদি তারা ছাড়া অন্য কারও লেখা পড়ে তাহলে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে – এ কেমন নীতি! নিজে ফেসবুকে বসে অন্যদেরকে ফেসবুক থেকে জ্ঞান অর্জন করতে নিষেধ করে। অথচ এর ফল যে এই দাঁড়াচ্ছে, খোদ তার শাইখও যদি কাগজের পাতায় কিছু লিখে দেয়, সেটা গৃহীত হবে আর একই মানুষ যদি কাগজের পাতায় না লিখে ফেসবুকের পাতায় লেখাটি প্রকাশ করে, তাহলে অগৃহীত হবে – এটা তারা ভাবে না। নিশ্চয়ই এ তো বড় হাস্যকর নীতি।

যারতার থেকে জ্ঞান নেওয়া যায় না। কিন্তু যার থেকে জ্ঞান নেওয়া যায়, সে অফলাইনে জ্ঞান বিতরণ করলেও যেভাবে নেওয়া যাবে, অনলাইনে করলেও তা একইভাবে নেওয়া যাওয়াই যুক্তির দাবি। অনলাইন একটি মাধ্যম; যা মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করে দিয়েছে। অফলাইনে মানুষ আপনার ব্যাপারে ধোঁয়াশায় থাকলেও অনলাইনে আপনার কাপড় খুলে যাচ্ছে, তাই তার বিরুদ্ধে সব ক্ষোভ উগড়ে দেওয়া তো কোনো বুদ্ধিমত্তার কথা নয়।

শুনুন, আপনি খোদা নন। আপনি নবিও নন। আপনার কথা ওহি নয়। আপনি ব্যক্তি হিসেবেও নিঃশর্ত অনুসরণীয় নন। আপনি বলেছেন – কেবলই এই যুক্তির ভিত্তিতে কোনো কথা গ্রহণীয় হয়ে যাবে না। আপনি যা বলার, দলিল-প্রমাণের সঙ্গে বলুন। যদি আপনার কথা হকই হয়ে থাকে তাহলে হকের ওপর তো নুর থাকে। আজ হোক আর কাল, মানুষ আপনার মত গ্রহণ করে নেবেই। গায়ের জোরে উম্মাহকে নিজের মত গিলানোর প্রয়াস সুন্দর নয়। সবক্ষেত্রে দলিল-প্রমাণের ফুলঝুরি ছড়ালেও এ ক্ষেত্রে মানুষকে কেন অন্ধত্বের দিকে ডাকছেন! বিপরীত পক্ষের মানুষেরা যদি ভুলের ওপরই থাকে তাহলে তাদের ভুলের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে বলতে এত ভয় কিসের? ট্যাগ খাওয়ার ভয়? খ্যাতি হারানোর ভয়? এভাবে আর যা হোক, অন্তত ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না।

আর মনে রাখবেন, অপবাদ দিয়ে, মিথ্যাচার করে সাময়িকভাবে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যায়। কিন্তু যখন সত্য প্রকাশিত হয়, আর সত্য তো প্রকাশিত হয়েই থাকে, তখন পরিণামে লজ্জা ও ঘৃণা ছাড়া নসিবে আর কিছু জোটে না। সাময়িক আনন্দের জন্য স্থায়ী নিরানন্দ ডেকে আনা শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়।

আজকাল পৃথিবীটা হাসির পাত্র হয়ে গেছে। এখানে মাজহুল (অজ্ঞাত) এসে মাজহুলের বিরুদ্ধে বলে। ফেইক আইডি এসে ফেইক আইডির বিরুদ্ধে বিবৃতি ছাড়ে। ‘শুনেছি’, ‘বলা হয়েছে’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে নিজের কথাকে ওহির মতো অকাট্যতার মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। মাছে-ভাতে বাঙালি। তাই বাহ্যিক লেবাস ধারণ করে দীনদার সাজলেও কাজেকর্মে হিংসা লালন ও বিদ্বেষ পোষণের মানসিকতা ছাড়তে পারে না। কারও উন্নতি দেখতে পারে না। একমাত্র নিজেকে ভাবে মাসুম আর বাকি সবাইকে নির্বোধ। তাই তো তার পক্ষে যারা সাফাই গায়, তারাই হয় একমাত্র জ্ঞানীগুণী। আর যারা তার সঙ্গে ন্যূনতম ভিন্নমত পোষণ করে, তারাই হয়ে যায় দালাল, অন্ধভক্ত বা মুরিদান। যে অহংকারের কারণে ইবলিস ধ্বংস হলো, আজকালকার সাধুরাও সেই একই জিনিস ধারণ করে নিজেদেরকে ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে তাড়িত করছে। মানুষ আজকাল অন্যের চিন্তায় চিন্তায় (!) নিজের আখিরাতের ফিকিরও ভুলে বসেছে। কেউ তাই আখিরাতের কথা স্মরণ করালেও প্রত্যুত্তরে বিদ্রূপের হাসি হাসতে শুরু করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যারা আল্লাহর দীনের জন্য সহিহ পন্থায় কাজ করে, আমি নিজেকে তাদের পায়ের ধুলার সমানও মনে করি না। কখনো যদি নিরেট শাখাগত বিষয়ে তাদের কোনো বিষয়ের সমালোচনা করি, তা-ও একমাত্র সংশোধনের সদিচ্ছায়। কারণ, মানুষমাত্রই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে এর অর্থ কখনোই এ নয় যে, আমি তাদেরকে শত্রু মনে করি, তাদের প্রতি দ্বেষ লালন করি বা তাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পছন্দ করি। এমনকি যেকোনো সময় তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেও চেয়ার তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে নিচে বসার ইচ্ছা লালন করি। আল্লাহর দীনের খাদেমদের জুতো বহন করার বরকতেও আল্লাহ যদি আমাকে কবুল করেন, সেটাই তো আমার জন্য সফলতা।

আমি কখনোই তোষামোদের পক্ষপাতী নই। মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসায়ও বিশ্বাসী নই। এমনকি কারও কারও সাধারণ প্রশংসাও এড়িয়ে যাওয়াকে উত্তম মনে করি। তবে নাহি আনিল মুনকারের স্বার্থে হয়তো তার কোনো কাজের বিরোধিতা করি। তবে এর অর্থ এটা নয় যে, আমি কুফফারকে বাদ দিয়ে মুসলমানদেরকে দুশমন হিসেবে গ্রহণ করেছি। তা ছাড়া সব সমালোচনা যে অনলাইনে হয়, তা-ও নয়। অধিকাংশ বিষয় সরাসরি আলাপনেই সমাধা হয়ে যায়। অনলাইনে যেগুলো আসে, সেগুলো হয়ে থাকে একান্তই অপারগতার বিষয়; যা সাধারণত অনলাইনে না আসলেই নয়।

আমার লেবাসের অসংখ্যজন আমার বিরুদ্ধে অহর্নিশ চক্রান্তে লিপ্ত থাকলেও আমি তাদেরকে সেই কথাই বলব, যা আদম আ.-এর সৎ পুত্র তার ভাইকে বলেছিল, ‘যদি তুমি আমাকে হত্যা করার জন্য আমার দিকে তোমার হাত প্রসারিত করো তবুও আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দিকে আমার হাত প্রসারিত করব না। আমি তো জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’

হ্যাঁ, আমাদের ইখতিলাফ যে সর্বদা সব ধরনের শিষ্টাচার রক্ষা করে করা সম্ভব হয়, বিষয়টা তা নয়। বাড়াবাড়ি হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। পিচ্ছিল পথে হাঁটতে গেলে মানুষ হঠাৎ হোঁচট খায়। এ ক্ষেত্রেও বিষয়টা ভিন্ন নয়। এ জন্য আমরা সর্বদা মহান সাহাবির মতো বলি, আমাদের যা কিছু কল্যাণকর, তা আল্লাহর পক্ষ হতে। আর যা কিছু অকল্যাণকর, তা নফস ও শয়তানের পক্ষ হতে। সর্বোপরি সমালোচিত যেমন ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, সমালোচনাকারীও তা নয়। হ্যাঁ, দীনের ক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় দিতে বা বাতিলের সঙ্গে আপস করতে রাজি নই। এতে কারও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে হোক, তাতে ন্যূনতমও পরোয়া নেই। ভালোবাসা যেমন আল্লাহর জন্য, ঘৃণাও একমাত্র তাঁর জন্য। মেলবন্ধন যেমন আল্লাহর জন্য, বিচ্ছিন্নতাও একমাত্র তাঁরই জন্য। গুণ গাওয়াও যেমন আল্লাহর জন্য, ভুল ধরাও একমাত্র তাঁরই জন্য।

কোনো আলিমের প্রতি, কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের প্রতি আমাদের কোনো বৈরিতা নেই। কারও প্রতি ব্যক্তিগত শত্রুতা ও দ্বেষ নেই। হ্যাঁ, যারা নিজেদের আদর্শ পরিত্যাগ করেছে বা বাতিলের রঙে রঙিন হয়েছে, আমরা দীনের স্বার্থেই তাদেরকে পরিত্যাগ করি, তাদের বিরুদ্ধাচারণ করি এবং তাদের ব্যাপারে জনসাধারণকে সতর্ক করি। তবে তারা যদি আবারও কখনো সঠিক আদর্শের পথে ফিরে আসে তাহলে তারা আমাদের ভাই ও সুহৃদ। আমরা তখন তাদের সঙ্গে তেমন আচরণই করব, যেমন অন্যান্য হক্কানি আলিমদের সঙ্গে করে থাকি।

সর্বশেষ একটা অপ্রাসজ্ঞিক বিষয় টেনে এই পোস্টের ইতি টানছি। অধিকাংশের বিরক্তি উদ্রেককারী এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জনগণ অনুগ্রহকারী। কারণ, তারা রোহিঙ্গা মুহাজিরদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এ অঞ্চলের আলিম-তালিবে ইলম থেকে শুরু করে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম পুরুষ অপরাধী। কারণ, তারা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের ওপর আরোপিত একটি ফরজে আইনকে অগ্রাহ্য করেছে।

Share This