এক মাজলুম মাওলানা

আল্লাহর রাসুলের মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। রাসুল মিষ্টি খেয়েছেন, তাই আমরা মিষ্টি খাব। রাসুল তায়েফে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, তাই আমরা নির্যাতিত হব। এভাবেই শান্তিকামিতার মূলনীতিকে ঠিক রেখে আমরা প্রিয় রাসুলকে অনুসরণ করে যাব। যেখানে এই মূলনীতি ব্যাহত হবে, সেখানে রাসুলের জীবনের সে-সংক্রান্ত অধ্যায়কে স্রেফ বইয়ের পাতার মধ্যেই এঁটে রাখাব অথবা তার অপব্যাখ্যা করে ভিন্ন কোনো প্রয়োগক্ষেত্রে প্রয়োগ করব।

রাসুল সা. তখন হুদাইবিয়ায়। খবর পেলেন উসমান রা.-কে তাগুতের দোসররা বন্দী করে ফেলেছে; এমনকি তার রক্তে নিজেদের হাত রঞ্জিত করেছে। রাসুলুল্লাহ সা. তখন সাহাবিদের একত্রিত করে সকলের কাছ থেকে বাইয়াত নিলেন। আল্লাহ সে প্রসঙ্গে বলেছেন, যারা আপনার কাছে বাইয়াত দিচ্ছে, তারা তো আল্লাহর কাছে বাইয়াত দিচ্ছে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর। যে এই বাইয়াতকে ভঙ্গ করবে, সে তার নিজেরই ক্ষতি করবে। আর যে আল্লাহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে, অবশ্যই তিনি তাকে মহা প্রতিদান দান করবেন।

এক মাওলানা ধৃত হয়েছেন। তার অপরাধ খুব বেশি কিছু নয়। তিনি নাকি উগ্রবাদ প্রচার করতেন। আচ্ছা, উগ্রবাদের সংজ্ঞা কী? আমরা তো দেখি, শাহবাগি নাস্তিকরা সেখান থেকে উগ্রবাদ প্রচার করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসারী ছাত্ররা তো শুধু উগ্রবাদই নয়; বরং রীতিমতো সন্ত্রাসবাদের প্রচার করছে। আর দাদাদের দেশের হিন্দুগোষ্ঠী তো উগ্রতার চরম শিখর স্পর্শ করেছে।

উগ্রবাদ হলো তাত্ত্বিক ব্যাপার আর সন্ত্রাসবাদ হলো প্রায়োগিক ব্যাপার। ইসলাম উগ্রবাদী ধর্ম নয়। এ কথা তো সর্বজনস্বীকৃত। তাহলে যে বিষয়গুলো ইসলাম-সমর্থিত, তা কখনো উগ্রবাদ হতে পারে না। বরং নিঃসন্দেহে তা-ই ভারসাম্যের পথ। এবার দেখা যাক, এই মাওলানা যা কিছু প্রচার করতেন, তা ইসলাম-সমর্থিত কি না। যদি তা ইসলাম-সমর্থিত হয় তাহলে কখনোই তা উগ্রবাদ নয়। এ ধ্রুব সত্যকে অস্বীকার করার কোনো জো নেই।

এই মাওলানার আরেকটা অপরাধ হলো, তিনি গাজওয়ার হাদিসগুলোতে বিশ্বাস করতেন। আচ্ছা, তাহলে কি কোনো মুসলমানের জন্য কুরআন এবং সুন্নাহর কিছু অংশকে অবিশ্বাস করার সুযোগ রয়েছে! তিনি বিশ্বাস করতেন—এ জন্য তিনি অপরাধী। এর মানে হলো, অধিকাংশ মুসলিমই এসব হাদিসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। আর সেই কারণে তারা অপরাধী নয়। আচ্ছা, যারা কিছু হাদিসে বিশ্বাস রাখে না, তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিলেও কীভাবে তারা মুসলিম হতে পারে! আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশের প্রতি ইমান রাখো আর কিছু অংশকে অস্বীকার করো! যে-কেউ এমনটা করবে, তার শাস্তি এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, দুনিয়াতে তার জন্য থাকবে লাঞ্ছনা আর আখিরাতে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে ভয়াবহ শাস্তির দিকে। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে বে-খবর নন।’

একজন আলিমকে মাজলুম হতে দেখেও আজ কেউ প্রতিবাদ করবে না। কারণ, মুখে স্বীকার না করলেও আমাদের দৃষ্টিতেও তিনি একধরনের অপরাধী। নাস্তিকদের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই, যা ইসলামের দর্পণে দেখলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটুকু গুরুত্ব রাখে এবং সার্বিক ফলাফলের বিচারে তার উপকারিতাই কতটুকু, তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেই লড়াই আমাদের চোখে বীরত্বের মাপকাঠি হলেও দীনের বার্তা প্রচার এবং বিশুদ্ধ ইলমের খেদমত আমাদের চোখে কোনো কিছুই নয়। বরং তা-ই আমাদের চোখে একধরনের অপরাধ, যে কারণে আজ এক মাজলুম আলিমের জন্য কেউ সমবেদনাটুকুও প্রকাশ করবে না।

তিনি কোনো গণতান্ত্রিক দলের সদস্য নন, তাই আজ তার জন্য মিছিল হবে না। কেউ তার জন্য র‍্যালি বের করবে না। তার জন্য কোনো মানববন্ধনও হবে না। কোনো প্রেস ব্রিফিং দিতেও কাউকে দেখা যাবে না। বিনাশ্রমের একটা জিনিস—ফেসবুকের পোস্ট, তা-ও কেউ করবে না। পাছে না এর জন্য নিজেকেই অপরাধী হতে হয়।

বস্তুত আমরা পাশ্চাত্যের ছকে আঁকা ইসলামেই সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছি। তাই এর বাইরের কিছু করা আমাদের জন্য বড় কঠিন। পরাজিত মানসিকতা আজ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে গেছে। জীবন তো একটাই। এ জীবন তো ভোগ-বিলাসের জন্য নয়। দুনিয়া তো মুমিনের জন্য কারাগার। পুরো জীবনটাই যেখানে কারাগার, সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারাগারগুলো তো গৌণ ব্যাপার। আল্লাহ তাআলার কাছে পুরো দুনিয়ার মূল্য মাছির ডানা পরিমাণও নয়।

মুমিনদের জন্য সুখের দিন তো আগামীতে, মৃত্যুর পরে। সেখানে আল্লাহ মুমিনদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন এমন জান্নাত, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি কোনো অন্তরেও যার কল্পনা আসেনি। ইউসুফ আ. বড় সুন্দর বলেছিলেন, ‘প্রভু হে, ওরা আমাকে যে দিকে ডাকছে (হালের প্রেক্ষাপটের আলোকে বললে, ওরা আমাকে যে মডারেট-পরিমার্জিত ইসলাম মানাতে চাচ্ছে) তারচে তো কারাগারই আমার কাছে বড় বেশি পছন্দনীয়।’

মনে রেখো হে শান্তিকামীরা, সর্বোত্তম জিহাদ হলো জালিম শাসকের সামনে সত্যের বাণী তুলে ধরা। তোমরা তো নিষ্ক্রিয়তাকেই মানহাজ বানিয়ে নিয়েছ, নীরবতাকেই মুক্তির উপায় হিসেবে গণ্য করেছে; কিন্তু আল্লাহর রাসুল সা. প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সত্যের বাণী তুলে ধরাকে কোনো অসতর্কতা নয়; বরং সর্বোত্তম জিহাদ বলে অভিহিত করে গিয়েছেন।

আজ যারা সত্যের বাণী প্রচারের কারণে এক মাজলুম ব্যক্তিকেই বরং অপরাধী হিসেবে মূল্যায়ন করছ, জেনে রেখো, সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন তোমার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটবে; আর তোমার সেই দুর্দিনে অন্যরাও মুখে কুলুপ এঁটে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করবে। তোমার সাহায্যে কেউই এগিয়ে আসবে না।

দীন না মানা সত্ত্বেও জাতিগতভাবে স্রেফ মুসলিম পরিচয়ধারী হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে যে দুর্দিন নেমে এসেছে, পূর্ণাঙ্গ ইসলামে বিশ্বাস করার কারণে আজ যেমন বাঙালিদের ওপরও ভয়াল নির্যাতন নেমে আসছে, সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন শুধু ব্যক্তিগত ইসলাম তথা নামাজ-রোজার কারণেই তোমার বুককে বেয়নেটের খোঁচায় রক্তাক্ত করা হবে এবং তোমার খুন ঝরতে দেখে জালিমরা পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠবে। তোমার আর্তনাদ দেখে গগনবিদারী হাসির হররা ছুটবে তাগুতের দোসরদের ঝলমলে প্রাসাদগুলোতে।

যে ব্যক্তি নিজের ভাইকে মাজলুম হতে দেখে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাধ্যানুসারে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে না, আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করেন এবং তাকে এমন বিপদে ফেলেন, যে ক্ষেত্রে তার সাহায্যেও অন্য কেউ আর এগিয়ে আসে না।

 

চলে গেলেন মাওলানা ইসহাক,

রেখে গেলেন হেকমতিয়ারদের জন্য হাজারো অজুহাত

তিনি চলে গেছেন হাজতে। রেখে গেছেন হেকমতিয়ারদের জন্য হাজারো অজুহাত। এখন তারা আরও জোর গলায় বলতে পারছে, দেখেছ, আমরা বলেছিলাম না, এ যুগে এসব কথা বলতে নেই। না অনলাইনে আর না অফলাইনে। এসব কথা বললে পরিণতি শুভ হবে না। দেখেছ, আজ তা-ই হলো। রাসুলের যুগের মুনাফিকরা যেমন বলেছিল, আমাদের কোনো কথা যদি শোনা হতো তাহলে আজ আমরা এভাবে মারা পড়তাম না। এই যে আবেগী জিহাদিরা, ওরা যদি আমাদের কাছে থাকত তাহলে ওরা মরত না, নিহতও হতো না।

কারও কারও কথা শুনে মনে হয়, মাওলানা ইসহাক বোধ হয় এতটাই নির্বোধ ছিলেন যে, তিনি বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। অথচ এ পথের কোন পথিক এমন, যে বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়! তিনি অবশ্যই জানতেন, তার ওপর কী নির্মম পরিস্থিতি নেমে আসতে পারে। হাঁ, কিছু বিষয়ে তার ওভার কনফিডেন্স ছিল, তা ভিন্ন বিষয়।

তিনি যে এসব করে গেলেন, এতে উপকার কী হলো? উপকার কী হয়েছে, তা বোঝার জন্য আপনার দৃষ্টিকে প্রথমে ইহলৌকিকতা থেকে বের করে পারলৌকিকতার মধ্যে প্রবেশ করাতে হবে। কারণ, ইহলৌকিক দৃষ্টি দিয়ে এর উপকারিতা ঠাহর করা অনেকটাই দুরূহ ব্যাপার। নজরুল বড় সুন্দর বলেছেন :

উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই; 
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!

যারা চায় দুনিয়ার সুখ এবং সমৃদ্ধি; যাদের কাছে পৃথিবীর সুখ ঠিক রেখে এবং মনোরম জীবনের গতিধারাকে ব্যাহত না করে কোনোরকম দীনের কাজ করতে পারাই মুক্তির উপায় কিংবা পরাক্রমশালী প্রতিপালকের সামনে উপস্থাপনযোগ্য অজুহাত, তাদের থেকে এমন মন্তব্য পাওয়াটা স্বাভাবিক, খুবই স্বাভাবিক। আমি এতে মোটেও অবাক হই না।

শরিয়াহর যেসব কথা বললে পিঠের চামড়া যাবার ভয় নেই, সেসব কথা তো সবাই বলে। এক আপনি না বললে কিছুই হবে না। আর এ জন্য আপনার পেছনে এই লাখ লাখ টাকা ঢেলে, বড় বড় প্রতিষ্ঠান-বিদ্যালয়ে পড়িয়ে আপনাকে এমন বড়সড় জ্ঞানীগুণী বানানোর প্রয়োজনও ছিল না। ওসব কথা মানুষের এখন এতটাই মুখস্থ যে, বাংলা তো বাদই, আরবি না পারা সত্ত্বেও ইমাম সাহেবের খুতবা শেষ হওয়ার মিনিট খানেক আগেই সবাই নামাজের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে যায়। কারণ, ইমাম সাহেবের চর্বিতচর্বণ খুতবা সকলেরই আত্মস্থপ্রায়। বাংলা আলোচনার কথা আর কীই-বা বলার আছে। ভূমিকা তো সর্বদা একই। আর বাকিটা হলো মৌসুমি বয়ান। মৌসুম তো সর্বদা একেকটা লেগেই থাকে। শৈশব থেলে বার্ধক্য – একই আলোচনা শুনতে শুনতে মানুষের কানও এখন অতিষ্ঠ। আর এ কারণেই আপনাদের শত বারণ সত্ত্বেও মানুষ এখন ড. জাকির নায়েক প্রমুখদের দিকে অভিমুখী।

এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, জ্ঞানীদের বড় একটা অংশই ইসলামের মাজলুম বিধানগুলো সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রাখে না। আচ্ছা, যারা কিছুটা হলেও জ্ঞান রাখে, তারাও বা কেন বলে না?

ওয়াজের ময়দানে হক কথা বললে আগামী বছর দাওয়াত পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আয়োজক কমিটিও ভালোই বিপদে পড়বে। মসজিদে এসব বিষয়ে আলোচনা করলে আর চাকরি থাকবে না। তাবলিগ জামাত বা খানকাহেও এ নিয়ে আলোচনা হবে না, যেহেতু তাদের ভাষ্যানুসারে এগুলো তাদের কাজ নয়। যেহেতু পৃথিবী থেকে এ বিষয়গুলো অনেকটাই না-ই হয়ে গেছে কিংবা যেহেতু এ বিষয়গুলো অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ততটা প্রয়োজনীয় নয় (!), তাই মাদরাসার নেসাবেও আর এগুলোকে রাখা হয়নি। কুরআনের অনুবাদ আর হাদিসের গ্রন্থাদি থেকে যদিও এগুলোকে বাদ দেওয়া যায়নি, কিন্তু হাদিসের এসকল অধ্যায়কে রাখা হয়েছে আলোচনার বাইরের অংশে আর কুরআনেও বেশি কথা বলার সুযোগ নেই; অন্যথায় প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বেচারা আলোচকের চাকরি নিয়েই টানাহেঁচড়া দেখা দেবে।

পরিস্থিতি যখন এ-ই, তখনও যদি কিছু জানবাজ লোক মুখ না খুলে নিজেকে বাঁচানোর যুক্তিতে মুখে কুলুপ এঁটে রাখে তাহলে কি আল্লাহ এবং তার ফেরেশতারা জমিনে নেমে এসে মানুষের সামনে সত্যকে তুলে ধরবেন? (নাউজুবিল্লাহ) কিছু মানুষ যদি নিজেদের ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে, নিজেদের প্রাণের ওপর ইসলামকে প্রাধান্য না দেয় তাহলে কি গোটা জ্ঞানীসমাজ ‘কিতমান’-এর ভয়াবহ গুনাহে আক্রান্ত হবে না আর তার পরিণতিতে সকলের ওপর আল্লাহর পাকড়াও নেমে আসবে না? এই দু-চারজন লোক, যারা প্রাণের ওপর দীনকে প্রাধান্য দিয়ে ইসলামের বাণীকে নিঃসঙ্কোচে তুলে ধরছে, তারা তো আমাদের ভর্ৎসনা নয়; বরং সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য ছিল। কারণ তারা আমাদের জাতিগত অপরাধকে কিছুটা হলেও লঘু করেছে।

প্রাণের মায়ায় যারা সত্যকে গোপন করতে চায়, তাদের জন্য আসহাবুল উখদুদের ঘটনায় পর্যাপ্ত শিক্ষা রয়েছে। অনেক সাহাবির ঘটনায় এমন পাওয়া যাবে, ইসলামগ্রহণের পর রাসুলের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিয়েছেন আর পরিণামে কুফফারের হাতে নির্দয়ভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। আচ্ছা, কারও কি এই দুঃসাহস আছে যে, এবার সেসকল সাহাবিকে আবেগী, অপরিণামদর্শী, হিকমাহশূন্য অভিধায় অভিহিত করবে?

নজরুল বড় সুন্দর বলেছিলেন :

‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? 
তোমার ছেলে জাগলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’

মাওলানা ইসহাক খানদের ওপর আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ, যখন হাদিসের ঘোষণা অনুসারে বনি ইসরাইলের আলিমদের মতো এই উম্মাহর জ্ঞানীরাও ভয়ে লেজ গুটিয়ে রেখেছে; বরং গুইসাপের গর্তে ঢুকে পড়েছে, তখন তারা নিঃসঙ্কোচে নির্ভয়ে বজ্রদীপ্ত কণ্ঠে সত্যের বাণী তুলে ধরেছেন। নিঃসঙ্গ এ যাত্রায় হাজারো বাধা, তাগুতি প্রশাসনের বাধার চাইতে মুসলিমদের জ্ঞানীসমাজের বাধাই ছিল বেশি, মাড়িয়ে এতকাল টিকে ছিলেন – এ তো তাদের অসীম সাহসিকতার নমুনা। পরবর্তীদের জন্য এর মধ্যে তারা উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন।

মাওলানা ইসহাক খান, একদিন যে তাকে নবি ইউসুফের পাঠশালায় যেতে হবে, এটা তার ভালো করেই জানা ছিল। জেনেবুঝেই সব করেছেন। আল্লাহর শুকরিয়া যে, মাঝের সময়টা বেশ দীর্ঘই ছিল। আসহাবুল উখদুদের ছেলেটার মতো ক্ষণকাল সময় নয়; বরং ফল পাঁকা পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন তার মতো করে। তার কাজগুলোর মূল্যায়ন এখানে উল্লেখ করছি না। আর এখন তার সময়ও নয়। তবে তিনি যা করে গেছেন, সকল ত্রুটিবিচ্যুতির পরও তা তাকে সুদীর্ঘকাল অমর রাখবে ইন শা আল্লাহ।

আচ্ছা, সত্যের বাণী তুলে ধরার দ্বারা কী হয়েছে? হয়েছে, অনেক কিছুই হয়েছে। আলিম নামের সার্থকতা কিছুটা হলেও এসেছে। কিতমানের গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। আর আপনার-আমার মতো শৃগাল নয়; উম্মাহর কিছু সিংহশাবক জেগেছে, যাদের কারও হাত ধরে হয়তো পরিবর্তিত হবে উম্মাহর ভাগ্য এবং চরম লাঞ্ছনার পর আসবে সোনালি সুদিন।

সর্বোপরি এটা কোনো অনর্থক কাজ নয়; বরং এটা তো এক গুরুত্বপূর্ণ ফারিজা। করতে পারলে ভালো, না করলেও সমস্যা নেই ক্যাটাগরির কোনো বিষয় তো এটা নয়। শেয়ালের মতো হাজার বছর বাঁচার থেকে সিংহের মতো একদিন বাঁচাই উত্তম। কী হবে এত মেধা এবং প্রতিভা দিয়ে, যদি ইসলাম নিক্ষিপ্ত থাকে আস্তাকুঁড়ে! বড় সৌভাগ্যবান তো সেই ব্যক্তি, আল্লাহ যার মেধা এবং প্রতিভাকে দীনের পুনরুজ্জীবনের খেদমতে লাগিয়েছেন; যদিও তা সামান্য সময়ের জন্য হয়। কী হবে দীর্ঘ জীবন দিয়ে! মানজিলে মাকসুদ তো রেজায়ে মাওলা। এত হিকমাহ বুঝে কী লাভ! আল্লাহ এবং তার রাসুলের নির্দেশ ও নির্দেশনার বাইরে কোনো হিকমাহ থাকতে পারে না। বাহ্যত সেগুলোকে হিকমাহ মনে হলেও আদতে সব মরীচিকা।

রাসুলুল্লাহ সা. বলেন,

‘সর্বোত্তম জিহাদ হলো জালিম শাসকের সামনে সত্যের বাণী তুলে ধরা।’

তাগুতের ভূমিতে বসে, তাগুতের পর্যবেক্ষণের মধ্যে থেকে একটা হক কথা বলতে পারাও বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার, যেই সৌভাগ্য আল্লাহ সবাইকে দেন না।

আর হে ‘জলদবাজি’তে আক্রান্ত ফলাফল প্রত্যাশীরা, বীজ তো কেবল রোপিত হয়েছে। ফলাফলের জন্য কিছুকাল তো অপেক্ষা করো। আল্লাহর কসম, শহিদানের রক্ত এবং মাজলুমানের অশ্রু বৃথা যাবে না; যেতে পারে না। আর আমি তোমাদের আল্লাহর ঘোষণা শুনিয়ে দিই, ‘সুতরাং পারলে তোমরা নিজেদের থেকে মৃত্যুকে প্রতিরোধ করো দেখি!’ আরে, প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। তা একমিনিট আগাবেও না, কয়েক সেকেন্ড পেছাবেও না। আপন জায়গায় স্থির। মৃত্যু তার যথাসময়ে তোমাকে স্পর্শ করবে; যদিও তুমি কোনো সুরক্ষিত প্রাসাদেও আশ্রয় নাও। আর জেনে রাখো, ইসলাম নামক বৃক্ষের গোড়ায় পানি নয়, বরং রক্ত ঢালতে হয়। কারণ, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হ্যর কারবালা কে বা’দ।

শাইখ মাকদিসি লেখেন,
‘কাফেলা এগিয়ে চলছে এবং কুকুরগুলো পেছনে ঘেউঘেউ করে যাচ্ছে।’ কাফেলার সময় কোথায় এসব আওয়াজে কান দেয়ার!

ولست أبالي حين أقتل مسلما ـــــ على أي شق كان لله مصرعي

وذلك في ذات الإله وإن يشأ ـــــ يبارك على أوصال شلو ممزع.

অর্থ : মুসলিম অবস্থায় যদি নিহত হই তবে আর কোনো পরোয়া নেই, যে পার্শ্বদেশেই হোক না কেন, আল্লাহর জন্যই আমার এ ভূমিশয্যা।

এ তো শুধু মাবুদের সন্তুষ্টির জন্য, তিনি যদি চান তবে আমার ছিন্নভিন্ন প্রতিটি অঙ্গে তিনি বরকত দান করবেন

 

পরস্পরবিরোধী দুই মানহাজের চিন্তাধারার চিত্র 

দুজন ভাইয়ের দুটো লেখা। প্রথম লেখাটির জবাবে দ্বিতীয়টি লেখা। দুটো লেখাতেই ভেসে উঠেছে গভীর চিন্তার ছাপ। তবে চিন্তা দুটো ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের। পাশাপাশি রেখে দুটোকে পড়লে ভাবনার দিগন্ত বিস্তৃত হয়, কল্পনার ফানুস ছেড়ে বাস্তবতা নিয়ে ভাবা যায়, তত্ত্ব এবং জীবনের ফারাক সম্পর্কে ভাবা যায়। সর্বোপরি বর্তমানকালে অবিচলতার সঙ্গে সত্যের বাণী তুলে ধরা কিংবা গোপন করার তাৎপর্য সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করা যায়। তথাপি বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ মানুষ নিজেদের বিবেককে কাজে লাগায় না। চোখে এঁটে রাখা রঙিন চশমা, যাবত না মেরুদণ্ডের হাড়ের ওপর নেমে আসে প্রচণ্ড আঘাত। মানুষ অন্যের অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয় না, আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে না।

দুটো লেখাই সমান্তরাল রেখায় ইতিহাসে অঙ্কিত থাকার মতো। তাই আপাতত দুটোকে পাশাপাশি করে গেঁথে রাখলাম ফেবুর ওয়ালে। উল্লেখ্য, ‘কোনো কিছু উল্লেখ করা তার পুঙ্খানুপুঙ্খ সমর্থনকে অপরিহার্য করে না।’

১.

মাওলানা ইসহাক খানের গ্রেফতার নিয়ে কিছু কথা

দিন কয়েক আগে গ্রেফতার হয়েছে লেখক ও প্রকাশক মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক খান। জঘন্যকণ্ঠে তাকে ‘জঙ্গী তৈরির কারিগর’ উল্লেখ করা হয়েছে। আমার জানামতে তিনি জিহাদ-কিতাল নিয়ে লেখালেখি করতেন। ময়দানের মুজাহিদদের কথা বলতেন। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সংযুক্তির চরম বিরোধিতা করতেন।

এমন লোকের সংখ্যা আমাদের মহলে কম নয়। আমার বন্ধুতালিকাতেও এমন অনেক ভাই আছেন যারা শ্রদ্ধেয় ইসহাক খানের সমমনা। বরং তার চেয়েও অধিকতর স্পষ্টভাষী, দুঃসাহসী ও অকপট। তারা সরকারকে ত্বাগুত বলেন। যারা ইসলামী গণতন্ত্র করেন, হোক সেটা বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান, তাদের কঠোর সমালোচনা করেন, উপহাসও করেন। খোল্লাম-খোলা জিহাদের কথা বলেন। ময়দানে জিহাদরত উলামায়ে কিরামের আদর্শ ও বাণী সর্বান্তকরণে ধারণ, গ্রহণ ও প্রচার করেন।

অনলাইনে এসব প্রচারণা কতটুকু নিরাপদ সেটা এই গ্রেফতারের ঘটনা আবারও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। জিহাদ ও কিতাল নিয়ে লেখালেখিকে অনেক সময় আমরা ‘কম্বল জিহাদ’ বলে আখ্যা দিলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এটা নিছক কম্বলের নয়; সমাজেও এর একটা প্রভাব আছে। এতে একটা জনবল তৈরি হয়, আওয়াজ ওঠে, যেটা সরকারের পছন্দ হয় না। এমনকি ইসলামী মহলেরও অনেকের পছন্দ হয় না। ফলে ভাই ভাইয়ের পিঠে ছুরি বসাতেও দ্বিধা করে না। এসব কারণেই জঙ্গীবাদের ধোঁয়া তুলে আলেমদের গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে।

কিন্তু কথা হচ্ছে ফলাফল কী? এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জঙ্গীবাদের অভিযোগে অনেক সম্ভাবনাময় আলেম প্রতিভাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বছরের পর বছর অন্ধকারে তারা তাদের জীবন শেষ করেছেন। ফলাফল? কিছু না। আমার মনে হয়েছে, অনলাইনে এ প্রচারণার বাস্তবমুখী প্রয়োগ নেই। আমি কয়েকজন নাম-না-জানা আইডির সঙ্গে কথা বলেছি। বাস্তবে এদেশে তাদের কোনো রোডম্যাপ নেই। উনারা আফগানের কথা বলেন, আরাকানের কথা বলেন, কাশ্মীরের কথা বলেন, সর্বোপরি গাযওয়ায়ে হিন্দের কথা বলেন, কিন্তু নিজের দেশে কোনো কাজ নেই। কোনো পরিকল্পনা নেই। একজন আমাকে বলেছিলেন, আগে ওদিকের কাজ শেষ হোক, এরপর এখানে শুরু হবে। মানহাজ গ্লোবাল, কিন্তু সে গ্লোবে নিজের দেশ নাই।

নাম-না-জানা আইডি আর ওয়ার্ডপ্রেসে ফ্রি একাউন্ট খুলে এই মানহাজের কাজ আর ক’দিন? তিন দশক আগের আফগানের কথা বলে আর কতকাল? কুরআন ও সুন্নাহর আবেগময়ী ভাষণ, বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল, কানা দাজ্জাল, খোরাসানের কালো পতাকা, গাযওয়ায়ে হিন্দ- এগুলোতে সাময়িক উচ্ছ্বাস তৈরি হয়, শা-শা করে ফলোয়ার বাড়ে, কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু হয়? বছরের পর বছর জঙ্গীবাদের অভিযোগে যেসব ভাইয়েরা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের বের করে আনার জন্য কী কী করা হয়েছে? তাদের পরিবারের হাল কে ধরেছে? জালিমের জেলখানা যদি জান্নাত হয়, তবে তাদের গ্রেফতারের পর আলেমদের নীরবতার প্রতি আক্রোশ দেখানোর মানে কী?

দিনশেষে আমরা সকলেই মানুষ। এবং এই যুগের মানুষ। আমাদের জীবন আছে। পরিবার আছে। বাবা-মা ও সন্তান আছে। ভবিষ্যতের চিন্তা আছে। জানটা যদি আল্লাহর পথে যায়, দীনের কল্যাণের পথে ব্যয় হয় তবে আফসোস নেই। কিন্তু কোনো হঠকারী পদক্ষেপ বা সারশূন্য আবেগী দাওয়াতের খেসারত হিসেবে যদি শুধুশুধুই জেলখানায় কুড়ে কুড়ে মরতে হয়, তবে এ জিহাদের কোনো মানে নেই। আপনি ইসলামী রাজনীতকদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবেন, আর গ্রেফতার হলে তাদের সহানুভূতির আশা করবেন- এটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। এমন কিতালের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। একটা বাস্তব ঠিকানা নেই, বিপদে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, একটা ভার্চুয়াল নিজস্ব সাইট নেই, বাস্তব শরীরী নেতৃত্ব নেই- এমন আন্দোলনের সাফল্য আসবে কীভাবে?

এজন্যই এসব ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে চায় প্রোফাইলে বটগাছ কিংবা হাতপাখার ছবি টাঙিয়ে ফেলি।

২.
এসব করে কী হয়েছে?

অ্যাটলিস্ট আল্লাহর সামনে এই ভূখন্ডের মুসলিমদের একটা ওজর হয়েছে, যেটা বসে থাকা ফাসেকের হয় নাই।

(এ পয়েন্টের বিস্তারিত আলোচনা এখানে : https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2080013665602514&id=100007817025283)

তবে আমি চিন্তিত পালটা প্রশ্ন নিয়ে। সেটা করা যাবে? নাকি করলে উগ্রবাদী হতে হবে?

১) ফলাফল কী?

তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলা চরমোনাইয়ের “ইসলামী রাজনীতির ফলাফল কী? ফলাফল কী জমিয়তের উপমহাদেশ জুড়ে থাকা কয়েক হালি ভার্শনের রাজনীতির? ফলাফল কী প্রায় ৮ দশকে ধরে চলে আসা জামায়তে ইসলামী ও ইখওয়ানের রাজনীতির? ফলাফল কী মহাচিন্তকদের চিন্তা ও তত্ত্ব-তাত্ত্বিকতার পাহাড়ের? ফলাফল কী এতো দশক ধরে চলে আসা “ঠান্ডা দাওয়াতের”? ফলাফল কী হেফাযতের লাখ লাখের? ফলাফল কী দশকের পর দশকে চলে আসা তাবলীগের? আর ষাটের দশক থেকে চলে আসা আক্বিদা “সহিহ” করার তারবিয়াহ-তাসফিয়ার মানহাজের? পঞ্চাশের দশক থেকে চলে আসা নুসরত খোঁজার মানহাজের? ফলাফল কী “অধিকাংশ উলামার অধিকাংশের কাছে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতির”?

– রাষ্ট্রে ক্রমান্বয়ে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাওয়া?
– সমাজে ক্রমাগত ইসলামী মূল্যবোধের বৃদ্ধি?
– আমল বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের প্রসার?
– ইসলামবিরোধী সেন্টিমেন্ট এবং অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় শক্ত অবস্থান?
– আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবমাননার শাস্তি নিশ্চিত করা?
– সমাজে প্রকাশ্য গুনাহ, ব্যভিচার হ্রাস পাওয়া?
– ইসলামী হুকুম আহকাম ও শিয়ারের প্রতি বিদ্বেষ ও এগুলোর ভিত্তিতে হয়রানির বদলে সম্মান?
– পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষা বৃদ্ধি পাওয়া?
– এক সেন্টিমিটার ভূমিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা?
– পৃথিবীর কোন একটি ভূমিতে নির্যাতিত মুসলিমদের কুরআনি পদ্ধতিতে নির্যাতন থামানোর চেষ্টা করতে পারা?
– মাদক ও অশ্লীলতার প্রসার বন্ধ করা?
– ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ (আল ওয়ালা ওয়াল বারা) -এর ওপর আমল করা?
– মিশনারীদের দৌরাত্ম হ্রাস পাওয়া?
– ইসকনের জাতীয় মুশরিক সংগঠনের দৌরাত্ম হ্রাস পাওয়া?
– দেওয়ানবাগীর মতো মুরতাদ, দাজ্জালের দৌরাত্ম হ্রাস পাওয়া?
– শিয়া, কাদিয়ানি আর ইসমাইলিদের প্রভাব হ্রাস পাওয়া?
– সমাজে দাওয়াহর ক্ষেত্রে প্রসারিত হওয়া?

কী? ফলাফল কী?

এই প্রশ্নগুলোর ফলাফল উত্তরের আলোকে যেই স্ট্যান্ডার্ডে অধিকাংশের বিচার করা হবে, সেই একই স্ট্যান্ডার্ডে কি যারা অধিকাংশ না তাদেরও সাফল্যের বিচার করা হবে? নাকি অধিকাংশের ক্ষেত্রে মার্কিংয়ের মানহাজ এক রকম, আর ‘অল্পসংখ্যক’ হলে মার্কিং আরেকরকম?

আর যদি এসবের কোন এক প্রশ্নের জবাবে – “না এখানে হয়নি” কিন্তু ওখানে…” -কে উত্তর হিসেবে আনা হয় তাহলে সবগুলো প্রশ্নের উত্তরে এখানে হয়নি কিন্তু খুরসান, ইরাক, শাম, সোমাল, মাগ্বরিব, ওয়াযিরিস্তান ৯৬ থেকে ১৮ পর্যন্ত ধারা চলমান এবং আল্লাহর ইচ্ছায় সাফল্য – এই উত্তর কি আনা যাবে নাকি তখন সেটা আবেগী কথা হবে?

যাদের পুরো মানহাজও আবেগ আর বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন রেটোরিকের ওপর দাঁড়িয়ে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তাদের বাস্তবতার দিকে আঙ্গুল তোলা যাবে? নাকি তখন সেটা ভদ্রতার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে?

২) রোডম্যাপ কী?

বাংলাদেশে হেফাযতের রোডম্যাপ কী? জামায়তে ইসলামের রোডম্যাপ কী? চরমোনাইয়ের রোডম্যাপ কী? খেলাফতে মজলিশের রোডম্যাপ কী? আরো হালি হালি যেসব দল আছে যেগুলোকে সদস্যরা চেনে, এবং উম্মতের আশা আকাঙ্ক্ষার ধারক-বাহক মনে করে, কিন্তু দেশের মানুষ তাদের চেনা তো দূরে থাক তাদের নামও জানে না – তাদের রোডম্যাপ কী? আই মীন, ফটোসেশন, বিভিন্ন সনদ টনদের স্বীকৃতির অনুষ্ঠানে দোয়া করা, খাওয়াদাওয়া, হাতে গুণে কয়েকশো কিংবা কয়েকহাজার পড়ে, এমন কিছু নিউজ পোর্টালে আর ফেইসবুকে আইডিতে খুব তত্ত্বকথা আওড়ানো আর আবেগের চাষবাস করা ছাড়া রোডম্যাপ কী? ভেদে মারেফতের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, আহলে হাদিস ফিতনা প্রতিরোধে মসজিদ কিংবা মারকাজ উৎপাটন, এতাআতপন্থি আর আলামীশূরাপন্থীদের পাল্টাপাল্টি তর্কবিতর্ক -মারামারি-পুলিশ ডাকাডাই আর ‘মুখোশ উন্মোচন”, বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন তাত্ত্বিকতা অথবা দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম চর্চার মোটিভেইশানাল ইসলামের বই ছাপানোর বাইরে রোডম্যাপ কি? ক্রমাগত নাস্তিকদের প্রভাব বাড়তে থাকা সমাজে বসে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে বই লিখে আত্মতৃপ্তি আর ক’দিন? দ্বীনি ভাই, দ্বীনি আড্ডা, দ্বীনি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আহ্লাদের আর ক’দিন? যে সহিহ আক্বিদা শিখে ইমান-কুফরের পার্থক্য করা যায় না, আল ওয়ালা ওয়াল বারা শেখা যায় না, কুফর আর শিরককে চেনা যায় না – সেই সহিহ আক্বিদার দাওয়াহ নিয়ে আর ক’দিন? রুটিন করে বন্ধ হয়ে যায় এমন স্কুল, আর প্রতিষ্ঠান খোলার বাইরে রোডম্যাপ কী?

হেফাযত আর জামাতের যেসব সমর্থকেরা (সদস্য না) গ্রেফতার হয় তাদের মুক্তির ব্যাপারে হাল ধরেছে কে? শাপলা চত্বরের শহিদের ব্যাপারে কী অবস্থা? কোন কোন সংগঠন সমর্থকদের পরিবারের দায়িত্ব নেয় তাদের লিস্টটা কোথায়?

গলাবাজি আর স্ট্যাটাসবাজি করে আর ক’দিন? ইন্টেলেকচুয়াল সেজে আর তত্ত্বকথা আওড়ে আর ক’দিন? সংস্কৃতি আর মিডিয়াসচেতনতার ভান করে আর ক’দিন? চারপাচ ভাষা আর পাচমিশালী পরিভাষা মিলিয়ে না খাওয়া যায়, না পরা যায়, না কোন কাজে লাগে এমন লেখালেখি করে নিজেনিজে গদগদ হয়ে আর ক’দিন? ইতিদাল-ইতিদাল ভাব নিয়ে নিজের আগে থেকে ঠিক করে রাখা উপসংহারকেই চাপিয়ে দেয়ার মুতাদিল হয়ে আর ক’দিন? ঠান্ডা দাওয়াত আর ক’দিন? আকাবীর বিক্রি করে আর ক’দিন? দেওবন্দ বন্ধক দিয়ে আর ক’দিন? আমলহীন ইলমের গর্ব নিয়ে আর ক’দিন? সাহস ছাড়া শরীর নিয়ে আর ক’দিন? অজুহাত দিয়ে আর ক’দিন? আরেকজনের দিকে আঙ্গুল তুলে আর ক’দিন?

কাদায় গড়াগড়ি দিতে দিতে শূচির সবক দেয়া আর মাটিতে সোজা হয়ে শুয়ে আকাশে থুথু ছোড়ার বাইরে রোডম্যাপ কী? আল্লাহর সামনে আকাবীর আর অধিকাংশকে উকিল হিসেবে ধার্য করার বাইরে আর রোডম্যাপ কী?

ফলাফলের প্রশ্ন তুলে মানহাজ নিয়ে প্রশ্ন করার ধাপ্পাবাজি আর ক’দিন? কতোদিন আর আদেশ পালনের কারণে গোলামকে দোষারোপ? নাম-জানা, আর ডোমেইন হোস্টিং এর খরচ দেয়া লোকেদের একজন কোনদিন সাহস করে প্রশ্ন করবেন?

“আল্লাহ তুমি হুকুম দিলা, কিন্তু এই হুকুম পালন এতো কঠিন করলা ক্যান? আল্লাহ তুমি ফরয করলা কিন্তু ফরয পালনে বিজয় আসেনা ক্যান? এখনি আসে না ক্যান?”

‘এবং মানুষের মধ্যে কেউ কেউ সংশয়ের সাথে আল্লাহর ইবাদাত করে। সে যদি কল্যাণপ্রাপ্ত হয়, তবে এতে সে প্রশান্তি লাভ করে, কিন্তু যদি কোনো বিপর্যয় তার উপর আপতিত হয়, সে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানেই সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটাই সুস্পষ্ট ক্ষতি।’ (সুরা আল-হাজ (২২) : ১১)

{প্রথমটির লেখক : মিজান হারুন। দ্বিতীয়টির লেখক : আসিফ আদনান।}

Share This