ইমানের পরিচয়

আল্লামা সায়্যিদ মাহমুদ আলুসি বাগদাদি রহ. বলেন,

الإيمان هو التصديق بما علم مجيئ النبي به ضرورة، تفصيلا فيما علم تفصيلا وإجمالا فيما علم إجمالا تصديقا جازما ولو من غير دليل.

ইমান হলো এমন সব বিষয়কে সুদৃঢ়ভাবে সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়া, যা রাসুলুল্লাহ সা.-এর আনীত দীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারটি আবশ্যিকভাবে বিদিত হয়েছে। যে বিষয়গুলো বিস্তরভাবে জানা গেছে, সেগুলোকে বিস্তরভাবে বিশ্বাস করা এবং যে বিষয়গুলো অস্পষ্টভাবে জানা গেছে, সেগুলোকে অস্পষ্টভাবে বিশ্বাস করা; যদিও তা দলিলবিহীন হয়। (অর্থাৎ যদিও তা সেরেফ রাসুলের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে হয়।)

অর্থাৎ যে বিষয়গুলো দীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারটি অকাট্য ও সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার নাম হলো ইমান। যে বিষয়গুলো বিস্তরভাবে জানা গেছে, যেমন : নামাজ, জাকাত, রোজা, হজ ইত্যাদি, সেগুলোর প্রতি বিস্তর ইমান। এবং যে বিষয়গুলো অস্পষ্টভাবে জানা গেছে, সেগুলোর প্রতি অস্পষ্ট ইমান। যেমন : তাকদির।

‘আবশ্যিকভাবে জানা গেছে’, এর অর্থ হলো, তা দীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি সাধারণ-অসাধারণ সকলের জানা। কিংবা তা প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিত এবং তা ‘জরুরিয়াতে দীনে’র অন্তর্ভুক্ত।

উল্লেখ্য, ‘জরুরিয়াতে দীন’ বলা হয় সে সকল বিষয়কে, যা সন্দেহাতীতভাবে যুগপরম্পরায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং উম্মতের সাধারণ দ্বীনদার শ্রেণীও যে সকল বিষয়কে নবিজির শিক্ষা বলে জানে। আলিমগণের পরিভাষায় এ ধরনের বিষয়কে ‘জরুরিয়াতে দীন’ বলা হয়। যেমন : আল্লাহ একমাত্র ইলাহ, তার কোনো শরিক নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসুল। কেয়ামত ও আখেরাত সত্য। কোরআন আল্লাহ তাআলার নাজিল করা কিতাব। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। পবিত্র মক্কা নগরীর কাবাঘর হলো মুসলমানদের কেবলা ইত্যাদি।

এগুলো এমন বিষয়, ইসলাম ও তার নবি সম্পর্কে যার সামান্য জানাশোনা আছে, সে-ই নিশ্চিতভাবে জানে যে, নবিজি উম্মতকে এসকল জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন। এতে সন্দেহ পোষণের কোনো অবকাশ নেই। তো মুসলমান হওয়ার জন্য এ-জাতীয় বিষয়ের অস্বীকার থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। কারণ, এ ধরনের বিষয় অস্বীকার করার অর্থ হলো সরাসরি নবীজীর তালীম ও হেদায়াতকে অস্বীকার করা। যার পর ইসলামের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই আর থাকে না।

ইমাম গাজালি রহ. বলেন,

الإيمان هو التصديق بجميع ما جاء به النبي، والكفر تكذيب النبي في شيئ مما جاء به.

ইমান হলো নবিজি সা. যা কিছু এনেছেন, তার সবকিছুকে স্বীকার করে নেওয়া। আর কুফর হলো, নবিজি সা. যা কিছু এনেছেন, তার কোনো কিছুকে অস্বীকার করা।

এই সংজ্ঞার আলোকে একটা বিষয় বোঝা গেল, ইমান আনয়নের জন্য পুরো দীন এবং শরিয়াহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরি। কিন্তু ইমান হারানোর জন্য দীন এবং শরিয়াহর যেকোনো একটি বিষয় অস্বীকার করাই যথেষ্ট।

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ. বলেন,

تصديق النبي بما جاء به النبي بالاعتماد على النبي.

নবির প্রতি আস্থা রেখে নবি সা. যা কিছু এনেছেন, সেসব ব্যাপারে তাকে সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়া।

এ সংজ্ঞার আলোকে বোঝা যাচ্ছে, যারা নবির প্রতি আস্থা থেকে নয়; বরং আকল এবং বিজ্ঞানের দলিলের ভিত্তিতে ইসলামকে মেনে নেয়, তারা মুসলিম নয়।

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন,

تصديق النبي بما جاء به مع التبري عما سواه.

নবি সা. যা কিছু এনেছেন, সেসব ব্যাপারে তাকে সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়া; পাশাপাশি তা ছাড়া অন্য সকল কিছুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।

এই সংজ্ঞা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ইমান আনয়নের জন্য সকল কুফরি তন্ত্রমন্ত্র, বিধানসংবিধানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা অপরিহার্য। অন্যথায় সারাদিন মুখে কালিমা জপলেও তা ইমান বলে বিবেচিত হবে না।

শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. বলেন,

کتاب اللہ کا ظاہرا اور باطنا اقرار کرنا اور اس کے معانی کو قرآن وحدیث کے موافق استعمال کرنا.

প্রকাশ্যে এবং গোপনে আল্লাহর কিতাবকে স্বীকার করে নেওয়া এবং তার অর্থকে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে ব্যবহার করা।

এ সংজ্ঞার আলোকে বোঝা যায়, যারা দীনের পরিভাষাগুলোকে কুরআন ও হাদিস নির্দেশিত প্রয়োগক্ষেত্রে প্রয়োগ না করে যেকোনো স্বার্থসিদ্ধির মানসে অন্য কোনো প্রয়োগক্ষেত্রে প্রয়োগ করে; যেমন : জিহাদ-শাহাদাতের বিকৃত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে, তারা মুমিন নয়; বরং তারা মুলহিদ ও জিন্দিক।

ইমানকে আমরা পাঁচভাগে ভাগ করতে পারি :

১. ইমানে মাতবু’। এটা হলো ফেরেশতাদের ইমান। যার মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসে না। যেন তা মোহর মারা। তাতে কোনো হ্রাস-বৃদ্ধিও ঘটে না।
২. ইমানে মা’সুম। মা’সুম অর্থ সংরক্ষিত। এটা হলো নবিদের ইমান।
৩. ইমানে মাকবুল। মাকবুল অর্থ গ্রহণযোগ্য। এটা হলো সাধারণ মুমিনদের ইমান।
৪. ইমানে মাওকুফ। মাওকুফ অর্থ ঝুলন্ত। এটা হলো বিভ্রান্ত এবং বিদআতিদের ইমান। তারা যতক্ষণ না তাদের গোমিরাহি এবং বিদআতি থেকে তাওবা করে ফিরে আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ইমান ঝুলন্ত থাকবে; গ্রহণীয় হবে না।
৫. ইমানে মারদুদ। মারদুদ অর্থ প্রত্যাখ্যাত। এটা হলো মুনাফিক এবং জিন্দিকদের ইমান। বাহ্যত তারা নিজেদের যতই মুমিন হিসেবে পরিচয় দেক না কেন, আদতে তারা মুমিন নয়।

প্রতিটি বিষয়ের স্বরূপ তার বিপরীত বিষয়ের দ্বারা সুস্পষ্ট হয়। ইমানের বিপরীত হলো কুফর। কুফর হলো, নবিজি সা. যা কিছু এনেছেন, তার কোনো কিছুকে অস্বীকার করা।

সাধারণভাবে কুফরকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়, যেগুলো কুফরের মৌলিক প্রকার।

১. কুফরে ইনকার : ‘জরুরিয়াতে দীন’কে অন্তরেও বিশ্বাস না করা, মুখেও স্বীকারোক্তি প্রদান না করা। যেমনটা সাধারণ কাফিরদের অবস্থা।

২. কুফরে জুহুদ : অন্তরে ‘জরুরিয়াতে দীনে’র প্রতি বিশ্বাস রাখা, কিন্তু মুখে তার স্বীকারোক্তি না দেয়া। ইবলিস-শয়তানের কুফর এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। রাসুলের যুগের অনেক আহলে কিতাবের অবস্থাও ছিলো এমন।

৩. কুফরে ইনাদ : অন্তরে ‘জরুরিয়াতে দীনের’ প্রতি বিশ্বাস রাখে, মুখেও স্বীকার করে; কিন্তু অন্য কোনো কুফরি ধর্ম মতবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে না, বরং ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা কুফরি মতবাদকেও সঠিক মনে করে। রাসুলুল্লাহ সা. এর চাচা আবু তালিব কিংবা বাদশাহ হিরাক্লিয়াসের অবস্থাও এমন ছিল। বর্তমান সময়ে যারা কুফরি তন্ত্রে-মন্ত্রে, বাদ-মতবাদে বিশ্বাসী, তাদের কুফরও এই পর্যায়ভুক্ত।

৪. কুফরে নিফাক : অন্তরে ‘জরুরিয়াতে দীনে’র প্রতি বিশ্বাস রাখে না, কিন্তু কোনো হেকমত-মাসলাহাত বা দুনিয়াবি স্বার্থসিদ্ধির মানসে মুখে ইমানের ঘোষণা দেয়। এমন কাফিরকে মুনাফিক বলা হয়। মুনাফিক সাধারণ কাফিরের চেয়ে বহুগুণে নিকৃষ্ট।

৫. কুফরে যানদাকাহ বা কুফরে ইলহাদ : এটা গোপন কুফর। কেননা এই পাপে পাপী বাহ্যত সকল ‘জরুরিয়াতে দ্বীনে’র প্রতি ইমান প্রকাশ করে, তার বাহ্যিক সুরত-লেবাস দেখলে তাকে মুমিন-মুসলিম, এমনকি মৌলবিও মনে হয়। কিন্তু সে ‘জরুরিয়াতে দ্বীনে’র অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয়ের এমন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে, যা দ্বীনের অকাট্য ব্যাখ্যা, সেই বিষয়ের স্বীকৃত দ্বীনি ব্যাখ্যার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। কাদিয়ানিদেরকে মুলহিদ-যিন্দিক-কাফির বলার পেছনে অন্যতম কারণ এটাও। বর্তমানকালে এই কুফরের চর্চা খুব ব্যাপক।

শায়খ তাহির মাসউদ দা. বা. বলেন, শায়খ আব্দুল হাফিজ মক্কি রহ. ও আমাদের দেওবন্দি আকাবিরগণও তা সমর্থন করেন, যে ব্যক্তি অনৈসলামি আইনকানুন বিধানসংবিধানকে ইসলামি আইনকানুন ও বিধানসংবিধানের থেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করবে, সেই ব্যক্তি ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি ইসলামের আইনকানুনের খেলাফ অন্য কিছুর প্রবক্তা হবে, সেও কাফির। {আকায়িদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত : ৬১-৬২}

জাওয়াহির গ্রন্থে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি সর্বস্বীকৃত কোনো হারাম বিষয়ের হারাম হওয়াকে অস্বীকার করবে অথবা তাতে সন্দেহ পোষণ করবে, (এক্ষেত্রে উভয়টি সমান) যেমন— মদ ব্যভিচার সমকামিতা সুদের নিষিদ্ধতাকে অস্বীকার করা, কিংবা এমনটা দাবি করা যে, সগিরা-কবিরা গুনাহগুলো হালাল, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। {শরহুল ফিকহিল আকবার : ১৮৭-১৮৮}

 

আমরা ইসলামকে পাঁচ ভাগে ভাগ করতে পারি :

১. বিশ্বাস; যাকে আমরা ইমান শব্দে অভিহিত করতে পারি।
২. ইবাদত।
৩. মুআমালা।
৪. দণ্ডবিধি।
৫. শিষ্টাচার।

ইমানের মূল বিষয়গুলো হলো :
১. আল্লাহর প্রতি ইমান।
২. রাসুলের প্রতি ইমান।
৩. কিতাবুল্লাহর প্রতি ইমান।
৪. ফেরেশতাদের প্রতি ইমান।
৫. পরকালের প্রতি ইমান।
৬. তাকদিরের প্রতি ইমান।
৭. মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থানের প্রতি ইমান।

মৌলিক ইবাদত হলো :
১. সালাত।
২. জাকাত।
৩. সিয়াম।
৪. হজ।
৫. জিহাদ।

মুআমালার মৌলিক শাখাগুলো হলো :
১. বিবাহশাদি।
২. আর্থিক লেনদেন।
৩. পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদ।
৪. আমানত।
৫. পরিত্যক্ত সম্পত্তি।

দণ্ডবিধির মূলনীতিগুলো হলো :
১. মানবহত্যার দণ্ড। অর্থাৎ কিসাস।
২. সম্পদ আত্মসাতের দণ্ড। অর্থাৎ চুরি-ডাকাতির হদ।
৩. সম্মান-সম্ভ্রমহানির দণ্ড। অর্থাৎ অপবাদের হদ।
৪. পর্দা লঙ্ঘনের দণ্ড। অর্থাৎ ব্যভিচারের হদ।
৫. ইসলামের রজ্জুকে ছিন্ন করার দণ্ড। অর্থাৎ রিদ্দাহর হদ।

শিষ্টাচারের মূলনীতিগুলো হলো :
১. আখলাক। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নিজেকে উত্তম বৈশিষ্ট্যে সজ্জিত করা এবং অন্তরকে মন্দ বৈশিষ্ট্যগুলোর কলুষতা থেকে মুক্ত করা।
২. ভালো স্বভাব গড়ে তোলা।
৩. সিয়াসাত। অর্থাৎ সকল কাজ যথাযথ শৃঙ্খলা এবং পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পাদন করা।
৪. মুআশারা। পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশ এবং নির্দেশনা অনুসরণ করা।

Share This