আমরা মানুষদের আশআরি বা মাতুরিদি মতবাদের দিকে দাওয়াত দিই না। আমরা মানুষদের মহান সালাফের পথের দিকে আহ্বান করি। বিকৃত সালাফিয়াত নয়, বরং প্রকৃত সালাফিয়াত। সালাফের অধিকাংশ আল্লাহর সিফাতের মাসআলায় ‘তাফবিয’ করেছেন। (এ বিষয়টি বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে। যার জন্য স্বতন্ত্র নিবন্ধ প্রয়োজন।) তাদের কেউ কেউ ‘ইসবাত’ও করেছেন আর কেউ কেউ ‘তাবিল’ও করেছেন। সপ্তম শতাব্দীতে এসে ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. ভুলবশত অধিকাংশ সালাফের পথকে বিদআতি এবং মুলহিদদের (?) পথগুলোর মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট পথ বলে অভিহিত করেছেন। এরপর তার অন্ধ তাকলিদকারীরাও এ পথে চলেছে। সালাফ ‘তাবিল’ করার পরও ‘তাবিলে’র অপরধারে আশআরি-মাতুরিদিরা যদি বিদআতি হয় এবং উম্মাহর অধিকাংশ লোক এই দুই মাযহাবের কোনোটির অনুসরণের কারণে গোমরাহ বলে আখ্যায়িত হয়, তাহলে নব্য সালাফিরা অধিকাংশ সালাফের মানহাজ ‘তাফবিয’ অস্বীকার করে ‘ইসবাতে’ লিপ্ত হওয়ার কারণে কী অভিধায় অভিহিত হবার উপযুক্ততা রাখে?

সিফাত বা আল্লাহ তাআলার গুণবাচক বিশেষণের ক্ষেত্রে ‘তাফবিয’ কী? উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ কুরআনে তার ‘ইয়াদে’র কথা বলেছেন। এখন তাফবিয হলো এ কথা বলা যে, আল্লাহ তাআলার সিফাতে ইয়াদ রয়েছে। ‘ইয়াদ’ অর্থ কী? তা আল্লাহই ভালো জানেন। ‘ইয়াদ’ কেমন? তা মাখলুকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয় এবং এর প্রকৃত ইলমও আল্লাহরই কাছে। অর্থাৎ, ইয়াদের অর্থ এবং এর হাকিকত উভয়টা আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করা এবং মাখলুকের সঙ্গে তার সাদৃশ্য নিরোধ করা।

ইসবাত কী? ইসবাত হলো আল্লাহ তাআলার সিফাতের ক্ষেত্রে অর্থকে সাব্যস্ত করা এবং এর রূপ (কাইফিয়াত)-কে তাফবিয করা (আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করা)।

যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, কুরআনে যেমন ‘ইয়াদ’ শব্দ এসেছে, যার অর্থ হাত। এখন এর অর্থ সাব্যস্তকরণের নমুনা হলো, এখানে ‘ইয়াদ’ শব্দ দ্বারা তা-ই উদ্দেশ্য, আরবি ভাষায় যা এগুলোর প্রকৃত অর্থ। আরবি ভাষায় এর প্রকৃত অর্থ হলো, দেহের একটি অঙ্গ, যা দ্বারা এটা-সেটা ধরা হয়ে থাকে। তাফবিয এবং ইসবাতের পার্থক্যই হলো অর্থ সাব্যস্ত করা এবং না-করার দিক থেকে।

আচ্ছা, তবে কি সেই হাত মাখলুকের হাতের মতো হয়ে গেলো না? বলা হবে, না। আমরা তো এর রূপ কেমন তার ইলম আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করি এবং মাখলুকের সঙ্গে তার সাদৃশ্য নেই এ কথা বলি।

আচ্ছা, এর অর্থ সাব্যস্ত করারই বা কী দরকার? সরাসরি পুরো বিষয়টিকে আল্লাহর ইলমের দিকে তাফবিয তথা ন্যস্ত করলে হয় না? ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. এর উত্তর দিচ্ছেন, ‘সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, তাফবিযকারীরা (অর্থাৎ যারা এর অর্থ এবং রূপ উভয়টিই আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করে), যারা দাবি করে যে, তারা সুন্নাহ এবং সালাফের অনুসরণ করছে, তাদের বক্তব্য বিদআতি এবং মুলহিদদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে সবচে নিকৃষ্ট বক্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।’ {দারউ তাআরুজিন নাকলি ওয়াল আকলি: ১/২০৫}

এখান থেকেই মূলত শুরু এ ব্যাপারে অধিকাংশ সালাফের মাযহাবকে অস্বীকার করা, ‘তাফবিযে’র নিন্দায় অতিশয়োক্তি করা গুটিকয়েকের অভিমত টেনে পুরো বিষয়টিকে উলটে দেয়া। এর মূল কারণ হলো, উনারা আসলে ‘তাফবিযে’র অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হননি, যেমনি তারা ‘আশআরি-মাতুরিদি মাযহাব’কে উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি এবং যেমনি তারা ‘হানাফি মাযহাব’কে পর্যন্ত চিনতে সক্ষম হননি।

ক এবং খ কথোপকথন করছে

ক. আচ্ছা, আপনারা যে এ সকল সিফাতকে আরবি ভাষাভাষীদের মাঝে প্রচলিত অর্থের ওপর বহন করছেন এবং এগুলোর প্রকৃত শাব্দিক অর্থ যা তা সাব্যস্ত করছেন—এর মাধ্যমে তো ‘দেহবাদ’ সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণ আরবরা ‘ইয়াদ’ (হাত) বললে দেহই বোঝে, তেমনি ‘আইন’ (চোখ) ‘উযুন’ (কান) বললেও যা বোঝে, তা কিন্তু দেহই। তো আপনাদের কথা তো দেহবাদীদের অবস্থানকেই সুদৃঢ় করছে।

খ. আমরা এ কথা স্বীকার করি না যে, এগুলোকে বাস্তবিক অর্থে ‘ইসবাত’ করলে ‘দেহবাদ’ সাব্যস্ত হয়। কারণ, আমরা তো ‘দেহবাদ’ নিরোধ করি এবং এর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করি। তো যে বিষয়টি আমরা অস্বীকার করি, তা-ই কীভাবে আমাদের আকিদা দ্বারা সাব্যস্ত হবে? এ শব্দগুলোকে মাখলুকের দিকে নিসবত করলে তখন ওসব অর্থ হয়, এগুলোকে আল্লাহ তাআলার দিকে নিসবত করলে তো এর এর দ্বারা সেই অর্থ উদ্দেশ্য হবে না, যা মাখলুকের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। কারণ, আমরা তো সৃষ্টের সঙ্গে স্রষ্টার সাদৃশ্য আগেই অস্বীকার করে এসেছি।

ক. হাঁ, আপনার কথা ঠিক আছে। কিন্তু এই শব্দগুলোকে যে অর্থের জন্য গঠন করা হয়েছে, যখন এগুলোকে তা থেকে সরিয়ে ফেলা হবে, তখন তো আর এ কথা বলাই সহিহ হবে না যে, এগুলো তার হাকিকি (প্রকৃত) অর্থের ওপর রয়েছে। আমরা তো আপনাদের ওপর যে বিষয়টি আপত্তি করছি, তা তো এই যে, আপনারা বলছেন, এগুলোর অর্থ তা-ই, যা আরবি ভাষায় এগুলোর প্রকৃত অর্থ। কারণ, এ অর্থগুলো তো কখনোই আল্লাহ তাআলার দিকে নিসবত করা সমীচীন নয়।

যদি আপনারা আয়াত এবং হাদিস উল্লেখ করেই ক্ষান্তি দিতেন এবং এগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এ কথা না বলতেন যে, ‘এ সকল শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে, তো আমরা বিশ্বাস করি, এসব ক্ষেত্রে এগুলোর প্রকাশ্য এবং প্রকৃত অর্থই উদ্দেশ্য’, তাহলে তো আমরা আপনাদের নিয়ে কোনোই মাথা ঘামাতাম না।

এটা তো সর্বজনবিদিত যে, এ সকল শব্দের প্রকাশ্য এবং প্রকৃত অর্থ, শব্দ-শোনামাত্র কল্পনায় যে অর্থ ভেসে ওঠে, তা দেহ বৈ কিছু নয়। আর আল্লাহ তাআলাকে এই গুণে গুণান্বিত করা অসম্ভব। কারণ, এতে সৃষ্টের সঙ্গে তার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। কারণ, ‘ইয়াদ’ দ্বারা প্রকৃত অর্থ উদ্দেশ্য বলা যে কথা, আর ‘ইয়াদ’ দ্বারা অঙ্গ উদ্দেশ্য বলা একই ধরনের কথা। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইসহাক ইবনু রাহুওয়াহ রহ.ও এ দিকে ইঙ্গিত করেছেন, ‘নিশ্চয়ই তাশবিহ (সৃষ্টের সঙ্গে স্রষ্টার সাদৃশ্য) হবে তখন, যখন বলা হবে, হাতের মতো হাত।’ কারণ, আপনি যদি বলতেন যেভাবে আমরা বলি যে, ‘আল্লাহ তাআলার ‘ইয়াদ’ রয়েছে (হাত রয়েছে এভাবে নয়)’, তবে তাতে কোনো সাদৃশ্য থাকতো না। কিন্তু যখন বললেন, সেই ‘ইয়াদ’ দ্বারা তার প্রকৃত অর্থ উদ্দেশ্য, তখন আপনি—স্বীকার করেন বা না করেন—আল্লাহ তাআলার জন্য দেহ এবং অঙ্গ সাব্যস্ত করে ফেলেছেন।

খ. আমি তো আল্লাহ তাআলার জন্য অঙ্গ সাব্যস্ত করছি না।

ক. আপনি পুনরায়ও বিপরীতমুখী কথা বলছেন। আরেকটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, তাহলে ইন শা আল্লাহ বুঝতে পারবেন। আপনার মতবাদ আপনার অজ্ঞাতসারেই সুরা শুরার ১১ নম্বর আয়াতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ।

খ. শুনুন, আমি আল্লাহ তাআলার জন্য ‘ইয়াদে’র প্রকৃত শাব্দিক অর্থ (হাত) সাব্যস্ত করছি, এটা তো স্বীকার্য। কিন্তু এ শব্দের অর্থ তো তা নয়, যা মানুষের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। আমি তো আল্লাহর জন্য কোনো অঙ্গ সাব্যস্ত করছি না, যেহেতু এ ব্যাপারে কোনো নস (আয়াত-হাদিস) বর্ণিত হয়নি।

ক. ভাই সাহেব, আপনি স্রষ্টা এবং সৃষ্টের মাঝে অর্থের দিক থেকে সমতা বিধান করছেন এবং নাম ও শব্দের দিক থেকে পার্থক্য করছেন। আপনি ‘দেহবাদ’ থেকে বাঁচার জন্য এর অর্থ নির্ধারণের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকছেন, অথচ আপনার এই মতবাদ তাদের থেকেও নিকৃষ্ট, যারা আল্লাহর জন্য ‘হাত’-এর শব্দ সাব্যস্ত করে এবং দেহবাদকে নিরোধ করে। কারণ, যে আল্লাহ তাআলার দিকে ‘হাত’ শব্দকে নিসবত করলো, সে তাঁর দিকে এমন কিছু নিসবত করলো, শরিয়াহ যা বলেনি। আর যে অর্থের ওপর আকিদা রাখলো আর শব্দকেই নিরোধ করলো, সে তার জবানকে বাতিল থেকে বাঁচালেও তার আকিদা ঠিকই কিন্তু বাতিল দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গেলো।

আপনি মুখে যে জিনিসটি অস্বীকার করছেন কার্যত আবার তা-ই সাব্যস্ত করছেন। কেমন যেন আপনি মনে করছেন যে, আল্লাহ তাআলার অনেক বড় একটা দেহ রয়েছে; যার একটা অংশ হলো হাত, একটা অংশ চোখ, একটা অংশ কান। আপনি ভেবেছেন, মহান সালাফগণ যে আল্লাহ তাআলার থেকে হাত কান চোখকে নিরোধ করেছেন, তারা বোধহয় এই কাজটি এজন্য করেছেন, শরিয়াহ এ শব্দগুলো বলেনি। অথচ বাস্তবে বিষয়টি তা নয়। তারা এই শব্দগুলোকে নিরোধ করেছেন শুধু সেজন্য নয়, বরং এজন্য যে, এতে রয়েছে বাতিল অর্থ এবং রূপ। বিদআতিদের সঙ্গে তাদের মতবিরোধ শুধু শাব্দিক মতবিরোধই নয়।

সুতরাং ভাই সাহেব, বিদআতি নব্য সালাফিবাদকে ত্যাগ করে প্রকৃত সালাফি হবার চেষ্টা করুন। আমি আপনাকে আশআরি-মাতুরিদি হতে বলি না, যেহেতু আপনার দৃষ্টিতে তারা বিদআতি। কিন্তু এক বিদআতির দুর্নাম করে আরেক বিদআতির আঁচল ধরে রাখাটা কেমন?

 

পুনশ্চ

আজিব রহস্য

 

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. আল্লাহ তাআলার চেহারা, চোখ, কান, হাত ইত্যাদিকে সিফাত বলে থাকেন। (আমাদের ভাষায় বললে—চেহারা, চোখ, হাত নয়; বরং ‘সিফাতে ওয়াজহ’, ‘সিফাতে আইন’, ‘সিফাতে ইয়াদ’ ইত্যাদি। কারণ এগুলোর অর্থ আমরা জানি না, বরং আল্লাহই ভালো জানেন।)

তিনি ‘সিফাত’ এবং ‘যাত’ তথা গুণ এবং সত্তার মধ্যে পার্থক্য করে থাকেন। অর্থাৎ উপরিউক্ত বিষয়গুলো আল্লাহ তাআলার সিফাত। আর যা-কিছু ‘সিফাত’, তা ‘যাত’ তথা সত্তা নয়।

ইমাম ইবনু তাইমিয়া এ কথা বলেই সন্তুষ্ট হতে চান না যে, আল্লাহ তাআলার এরাদা (ইচ্ছা) কুদরত (ক্ষমতা) রহমত (দয়া) ইত্যাদির মতো এগুলোও তাঁর সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো বিষয়। অর্থাৎ এরাদা কুদরত ইত্যাদি যেমন সিফাত, এগুলোও ঠিক তেমন সিফাত এ কথা তিনি বলেন না। বরং তার দৃষ্টিতে এমনটা মনে করা ‘তাবিল’ (ব্যাখ্যাকরণ) বা ‘তাতিল’ (কর্মহীনকরণ)। আর তিনি ‘তাবিল’-‘তাতিল’কে বাতিল মনে করেন।

আচ্ছা, তবে কি এগুলো দেহ, অঙ্গ, আল্লাহ তাআলার সত্তার অংশ? না, এ কথাও তিনি বলবেন না; কারণ, নসে এ ধরনের কথা বর্ণিত হয়নি। আর তাছাড়া এ কথা বলাটা হলো তাশবিহ (সাদৃশ্যকরণ)।

তাহলে তিনি তাবিল (ব্যাখ্যা) তাতিল (কর্মহীনকরণ) তাশবিহ (সাদৃশ্যকরণ) এ সবগুলোকেই বাতিল মনে করেন।

আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে আমরা এসবের ব্যাপারে নীরব থাকি এবং এর অর্থ আল্লাহ তাআলার ইলমের দিকে ‘তাফবিয’ (ন্যস্ত) করি? না, তিনি এটাও মানতে নারাজ। কারণ, তার দৃষ্টিতে এটা অজ্ঞ প্রতিপন্নকরণ।

আল্লাহ তাআলা কুরআনকে বানিয়েছেন নুর এবং শিফা (আরোগ্য)। সুতরাং কুরআন মধ্যহ্নের আলোর থেকেও অধিক সুস্পষ্ট। ভোরের থেকেও আলোকময়। অথচ বাস্তবতা হলো, ইমাম ইবনু তাইমিয়ার মতাদর্শের হাকিকত হৃদয়ঙ্গম করা শুধু কঠিনই নয়, বরং কঠিন থেকে কঠিনতর।

এখানে কাউকে হেয় করা উদ্দেশ্য নয়। উম্মাহর ইমামগণকে আমরা ভালোবাসি। এটা ধ্রুবসত্য। এবং এরচে অধিক সত্য হলো, আমরা সত্যকে যে-কোনো ব্যক্তির থেকেও অধিক ভালোবাসি।

Share This