ফিতনার বজ্রধ্বনি—১ 

 

কিয়ামাত কখন সংঘটিত হবে

 

কিয়ামাত কখন সংঘটিত হবে—এটা তো সুনিশ্চিতভাবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন—

“লোকেরা আপনাকে কিয়ামাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন, কিয়ামাতের জ্ঞান তো আল্লাহ্‌রই কাছে। আপনি কী করে জানবেন? হতে পারে, কিয়ামাত অতি নিকটবর্তী।”[1]

“তারা আপনাকে কিয়ামাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে যে, তা কখন সংঘটিত হবে? এ বিষয়ের আলোচনার সাথে আপনার কী সম্পর্ক? এর জ্ঞান তো আপনার প্রতিপালকের কাছেই সমাপ্ত। যে ব্যক্তি কিয়ামাতের ভয় পোষণ করে, আপনি কেবল তার সতর্ককারী।”[2]

“লোকেরা আপনাকে কিয়ামাত সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে, তা কখন ঘটবে? বলে দিন, এ বিষয়ের জ্ঞান কেবল আমার প্রতিপালকেরই কাছে। তিনিই তা যথাসময়ে প্রকাশ করে দেখাবেন; অন্য কেউ নয়। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর জন্য তা অতি ভারি বিষয়। তোমাদের কাছে যখন তা আসবে, হঠাৎ করেই আসবে। তারা আপনাকে এমনভাবে জিজ্ঞেস করে, যেনো আপনি তা সম্পূর্ণরূপে জেনে রেখেছেন। বলে দিন, তার জ্ঞান কেবল আল্লাহ্‌রই কাছে রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়টি জানে না।”[3]

“কিয়ামাতের জ্ঞান শুধু আল্লাহ্‌র নিকট রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনিই জানেন, যা জরায়ুতে রয়েছে। কেউ জানে না, আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না যে, কোন স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ব বিষয়ে অবহিত।”[4]

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, জিবরিল আ. রাসুলুল্লাহ সা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, কিয়ামাত কখন সংঘটিত হবে? তিনি বললেন, এ ব্যাপারে যাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তিনি জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা অধিক জ্ঞাত নন। তবে আমি আপনাকে কিয়ামাতের আলামাতসমূহ বলে দিচ্ছি—বাদী যখন তার মনিবকে জন্মদান করবে, উটের নগণ্য রাখালরা যখন বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণে প্রতিযোগিতা করবে। কিয়ামাতের জ্ঞান সেই পাঁচটি জিনিসের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। এরপর রাসুলুল্লাহ সা. এই আয়াতটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন—……(সুরা লুকমান: ৩৪)।[5]

আল্লামা ইবনু কাসির রহ. বলেন—

“আয়াতের অর্থ হলো—কিয়ামাতের জ্ঞান আপনার কাছে নেই, অন্য কোনো সৃষ্টজীবের কাছেও নেই। এর সকল জ্ঞান মহান আল্লাহরই কাছে। একমাত্র তিনিই নির্দিষ্টভাবে এর সময় জানেন।”[6]

আল্লামা সা‘দি রহ. বলেন—

“এজন্য যেহেতু কিয়ামাতের জ্ঞান এমন বিষয় সাব্যস্ত হলো, যা জানার মাঝে পার্থিব বা পারলৌকিক কোনো কল্যাণ নেই, বরং তা গোপন রাখার মাঝেই সুপ্ত রয়েছে সার্বিক কল্যাণ, তাই আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিকুলের থেকে এর জ্ঞানকে গোপন রেখেছেন এবং নিজের কাছেই শুধু এর দখল রেখেছেন।”

ইমাম ইবনু কাসির রহ. বলেন—

“নবি সা. থেকে কোনো হাদিসে এমনটা প্রমাণিত নেই যে, তিনি কোনো নির্দিষ্ট সময়ের সাথে কিয়ামাতকে সুনির্ধারিত করেছেন। তিনি শুধু এর আলামত, চিহ্ন এবং নিদর্শন উল্লেখ করেছেন।”[7]

হাফিজ সাখাবি রহ. বলেন—

“এমন যতো বর্ণনা রয়েছে, যাতে নির্দিষ্টভাবে কিয়ামাতের সময়সীমাকে সুনির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, সেগুলোর অবস্থা হলো—হয়তো তার ভিত্তিই নেই, কিবা সনদ সাব্যস্ত নয়।”[8]

সারকথা হলো, কিয়ামাত কখন সংঘটিত হবে—এর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্‌রই কাছে। তিনি ছাড়া আর কেউই তা জানে না। রাসুলুল্লাহ সা. কিবা জিবরিল আ.ও এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। হাঁ, কিয়ামাতের অনেক আলামত ও নিদর্শন রয়েছে; যার অনেকগুলো রাসুলুল্লাহ সা. খুলে খুলে বয়ান করেছেন। মুহাদ্দিসগণ তাদের রচিত হাদিসের কিতাবাদিতে ফিতান এবং আশরাতুস সা‘আহ নামে আলাদা অধ্যায় কায়েম করে এ বিষয়ক হাদিসগুলোকে সংকলিত করেছেন। এ বিষয়ক বর্ণনা সম্বলিত স্বতন্ত্র গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়।

 

মুসলিম উম্মাহ্‌র আয়ু

 

কোনো উম্মাহ্‌র আয়ু বলা হয় সেই সময়কে—যখন সেই উম্মাহ্‌র নবি প্রেরিত হন এবং এই আয়ু স্থায়িত্ব লাভ করে সেসময় পর্যন্ত, যখন তার পরবর্তী নবি প্রেরিত হন। পরবর্তী নবি প্রেরিত হবার পর পূর্ববর্তী উম্মাহ্‌র যেসকল জীবিত উম্মাতি এই নবির ওপর ইমান আনয়ন করবে, তারা দ্বিগুণ প্রতিদান পাবে—যেহেতু তারা দুই নবির উম্মাহ হবার সৌভাগ্য লাভ করেছে।[9] আর যেসকল উম্মাতি এই পরবর্তী নবির প্রতি ইমান আনতে অস্বীকৃতি জানাবে, তারা চরম হতভাগায় পরিণত হবে। তাদের অবস্থা হবে এমন, যেনো তারা সকল নবিকে অস্বীকার করেছে।

এর আলোকে প্রতিভাত হয় যে, মুসলিম উম্মাহ—মুহাম্মাদে আরাবি সা. এর উম্মাহ—এর আয়ু হলো রাসুলুল্লাহ সা. এর প্রেরিত হবার সময় থেকে কিয়ামাত পর্যন্ত, যেহেতু এরপর আর কোনো নবির আবির্ভাব হবে না, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় যে, ইসা আ. এর তিরোধানের পর ইয়ামান থেকে সেই কোমল বাতাসের প্রকাশ পর্যন্ত, যা সকল মুমিনের জীবনের যবনিকাপাত করবে। এরপর পৃথিবীর বুকে আর কোনো মুমিনের অস্তিত্ব থাকবে না। অনন্তর নিকৃষ্ট সৃষ্টজীবের ওপর কিয়ামাত প্রতিষ্ঠিত হবে।

এখানে একটি বিষয় সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য, এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা মানবজাতির মাঝে হতাশার বীজ বপন করতে চাই না এবং সকলকে কাজকর্ম থেকে নিবৃত্ত করতে চাই না। রাসুলুল্লাহ সা. তো বলেই দিয়েছেন—

“যদি কিয়ামাত এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, তোমাদের কারো হাতে গাছের চারা থাকে, আর সে ওঠার পূর্বে তা রোপন করার মতো সক্ষমতা রাখে, তাহলে সে যেনো তা রোপন করে নেয়।”[10]

আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রা. বলেন—

“তুমি তোমার দুনিয়ার জন্য এমনভাবে কাজকর্ম করো, যেনো তুমি চিরকাল এখানে বাস করবে। আর তুমি তোমার আখিরাতের জন্য এমনভাবে আমল করো, যেনো তুমি আগামীকালই মৃত্যুবরণ করবে।”[11]

সুতরাং আমাদের উদ্দেশ্য মানুষের মাঝে নৈরাশ্য জাগানো নয়; বরং উদ্দেশ্য হলো, বাস্তবতাকে পরিস্ফুট করা এবং পারলৌকিক জীবনের জন্য পাথেয় প্রস্তুতকরণের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানানো। মানুষদেরকে ভয় পাইয়ে দেয়া উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য হলো, গাফিলদেরকে অলসনিদ্রা থেকে জাগ্রত করা।

আর এখানে আমরা মুসলিম উম্মাহ্‌র বয়স হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো সময় বা তারিখকে উল্লেখ বা নির্ধারিত করবো না। এটা তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। বরং বিশুদ্ধ আসার এবং সালাফ ইমামগণের উক্তির আলোকে আমরা সম্ভাব্য সময়সীমার ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো মাত্র। আমরা পৃথিবীর সমাপ্তির ক্ষণ নিয়ে কোনো আলোচনাই করবো না। আর এর সাধ্যও আল্লাহ কাউকে দেন নি। বরং আমরা ‘মালাহিমে’র সূচনার সম্ভাব্য ক্ষণের ওপর আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো মাত্র।

 

উম্মাহ্‌র আয়ু সংক্রান্ত দুটি হাদিস

 

১.        রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “আগেকার উম্মাহ্‌র স্থায়িত্বের তুলনায় তোমাদের স্থায়িত্ব হলো আসর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যবর্তী সময়ের মতো। তাওরাত-অনুসারীদেরকে তাওরাত দেয়া হয়েছিলো। তারা এর আলোকে আমল করে যাচ্ছিলো। যখন দুপুর হলো, তখন তারা অপারগ হয়ে পড়লো। অনন্তর তাদেরকে এক এক ‘কিরাত’ করে পারিশ্রমিক দেয়া হলো। আর ইনজিল-অনুসারীদেরকে ইনজিল দেয়া হলো। তারা আসরের সালাত পর্যন্ত কাজ করে অপারগ হয়ে পড়লো। তাদেরকে এক এক ‘কিরাত’ করে পারিশ্রমিক দেয়া হলো। এরপর আমাদেরকে কুরআন দেয়া হলো। আমরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করলাম। অনন্তর আমাদেরকে দু’ দু’ ‘কিরাত’ করে প্রদান করা হলো। তখন কিতাবিগণ বললো, হে আমাদের প্রতিপালক, তাদেরকে দু’ দু’ ‘কিরাত’ করে প্রদান করেছেন, আর আমাদেরকে দিয়েছেন এক এক ‘কিরাত’ করে; অথচ কর্মের দিক দিয়ে আমরাই বেশি। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তোমাদের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে আমি কি তোমাদের ওপর কোনোপ্রকার জুলুম করেছি? তারা বললো, না। তখন তিনি বললেন, এ হলো আমার অনুগ্রহ—যাকে ইচ্ছা করি, তাকে দিই।”[12]

২.       মুসলিম ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের দৃষ্টান্ত হলো এমন—এক ব্যক্তি একদল লোককে নিয়োগ করলো, তারা তার জন্য রাত পর্যন্ত কাজ করবে। কিন্তু অর্ধদিবস পর্যন্ত কাজ করার পর তারা বললো, আপনার পারিশ্রমিকের আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। সে ব্যক্তি অন্য আরেক দল লোককে কাজে নিয়োগ করলো এবং বললো, তোমরা দিনের বাকি অংশ কাজ করো, তোমরা আমার নির্ধারিত পারিশ্রমিক পাবে। তারা কাজ করতে শুরু করলো। যখন আসরের সালাতের সময় হলো, তখন তারা বললো, আমরা যা কাজ করেছি, তা আপনার জন্য রেখে গেলাম। এরপর সে ব্যক্তি আরেক দল লোককে কাজে নিয়োগ করলো। তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনের বাকি অংশে কাজ করলো এবং সে দু’দলের পারিশ্রমিক অর্জন করলো।[13]

 

হাদিসদ্বয়ের সাধারণ অর্থ

 

এই দুই হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. আমাদেরকে স্পষ্টতার জন্য দৃষ্টান্ত ও উদাহরণের সাথে মুসলিম উম্মাহ্‌, পাশাপাশি ইহুদি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের স্থায়িত্বের সময়সীমা অবগত করছেন। তো আমরা হাদিস থেকে জানতে পারছি যে, মুসলিম উম্মাহ্‌র স্থায়িত্বের সময়সীমা হলো, আসর থেকে মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়। ইহুদিদের স্থায়িত্বের সময়সীমা হলো, ফজর থেকে জোহরের মধ্যবর্তী সময়। আর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের স্থায়িত্বের সময়সীমা হলো, জোহর থেকে আসরের মধ্যবর্তী সময়। অর্থাৎ মুসলিম এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের স্থায়িত্বের সময়সীমার দ্বিগুণ হলো ইহুদি গোষ্ঠীর স্থায়িত্বের সময়সীমা। কেননা ইহুদি গোষ্ঠী কাজ করেছে অর্ধদিবস আর মুসলিম এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায় মিলে কাজ করেছে দিনের বাকি অর্ধাংশ।[14]

পাশাপাশি হাদিস থেকে আমরা এও জানতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা এই উম্মাহকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। তিনি পূর্ববর্তী উম্মাহ্‌র লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য পারিশ্রমিকও পূর্ণরূপে প্রদান করেছেন, আর এই উম্মাহকে দান করেছেন তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহ্‌র প্রতি যে বিশেষ করুণা করেছেন, এ কারণে কিতাবিগণ ঈর্ষাকাতর হয়ে আপত্তি জানিয়ে বলে বসেছে—“হে আমাদের প্রতিপালক, তাদেরকে দু’ দু’ ‘কিরাত’ করে প্রদান করেছেন, আর আমাদেরকে দিয়েছেন এক এক ‘কিরাত’ করে; অথচ কর্মের দিক দিয়ে আমরাই বেশি।”

উল্লেখ্য, “কর্মের দিক দিয়ে আমরাই বেশি।” বাক্যটির দুই অর্থ—

১. আমরা দুনিয়াতে দীর্ঘ জীবন লাভ করেছি। ফলে আমাদের কর্মের পরিমাণও ছিলো বেশি।

২. আমাদের সদস্য ও অনুসারী সংখ্যা ছিলো বেশি। ফলে অপরিহার্যভাবে আমাদের কর্মের পরিমাণও আধিক্যের গুণে গুণান্বিত।

কথাটি প্রথম অর্থে ইহুদি গোষ্ঠীর উক্তি। আর মুসলিম জাতির তুলনায় তাদের স্থায়িত্বের সময়সীমা যে বেশি—এ বিষয়টি তো সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত। আর তা দ্বিতীয় অর্থে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উক্তি।[15]

এবার আমরা মূল আলোচনায় ফিরি—

হাফিজ ইবনু হাজার রহ. ফাতহুল বারি গ্রন্থে বলেন—“উপরিউক্ত হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, এই উম্মাহ্‌র স্থায়িত্ব এক হাজার বছরের থেকে অধিক হবে। কেননা হাদিসের দাবি হলো, ইহুদি গোষ্ঠীর সময়সীমা খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং মুসলিম উম্মাহ্‌র সময়সীমার তুলনায় দ্বিগুণ। বর্ণনাকারীগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, নবি সা. এর প্রেরিত হবার সময় পর্যন্ত ইহুদি গোষ্ঠীর স্থায়িত্বের মেয়াদ ছিলো, দু’হাজার বছরের থেকেও বেশি, আর এখান থেকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মেয়াদ হলো ছয়শ বছর।”[16]

তিনি আরো বলেন—“আলোচ্য হাদিসে দুনিয়ার আয়ুর স্বল্পতার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে।”[17]

হাফিজ ইবনু হাজার রহ. এর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যকে কিছুটা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলে তার রূপ এমন দাঁড়ায়—

১. ইহুদিদের আয়ুর দৈর্ঘ্য মুসলিম এবং খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের আয়ুর দৈর্ঘ্যের সমপরিমাণ। অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহ্‌র আয়ু + খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আয়ু = ইহুদি গোষ্ঠীর আয়ু।

২. খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আয়ু ছয়শ বছর, যেমনটা সহিহ আসারে বর্ণিত হয়েছে। সালমান ফারসি রা. বলেন—“ইসা আ. এবং মুহাম্মাদ সা. এর মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান হলো ছয়শ বছর।[18]

৩. ইহুদি গোষ্ঠীর সূচনা থেকে রাসুলুল্লাহ সা. প্রেরিত হওয়া পর্যন্ত সময়কাল ছিলো দু’হাজার বছরের কিছু বেশি। ঐতিহাসিকদের বর্ণনাগুলোর আলোকে অনুমিত হয় যে, এই “কিছু বেশি”র পরিমাণ খুব বেশি নয়, বরং একশ বছরের কিছু বেশি। তাহলে বাকি দুই উম্মাহ্‌—মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের বয়সও হবে অনুরূপ। এখান থেকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ছয়শ বছর বিয়োগ করলে ফলাফল দাঁড়ায় ১৫০০ বছরের কিছু বেশি। উল্লেখ্য যে, আমরা হিজরি ১৪৩৮ সনে বসবাস করছি। রাসুলুল্লাহ সা. নবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন হিজরি সন গণনা শুরু হবার ১৩ বছর পূর্বে। অর্থাৎ আমাদের বয়স ইতোমধ্যে ১৪৩৮ + ১৩ = ১৪৫১ বছর।

ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহ. বলেন—“আসারের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, এই উম্মাহ্‌র বয়স হাজার বছরের বেশি হবে। তবে এই বেশির পরিমাণ মৌলিকভাবে পাঁচশ বছর মাড়াবে না।”[19]

এখানে অবশ্য একটি বর্ণনা কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক—সা‘দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি দৃঢ়ভাবে এ কামনা করতে পারি যে, আমার উম্মাহ তার রবের নিকট মাত্র অর্ধদিনের অবকাশে অক্ষম হবে না। সা‘দ রা.কে প্রশ্ন করা হলো, অর্ধদিন কতোটুকু সময়? তিনি বললেন, পাঁচশ বছরের সমান।”[20]

এই বর্ণনাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর একটা ব্যাখ্যা হলো যা মুনাবি রহ. উল্লেখ করেছেন, “অর্থাৎ আমি আশা করি যে, আল্লাহ্‌র কাছে আমার উম্মাহ্‌র এমন অবস্থান থাকবে, তিনি তাদেরকে আমার এই সময় থেকে পাঁচশ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দেবেন।” আল্লামা তিবি, মোল্লা আলি কারি রহ.ও অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম আবু দাউদ এবং ‘আলমাসাবিহ’ প্রণেতার রীতি থেকেও অনুমিত হয় যে, তাদের কাছেও এই ব্যাখ্যাই গ্রহণীয় বোধ হয়েছে।

অর্থাৎ আমার নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় থেকে পাঁচশ বছর পর্যন্ত কিয়ামাত সংঘটিত হবে না—আমি এমনটা প্রত্যাশা করতে পারি। আর এই মেয়াদের পর যেকোনো সময় কিয়ামাত সংঘটিত হতে পারে। উল্লেখ্য, ‘অর্ধদিন’ শব্দকে ‘পাঁচশ বছর’ শব্দে ব্যাখ্যা করেছেন হাদিসের বর্ণনাকারী সাহাবি সা‘দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রা.; স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা. নন।

সুহায়লি রহ. বলেন, “এই হাদিসে এমন কথা নেই, যা পাঁচশ বছরের অধিক স্থায়িত্বের সম্ভাবনাকে নাকচ করে।” হাফিজ ইবনু কাসির এবং হাফিজ ইবনু হাজার রহ. এ বিষয়টিকে আরো বিস্তরভাবে সুস্পষ্ট করেছেন। সুনানে আবি দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আওনুল মা‘বুদে’ও আলোচিত হাদিসটির অধীনে সুন্দর আলোচনা পাওয়া যাবে।

এখানে পাঠকমনে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে, জোহর থেকে আসরের মধ্যবর্তী সময় আর আসর থেকে মাগরিবের মধ্যবর্তী সময় তো কাছাকাছি, ব্যবধান অতি স্বল্প; বরং বলা যায়, অনেক মৌসুমেই জোহর থেকে আসরের মধ্যবর্তী সময় আসর থেকে মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। অথচ মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের বয়স প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনা থেকে তো প্রমাণিত হচ্ছে এর সম্পূর্ণ উল্টো। তাহলে এর কী হেতু এবং রহস্য?

১৪ নাম্বার টীকার অধীনে আমরা এ সংশয়ের সমাধান করেছি। তাই এ আপত্তির সমাধান জানতে হলে ১৪ নাম্বার টীকা দ্রষ্টব্য।

 

কিতাবিদের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে উপরিউক্ত আলোচনার স্বপক্ষে প্রমাণ

আংগুর ক্ষেতের মজুরেরা

“বেহেশতী রাজ্য একজন গৃহস্থের মত। তিনি একদিন সকালবেলায় ক্ষেতের কাজে মজুর লাগাবার জন্য বাইরে গেলেন। তিনি মজুরদের সংগে ঠিক করলেন যে, দিনে এক দীনার করে দেবেন। এর পর তিনি তাদের তাঁর আংগুর ক্ষেতে পাঠিয়ে দিলেন। প্রায় ন’টার সময় আবার তিনি বাইরে গেলেন এবং বাজারে আরও কইয়েকজন বিনা কাজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরাও আমার আংগুর ক্ষেতে কাজ করতে যাও। আমি তোমাদের উপযুক্ত মজুরি দেব।’ তাতে সেই লোকেরাও কাজ করতে গেল।

সেই গৃহস্থ আবার প্রায় বারোটায় এবং তিনটায় বাইরে গিয়ে ঐ একই রকম করলেন। প্রায় পাঁচটার সময় বাইরে গিয়ে অন্য কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা কাজ না করে সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

তারা তাঁকে বললো, ‘কেউ আমাদের কাজে লাগায় নি।’

তিনি সেই লোকদের বললেন, ‘তোমরাও আমার আংগুর ক্ষেতের কাজে যাও।’

পরে সন্ধ্যা হলে আংগুর ক্ষেতের মালিক তাঁর কর্মচারীকে বললেন, মজুরদের ডেকে শেষ জন থেকে শুরু করে প্রথম জন পর্যন্ত প্রত্যেককে মজুরি দাও।’

বিকাল পাঁচটার সময় যে মজুরদের কাজে লাগানো হয়েছিল তারা এসে প্রত্যেকে এক এক দীনার করে নিয়ে গেল। এতে যাদের প্রথমে কাজে লাগানো হয়েছিল তারা বেশী পাবে বলে মনে করল, কিন্তু তারাও প্রত্যেকে এক এক দীনার করেই পেল।

তাতে তারা সেই মালিকের বিরুদ্ধে বিরক্তি প্রকাশ করে বলতে লাগল, ‘আমরা সারা দিন রোদে পুড়ে কাজ করেছি। কিন্তু যাদের শেষে কাজে লাগানো হয়েছিল তারা মাত্র একঘণ্টা কাজ করেছে, অথচ তাদের আপনি আমাদের সমান মজুরি দিলেন।’

তখন মালিক তাদের মধ্যে একজনকে বললেন, ‘বন্ধু আমি তোমার উপর তো অন্যায় করি নি। তুমি এক দীনারে কাজ করতে রাজী হও নি? তোমার পাওনা নিয়ে চলে যাও। তোমাকে যেমন দিয়েছি, এই শেষের জনকেও তেমনই দিতে আমার ইচ্ছা। যা আমার নিজের, তা আমার খুশীমত ব্যবহার করবার অধিকার কি আমার নেই? নাকি আমি দয়ালু বলে আমার চোখ টাটাচ্ছো?’

গল্পের শেষে ঈসা বললেন, ‘এইভাবেই শেষে যারা তারা প্রথম হবে, আর প্রথম যারা তারা শেষে পড়বে।’[21]

এ বিষয়ে কিতাবিদের আরো উক্তি জানার জন্য দ্রষ্টব্য— القدس بين الوعد الحق والوعد المفترى।

 

[1] সুরা আহযাব: ৬৩

[2] সুরা নাযি‘আত: ৪২-৪৫

[3] সুরা আ‘রাফ: ১৮৭

[4] সুরা লুকমান: ৩৪

[5] সহিহ বুখারি: ৫০

[6] তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, হাফিজ ইবনু কাসির: ৪/৪৩৬

[7] আননিহায়াহ ফিলা ফিতান ওয়াল মালাহিম: ১/২৫

[8] আলমাকাসিদুল হাসানাহ: ৪৪৪। একই কথা ইমাম ইবনু কাসির রহ.ও বলেছেন। দেখুন—আননিহায়াহ ফিলা ফিতান ওয়াল মালাহিম: ২/২৮। হাফিজ ইবনুল কাইয়িম রহ.ও অনুরূপ অভিমত প্রদান করেছেন। দেখুন—আলমানারুল মুনিফ: ১/৮০

[9] এর দৃষ্টান্ত হলেন—সালমান ফারসি, সুহাইব রুমি, আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম, নাজাশি রা.

[10] আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল: ১২৯০২; আলআদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারি: ২৭৯; আলমুসনাদ, আব্‌দ ইবনু হুমায়দ: ১২১৬; আলমুসনাদ, বায্‌যার: ৭৪০৮; আস্‌সিলসিলাতুস্‌ সাহিহাহ: ০৯

[11] বর্ণনাটি সুনানুল বায়হাকি, দায়লামি রহ. এর মুসনাদুল ফিরদাউস এবং সুয়ুতি রহ. এর আলজামিউস সাগিরে রাসুলুল্লাহ সা. এর দিকে নিসবত করে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণনাটি রাসুলুল্লাহ সা. থেকে প্রমাণিত নয়; বরং এটি আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রা. উক্তি। দেখুন—সিলসিলাতুল আহাদিসিয্‌ যায়িফাহ: ১৮

[12] সহিহ বুখারি: ৫৫৭, ৭৪৬৭, ৭৫৩৩; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৬১৩৩

[13] সহিহ বুখারি: ৫৫৮, ২২৭১

[14] এখানে অবশ্য একটি বিষয় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, ইমাম শাফেয়ি, মালিক, আহমাদ, আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদ রহ. এর মতে মূল ছায়া বাদে যখন কোনো বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয়, তখন জোহরের সালাতের ওয়াক্ত সমাপ্ত হয় এবং এরপর থেকেই আসরের সালাত আদায় করা যায়। শুধু ইমাম আবু হানিফা রহ. এর অভিমত হলো, বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত জোহরের ওয়াক্ত থাকে এবং তারপর গিয়ে আসরের সালাতের ওয়াক্ত আসে। জুমহুর ইমামগণ যেসকল নুসুসের মাধ্যমে দলিল দেন, তার মধ্যে উপরিউক্ত হাদিসটি অন্যতম। এর আলোকে প্রতিভাত হয় যে, জোহর থেকে আসরের মধ্যবর্তী সময়ের তুলনায় আসর থেকে মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ের পরিমাণ বেশি বা বলা যায় প্রায় দ্বিগুণ। সামনে আমরা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আয়ু এবং মুসলিম উম্মাহ্‌র আয়ুর ওপর যখন আলোকপাত করবো, তখন এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে ইন শা আল্লাহ। আর এজন্য হানাফি ফকিহগণও বলেছেন যে, জোহরের সালাত প্রথম মিসিলে পড়া এবং আসরের সালাত দ্বিতীয় মিসিলের সমাপ্তির পরে পড়াই উত্তম। কারণ এভাবে ইখতিলাফের আওতা থেকে বাইরে থাকা যায় এবং সালাতের বিশুদ্ধতার ব্যাপারেও অন্তর প্রশান্ত হয়।

[15] ফাতহুল বারি: ৪/৪৪৬, ইজারা অধ্যায়

[16] ফাতহুল বারি: ৪/৪৪৯

[17] ফাতহুল বারি: ৪/৪৪৮

[18] সহিহ বুখারি: ৩৯৪৮

[19] আলকাশ্‌ফ: ২০৬

[20] সুনানে আবি দাউদ: ৪৩৫০; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ১৪৬৫

[21] ইনজিল, ১ম সিপারা—মথি: ২০/১-১৬

Share This