ফিকহুস সিরাত

গুহার ধ্যানমগ্নতা : ফিকহ 

 

১. উপরিউক্ত সিরাতের ফিকহ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথম যে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে, তা হলো: নির্জনতা এবং একাকিত্ব গ্রহণের বিধান। আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সা.-কে নবুওয়াতের মহান গুরুদায়িত্ব অর্পণ করার পূর্বে তাঁর তারবিয়াতের অংশ হিসাবে নির্জনতাকে তাঁর কাছে প্রিয় করে তুলেছিলেন; যার বিস্তারিত আলোচনা ওপরে উল্লেখিত হয়েছে। এর আলোকে তো স্বাভাবিকভাবে এ বিষয়টি প্রতিভাত হয় যে, ব্যাপকভাবে মুসলমানদের জন্য এবং বিশেষভাবে দায়ি ও যারা নবুওয়াতের উত্তরাধিকারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখে—তাদের জন্য একাকিত্ব ও নির্জনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এবং উপকারী একটি বিষয়। বাহ্যিক ইবাদত—হোক তা ফরজ ইবাদত কিংবা দাওয়াহর মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ—প্রচুর পরিমাণ করা হলেও অনেক সময় নফস এবং শয়তান মানুষের ভেতরে ভয়ানক সব ব্যাধি সৃষ্টি করে দেয়। অন্তরের এমন কিছু ব্যাধি রয়েছে, যার উপশমের জন্য কিছু সময় সমাজের কোলাহল এবং মানুষের উপস্থিতি থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। একান্তে নিজের নফসের মুহাসাবা করা প্রয়োজন। অহংকার, আত্মগরিমা, হিংসা, লৌকিকতা, দুনিয়ার ভালোবাসা ইত্যাদি এমন সব ব্যাধি, যা মানুষের অন্তরে রেখাপাত করে এবং ভেতরে সুদৃঢ়ভাবে শেকড় গাড়ে। বাহ্যিকভাবে সে অনেক নেক কাজ করলেও অন্তরের এসব ব্যাধি তার আত্মিক উন্নতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। যখন সে একান্তে মুরাকাবা করবে, নফসের মুহাসাবা করবে, নিজের স্বরূপ সম্পর্কে ভাববে, স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং স্রষ্টার প্রতি তার অভিমুখিতা সম্পর্কে ভাববে, এরপর মানুষদের দুর্বলতার কথা স্মরণ করবে, স্রষ্টার সামনে তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে চিন্তা করবে তখন তাদের নিন্দা-প্রশংসার অবস্থানও তার সামনে উদ্ভাসিত হবে। এ ছাড়াও আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব এবং মহত্ব, মৃত্যুপরবর্তী অবস্থা, জান্নাত এবং তার নেয়ামতরাজি, জাহান্নাম এবং তার ভয়াবহ পরিণতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যখন সে ভাববে তখন তার অন্তর আলোকিত হবে, অন্তরের ব্যাধিসমূহ দূর হবে, সে অপার্থিব শক্তিতে শক্তিমান হয়ে দীনি খেদমতে আত্মনিয়োগ করতে পারবে।

এখন যে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে, তা হলো: এই নির্জনতা এবং একাকিত্ব কি সর্বাবস্থায় উপকারী? যে-কোনো ধরনের একাকিত্বই কি শরিয়াহর কাম্য? সমাজবিচ্ছিন্ন জীবন কি সামাজিক জীবনের থেকে উত্তম?

উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে তো এতটুকু স্পষ্ট যে, এসব ক্ষেত্রে একাকিত্ব এবং নির্জনতাই মূল লক্ষ্য নয়; বরং তা লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে সহায়ক মাত্র। যেহেতু তা লক্ষ্য নয়, বরং উপলক্ষ্য ও সহায়ক, তাই তার কিছু সীমা-পরিসীমা এবং স্বতন্ত্র বিধান থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।

একটি বিষয় লক্ষণীয়: নির্জনতা বোঝানোর জন্য এসব ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় দুটি শব্দ প্রচলিত রয়েছে—‘খালওয়া’ এবং ‘উযলাহ’। শব্দদুটির মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা.-এর হেরা গুহার ধ্যানমগ্নতা সংক্রান্ত হাদিসে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা হলো ‘খালওয়া’। ‘খালওয়া’ শব্দের শাব্দিক এবং পারিভাষিক অর্থ একই—নির্জনতা, একাকিত্ব।[1] আর ‘উযলাহ’ শব্দের অর্থ—বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব। এ দুই শব্দের পার্থক্য তুলে ধরেছেন ইমাম সুহরাওয়ারদি রহ.। তিনি বলেন: ‘খালওয়া এবং উযলাহ এক নয়। খালওয়া বলা হয় অন্য মানুষদের থেকে পৃথক হয়ে একাকী অবস্থানকে। আর উযলাহ বলা হয় নিজের নফস এবং যা-কিছু আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে উদাসীন করে দেয় তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনতা অবলম্বন করা। খালওয়া প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যায়। তবে উযলাহ্‌র অস্তিত্ব প্রায় শূন্যের কোঠায়।’[2]

সারকথা হলো, উযলাহ মানে হলো সবকিছু থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, এমনকি নিজের নফস এবং আরও যা-কিছু আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ করতে পারে—এমন সব কিছু থেকে দূরে বাস করা। আর খালওয়া মানে হলো মানুষদের থেকে সাময়িকভাবে নির্জনতা অবলম্বন করা।

খালওয়ার বিধান হলো: মৌলিকভাবে তা বৈধ। ক্ষেত্রবিশেষ তা মুসতাহাবও হয়ে যায়—যখন যিকির বা ইবাদতের জন্য তা হয়ে থাকে। ওপরে সহিহ বুখারি সূত্রে বর্ণিত হাদিসে নবি সা.-এর খালওয়ার কথা উল্লেখিত হলো। ইমাম নববি বলেন:

الْخَلْوَةُ شَأْنُ الصَّالِحِينَ وَعِبَادِ اللَّهِ الْعَارِفِينَ

খালওয়া নেককার এবং আল্লাহ তাআলার পরিচয়-লাভকারী বান্দাদের বৈশিষ্ট্য।[3]

এবার আসি উযলাহ প্রসঙ্গে। উযলাহ মানে সমাজবিচ্ছিন্ন জীবন। তো এই বিচ্ছিন্নতা উত্তম, নাকি সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা—এটাই এখানে আলোচ্যবিষয়। যে সময়ে সমাজে ব্যাপকভাবে ভয়াবহ ফিতনা ছড়িয়ে পড়ে, ইমান বাঁচানোই যখন দুরূহ হয়ে পড়ে তখন সর্বসম্মতিক্রমেই সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী মহান প্রতিপালকের ইবাদতে আত্মমগ্ন থাকা উত্তম।

পবিত্র কুরআনে ইবরাহিম আ.-এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে: ‘আমি আপনাদের থেকে এবং আপনারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করেন তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছি। আমি আমার প্রতিপালককে ডাকতে থাকবো। আমি পরিপূর্ণ আশাবাদী যে, আমি আমার প্রতিপালককে ডেকে ব্যর্থকাম হবো না। যখন সে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকতো তাদের থেকে পৃথক হয়ে গেলো, তখন আমি তাকে (নেয়ামতস্বরূপ) ইসহাক ও ইয়াকুব দান করলাম এবং তাদের প্রত্যেককে নবি বানালাম।’[4]

উকবা ইবনু আমির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর রাসুল, মুক্তির উপায় কী?’ তিনি বললেন: ‘তুমি তোমার জিহ্বা সংযত রাখো। তোমার বাসস্থান যেন তোমার জন্য প্রশস্ত হয় (অর্থাৎ তুমি তোমার ঘরেই অবস্থান করো) এবং নিজ গুনাহের জন্য কাঁদো।’[5]

আসহাবে কাহাফের ঘটনা তো সুবিদিত। উসমান রা.-এর শাহাদাতের পর বদরি সাহাবিগণের কয়েকজন সমাজবিচ্ছিন্ন জীবন গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদেরকে এরপর আর ঘরের বাইরে দেখা যায়নি; শুধু তাঁদের লাশ ছাড়া।[6]

হাঁ, তবে যদি সে এমন ব্যক্তি হয়, যে মাথাচাড়া দিয়ে জেগে ওঠা ফিতনাসমূহকে নির্বাপিত করতে পারে তবে তার জন্য সমাজবিচ্ছিন্ন না হয়ে সমাজে থেকে ধীরে ধীরে  ফিতনার মোকাবেলা চালিয়ে যাওয়াই উত্তম।[7]

যখন সমাজে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে তখন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ইবাদতে আত্মমগ্ন থাকার কী বিধান—এ ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম নববি রহ. বলেন: ‘জেনে রেখো, মানুষের সাথে সেভাবে মেশা—যা আমি বললাম, অর্থাৎ সমাজের ভালোদের সঙ্গে ওঠাবসা করা ও মন্দদের থেকে দূরে থাকা এবং নিজের অনিষ্ট থেকে সমাজের ভালো মানুষগুলোকে নিরাপদ রাখা—এটাই গ্রহণীয় পথ, যার ওপর ছিলেন রাসুলুল্লাহ সা., অন্য সকল নবি আ., তেমনি খুলাফায়ে রাশেদিন এবং তাঁদের পরবর্তী সাহাব-তাবেয়িগণ, তাঁদের পরবর্তী মুসলমানদের আলিম এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ। অধিকাংশ তাবেয়ি এবং তৎপরবর্তীদের মাযহাব এটাই। ইমাম শাফেয়ি, আহমাদ এবং অধিকাংশ ফকিহ রহ.ও এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।’[8]

এই অভিমতের পক্ষে এ ছাড়াও আরও অনেক প্রমাণ রয়েছে:

ক. আল্লাহ তাআলা সামাজিক জীবন যাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, এ ব্যাপারে উৎসাহও দিয়েছেন এবং তিনি পৃথক হতে নিষেধ করেছেন, এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রশিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিভক্ত হোয়ো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রেখো। একটা সময় ছিলো, যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে। এরপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহ জুড়ে দিলেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে।’[9]

খ. আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা তাদের মতো হোয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি আসার পরও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো এবং আপসে মতভেদ সৃষ্টি করেছিলো।’[10]

গ. রাসুলুল্লাহ সা. বলেন: ‘যে মুমিন মানুষজনের সাথে মিশে এবং তাদের দেয়া কষ্টের ওপর ধৈর্যধারণ করে, সে ওই মুমিন বান্দার থেকে উত্তম, যে মানুষজনের সাথে মিশে না এবং তাদের দেয়া কষ্টের ওপর ধৈর্যধারণ করে না।’[11]

ঘ. এ ছাড়াও ইসলামের আরও অনেক বিধান রয়েছে, যা সমাজজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেমন: সৎকাজের আদেশ এবং অষৎকাজ থেকে নিষেধ, ইসলামের শাআয়িরমূলক ক্ষেত্রগুলোতে উপস্থিতি, নেককাজ এবং তাকওয়ার পথে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, অভাবীদেরকে সাহায্য করা এবং সামাজিক আদর্শিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা, মুসলমানদের জামাআতের সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রভৃতি। এসব কারণেও সামাজিক জীবন সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনের থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যারা সামাজিক সংস্কারমূলক কাজ করার সক্ষমতা রাখে, তাদের জন্য তো আরও বেশি নিন্দনীয়।[12]

সারকথা হলো: সাময়িক নির্জনতা কল্যাণকর। স্থায়ীভাবে সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনযাপন বিশেষ ক্ষেত্রে উত্তম; তবে ব্যাপকভাবে নয়। স্বাভাবিক বিধান হলো, সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা এবং সর্বদা সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পেছনে মেহনত ব্যয় করা সর্বোত্তম। আর এক্ষেত্রে আত্মিক শক্তিতে প্রবৃদ্ধি ঘটানোর জন্য মাঝে মাঝে বিরতি নিয়ে একাকী নির্জনে আল্লাহ তাআলার দিকে অভিমুখী হয়ে মুরাকাবা-মুহাসাবা করা, আল্লাহ তাআলার যিকির এবং ইবাদতে আত্মনিমগ্ন থাকা।

এককথায়, একাকিত্ব এবং নির্জনতা হলো ওষুধের মতো, রোগের উপশমের জন্য যা সাময়িকভাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। একান্ত বাধ্য হয়ে যা স্বল্প পরিমাণে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যদি এই নির্জনতাকে বিচ্ছিন্নতা বানিয়ে ফেলা হয় এবং ওষুধই রোগে পরিণত হয়ে দাঁড়ায়, তখন বরং এরই চিকিৎসা প্রয়োজন। কোনো কোনো আবিদের জীবনীতে পাওয়া যায় যে, তারা সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেছেন, আত একান্তই তাদের ব্যক্তিগত হালত; উম্মাহর জন্য অনুসরণীয় নয়। এটা নবি সা. কিংবা খাইরুল কুরুনের আদর্শ নয়।[13]

কোন ধরনের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা এবং কোন ধরনের মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা শরিয়াহর দাবি—এ ব্যাপারে অত্যন্ত সুন্দর বক্তব্য প্রদান করেছেন হাফিজ ইবনুল কায়্যিম রহ., যে বক্তব্যকে এ বিষয়ের মানদণ্ডরূপে গণ্য করা যেতে পারে। তিনি বলেন:

‘মানুষের সঙ্গে অতিরিক্ত মেলামেশা হলো দুরারোগ্য ব্যাধি, যা সকল অনিষ্টকে টেনে আনে। মানুষের সঙ্গে সংমিশ্রণ এবং মেলামেশা কত নেয়ামতকে ছিনিয়ে নিয়েছে, অন্তরে কত শত্রুতার বীজ চাষ করেছে, হৃদয়ে কী পরিমাণ হিংসা-বিদ্বেষের চারা রোপন করেছে! অনড় পাহাড় টলে যায়, কিন্তু অন্তর থেকে তা সরে না। অনর্থক মেলামেশায় রয়েছে দুনিয়া এবং আখিরাতের ক্ষতি। মানুষের জন্য উচিত হলো প্রয়োজন পরিমাণ মেলামেশাকে গ্রহণ করা এবং মানুষদেরকে চার ভাগে ভাগ করে নেয়া। যখন সে এক ভাগের সঙ্গে অন্য ভাগকে মিলিয়ে ফেলবে, তখনই অনিষ্ট দেখা দেবে।

ক. যাদের সঙ্গে মেলামেশা করা খাদ্যের মতো; রাত-দিনে যাদের থেকে সে অমুখাপেক্ষী থাকতে পারে না। যখন সে এ থেকে তার প্রয়োজন গ্রহণ করে নেবে, তখন সে সঙ্গ ছেড়ে দেবে। এরপর যখন পুনরায় প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন তার সঙ্গ আবারও গ্রহণ করবে। সর্বদা তা এভাবেই চলতে থাকবে। এই প্রকার লাল দিয়াশলাইয়ের থেকেও অধিক দামি। তাঁরা হলেন: আল্লাহ তাআলা, তাঁর নির্দেশনাবলি, তাঁর শত্রুদের চক্তান্ত-অপকৌশল, অন্তরের ব্যাধি এবং তার চিকিতসা সম্পর্কে জ্ঞাত আলিমগণ, যারা আল্লাহ, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসুল এবং মুমিনদের প্রতি কল্যাণকামী। এই প্রকার এমন, যাদের সঙ্গ গ্রহণের মধ্যে রয়েছে কল্যাণ এবং কল্যাণ।

খ. দ্বিতীয় প্রকার এমন, যাদের সঙ্গ ওষুধপথ্যের মতো। রোগ হলে যার দিকে মানুষ মুখাপেক্ষী হয়। যখন তুমি সুস্থ থাকবে, তখন তার সঙ্গে মেলামেশা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তারা হলো সেসব লোক, জীবন-জীবিকা পরিচালনার জন্য যাদের সঙ্গে মেলামেশা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন, যেমন: লেনদেন, সামাজিক আচার-আচরণ, শলা-পরামর্শ, রোগের জন্য চিকিৎসা প্রভৃতি। যখন এই প্রকার মানুষের সঙ্গে প্রয়োজন শেষ হবে, তখন বাকি থাকবে তৃতীয় প্রকারের সঙ্গে তাদের মেলামেশা।

গ. যাদের সঙ্গ ব্যাধির মতো। এদের স্তরবিন্যাস রয়েছে, প্রকারের ভিন্নতা রয়েছে। তেমনি দুর্বলতা-শক্তিমত্তার বিচারেও এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

ঘ. যাদের সঙ্গ পুরোটাই ধ্বংসের কারণ। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা বিষ খাওয়ার পর্যায়ভুক্ত। যদি বিষ খেয়ে ফেলার অব্যবহিত পরেই বিষনাশক খাওয়া হয়, তাহলে তো প্রাণ বেঁচে যাবে; নইলে ভবলীলাই একেবারে সাঙ্গ হয়ে যাবে। মানুষের মধ্যে এই প্রকারের লোকদের সংখ্যা কত না বেশি! আল্লাহ তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি না করুন! এরা হলো পথভ্রষ্ট এবং বিদআতপন্থী লোকেরা, যারা রাসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ থেকে মানুষদেরকে ফিরায় এবং এর বিপরীত পথের দিকে আহ্বান করে। যারা আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে এবং সেই পথকে বক্ররূপে পেতে চায়।[14]

২.  বান্দার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মহান প্রতিপালকের সঙ্গে সম্প্রীতি এবং ভালোবাসার সেতুবন্ধন রচনা করা। সবকিছুর থেকে আল্লাহকে অধিক ভালোবাসা। আর আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের জন্য সহজ পন্থা হলো, তাঁর বড়ত্ব এবং মহত্ব নিয়ে ভাবা, তাঁর নেয়ামতরাজি নিয়ে চিন্তা করা, এরপর মুখে এবং অন্তরে আল্লাহকে বেশি থেকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করা। এসব অর্জিত হবে সমাজের কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে নির্জনে মহান আল্লাহর ধ্যানে আত্মমগ্ন হওয়ার মাধ্যমে। দায়িদের জন্য বিষয়টি অত্যাধিক গুরুত্ববহ।

৩. আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব এবং মহত্ব, তাঁর সৃষ্টি এবং অবারিত নেয়ামতরাজি নিয়ে চিন্তা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘নিশ্চয়ই আকাশসমূহ এবং পৃথিবীর সৃষ্টিতে ও রাত-দিনের পালাক্রমে আগমনে বহু নিদর্শন আছে সে-সকল বুদ্ধিমানের জন্য, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে…।’[15] রাসুলুল্লাহ সা. বলেন: ‘তার জন্য দুর্ভোগ, যে তা পড়ে, কিন্তু তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করে না।’[16] আলি রা. থেকে আসারে বর্ণিত হয়েছে: ‘চিন্তা-ফিকিরের মতো আর কোনো ইবাদত নেই।’[17]

৪. ইবাদতের জন্য আত্মত্যাগ। রাসুলুল্লাহ সা. হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন হওয়ার জন্য মক্কা থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত জাবালে নুরের উদ্দেশে একাকী গমন করতেন। গ্রীষ্পের দাবদাহ কিংবা শৈত্যপ্রবাহ সবকিছু উপেক্ষা করে মহান প্রতিপালকের উদ্দেশে ছুটে যেতেন। সুউচ্চ পাহাড় অতিক্রম করে সেই নির্জন গুহায় গিয়ে ইবাদতে রত হতেন। অথচ তখনও তিনি শরিয়াহপ্রাপ্ত হননি। এই ইবাদতগুলো তাঁর ওপর অপরিহার্য ছিলো না। একান্ত স্বেচ্ছায় তিনি ত্যাগের এই অসামান্য নাযরানা পেশ করেছেন। এতে রয়েছে উম্মাহর জন্য বিরাট শিক্ষা।

৫. রাসুলুল্লাহ সা. হেরা গুহায় ধ্যানমগ্নতা অবলম্বন করলেও পরিবারের হক আদায়ে কোনো ত্রুটি করেননি। তিনি স্থায়ীভাবে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল্লাহ দাররায বলেন: ‘আয়িশা রা.-এর হাদিসে প্রয়োগকৃত শব্দ ‘এভাবে কয়েক রাত তিনি ইবাদতে রত থাকতেন’ থেকে অনুমিত হয় যে, তার ধ্যানমগ্নতার মুদ্দত খুব কমও ছিলো না, আবার মাত্রাতিরিক্ত বেশিও ছিলো না। নবি হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বেই তাঁর এই কর্মপন্থা ছিলো ভারসাম্য এবং মধ্যমপন্থার অনন্য দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাঁকে জগতবাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করার পর এটাই ছিলো মিল্লাতে ইসলামিয়ার প্রতীক, মহান নববি আদর্শের নিদর্শন।’[18]

৬. জাহেলি সমাজে বাস করেও সমাজের রীতির সাথে তাল না দেয়া, গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে না দেয়া। ওপরে উল্লেখিত হয়েছে যে, কুরাইশরা ইবরাহিম আ.-এর আদর্শ হজের মধ্যে অহংবশত কী বিকৃতি-পরিবর্তন সাধন করেছিলো এবং স্বার্থপূর্ণভাবে কীভাবে নিজেদের জন্য আলাদা বিধান প্রণয়ন করে নিয়েছিলো। সেই সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়েও তিনি কীভাবে কার্যত সমাজের বিরোধিতা করেছেন এবং নিঃসঙ্কোচভাবে সত্যকে অনুসরণ করেছেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

 

আরও পড়ুন: গুহার ধ্যানমগ্নতা-১

টীকা 

[1] বাদায়িউস সানায়ি: ২/২৯৩; আলমাজমু: ৪/১৫৫; শারহু সহিহ মুসলিম, ইমাম নববি: ২/১৯৮

[2] আওয়ারিফুল মাআরিফ: ৪২৪-৪২৫

[3] শারহু সহিহ মুসলিম: ২/১৯৮

[4] সুরা মারয়াম: ৪৮-৪৯

[5] জামি তিরমিযি: ২৪০৬; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ১৭৩৩৪, ১৭৪৫২, ২২৩৫

[6] তাফসিরুল কুরতুবি: ১০/৩৬২

[7] উমদাতুল কারি: ১/১৬৩; কুরতুবি: ১০/৩৬০, ১৭/২৬৪

[8] দালিলুল ফালিহিন: ৩/৪৬-৪৭; উমদাতুল কারি: ১/১৬৩

[9] সুরা আলে ইমরান: ১০৩

[10] প্রাগুক্ত: ১০৫

[11] আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৫/৩৬৫; আলআদাবুশ শারইয়্যাহ: ৩/৪৭৬

[12] উমদাতুল কারি: ১/১৬৩; ফাতহুল বারি: ১৩/৪২-৪৩

[13] ফিকহুস সিরাত, বুতি: ৯৪-৯৫

[14] বাদায়িয়ুল ফাওয়ায়িদ: ২/২৭৩-২৭৪; আলমাজমুউল কায়্যিম: ১৭৪-১৭৬

[15] সুরা আলে-ইমরান: ১৯০-১৯১

[16] সহিহ ইবনু হিব্বান: ৬২২

[17] শুআবুল ইমান, বায়হাকি

[18] আলমুখতার মিন কুনুযিস সুন্নাহ: ১৯

Share This