মহাপবিত্র গ্রন্থ আলকোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন —

إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

নিশ্চয়ই কেয়ামতের ক্ষণ স¤পর্কিত জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন, মাতৃগর্ভে কী আছে। কোনো প্রাণী জানে না, সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনো প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু তার হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে পূর্ণ অবগত, সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ খবর রাখে। {সুরা লুকমানঃ ৩৪}

 

যখন থেকে আবহাওয়াবিদরা ঝড়ের পূর্বাভাস দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান উৎকর্ষ লাভ করে গর্ভস্থ সন্তানের জেন্ডার কী— তা আগাম বলে দিতে পারে, তখন থেকে উপরিউক্ত আয়াতটির প্রতি মুক্তমনা আধুনিকমনস্ক অনেককে দেখা যায়, অভিযোগের তীর্যক বাণ ছুঁড়ে বসেন, ইসলামের দিকে বুড়ো আঙ্গুল উঁচু করেন। আলকোরআনের সংবাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য এ তো এক মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগ হাতছাড়া করলে কি আর চলে!

 

এবার আমরা দেখি, আয়াত আসলে কী বলছে আর তারা কী ছাই বুঝে তাকধিনাধিন ধিনধিনতার লয়ে অবিরল নৃত্য করছে। আলকোরআনের এক আয়াত অন্য আয়াতের তাফসিরস্বরূপ। সুরা আনআমের উনসত্তর নাম্বার আয়াতটি লক্ষ করুন—

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ

তাঁরই কাছে গায়বের চাবিকাঠি; যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। জলে-স্থলে যা-কিছু আছে, সব তিনি জানেন।

 

সুরা আনআমের এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, গায়বের চাবিকাঠি হলো পাঁচটি। এরপর তিনি সুরা লুকমানে উল্লেখিত পাঁচটি জিনিস উদ্ধৃত করেন। অর্থাৎ সেই পাঁচটি বিষয় এমন, যার ইলম একমাত্র আল্লাহ তাআলার কাছে। {দ্রষ্টব্য— তাফসিরে তাবারিঃ ১১/৪০২}

 

আচ্ছা, তাহলে কি আল্লাহ তাআলা বিশেষ জ্ঞান মাত্র এই পাঁচটি বিষয়? না, বিষয়টি আসলে তা নয়। উপরিউক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রকৃত বিষয়টি ইনশাআল্লাহ দিবালোকের মতো ¯পষ্ট হয়ে যাবে।

 

ওয়ারিস ইবনে আমর নামক এক গেঁয়ো লোক রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে এসে বললো, কেয়ামত কখন হবে? এরপর জিজ্ঞেস করলো, আমাদের চাষাবাদের যমিনগুলো অনাবৃষ্টিতে ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। বৃষ্টি কখন হবে? এরপর তার তৃতীয় প্রশ্ন— বাড়িতে স্ত্রীকে গর্ভবতী অবস্থায় রেখে এসেছি। সে কী সন্তান (ছেলে না মেয়ে) প্রসব করবে? তার চতুর্থ প্রশ্ন— গতকাল কী করেছি এবং আজ কী করছি, তা তো আমার জানা আছে। কিন্তু আগামী দিন আমি কী করবো? এরপর তার সর্বশেষ প্রশ্ন— আমার জন্মস্থান তো আমি চিনি। কিন্তু আমার মৃত্যু কোথায় হবে? ওয়ারিস ইবনে আমর পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলো। তার প্রশ্নের জবাবে আলকোরআনের উপরিউক্ত আয়াতটি নাযিল হয়। তাতে বলা হয়, এ বিষয়গুলোর জ্ঞান তো একমাত্র আল্লাহ তাআলার কাছে। তাই অন্য কারো কাছে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা সমীচীন নয়। সুতরাং এ আয়াত থেকে এই কথা প্রতীয়মান হয় না যে, গায়বের ব্যাপ্তি কেবল এই পাঁচটি বিষয়ই। আয়াতটি গায়বের বিষয়সমূহের কোনো সূচি বা তালিকা নয়। ওয়ারিস ইবনে আমরের প্রশ্নের উত্তরে বিবৃত একটি মূলনীতি মাত্র {দ্রষ্টব্য— তাফসিরে ফাতহুল কাদির, শাওকানিঃ ৪/২৮২}

আল্লাহ তাআলার ইলমের বৈশিষ্ট্য কী? সুরা আনআমের উপরিউক্ত আয়াতটি লক্ষ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলার ইলমের অনন্য বৈশিষ্ট্য দু’টি—

১.        আল্লাহ তাআলা গায়ব সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।

২.       আল্লাহ তাআলার ইলম পরিপূর্ণ এবং সর্ববিষয়ে পরিব্যাপ্ত।

 

আয়াতের দু’অংশে দু’টি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাহলে এই আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, উপরিউক্ত দু’টি বৈশিষ্ট্য কেবল আল্লাহ তাআলার ইলম এবং জ্ঞানের সাথে বিশেষিত। কোনো মাখলুকের জ্ঞানের মধ্যে উক্ত বৈশিষ্ট্যদু’টি পাওয়া যাবে না।

গায়ব কী? গায়ব হলো এমন বিষয়, যা মানুষের আকল ও পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না। প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল্লামা নাসাফি রহ. বলেন, গায়ব হলো এমন বিষয়, যার ওপর কোনো দলিল প্রতিষ্ঠিত হয় না। {দ্রষ্টব্য— তাফসিরে নাসাফিঃ ২/৬১৭}। যেমন, জান্নাত জাহান্নাম পরকাল ফেরেশতা— এসবই গায়ব। না আকল দ্বারা এ বিষয়গুলোর স্বরূপ উদ্ঘাটন করা সম্ভব আর না পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা। এজন্যই তো মুসলমানরা তাদের মেটাফিজিক্সের ক্ষেত্রে আকলে নয়, নকলে (কোরআন-সুন্নাহয়) বিশ্বাসী। বাতিলপন্থীদেরকে বোঝানোর জন্য আকলি যুক্তি উপস্থাপন করে ঠিক, তবে নিজেদের বিশ্বাসের ভিত্তি আকলের ওপর রাখেনি, রেখেছে নকলের ওপর। নকলকে অন্যদের চোখেও শক্তিশালী প্রমাণিত করার জন্য এবং নিজেদের আকিদাগত অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য, সর্বপ্রকার সংশয়-সন্দেহ থেকে দূরে থাকার জন্য মূলত আকলি দলিলের ব্যবহার। (এ স্পষ্ট কথাটি অনেক উর্বর মস্তিষ্কের বোধে ধরে না। আকলের সঙ্গে এক গোষ্ঠীর বৈরিতা আজ থেকে নয়, বরং প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলছে সে ধারা। এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে মনে করে নির্বোধ ও ভ্রান্ত। বিস্তারিত আল্লামা যফর আহমদ উসমানি রচিত আলআকলু ওয়ান নাকলু কিতাবে দ্রষ্টব্য।)

এবার আমরা মানবজাতির জ্ঞানের দিকে দৃষ্টিপাত করি। এ বিশয়ে তো কেউ দ্বিমত করবে না যে, মানুষের জ্ঞান পরিপূর্ণ নয়, সর্ববিষয়ে পরিব্যাপ্তও নয়। আর জ্ঞানের জন্য মানুষ পঞ্চইন্দ্রিয় এবং আকলের মুখাপেক্ষী। এছাড়া জ্ঞানার্জনের জন্য ভিন্ন কোনো পন্থা বা মাধ্যম তাদের কাছে নেই। ফলে তাদের অর্জিত জ্ঞান অকাট্যও নয়। এজন্যই তো ঝড়ের সংকেত দেয়ার পরও অনেক সময়ই ঝড় হয় না, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া সত্ত্বেও ভূমি কাঁপে না, পৃথিবী ধ্বংসের সুনিশ্চিত বার্তা প্রচার করার পরও সবকিছু থাকে আগেরই মতো, গর্ভস্থ সন্তানের জেন্ডার একটা নির্ধারণ করে জন্মলাভের পর দেখা যায়, নবজাতক ভিন্ন জেন্ডারের। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলার জ্ঞান অকাট্য, পরিপূর্ণ, সর্ববিষয়ে পরিব্যাপ্ত।

গায়বের ইলম একমাত্র আল্লাহ তাআলার কাছে। তিনি কাউকে কোনো কিছু জানালেই কেবল সে তার জানতে পারে। ভবিষ্যৎ হলো গায়বের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু হাদিসের সাধারণ পাঠকও অবগত যে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সা. অনেক কিছুই বলে গেছেন। তা কীভাবে সম্ভব হলো? তবে কি তিনিও গায়ব জানতেন? না, বরং আল্লাহ তাআলা তাকে জানিয়েছেন বলেই তিনি তা জেনেছেন। আল্লাহ তাআলা কাউকে ওহির মাধ্যমে কোনো কিছু জানান। আর কাউকে জানান ভিন্ন কোনো মাধ্যমে। যেমন ধরুন, আমরা তো বিশ্বাস করি, সবকিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ তাআলা। তাহলে আমরা যে প্রতিদিন নিজেদের হাতে অসংখ্য জিনিস তৈরি করছি, রচনা করছি, সৃষ্টি করছি — এসব আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআন হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। অথচ এই কোরআন তো আমরাই সিনায় ধারণ করছি, সংরক্ষণ করছি। শুধু আলকোরআনের সব্দই নয়, বরং শব্দ-মর্ম সবকিছুকেই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করছি। আলকোরআনের শব্দ তো দূরের কথা, কেউ তার কোনো অর্থ-পরিভাষা বিকৃতির অপপ্রয়াস চালালেও কঠোরভাবে তার প্রতিরোধ করছি, রাজপথ উত্তপ্ত করে আন্দোলনে নামছি। এমনভাবে সব জিনিসই। পৃথিবী যে এই সুন্দর সুশৃঙ্খল ধারায় পরিচালিত হচ্ছে, কোনো না কোনো মাধ্যম তো প্রায় সবক্ষেত্রেই কার্যকর রয়েছে। আদতে সব তো আল্লাহ তাআলাই করছেন। কেবল নেযাম-শৃঙ্খলার স্বার্থে প্রায় সবক্ষেত্রে কোনো না কোনো মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন এই বিষয়গুলো কেউ যদি নিজের বলসে দাবি করে, দু-চারটি জিনিস তৈরি করে নিজেকে সৃষ্টিকর্তা ভাবতে শুরু করে — তাহলে তার এই উর্বর মস্তিষ্কের ওপর করুণা বর্ষণ ছাড়া আমরা আর কোনো গত্যন্তর দেখি না। তার তো কিছুই না। সে তো কেবল একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সৃষ্টি, রিজিকদান, জীবন ও মৃত্যু দান প্রভৃতি — এগুলো সব আল্লাহর তাআলার সিফাত। বাহ্যিক মাধ্যম হিসেবে কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা আমদেরকে ব্যবহার করেন। গায়বের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তাআলারই কাছে। (গায়বের ব্যাখ্যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।) তিনি কাউকে গায়বের কোনো বিষয় জানালে তখনই কেবল সে তা জানতে পারে। আদতে সেটা তার অর্জন নয়, বরং আল্লাহ তাআলারই দান। এখানে তার সবিশেষ কোনো ক্রেডিট নেই। নবিগণ যে গায়বের বিভিন্ন বিষয় জানিয়ে গেছেন, তা সব এরই পর্যায়ভুক্ত।

মানুষ যেমন গায়ব জানে না, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই তা জানে না; এমনকি ফেরেশতারাও নয়। আপনি যে মেয়েটিকে বিয়ে করবেন, তার কি আদৌ কোনো সন্তান হবে কিনা, হলে ছেলে হবে না মেয়ে — এসব বিষয়ের জ্ঞান মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কারো কাছে নেই; জিন-ফেরেশতাদের কাছেও নয়। তবে হাঁ, আল্লাহ তাআলা যখন দায়িত্বরত ফেরেশতাদেরকে তা জানান, তখন তারা জানতে পারে। বৃষ্টি বর্ষণ হওয়ার আগে তিনি যখন মেঘের ফেরেশতাদেরকে নির্দেশনা দেন, তখনই তারা তা জানতে পারে, তার একমুহূর্ত পূর্বেও নয়। সহিহ বুখারির নিম্নবর্ণিত হাদিসটি লক্ষ করুন—

عن أنس بن مالك عن النبي صلى الله عليه وسلم قال إن الله عز وجل وكل بالرحم ملكا يقول يا رب نطفة يا رب علقة يا رب مضغة فإذا أراد أن يقضي خلقه قال أذكر أم أنثى شقي أم سعيد فما الرزق والأجل فيكتب في بطن أمه

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সা. বলেন, আল্লাহর তাআলা জরায়ুর দায়িত্বে একজন ফেরেশতাকে নিয়োজিত করেছেন। ফেরেশতা (তার নির্দেশিত সময়ে) বলে, হে প্রভু, বীর্য! হে প্রভু, রক্তপিণ্ড! হে প্রভু, গোশতপিণ্ড! অনন্তর যখন আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির ফায়সালা চূড়ান্ত করার ইচ্ছে করেন, তখন বলে দেন— ছেলে হবে না মেয়ে, সৌভাগ্যবান হবে না দুর্ভাগা, রিজিক কী হবে, মৃত্যু কখন কোথায় হবে। সন্তান মায়ের পেটে থাকা অবস্থায়ই এ বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করে ফেলা হয়।

আচ্ছা, পবিত্র কোরআনের উপরিউক্ত আয়াত তো বলছে, গর্ভে কী আছে, তা শুধু আল্লাহ তাআলা জানেন। এখন তো এই হাদিস থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছে, গর্ভে থাকা অবস্থায়ই দায়িত্বরত ফেরেশতারাও তা জেনে যায়। এ কি তবে আলকোরআনে বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক ও বিরোধপূর্ণ হয়ে গেলো?! সুস্থমস্তিষ্কের কেউই নিশ্চয়ই এমন মন্তব্য করবে না। কেননা এই জ্ঞান তো কেবল আল্লাহ তাআলার কাছেই ছিলো। তিনি জানিয়েছেন। ফেরেশতা তার জ্ঞানার্জনের মাধ্যম দ্বারা আল্লাহ তাআলার ফায়সালা জেনেছে। এটা তার নিজস্ব অর্জিত জ্ঞান নয়। আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন বলেই সে জানতে পেরেছে। আচ্ছা, আল্লামা ইবনে কাসির এবং তাফসিরে রুহুল মাআনি প্রনেতা আল্লামা আলুসি রহ.দের যুগে তো আবহাওয়া ও চিকিৎসা বিজ্ঞান এই উৎকর্ষে পৌঁছেনি। আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাদের তাফসির দেখা যেতে পারে। আল্লামা ইবনে কাসির রহ. এর বক্তব্য লক্ষ করুন—

هَذِهِ مَفَاتِيحُ الْغَيْبِ الَّتِي اسْتَأْثَرَ اللَّهُ تَعَالَى بِعِلْمِهَا، فَلَا يَعْلَمُهَا أَحَدٌ إِلَّا بَعْدَ إِعْلَامِهِ تَعَالَى بِهَا؛…وَكَذَلِكَ إِنْزَالُ الْغَيْثِ لَا يَعْلَمُهُ إِلَّا اللَّهُ، وَلَكِنْ إِذَا أَمَرَ بِهِ عَلِمَتْهُ الْمَلَائِكَةُ الْمُوَكَّلُونَ بِذَلِكَ ومَنْ شَاءَ اللَّهُ مَنْ خَلْقِهِ. وَكَذَلِكَ لَا يَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ مِمَّا يُرِيدُ أَنْ يَخْلُقَهُ اللَّهُ تَعَالَى سِوَاهُ، وَلَكِنْ إِذَا أَمَرَ بِكَوْنِهِ ذِكْرًا أَوْ أُنْثَى، أَوْ شَقِيًّا أَوْ سَعِيدًا عَلِمَ الْمَلَائِكَةُ الْمُوَكَّلُونَ بِذَلِكَ، ومَنْ شَاءَ اللَّهُ مِنْ خَلْقِهِ.

এগুলো হলো গায়বের চাবিকাঠি, যা শুধু আল্লাহ তাআলাই জানেন। সুতরাং অন্য কারো পক্ষে এসব বিষয়ে আল্লাহ তাআলা জানানোর পরেই শুধু জানা সম্ভব। …তেমনই বৃষ্টি বর্ষণের জ্ঞানও শুধু আল্লাহ তাআলাই জানেন। হাঁ, যখন তিনি নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সে বিষয়ে দায়িত্বরত ফেরেশতা এবং সৃষ্টজীবের মধ্যে থেকে আল্লাহ তাআলা যার ব্যাপারে চান, সে জানতে পারে। তেমনিভাবে আল্লাহ তাআলা গর্ভাশয়ে কী সৃষ্টি করতে চান, তা তিনি ছাড়া আর কেউই জানে না। কিন্তু যখন তিনি ছেলে বা মেয়ে হওয়ার, সৌভাগ্যবান বা দুর্ভাগা হওয়ার নির্দেশ জারি করেন, তখন দায়িত্বরত ফেরেশতা এবং সৃষ্টজীবের মধ্যে থেকে আল্লাহ তাআলা যার ব্যাপারে চান, সে জানতে পারে।

আল্লামা ইবনে কাসির রহ. ¯পষ্ট বলছেন, বৃষ্টি এবং গর্ভস্থ সন্তানের জ্ঞান আল্লাহ তাআলা ছাড়া কেউ জানে না। হাঁ, তিনি যাকে জানান, সে জানতে পারে। আল্লাহ তাআলা যখন নির্দেশ প্রদান করেন, তখন দায়িত্বরত ফেরেশতা তা জানতে পারে এবং সৃষ্টজীবের মধ্য থেকে যার ব্যাপারে তিনি ইচ্ছে করেন, সে-ও জানতে পারে। এজন্যই তো গর্ভে আসা মাত্রই নয়, বরং নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরই কেবল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সন্তানের সম্ভাবনাপূর্ণ জেন্ডার বলতে পারে।

এরপরও কি আয়াতের ব্যাপারে কোনো সংশয় থাকে? ডাক্তার এবং আবহাওয়াবিদরা যদি জ্ঞানার্জনের কোনো মাধ্যম তথা আকল ও পঞ্চইন্দ্রিয় ব্যবহার না করেই এসব বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতে পারতো, তখনই কেবল তা আলকোরআনের বক্তব্যের সাথে বিরোধপূর্ণ বলে পরিগণিত হতো। আল্লাহ তাআলা তাকে জানাচ্ছেন, সে তার ইন্দ্রিয়শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান অর্জন করেছে মাত্র। ফেরশতাকেও যেমন আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন, ফেরেশতা নিজ জ্ঞানার্জনের মাধ্যম দ্বারা তা আয়ত্ত করেছে মাত্র,  তেমনি মানুষও। কোরআনের সাথে এর বিরোধ ও সংঘর্ষটা কোথায়? মাথাটা একটুও না খাটিয়ে লম্ফঝম্ফ শুরু করলে তো পরিণতি এমন হবেই। প্রথমে বেশ হাকডাক ছাড়লেও পরিসেষে নিজেকেই লজ্জা পেতে হবে। থাক, এতো লজ্জার কিছু নেই। আঁচলের আড়ালে মুখ লুকানোর চেষ্টা ছেড়ে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নেয়াটা কল্যাণকর হবে।

স্মতর্ব্য যে, আলোচ্য আয়াতে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো—  مَا فِي الْأَرْحَامِ । আরবি ভাষার সাধারণ জ্ঞান যাদের আছে, তাদের জানা থাকার কথা যে, مَا শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। আরবি ভাষার স্বীকৃত এবং স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হচ্ছে, ব্যাপককে তার ব্যাপকতার ওপর এবং শর্তহীন বিষয়কে তার নিঃশর্ততার ওপর বাকি রাখা হবে। সুতরাং আয়াতের অর্থ দাঁড়াচ্ছে, গর্ভস্থ সন্তানের সকল বিষয়আশয় আল্লাহ তাআলা জানেন। শুধু সন্তানের জেন্ডারই নয়, বরং তার জন্ম-মৃত্যু, ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, আবাস-কম, অর্থাৎ গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কিত যা কিছু আছে, তার জীবনের সূচনা থেকে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তার জীবনে যা-কিছু ঘটবে— সবই আল্লাহ তাআলা জানেন। পাঠক, আপনিই বলুন, এসব বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কারই বা আছে?! আর কার পক্ষেই বা এসকল বিষয়ের বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব?! আল্লাহ তাআলা আপন অনুগ্রহে দু-চারটি বিষয় যা জানান, এর বাইরে মানুষ আর কীইবা জানে?! মানুষের জ্ঞানার্জনের মাধ্যমগুলোও তো সেই আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি। এতোকিছুর পরও এই মানুষই চরম ঔদ্ধত্যে মেতে ওঠে। একপর্যায়ে সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। হায়রে মানুষ! হায়রে অকৃতজ্ঞ বান্দা!!

Share This