কর-সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা

বাংলাদেশ একটি সরকারতন্ত্রী করবান্ধব দেশ। জনগণ এখানে নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কামাই করবে আর শোষণকারী শাসকদের হাতে তার বড় অংশ তুলে দেবে। আগে তোলা হতো খাজনার নামে আর এখন তোলা হয় বাজনা বাজিয়ে। জুলুমের টাকা যে যত বেশি পরিশোধ করবে, সে তত বড় দেশপ্রেমী। এখন কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন কর, শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদির নামে যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়, আগে জমিদারতন্ত্রেও বোধ হয় এত বেশি পরিমাণ অর্থ জোরপূর্বক ভোগদখল করা হতো না।

তবুও মানুষ ইসলাম চায় না। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকলে জনগণ কিছুতেই এরকম জুলুমের শিকার হতো না।

মূলধারার জ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞাসা, বর্তমান বাজেট প্রস্তাবিত হওয়ার পর থেকে সরকার নির্দেশিত কর নিয়ে অনেক সমালোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমার জিজ্ঞাসা হলো :

১. সরকারের জন্য এই কর আরোপ জায়িয হয়েছে নাকি নাজায়িয? যদি জায়িয হয়ে থাকে তাহলে কিসের ভিত্তিতে জায়িয? আর যদি নাজায়িয হয়ে থাকে তাহলে কিসের ভিত্তিতে নাজায়িয? যদি জায়িয বলা হয় তাহলে প্রশ্ন আসবে, জায়িয বিষয় নিয়ে সমালোচনা কেন? আপনাদেরকে তো বৈধ ক্ষেত্রে শাসকের আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর যদি এটাকে ‘জুলুম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে নাজায়িয বলা হয়, তাহলে প্রশ্ন আসবে, পূর্বনির্ধারিত করের পরিমাণও কি নাজায়িয ছিল না? সেই নাজায়িযের ওপর তবে এতকাল আমল করে এসেছেন কেন? মানুষকে তা প্রদানে উৎসাহিত করেছেন কেন? স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য চলে না – এটা তো হাদিসেরই ঘোষণা! আর যদি বলা হয়, আগেরটা জায়িয ছিল, এখনেরটা নাজায়িয, তবে এই পার্থক্যের দলিল কী? মাসআলার মূল ইল্লত (Cause) কি আদৌ এই ভিন্নতা দাবি করে?

২. কর আরোপকে জায়িয বলা হলে কর ফাঁকি দেওয়াকে নাজায়িয বলাই যুক্তির দাবি। আর কর আরোপকে নাজায়িয বলা হলে কর প্রদানকেও নাজায়িয বলা যুক্তির দাবি। নাকি বিষয়টা এমন যে, শাসকের বিবেচনায় নাজায়িয; তবে জনগণের বিবেচনায় ফরজ। এখন যদি বর্তমানে ঘোষিত করকে নাজায়িয বলেন, তবে এসব কর ফাঁকি দেওয়া এবং এই ক্ষেত্রে শাসকের আনুগত্য করার ব্যাপারে কী মাসআলা বলবেন? আর যদি এগুলো জোরপূর্বক নিয়ে নেওয়া হয়ই, তবে সরকারি অন্য ফান্ড থেকে এর সমপরিমাণ অর্থ উশুল করাকে কি বৈধ বলবেন? আর যদি তা না হয়, তবে এ ক্ষেত্রে জনগণের কী করণীয়? জালিমের বিরুদ্ধে খোদ জালিমের কাছেই বিচার নিয়ে যাবে? তাগুতি হুকুমতের কাছে তাদেরই বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী হবে? নাকি নীরবে সব সয়ে যাবে? নীরবে জুলুম সয়ে যাওয়া কি নববি আদর্শ? সর্বোপরি এ ক্ষেত্রে নাহি আনিল মুনকারের সুরতই বা কী হবে?

দেওবন্দে যাতায়াত-সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা

আমাদের দেশের মূলধারার আলিমগণ বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যাপারে যে দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন, তাতে তাদের দৃষ্টিতে কোন মূলনীতির ভিত্তিতে কোনোপ্রকার ভিসা ছাড়া বা ট্রাবেল ভিসা নিয়ে ভারতে গিয়ে দেওবন্দ মাদরাসায় পড়াশোনা করা বৈধ হয়?

আমি যতটুকু জানি, দেশের মুহাক্কিক আলিমগণ এভাবে যাতায়াতকে ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থন করেন না। খোদ মাওলানা আবদুল মালেক (হাফিজাহুল্লাহ)-এর এক মুহাজারায় এ সম্বন্ধে শক্ত সমালোচনা শুনেছি। তিনি এ-ও বলেছেন, ‘তুমি পড়তে যাবে ভালো কথা। তাই বলে কি তুমি ফাতওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে গেছ! তোমার আর এখন ফাতওয়া লাগবে না! অথচ ইলমের পথে ফাতওয়ার অনুসরণ সবচে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল। একে তো করছ অবৈধ কাজ, আবার নাম দিচ্ছ “এলাহি ভিসা”। এটা তো প্রবৃত্তিপূজা ছাড়া কিছু নয়।’

এভাবে যাতায়াতে মূলধারার আলিমগণের কাছে স্বীকৃত মূলনীতির আলোকে মোটাদাগে অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে :

১. বৈধ ক্ষেত্রে সরকারের আনুগত্য ফরজ। আর এভাবে যাতায়াতের মাধ্যমে সেই ফরজ লঙ্ঘিত হচ্ছে।

২. দারুল উলুম দেওবন্দে স্টুডেন্ট ভিসা ছাড়া ভর্তি হওয়া নিষেধ। তাই নিজেদের নাম-ঠিকানা পাল্টে ফেইক ঠিকানা ব্যবহার করে, এরপর তার প্রমাণে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে প্রদর্শন করে দেওবন্দ মাদরাসাকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। এতে একই সঙ্গে মিথ্যা, ধোঁকা ও জালিয়াতিসহ অনেকগুলো অপরাধের সমন্বয় ঘটেছে।

৩. পড়াশোনা শেষ করে নিজেকে ‘কাসেমি’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। অথচ কোনো প্রতিষ্ঠানের দিকে নিজেকে সম্পর্কিত করার জন্য বৈধভাবে তার অনুমোদন পাওয়া শর্ত। দেওবন্দ মাদরাসা তো বাংলাদেশের এই তালিবুল ইলমকে সনদ দেয়নি। আর যাকে সে সনদ দিয়েছে, সে তো এই ছাত্র নয়। অর্থাৎ এখানে দেওবন্দ কর্তৃপক্ষকে ধোঁকায় ফেলে সনদ নেওয়া হয়েছে এবং আজীবন সেই সনদ ব্যবহার করে বিভিন্ন স্বার্থ হাসিল করা হচ্ছে।

৪. বাংলাদেশ একটা দারুল আমান। ভারত আরেকটা দারুল আমান। উভয় রাষ্ট্রের রয়েছে স্বতন্ত্র ‘উলুল আমর’। সুতরাং এখানে দাগাবাজি শুধু এক উলুল আমরের সঙ্গেই হয়নি; বরং হয়েছে দুই উলুল আমরের সাথে।

৫. সাধারণ ফাতওয়া জানা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে ফাতওয়ার ঊর্ধ্বে মনে করা, মুজাহিদদের ব্যাপারে ফাতওয়া প্রয়োগ করতে কঠোরতা করলেও ইলম অন্বেষণের অজুহাতে ফাতওয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো এবং নাজায়িয কাজের ব্যাপারে গর্ব করা, তা প্রচার করা ও অন্যদেরকে সে ব্যাপারে উৎসাহিত করা – এ সবগুলোই তো অপরাধকর্মের অন্তর্ভুক্ত।

৬. এর মাধ্যমে উভয় দেশের সম্প্রীতি ও বন্ধুভাবাপন্ন সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এভাবে যাতায়াতে প্রাণহানি বা বিপদের ঢের আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া এই সুযোগকে ব্যবহার করে জঙ্গিবাদ উসকে যাওয়ার আশঙ্কাকেও ফেলে দেওয়া যায় না।

৭. পথে পথে ঘুষ প্রদান করা। বর্ডারে আইনলঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে নাহি আনিল মুনকার না করে উল্টো তাদেরকে সহযোগিতা প্রদান করা। দুদেশের আইন লঙ্ঘন করে দালালদেরকে অর্থ দেওয়া। ভুয়া পরিচয় দিয়ে সিমকার্ড সংগ্রহ করা ও ট্রেনের টিকেট কাটা।

এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক সমস্যা। এতদসত্ত্বেও এ ব্যাপারে বড়দের প্রকাশ্য বিবৃতি, নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা কেন শোনা যায় না? যারা সেখান থেকে পড়ে আসে, তারাও কেন অপরাধবোধে ভোগে না? এমনকি মানবতার মঞ্চে তাদেরকে সসম্মানে বরণ করে নেওয়া হয়, কেউই বাঁকা চোখে তাকায় না, এর কী কারণ? নিশ্চয়ই এর পেছনে সুদৃঢ় কোনো হিকমাত থাকার কথা। অন্যথায় মুজাহিদিনের ক্ষেত্রে এক নীতি এবং এখানে আরেক নীতি প্রয়োগ করার কথা নয়। এ জন্য এই বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে জানা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতা-সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা

১. তারাবিহের হাদিয়া নেওয়া হারাম আর কুরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া কি আরাম? প্রথমটাকে কুরআনের বিনিময় হিসেবে বিবেচনা করা হলে দ্বিতীয়টাকেও কেন সেই হিসেবে বিবেচনা করা হয় না? উপরন্তু তা নিয়ে গর্ব করা হয়! অবৈধ জিনিস নিয়ে গর্ব করাও তো অবৈধ হওয়ার কথা। প্রথমটা নিয়ে এত প্রতিবাদ ও লেখালেখি, কিন্তু দ্বিতীয়টা নিয়ে সবাই কেন যেন ভয়াবহ রকমের নীরব!

২. কুরআন জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সমুন্নত করার জন্য আসেনি; বরং এসেছে তা মেটানোর জন্য। কুরআন এসেছে বিশ্ব মুসলিমের মধ্যে সম্প্রীতির মেলবন্ধন সৃষ্টি করে সকলকে এক সূত্রে গাঁথবার জন্য এবং তাদেরকে এমন ভূমি উপহার দেওয়ার জন্য, যেখানে ‘হাকিমিয়্যাহ’ (শাসনক্ষমতা) থাকবে আল্লাহর। নৃতাত্ত্বিক পরিচয় হিসেবে কোনো ভূখণ্ডের পরিচয় দেওয়া এক কথা আর জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রতীককে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে বা আনন্দে মাথায় তুলে আবেগ প্রকাশ করা আরেক কথা। কেউ যখন ভালো পারফরমেন্স করে, আমরা আনন্দিত হই। তার জন্য দুয়া করি। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে উচ্ছাস ও উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে শরিয়াহর নির্দেশনা উপেক্ষা করে অযথাই জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করা কি আদৌ সংগত? আর এটা তো কোনো প্রয়োজনের কাতারেও পড়ে না!

৩. আজকাল কুরআনকে অনেকে বাণিজ্যের উপায় বানিয়ে ফেলেছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও ছাত্র অর্থ উপার্জন ও সুখ্যাতি অর্জনকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছে। তাদের স্মরণ রাখা উচিত, কুরআন এ জন্য নাজিল হয়নি। যারা কুরআনকে মাধ্যম বানিয়ে বাণিজ্য করে সালাফের যুগে থাকলে তারা হতো চরম ধিকৃত; কিন্তু এ যুগে তারা সর্বমহলে বরিত। যাদের নিয়তেই গড়মিল থাকে, তাদের দ্বারা জাতি কখনো ভালো কিছু পেতে পারে না। হ্যাঁ, কারও নিয়তে যদি গণ্ডগোল না থাকে, বরং ভালো কোনো লক্ষ্যে প্রতিযোগিতায় অর্জন করে, সে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে আমরা আমাদের উস্তাদ ও শাইখগণকে সর্বদা এর পক্ষাবলম্বন করার পরিবর্তে বিরুদ্ধাচারণ করতে দেখেছি। বিশেষ করে আমার তালিমি ও তারবিয়াতি শাইখ ও মুরশিদ হজরত তো এ ব্যাপারে প্রচণ্ড কঠোর। হ্যাঁ, সবার দৃষ্টিভঙ্গি যে এক হবে, তা কখনোই নয়।

Share This