১. একবার প্রয়োজনে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনি কি হাফিজ? তিনি অস্বীকার করলেন। এতে খানিকটা ঝামেলাও হয়েছিল। পরবর্তীতে সঠিক তথ্য জানতে পারি। তখন তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেন, আসলে আমরা কুরআন মুখস্থ করলেও হাফিজ কি আর হতে পেরেছি? হাফিজ তো ছিলেন সাহাবিরা। হাফিজ তো ছিলেন অমুক-তমুক। আমরা আর কী হাফিজ!

২. আরেকবার অন্য একজনকে প্রশ্ন করলে তিনি জানালেন যে, তিনি একজন হাফিজ। পরবর্তীতে উল্টোটা জানা গেল। তখন তিনি বললেন, কুরআনের ত্রিশ নম্বর পারা তো আমার মুখস্থই আছে। যেকোনো জিনিস মুখস্থ করলেই তো শাব্দিক অর্থের বিচারে হাফিজ বলা যায়। পৃথিবীতে আমার কত জিনিসই তো মুখস্থ আছে!

৩. এক জায়গায় একবার বেশ ঝামেলা হচ্ছিল। একটা বিষয়ে ইলমি সমাধানের প্রয়োজন ছিল। আলিমের মতো দেখা যায়, এমন একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো, ভাই, আপনি কি আলিম? বিনয়বশত তিনি জানালেন, না, তিনি আলিম না। তার উদ্দেশ্য ছিল, আলিম তো ছিলেন ইমাম আবু হানিফা। কোনো সালাফ কি নিজেকে আলিম বলতেন? আমরা আর কী! আমরা আর কিসের ভিত্তিতে নিজেকে আলিম বলতে পারি! তাই আলিম হয়েও নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা। উপচেপড়া বিনয় যাকে বলা যায়!

৪. নামের আগে তিন লাইন লকব লিখলেও এটা কারও কাছে দৃষ্টিকটু হয় না। কেউ নিজের নামের সঙ্গে ‘মাওলানা’ (উম্মাহর প্রত্যাবর্তনস্থল), ‘মুফতি’ টাইটেল লাগিয়ে নিচ্ছে। এটাকে আবার কেউ অহংকার হিসেবে মূল্যায়ন করছে না। করার কথাও নয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশক সবাই-ই নিজের নামের সঙ্গে টাইটেল লাগাচ্ছে। এসবও কি অহংকার? তবে তো নাপিত, ধোপা, টোকাইও অহংকার হয়ে যাবে। নামের সঙ্গে কাসেমি লাগানোও অহংকার নয়। হাঁ, কেউ খারাপ উদ্দেশ্যে এসব করলে ভিন্ন কথা। এ লকবগুলো তো উস্তাদগণই দিয়ে দেন। শিক্ষা সমাপনের পর প্রদত্ত সার্টিফিকেটেই ‘হাফিজ’, ‘মাওলানা’, ‘কাসেমি’ লকবগুলো দিয়ে দেওয়া হয়। পাগড়ি প্রদানও মূলত এরই স্বীকৃতি।

৫. উসুলে ফিকহ সম্পর্কে যাদের কিছুটা জানাশোনাও রয়েছে, তাদের অজানা নয়, একটা শব্দের অনেক ধরনের অর্থ থাকে। তো অনেক অর্থের মধ্যে একটা অর্থ হলো উরফে প্রচলিত অর্থ। ‘আলিম’ শব্দটা আমাদের উরফে দাওরায়ে হাদিস সমাপনকারী মাওলানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ জন্য এই ধাপ সমাপন করেনি, এমন বড় বড় মানুষদেরও আলিম বলা হয় না। প্রোফেসর হজরত বা অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সাহেব কি কম জ্ঞানী? কিন্তু এরপরও তাদের আলিম বলা হয় না। আবার সেই ধাপ সমাপনকারী এমন ছেলেদেরও আলিম বলা হয়, যারা আদতে তেমন কিছুই জানে না। কারণ, এটা সকলেরই জানা যে, এসব উরফি অর্থে ব্যবহৃত। যার কারণে এ যুক্তি এখানে খাটবে না যে, সালাফ কি কখনো নিজেকে আলিম হিসেবে পরিচয় দিতেন। সালাফ তো নিজেকে মাওলানাও বলতেন না! এ ধরনের উরফি বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে ইতিহাসকে প্রমাণরূপে পেশ করা একধরনের মূর্খতা।

৬. প্রখ্যাত ফকিহ ইমাম খলিল রহ. বলেন, وندب ليشهر علمه। আলিম নিজেকে আলিম হিসেবে পরিচয় দেওয়া মুস্তাহাব, যাতে তার ইলম প্রসিদ্ধি লাভ করে। কবি বলেন,

إذا أنت لم يشهرك علمك لم تجد**** لعلمك مخلوقاً من الناس يقبله

وإن صانك العلم الذي قد حملته**** أتاك له من يجتنيه ويحمله

যখন তোমার ইলম তোমাকে প্রসিদ্ধ করবে না, তখন তুমি তোমার ইলমের জন্য এমন সব মানুষকে পাবে না, যারা তোমার ইলমকে গ্রহণ করবে। তুমি যে ইলম ধারণ করেছ, যদি সে ইলম তোমাকে সুরক্ষিত করে তবে তোমার কাছে এমন সব মানুষেরা আসবে, যারা তা হাসিল করবে এবং ধারণ করবে।

হাঁ, কেউ যদি অহংকারবশত নিজের ব্যাপারে এ কথা বলে তাহলে তা হারাম হবে। এটা তো শুধু আলিম শব্দের সঙ্গেই বিশেষিত নয়, বরং নিজেকে অহংকারবশত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, প্রকাশক-সম্পাদক বললেও হারাম হবে।

৭. আচ্ছা, যদি কেউ নিজের গুণগান গাইতে গিয়েও নিজেকে আলিম হিসেবে পরিচয় দেয় আর তার পেছনে দীনি স্বার্থ থাকে, তবে কি তা নিষিদ্ধ? কখনোই নয়। যেমন ইউসুফ আ. বলছেন,

اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ
আমাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত করুন। নিশ্চয়ই আমি সুসংরক্ষণকারী, সুবিজ্ঞ।

সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন,

لَوْ أَعْلَمُ أَحَدًا أَعْلَمَ بِكِتَابِ اللَّهِ مِنِّي تَبْلُغُهُ الْإِبِلُ لَأَتَيْتُهُ
আমি যদি এমন কাউকে জানতাম, কিতাবুল্লাহর ব্যাপারে যে আমার চাইতে অধিক জ্ঞানী আর তার দুয়ার পর্যন্ত উটে চরে ভ্রমণ করা যায়, তবে আমি অবশ্যই তার কাছে গমন করতাম। (বুখারি, মুসলিম)

আবু দারদা রা. বলেন,

سَلُونِي فَوَاَللَّهِ لَئِنْ فَقَدْتُمُونِي لَتَفْقِدُنَّ رَجُلًا عَظِيمًا
তোমরা আমার কাছে প্রশ্ন করো। আল্লাহর কসম, যদি তোমরা আমাকে পৃথিবী থেকে হারিয়ে ফেলো তবে তো এক সুমহান ব্যক্তিকে হারিয়ে ফেলবে।

আলি রা. বলেন,

وَاَللَّهِ مَا آيَةٌ إلَّا وَأَنَا أَعْلَمُ بِلَيْلٍ نَزَلَتْ أَمْ بِنَهَارٍ
আল্লাহর কসম, এমন কোনো আয়াত নেই, যে ব্যাপারে আমার ইলম নেই যে, তা কি রাতে নাজিল হয়েছে নাকি দিনে।

আবু বকর ইবনু আইয়াশ রহ. বলেন,

نَظَرْت إلَى أَقْرَأِ النَّاسِ فَلَزِمْته عَاصِمًا ، ثُمَّ نَظَرْت إلَى أَفْقَهِ النَّاسِ فَلَزِمْته مُغِيرَةً ، فَأَيْنَ تَجِدُ مِثْلِي
আমি সবচে বড় কারীর সন্ধান করলাম। এরপর তার সান্নিধ্য অবলম্বন করলাম। তিনি ছিলেন আসিম। এরপর আমি সবচে বড় ফকিহর সন্ধান করলাম। এরপর তার সান্নিধ্য অবলম্বন করলাম। তিনি ছিলেন মুগিরা। সুতরাং তোমরা আমার মতো কাউকে কোথায় পাবে?

এমনকি নবি সা.ও নিজের ব্যাপারে এমন প্রশংসাসূচক বাক্য প্রচুর বলেছেন। যেমন :

أنا سَيِّدُ وَلَد آدَم
আমি গোটা আদম সন্তানের নেতা।

أنا أعْلَمُكُمْ باللَّهِ وأتْقاكُمْ
আল্লাহর ব্যাপারে আমি তোমাদের মধ্যে সবচাইতে বড় আলিম এবং সবচাইতে বড় মুত্তাকি।

৮. মোদ্দাকথা, ‘আলিম’, ‘মাওলানা’, ‘হাফিজ’, ‘মুহাদ্দিস’ শব্দগুলো নিয়ে যদি কোনো ‘ডাক্তার’, ‘ইঞ্জিনিয়ার’, ‘সম্পাদক’ মন্তব্য করে তবে তা নিতান্ত হাস্যকর ব্যাপার হয়ে যায়। হাঁ, ‘মুফতি’ শব্দটি যেহেতু শরয়ি পরিভাষা, অন্যান্য শব্দগুলোর মতো শুধু উরফি টাইটেলই নয়, তাই এর যত্রতত্র প্রয়োগ অনুচিত এবং পরিহার্য।

৯. উপরিউক্ত আলোচনার অর্থ এ নয় যে, এখন নিজেই নিজের বাঁশি বাজাতে হবে। মাওলানা আবদুল মালেক (হাফিজাহুল্লাহ) নিজের নামের সঙ্গে কখনোই মুফতি শব্দ ব্যবহার করেন না। আচ্ছা, তবে ‘মাওলানা’ কেন ব্যবহার করেন? নিশ্চয় এর পেছনে হেকমত রয়েছে। যারা তাকে বাস্তবে চেনে না, তাদের অনেকেই কিন্তু অনেক শরয়ি বিষয়ে তার বই দেখলেও তা ছুঁবে না, যদি শুরুতে এ লকব না থাকে। আর যেহেতু ‘মাওলানা’ শব্দ দ্বারাই এ উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাচ্ছে আর তা ছাড়াও ‘মুফতি’ হলো ভারিক্কি শব্দ, শরয়ি পরিভাষা, তাই তা আর ব্যবহার করাকে প্রয়োজনীতা বোধ করেন না।

এককালে শরয়ি বিষয়ের বইপত্রে আমি নিজেও এই কাজ করতাম। গাইরে আলিমদের শরয়ি বিষয়ক বইগুলো সযত্নে পরিহার করে চলতাম। এমনকি মনে আছে, যাইনুল আবিদীন সাহেবের বইগুলোও পড়তাম না। যেহেতু আমার ধারণা ছিল, উনি বোধ হয় আলিম নন, তাই এসব বিষয়ে লেখার যোগ্য তিনি নন। হয়তো আহলে হাদিস টাইপের কেউই হবেন। অনেক পরে গিয়ে ভুল ভেঙেছে। এ ছাড়াও সাধারণ মানুষ তো অভ্যন্তরীণ এত সব বিনয়সমুদ্রের সঙ্গে পরিচিত নয়, তাই তারা বিভ্রান্ত হয়ে ইলমকে এভোয়েড করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

১০. এককথায়, এসব শব্দ ব্যবহার করা বা না করা, নিজেকে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এসব শব্দ বলে পরিচয় দেওয়া বা না দেওয়া প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে রাজনীতির কিছু নেই। যারা এ নিয়ে রাজনীতি করে, তাদের অন্তরে আসলে রোগ রয়েছে। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।

Share This