ফিকহের পরিচয় 

 

ফিকহের সবচে প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হলো, যা ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেছেন— “দলিলের বিস্তর উৎসসমূহ থেকে অর্জিত শরিয়তের আমলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধানাবলীর জ্ঞান।”

 

এই সংজ্ঞার আলোকে জানা গেলো যে, আকিদার বিষয়গুলো ফিকহের অংশ নয়। ইমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত মৌলিক ও শাখাগত বিষয়সমূহ ফিকহ নয়; বরং সেগুলো আলাদা শাস্ত্র।

তেমনি আরেকটি বিষয় বোঝা গেলো যে, ফিকহের দলিলগুলো অকাট্য হওয়া জরুরি নয়। এজন্যই উসুলিগণ বলে থাকেন, “আল-ফিকহু মিন বাবিয যুনুন/আল-ফিকহু যান্নি”। অর্থাৎ ফিকহ প্রবল ধারণাভিত্তিক শাস্ত্র; অকাট্য নয়। (দ্রষ্টব্য— শারহুল ইসনাওয়ি: ১/২০; আততাকরির ওয়াত তাহবির: ১/২০; আততালবিহ আলাত তাওযিহ: ১/১৮)।

আরো বোঝা গেলো, দলিলের বিস্তর উৎসসমূহ থেকে যা জানা যায়, তাকেই শুধু ফিকহ বলা হয়। আমাদের জনসাধারণ, যারা মুকাল্লিদ হিসেবে কোনো মুজতাহিদের বক্তব্যের ওপর আমল করে, তাদের এই জ্ঞান ফিকহ নয়; কেননা তাদের জ্ঞান বিস্তর দলিল থেকে উদ্ভূত নয়, বরং ‘ইজমালি’ দলিল থেকে আহৃত। এক্ষেত্রে ‘ইজমালি’ (সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট) দলিল হলো, মুজতাহিদের ইজতিহাদ সঠিক এবং তার আলোকে আমল করা যায়। বিস্তর দলিল বলা হয়, প্রত্যেক মাসআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সেই স্বতন্ত্র দলিলসমূহকে, যা তার বিধানের ওপর আলোকপাত করে।

আরো বোঝা গেলো, অর্জিত জ্ঞানকে ফিকহ বলা হয়। যে জ্ঞান অর্জন করা ছাড়া হাসিল হয়, তাকে ফিকহ বলা হয় না। সুতরাং আল্লাহ তাআলার জ্ঞান, ফিরিশতাদের জ্ঞান, নবিদের ওহির জ্ঞান ফিকহ নয়। তেমনি ‘যরুরিয়াতে দ্বীনে’র জ্ঞানও ফিকহ নয়; কেননা তা হাসিল হওয়ার পেছনে অর্জনের ভূমিকা নেই।

 

এটা হলো ফিকহের এক অর্থ। অর্থাৎ উপরিউক্ত বিষয়গুলোকে জানার নাম হলো ফিকহ। এখানে ‘ফিকহ’ একটি ক্রিয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু আমরা ‘ফিকহ’ নামে যে শাস্ত্রকে চিনি, সেখানে ফিকহ শব্দের অর্থ তো কোনো ক্রিয়া নয়। তাহলে সেখানে ফিকহের কী অর্থ? ফিকহশাস্ত্র বলতে আমরা যা চিনি, সেখানে ফিকহ অর্থ হলো, ‘ইসলামি শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত আমলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল বিধিবিধান’; সেগুলোর জ্ঞান অর্জন নয়।

 

ফিকহের প্রকার 

 

ফিকহি বিধানগুলো সাত ভাগে বিভক্ত—

  1. আল্লাহ তাআলার ইবাদতের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধিবিধান। এগুলোকে ‘ইবাদাত’ বলে।
  2. মানুষের পারিবারিক অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধিবিধান। এগুলোকে ‘আলআহওয়ালুশ শাখছিয়্যাহ’ বলে।
  3. মানুষের আয়-উপার্জন এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধিবিধান। এগুলোকে ‘মুআমালাত’ বলে। এই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রকারকে বর্তমান পরিভাষায় ‘আলকানুনুল মাদানি’ বলে।
  4. শাসিতের ওপর শাসকের কর্তৃত্ব এবং তাদের উভয়ের দায়িত্ব ও অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধিবিধানকে ‘আসসিয়াসাতুশ শারইয়্যাহ’ বলে। এই প্রকার থেকে বর্তমানে আরো দুটি শাখা প্রসার লাভ করেছে; যার একটিকে বলা হয়, ‘আলহুকুকুল ইদারিয়্যাহ’ আর অপরটিকে বলা হয়, ‘আলহুকুকুদ দুসতুরিয়্যাহ’
  5. অপরাধীদের শাস্তি এবং অন্যান্য স্বরাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধিবিধানকে বলা হয় ‘আলউকুবাত’
  6. পররাষ্ট্র ব্যবস্থা, এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক, শান্তিচুক্তি বা যুদ্ধবিগ্রহের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধিব্দিহানকে বলা হয় ‘আসসিয়ার’। বর্তমানে আইনের পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘আলহুকুকুদ দুয়ালিয়্যাহ আল‘আম্মাহ’
  7. স্বভাব-চরিত্র ভালো-মন্দ আদব-শিষ্টাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধিবিধানকে বলা হয়, ‘আলআদাব’

 

ফিকহ এবং শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য

 

শরিয়ত বলা হয় কুরআনের নুসুস, যা আল্লাহ তার রাসুলের ওপর অবতীর্ণ করেছেন এবং সুন্নাহ, যা রাসুলের কথা কাজ ও মৌন সমর্থনকে অন্তর্ভুক্ত করে। রাসুলের কথা কাজ হলো আলকুরআনের ব্যাখ্যা এবং তার প্রায়োগিক রূপ। কেননা তিনি নিজের থেকে শরিয়ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো কথা বলতেন না; বরং যা কিছু বলতেন ও করতেন, সবই ছিলো মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং নির্দেশনায়।

ফিকহ বলা হয়, আলিমগণ শরিয়তের নুসুস থেকে যা-কিছু বোঝেন, যে-সকল বিধান আহরণ করেন, তার আলোকে যে-সকল মূলনীতি এবং উসুল উদ্ঘাটিত করেন।

সুতরাং শরিয়ত হলো মা‘সুম, যা ভুলের সম্পূর্ণ উর্ধ্বে। আর ফিকহ হলো শরিয়ত বোঝার ক্ষেত্রে ফকিহগণের গৃহীত পন্থা এবং শরিয়তপ্রণেতার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উসুলি কাওয়ায়িদের আলোকে বিধান উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে শরিয়তের নুসুসের প্রয়োগের নাম।

 

এক্ষেত্রে অবশ্য লক্ষণীয়, ফিকহের দুটি অংশ রয়েছে। একটি হলো, যা সরাসরি কুরআন সুন্নাহয় উল্লিখিত হয়েছে এবং কুরআন সুন্নাহর অকাট্য নির্দেশ ও নির্দেশনার মাধ্যমে যা সাব্যস্ত হয়েছে। আর দ্বিতীয় হলো, যে ব্যাপারে সরাসরি বিধান প্রয়োগের ব্যাপারে কুরআন দুন্নাহ নীরব থেকেছে এবং সেক্ষেত্রে মুজতাহিদদের জন্য ইজতিহাদের পথ খোলা রেখেছে।

 

শরিয়ত এবং ফিকহের যা পার্থক্য ওপরে উল্লিখিত হলো, তা ফিকহের এই দ্বিতীয় অংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; প্রথম অংশের ক্ষেত্রে নয়। কেননা প্রথম অংশকে যদিও ফিকহ বলা হচ্ছে, তথাপি তা হলো অকাট্য এবং সংশয়হীন।

Share This