শরিয়তের মৌলিক বিষয়াদিতে কোনো মতবিরোধ নেই। সেগুলোতে মতবিরোধের কোনো সুযোগও নেই। ইসলামের ভিত্তি এসকল বিষয়াদির ওপরেই। গোটা ইসলামটা মোটেও মতবিরোধপূর্ণ নয়। যারা ইসলামের সকল বিধানকেই মতবিরোধের কেন্দ্র মনে করে, তারা মূর্খতার অথৈ সাগরে বাস করে।

শরিয়তের শাখাগত বিধিবিধানের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। সেগুলোতে মতবিরোধের সুযোগ শরিয়তই দিয়েছে। মৌলিক বিধানের থেকে শাখাগত বিধানের পরিমাণ যে বেশি হয়ে থাকে, একথা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ইসলামের ভিত্তি এসকল বিধানের ওপর নয়। তাই এসব মতভিন্নতার কারণে ইসলাম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার কোনোই সুযোগ নেই।

ইসলামের মৌলিক বিষয়াদিতে যেহেতু মতভিন্নতার কোনো সুযোগ নেই, তাই সেই বিধানগুলোর ক্ষেত্রে কোনো মাযহাব নেই। তাকলিদ করা যায় এমন বিষয়ে, যেখানে তাকলিদ করার অনুমতি রয়েছে। শরিয়তের মৌলিক বিষয়াদিতে তাকলিদের কোনো অনুমতি নেই। তাই সেসব ক্ষেত্রে মাযহাবও অকার্যকর।

মাযহাবের ইমামগণ কখনোই শরিয়তের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে টানাহেঁচড়া করেননি। তাই আমাদের কিছু ভাইয়ের বক্তব্য- “আল্লাহ এক, নবি এক, কোরআন এক, কেবলা এক, তাহলে মাযহাব চারটি কেনো” যে নিরেট অজ্ঞতাপ্রসূত মন্তব্য বৈ কিছু নয়, তা বুঝতে সুস্থমস্তিষ্কের কারো বেগ পাওয়ার কথা নয়।

শাখাগত বিধানের ক্ষেত্রে সেই সাহাবাযুগ থেকেই মতবিরোধ চলে আসছে। সেসব ক্ষেত্রে দলিলের আলোকেই আমলের একাধিক পন্থা উম্মাহর অনুসৃত আলিমগণের মধ্যে গৃহীত হয়েছে। তাই এখন যে-কোনো মুসলিম সেসব বিধানের ক্ষেত্রে কোনো এক ইমামের অনুসরণ করবে, সে অবশ্যই সরল পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে বিবেচিত হবে।

মাযহাব হলো কিছু মূলনীতি আর কিছু শাখাগত বিধানের নাম। মূলনীতির আলোকে বিধান উদঘাটিত হয়। চার মাযহাবের মূলনীতিতে ভিন্নতা রয়েছে বলেই শাখাগত বিধানগুলোর ক্ষেত্রেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মাযহাব মানার অপরিহার্যতা প্রথমত আলিমগণের জন্য। কারণ শরিয়ত পরিপালনের ক্ষেত্রে ও ফিকহি মাসায়িল উদঘাটনের ক্ষেত্রে কোনো না কোনো মূলনীতি তো তাদেরকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। আর এযুগের সাধারণ মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে নিজে নিজে মূলনীতি তৈরি করতে গেলে যেহেতু বিপথগামিতার সমূহ শঙ্কা থেকেই যায়, তাই সালাফের কারো মূলনীতি অনুসরণ করা, যার ওপর উম্মাহ হাজার বছর ধরে চলে আসছে, অবশ্যই নিরাপদ ও সকলের জন্য উপকারি।

হাঁ, ইজতিহাদের পথ বন্ধ হয়ে যায়নি। নিত্যনতুন মাসায়িলের ক্ষেত্রে কতো ইজতিহাদেরই তো প্রয়োজন হয়। এজন্যই তো আল্লামা তাকি উসমানি দা. বা. বলেছিলেন, “হাযরাত, ইজতিহাদ তো কাভীকাভা করনা পড়তা হ্যায়”। যদিও এই ধরনের ইজতিহাদকে বলা যায় অসম্পূর্ণ ইজতিহাদ। অর্থাৎ ইমামগণের উসুল ঠিক রেখে ফুরুয়ি মাসায়িলে মাযাহিবের ‘মুকারানা’ (পারস্পরিক তুলনা) এবং প্রয়োজনে সাময়িক ইজতিহাদ।

এখনও যদি কোনো যোগ্য ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে, যোগ্যতায় যিনি মাযহাবের ইমামগণকেও ছাড়িয়ে যান বা অন্তত তাদের সমপর্যায়ের হোন, আর তিনি নতুন করে পূর্ণাঙ্গ ইজতিহাদের পথে হাঁটেন, তাহলে অবশ্যই সে অধিকার তার আছে। হাঁ, উম্মাহর এই দুর্দিনে অন্য আরো সম্ভাবনাময় বহু ক্ষেত্র পরিহার করে সেপথে হাঁটাটা কতোটা বুদ্ধিদীপ্তি ও সচেতনতার পরিচায়ক হবে, নিশ্চয়ই তা স্বতন্ত্র আলোচনা-পর্যালোচনার দাবি রাখে।

আলিমগণের জন্য মাযহাব মানাটা একান্ত অপরিহার্য। কেননা তারা হলেন সমাজে অনুসৃত। তারা যদি বিপথগামী হয়ে পড়েন, তাহলে তাদের অনুসারীরাও বিপথগামী হতে বাধ্য। এই তো এযুগে এসে অনেক আলিমের অধঃপতনের পরিণামে তাদের অনুসারীদেরও যে কী করুণ হালত হচ্ছে, তা তো সচেতন মুসলমানদের অজানা নয়।

সাধারণ মানুষদের জন্য আলিমগণের অনুসরণ করা অপরিহার্য। তারা মাযহাবের বুঝেই বা কী! তাদের কেউ তো সচরাচর বুঝেশুনেও কোনো মাযহাব গ্রহণ করে না। বরং জন্মসূত্রে কাকতালীয়ভাবে তারা কোনো না কোনো মাযহাবের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। যেমনিভাবে আমাদের বাঙালি পাকিস্তানি বা ভারতীয় হওয়াটা কাকতালীয় ব্যাপার, মাযহাবের বিষয়টাও ঠিক তাই-ই।

যে যে অঞ্চলে থাকে, সে সেই অঞ্চলের আলিমগণের অনুসরণ করবে। আর আলিমগণ নির্দিষ্ট মাযহাবের মূলনীতি ও বিধানের আলোকে তাদেরকে শরিয়তের তালিম দেবেন। হাঁ, ইসলামের মৌলিক বিষয়াদির তালিমের ক্ষেত্রে তো মাযহাবের বিষয় আসবে না। সে আলোচনা তো ওপরেই বিগত হয়েছে। শাখাগত বিধিবিধানের ক্ষেত্রেই কেবল কোনো এক মাযহাবের আলোকে তিনি শরিয়তের তালিম দেবেন, মানুষের জিজ্ঞাসার জবাব দেবেন। অঞ্চলভেদে আলিমগণের মাযহাবের ভিন্নতার কারণে সাধারণ জনগণের মাযহাবও বিভিন্ন হবে। সাধারণ জনগণও মূলত মাযহাবের অনুসরণ করছে; তবে তা সরাসরি নয়, বরং আলিমগণের ভায়া হয়ে। আর তাদের জন্য কুর’আন-সুন্নাহর নির্দেশও এটাই- “তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা অবগত না হয়ে থাকো”।

হাঁ, কোনো আলিম যদি নির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণ না করেন, যেমন আরবের অনেক আলিমের অবস্থা, আর তিনি প্রকৃত অর্থেই ইজতিহাদের যোগ্য হয়ে থাকেন, তাহলে তো জনসাধারণের জন্য তাকে অনুসরণ করার সুযোগ রয়েছে; যদিও তাতে কিছুটা হলেও শঙ্কা থেকেই যায়। আর যদি তিনি প্রকৃত অর্থে যোগ্য না হয়ে থাকেন, আর এযুগে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক, তাহলে তার পেছনে ভক্তদের লাইন যতো দীর্ঘই হোক না কেনো, তাদেরকে অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার কোনো অবকাশ নেই। যে-কেউ এমন করবে, তার গোমরাহির আশঙ্কা ৯৯.৯৯%।

মাযহাব কোনো দ্বীন নয়। কেউ যদি মাযহাবকে দ্বীন মনে করে আর মাযহাবের ভিত্তিতে ঐক্য-বিভক্তি কায়েমের অপচেষ্টায় মেতে ওঠে, তাহলে সে গোমরাহ এবং প্রকাশ্য শয়তান। তেমনি যারা দু’চোখ কাপড়ে ঢেকে, কোমরে গামছা বেঁধে মাযহাবের বিরোধিতায় আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে, তারা যে চূড়ান্ত গাধামি ও খোলা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছে- এতেও আশা করি কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। মাযহাবকে মাযহাবের অবস্থানেই রাখতে হবে। তাকে ‘সিদরাতুল মুনতাহায়’ও তোলার সুযোগ নেই, আবার তাকে ‘আসফালা সাফিলিনে’ নামাবারও কোনোই অবকাশ নেই।

তুমি যেহেতু আলিম নও, তাই কোনো না কোনো আলিমের অনুসরণ তোমাকে করতেই হবে। তাই এমন কোনো আলিমেরই অনুসরণ করো, যার রয়েছে স্থির মূলনীতি, যে মূলনীতি উম্মাহর মাঝে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে গৃহীত হয়ে আসছে। যেসকল স্বঘোষিত শায়খদের স্থির মূলনীতিই নেই, যারা শরিয়ত ভালো করেই বোঝে না, যারা আদতে প্রবৃত্তির তাড়নায় চরম উত্তেজনায় ভোগে, তাদের পেছনে ছুটে ছুটে নিজের জীবনকে খয় করে আর পরকালকে বরবাদ করে আখের তুমি কী পাবে?!

পারলে একটু নিরপেক্ষভাবে গাইরে মুকাল্লিদ শায়খ (মাদখালি হোক বা না হোক) আর মাযহাবপন্থী শায়খদের ইলমের মধ্যে তুলনা করে দেখো। আখের একপক্ষে অস্থিরতা ও খালি কলসি ছাড়া আর কিছুই পাবে না। পাওয়ার কথাও নয়।

হাঁ, আমাদের একথাগুলো ফিকহের ক্ষেত্রে; আকিদার ক্ষেত্রে নয়। আকিদার ক্ষেত্রে আমরা তোমাকে এই চার মাযহাবের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে বলছিও না। আমি তো এমন অনেক ভাইকে দেখেছি, যারা আকিদায় সালাফি, কিন্তু ফিকহে হানাফি। এই ধারা পূর্ব থেকেই চলে আসছে। যেমন তাফসিরে কাশশাফের রচয়িতা জারুল্লাহ যামাখশারি রহ. ছিলেন আকিদায় মু’তাযিলি, আর ফিকহে হানাফি। এটা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।

এখন তো আবার আরেক সমস্যা। তাওহিদ আকিদা শব্দগুলো উচ্চারণ করলেও লোকে ভাবে সালাফি। সালাফি ছাড়া অন্য কারো যেনো এই শব্দগুলো উচ্চারণ করারই বৈধতা নেই। এসবই যেনো তাদের একচ্ছত্র সম্পত্তি। অনেক ভাইকে তো দেখা যায়, তারা তাওহিদ বলতে বোঝেন শুধু আশ’আরি-মাতুরিদির লড়াই আর এঁদের সঙ্গে সালাফিদের বিবাদ। যাক, সে হলো অন্য প্রসঙ্গ।

Share This