হযরত মুআবিয়া রা.। প্রিয় রাসুল মুহাম্মাদে আরাবি সা.এর মহান সাহাবিগণের মোবারক কাফেলার এক মহান ব্যক্তিত্ব। নবি-উদ্যানের এক সুরভিত পুষ্প। ইমান ও সত্যের আকাশে এক জ্যোতির্ময় তারকা। মক্কা বিজয়ের পুণ্যলগ্নে ইসলাম গ্রহণের পর থেকে কোরআন অবতরণের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওহি লেখার সুমহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন আলোকিত এই সাহাবি। এ মহান সৌভাগ্য সাহাবিগণের মাহফিলে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো সম্মান ও মর্যাদার শিখরে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কাননে। রাসুলে খোদাও প্রাণভরে দোয়া করেছিলেন জীবন সায়াণ্‌হে পাওয়া এই কুড়ানো মানিকটির জন্য। – ‘খোদা হে, মুআবিয়াকে তুমি পথপ্রাপ্ত ও পথপ্রদর্শক বানাও এবং তার মাধ্যমে মানবতাকে হেদায়াত দান করো। [তিরমিযি]

হযরত আলী রা.এর মর্মান্তিক শাহাদাতের পর তাঁর শাসনকালই ছিলো ইসলামি ইতিহাসের উজ্জ্বলতম যুগ। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তখন বিরাজমান ছিলো সুখ শান্তি স্থিতি ও নিরাপত্তা। বহিঃশত্রুর মন ও মানসজুড়ে ছিলো ইসলামি খেলাফতের অপ্রতিহত প্রভাব। ফলে মুসলিম জাহানের সীমান্তের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস ছিলো না তাদের। কিন্তু সীমাহীন লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়য়- ইসলামের মুখোশহীন ও মুখোশধারী শত্রুরা নবিজির এই প্রিয় সাহাবির বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ও প্রচারণার এমন ধূম্রজাল সৃষ্টি করে রেখেছে যে, ইসলামি ইতিহাসের এ স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় আজ হারিয়ে গেছে মুসলিম উম্মাহর দৃষ্টিপথ থেকে। এই মাজলুম সাহাবির চরিত্র হননে এমন কোনো অপকৌশল বোধহয় নেই, যা শত্রুরা ব্যবহার করেনি। ইসলামি ইতিহাসের আর কোনো ব্যক্তিত্বের প্রতি ওরা এতোটা নগ্ন, এতোটা নির্মম হয়নি।

সাধারণ ইতিহাস-পাঠকের দৃষ্টিতে প্রিয়নবির স্নেহধন্য সাহাবি মুআবিয়া রা.এর পরিচয় আজ এই দাঁড়িয়েছে যে, ‘ক্ষমতার মসনদ ছিলো তার স্বপ্ন। হত্যা ও রক্তপাত ছিলো তার নেশা। অত্যাচার ও ধোঁকাবাজি ছিলো তার পেশা। ক্ষমতার অন্ধ মোহই তাকে মাতিয়ে তুলেছিলো হযরত আলী রা.এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে। এবং…। আকারে ইনসান, প্রকারে শয়তান- এই হলো আজ তার পেহচান।’

প্রচারণার এই ধূম্রজালে উম্মাহ আজ বিস্মৃত হতে চলেছে যে, হযরত মুআবিয়া রা. হলেন ইসলামি ইতিহাসের প্রথম নৌবহর প্রতিষ্ঠার অনন্য গৌরবের অধিকারী ব্যক্তি, যার সম্পর্কে রাসুলে খোদার সুসংবাদ হলো- আমার উম্মতের প্রথম যে সৈন্যদলটি নৌ-অভিযানে অংশ নিবে তাদের জন্য জান্নাত অপরিহার্য হয়ে যাবে। [বুখারি]

জীবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো তার কেটেছে রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জিহাদের ময়দানে এবং ইসলামি খেলাফতের সীমান্ত সুরক্ষায় নাঙ্গা তলোয়ার হাতে, আরবি ঘোড়ার পিঠে। তরবারির আঁচড় কেটে একদিকে তিনি ইসলামি খেলাফতের সবুজ মানচিত্রে যোগ করে নিয়েছিলেন সাইপ্রাস ও রোডেসিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সব অঞ্চল, অন্যদিকে নিজের অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের গুণে দ্বিধা-বিভক্ত ইসলামি উম্মাহকে পুনঃঐক্যবদ্ধ করেছিলেন হিলালি ঝাণ্ডার ছায়াতলে।

তিনি ছিলেন ইলম ও আমলের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, ইনসাফ ও বিশ্বস্ততার মূর্ত প্রতীক, ধৈর্য ও সহনশীলতার অনুকরণীয় আদর্শ।

তিনি ছিলেন সেই আলোজিত কাফেলার একজন, যাদের ব্যাপারে আলকোরআনের ভাষ্য হলো- আল্লাহ সন্তুষ্ট তাদের প্রতি। তারাও সন্তুষ্ট আল্লাহর প্রতি। যাদের ব্যাপারে হাদিসের ভাষয় হলো- আমার সাহাবিরা তারকাতুল্য। তিমিরাচ্ছন্ন রাতে আকাশে তারার মেলা দেখে পথহারা পথিক যেমন খুঁজ পায় তার পথ, রাসুলের কোনো সাহাবির অনুসরণ করে আঁধারের অতল সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাতি তেমনই খুঁজে পায় জান্নাতের পথ। কারণ আলোকিত এই কাফেলার সকলেই ছিলেন প্রবৃত্তির মলিনতা থেকে চির পবিত্র। মনবতার কল্যাণে, খোদার রাহে সংগ্রামে তাদের জীবন ছিলো উৎসর্গিত। ইসলামের হেলালি নিশান ওড়াতে যে অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন অম্লানবদনে তারা সয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা চির অতুলনীয়।

অজ্ঞ ও মূর্খ লোকদের মনভোলান মিষ্টি কথায় প্রভাবিত হয়ে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, হযরত মুআবিয়া রা. সেই কাফেলার একজন, যাদের মতো করে ইমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। ইরশাদ হয়েছে- ‘ইমান আনো তোমরা, যেমন ইমান এনেছে লোকেরা (সাহাবিরা)।’[সুরা বাকারা]। পার্থিব জীবনের মোহে পড়ে মুআবিয়া রা. (নাউযুবিল্লাহ) ইমানহারা হয়ে গিয়েছিলেন- এ কথা কেউ বিশ্বাস করলে তা হবে মহাগ্রন্থ আলকোরআন অস্বীকার করার নামান্তর।

আল্লামা ইবন কাসির রহ. তার সুপ্রসিদ্ধ তাফসিরগ্রন্থে লিখেছেন- হযরত আলী রা. ছিলেন নির্ভুল পথে। তবে মুজতাহিদ হওয়ার কারণে মুআবিয়া রা.ও প্রতিদান লাভ করবেন। এটাই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব।

সাহাবিগণ অকপটে এ কথা স্বীকার করতেন যে, খোলাফায়ে রাশেদিন ও মুআবিয়া রা.এর শাসনামলে পার্থক্য ছিলো। প্রিয়নবির হাদিসও এ কথা বলে। তবে তা ছিলো পূর্ণ ও পূর্ণতরের পার্থক্য, উজ্জ্বল ও উজ্জ্বলতরের পার্থক্য। কাদেসিয়ার মহান সেনাপতি হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. বলেন- উসমানের পরে মুআবিয়ার চেয়ে অধিক সুবিচারকারী কাউকে আমি দেখিনি। পরবর্তী যুগের বরেণ্য ব্যক্তিগণও তাঁকে সে চোখেই দেখেছেন। জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম আমাশের মজলিসে খলিফাতুল মুসলিমিন উমর ইবনে আব্দুল আযিয রহ.এর ইনসাফ ও সুবিচারের কথা উঠলে তিনি বললেন- উমর ইবনে আব্দুল আযিযের সুবিচারেই তোমরা মুগ্ধ! হযরত মুআবিয়াকে যদি দেখতে তবে তোমাদের কী অবস্থা হতো!! হযরত কাতাদাহ, মুজাহিদ ও আবু ইসহাক রহ.এর  মতো বিশিষ্ট তাবেয়িগণ সে যুগের লোকদের সম্বোধন করে বলতেন- হযরত মুআবিয়ার শাসনামল দেখার সৌভাগ্য তোমাদের হলে তোমরা তাকে সুপথপ্রাপ্ত বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হতে।

অধুনা যে ইতিহাস আমাদের হাতে পৌঁছেছে, তাতে যেহেতু মারাত্মক রকমের বিকৃতি সাধন করেছে কাফির-বেইমানেরা, তাই ইতিহাস পাঠকের দায়িত্ব, পঠিত ইতিহাস গ্রহণের ক্ষেত্রে কোরআন ও হাদিসকে মানদণ্ডরূপে ব্যবহার করা। যাতে ভ্রান্তির জালে আটকে গিয়ে ইমানের আলোকচ্ছটায় উদ্দীপ্ত, প্রিয় রাসুলের ঘনিষ্ট সাহাবিগণকে গালমন্দ করার আস্পর্ধা কখনো না হয়। মহানবি সা. বলেছেন- আমার সাহাবিদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। আমার মৃত্যুর পরে তাদেরকে সমালোচনার পাত্র বানিও না। (তিরমিযি, মিশকাত)

হযরত ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন- যখন তোমরা সেসব লোকদেরকে দেখবে, যারা আমার সাহাবিদেরকে মন্দ বলে, তখন তোমরা তাদেরকে বলে দিবে, তোদের এই অশুভ কাজের ওপর আল্লাহর লানত। [তিরমিযি, মিশকাত]

‘আলোর পথে’র গত ঈদ সংখ্যায় জনাব আনোয়ার হোসেন লালন হযরত মুআবিয়া রা.এর যে চিত্র এঁকেছেন, তার ব্যাপারে শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে যে চরম সীমালঙ্ঘন করেছেন- সত্যিই তা বড় দুঃখজনক। ইমানদীপ্ত মুসলিম সমাজ তার লেখা পড়ে ভারি মর্মাহত। ইসলামের সেবার আড়ালে, পথপ্রদর্শকের মুখোশ পরে সমাজে ভ্রান্তি ছড়ালে তা যে বড় নিন্দনীয়- এতে নিশ্চয়ই কেউ সন্দেহ পোষণ করবে না। তার বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখার কলেবর বাড়াবো না। কারো ইচ্ছে হলে ঈদ সংখ্যা দেখে নিতে পারেন। প্রিয়নবির স্নেহধন্য এক মহান সাহাবি হযরত আমিরে মুআবিয়া রা.এর শানে তিনি যে গোস্তাখি করেছেন, দুঃসাহস দেখিয়েছেন জেনে-বুঝে তা করে থাকলে এতা তার ইমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর অজ্ঞতাবশত করে থাকলে তার উচিত আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করা ও নিজের ভুল স্বীকার করে পুনরায় কোনো লেখা দেয়া। নিজের জ্ঞান সীমানার বাইরের কোনো বিষ্যে হস্তক্ষেপ না করাই উচিত। তা লেখা পড়ে একজন মানুষও যদি পথভ্রষ্ট হন, আল্লাহ তাআলার কাঠগড়ায় তিনি এর দায় সামলাতে পারবন কি!

পাঠকদের সামনে হযরত মুআবিয়া রা.এর মর্যাদা ও অবস্থান যাতে সুস্পষ্ট হয়, তাই বিষয়টির প্রতি আরেকটু আলোকপাত করা সঙ্গত কনে করছি।

প্রথমেই আমাদেরকে বুঝতে হবে হযরত আলী রা. এবং হযরত মুআবিয়া রা.- উভয়ের ইচ্ছাই ছিলো সৎ এবং উদ্দেশ্য ছিলো মহৎ। সদিচ্ছা নিয়েই তারা মতবিরোধ করেছেন। কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়। হযরত মুআবিয়া রা. ভাবছিলেম, আলী রা. উসমান রা.এর ঘাতকদের বিচারপ্রক্রিয়া কেনো বিলম্বিত করতে চাচ্ছেন? ককীভাবে ঘাতকরা তার সৈন্যবাহিনীতে আশ্রয়-স্থান পাচ্ছে? হযরত উসমান রা.কে যারা শহিদ করেছে, তারা তো প্রশ্রয় পেতে পারে না এক মুহূর্তের জন্যও। এমন সুরাচার অপরাধী-ঘাতক পাপিষ্ঠদের উপস্থিতিতে আমরা কী করে হযরত আলীর খেলাফতের অধীনে অন্তর্ভুক্ত হতে পারি! অপরদিকে হযরত আলী রা. ভাবছিলেন- এতো অধিক সংখ্যক মানুষকে তিনি কীভাবে এখনই ধরে শাস্তি দিবেন? হযরত মুআবিয়া রা. আগে খেলাফত মেনে নিবেন, তারপর ইসলামি সাম্রাজ্যের শাসনকার্য সুসংহত করে অপরাধীদেরকে শাস্তি দেয়া হবে। সেটা তখন অনেক সহজও হবে।

মূলত দৃষ্টিভঙ্গি ও মতের ভিন্নতার কারণে মহান দুই সাহাবির মাঝে সংঘটিত হয় যুদ্ধ। ক্ষমতার মোহে পড়ে মুআবিয়া রা. যুদ্ধে লিপ্ত হননি। বিকৃত ইতিহাসকে কোরআন-হাদিসের কষ্টিপাথপরে যাচাই করার যোগ্যতা যাদের নেই, ইতিহাস নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকারই তাদের নেই। অযথা নিজের ইমান বিকিয়ে জাহান্নামের পথে পা বাড়ানো কি চরম নির্বুদ্ধিতা নয়!

পরিশেষে সম্পাদকমণ্ডলীর উদ্দেশে কয়েকটি কথা লিখছি। আজেবাজে লেখকদের লেখা ছেপে ‘আলোর পথে’র শুভযাত্রা ব্যাহত করা উচিত হবে না বলে আমরা মনে করি। ইসলামি পত্রিকা নাম বহন করে ভেতরে ইসলামেরই অনিষ্ট সাধন করাটা কেমন! ‘কারবালার কান্না’ উপন্যাসটি ছেপে মুসলিম জনতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটানোর হেতু কী? আশা করি, এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পাঠক-হৃদয়কে শান্ত করা হবে। নয়তো বাংলাদেশের মুসলমানরা ‘আলোর পথে’র ব্যাপারে নতুন করে কিছু ভাবতে বাধ্য হবে। ‘আলোর পথে’ হোক আলোর পথের প্রদর্শক- এই প্রত্যাশায়…।

 

পাঁচ বছর আগের ঘটনা। বাইতুস সালামে আমার পঞ্চম বর্ষের শুরুর কথা। মাসিক আলোর পথের সে বছরের ঈদ সংখ্যায় কারবালার ঘটনা নিয়ে আনোয়ার হোসেন লালনের একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক উপন্যাস- ‘কারবালার কান্না’ প্রকাশিত হয়। লেখক তার পুরো লেখায় আমিরে মুআবিয়া রা.র বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ ঝেড়েছেন। মুআবিয়া রা. ও তাঁর অনুসারীদেরকে খারেজি-কাফির প্রমাণিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। শ্রদ্ধেয় উস্তাদ লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক মাওলানা খন্দকার মনসুর আহমদ দা. বা.র নির্দেশে তখন নিচের লেখাটি প্রস্তুত করি। একই পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। শিরোনামও মুহতারাম উস্তাদের নির্দেশে এটাই দেয়া হয়। পরবর্তীতে তারা অবশ্য শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করে, পুরো লেখার কাঠামো ঠিক রেখে তা প্রকাশ করে। তদের দেয়া শিরোনাম ছিলো- ‘হযরত মুআবিয়া রা. ছিলেন একজন উঁচু মাপের সাহাবি’।

Share This