১.

জিনরা মানুষের মতোই শ্রেণিবিভক্ত। মুসলমান কাফির, ভালো মন্দ, আস্তিক নাস্তিক— এগুলো যেমন মানুষের মধ্যে আছে, তেমনি জিনদের মধ্যেও আছে। জিনদের ভাষায়—

وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَلِكَ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا

নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে কতক রয়েছে সৎকর্মপরায়ণ আর কতক রয়েছে এরচে ভিন্ন। আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথের অনুসারী। {সুরা জিন: ১১}

وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا الْقَاسِطُونَ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولَئِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا وَأَمَّا الْقَاسِطُونَ فَكَانُوا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا

আমাদের মধ্যে কতক মুসলিম হয়ে গেছে আর কতক রয়েছে জালিম। তো যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা হেদায়াতের পথ খুঁজে পেয়েছে। আর যারা জালিম, তারা হবে জাহান্নামের ইন্ধন। {সুরা জিন: ১৪-১৫}

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, “জিনরা বিভিন্ন ধর্মাবলাম্বী, যেমনটা আলিমগণ বলেছেন। জিনদের মধ্যে মুসলিম মুশরিক খ্রিস্টান সুন্নি বেদাতি সবই রয়েছে। জিনদের মধ্যে কাফির ফাসিক বদকার রয়েছে। প্রত্যেক শ্রেণির জিন তার অনুরূপ মানব শ্রেণির প্রতি আকর্ষিত হয়। ইহুদি জিন ইহুদি মানুষের সাথে, খ্রিস্টান জিন খ্রিস্টান মানুষের সাথে, মুসলমান মুসলমানের সাথে, ফাসিক ফাসিকের সাথে, জাহেল বেদাতি জিন অনুরূপ জাহেল বেদাতি মানুষের সাথে (সম্পর্ক গড়ে)। {মাজমুউল ফাতাওয়া: ১১/৩০৬, ১৯/৩৯, ৮/৫৩৪; মাজমুআতুর রাসায়িল আলকুবরা: ১/৬৬}

 

২.

পুরো দুনিয়া এক নেযামের অধীনে চলে। সুন্নাতুল্লাহ হলো, মুমিন এবং যিন্দিক-কাফিরদের মাঝে, আহলুত তাওহিদ এবং আহলুশ শিরকের মাঝে বিবাদ-লড়াই ঘাত-প্রতিঘাত জারি থাকবে। আল্লাহ তাআলা একদলের দ্বারা অপরদলকে প্রতিহত করবেন। এর মাধ্যমে দুনিয়ার নেযাম ঠিক থাকবে এবং টিকে থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ

আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলের দ্বারা অপরদলকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ তাআলা জগতসমূহের ওপর অনুগ্রহশীল। {সুরা বাকারা: ২৫১}

وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ

আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অন্য দলের মাধ্যমে প্রতিহত না করতেন, তবে ধ্বংস করে দেয়া হতো খানকাহ গীর্জা ইবাদতখানা ও মসজিদসমূহ— যাতে আল্লাহ তাআলার যিকির হয় বেশি-বেশি। আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাহায্য করবেন, যারা তার দীনের সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান পরাক্রমশালী। {সুরা হজ: ৪০}

মানুষের মধ্যে যেমন হারবি কাফির রয়েছে, যাদের সঙ্গে লড়াই করার বৈধতা শরিয়তই ঘোষণা করেছে এবং যারা নিজেদের মুখের ফুৎকারে ইসলামের দীপ্ত মশালকে নিভিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর, তেমনি জিনের মধ্যেও এই শ্রেণি রয়েছে, যারা সুযোগ পেলেই মুমিন জিন সম্প্রদায়ের ওপর চড়াও হয় এবং জিনসমাজ থেকে ইসলামকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিতে চায়। আবার অমুসলিম জিনদের মধ্যে আহদ-চুক্তিকারী জিনও রয়েছে।

قال شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله: “الجن الكفار كانوا يقاتلون الجن المؤمنين”.اهـ [مجموع الفتاوى 18/360]

“فنبينا صلى الله عليه وسلم هو مع الجن كما هو مع الإنس, والإنس معه إما مؤمن به, وإما مسلم له, وإما مسالم له, وإما خائف منه, كذلك الجن منهم المؤمن به, ومنهم المسلم له مع نفاق, ومنهم المعاهد المسالم لمؤمني الجن, ومنهم الحربي الخائف من المؤمنين”.اهـ [النبوات ص397].

কোরআন-সুন্নাহর অধিকাংশ নসই বর্ণিত হয়েছে সালাত এবং জিহাদের ব্যাপারে। কোরআন-সুন্নাহর সম্বোধিত পাত্র শুধু মানুষ নয়, বরং জিনও। ইসলাম জিন এবং ইনসানের জন্য। রাসুলুল্লাহ সা. জিন এবং ইনসানের নবি। যুগে যুগে মানুষেরা যেমন জিহাদ করেছে, জিনেরাও করেছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, “সুলায়মান আ. ছিলেন মহান যোদ্ধা, প্রায়শই তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। জলে-স্থলে তার যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করতেন। একদা তিনি এক সমুদ্র উপদ্বীপের (অত্যাচারী) শাসকের ব্যাপারে অবগত হন, অনন্তর সুলায়মান সা. তার মানুষ ও জিন বাহিনী নিয়ে বাতাসে চড়ে সেই সমুদ্র উপদ্বীপে গিয়ে অবতরণ করেন। এরপর তিনি সেখানকার শাসককে হত্যা করেন এবং সকল নাগরিককে বন্দি করেন। … {কিতাবুত তাওয়াবিনঃ ১৬}

এ প্রেক্ষিতেই শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, এই মূলনীতির ওপর তথা জিনেরা হজ করে সালাত আদায় করে জিহাদ করে এবং তারা গুনাহের শাস্তি পাবে— প্রমাণবহনকারী আয়াত হাদিসে বর্ণিত দলিলের সংখ্যা অত্যাধিক।” {মাজমুউল ফাতাওয়াঃ ৪/২৩৬, ৪/৪৯৪}

জিনদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের সর্বমোট সংখ্যা এবং তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া তো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে দু-চারটি ঘটনার কথা বর্ণনায় পাওয়া যায়। যেমন—

ইমাম বাইহাকি রহ. তার গ্রন্থে (৭/৪৪৫-৪৪৬) বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন, “আব্দুর রহমান ইবনে আবি লাইলা বলেন, তার সম্প্রদায়ের একজন আনসারি ব্যক্তি কাওমের অন্যান্য লোকদের সাথে এশার সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়। তখন এক জিন তাকে বন্দি করে ফেলে। আচমকা সে গায়েব হয়ে যায়। অনন্তর তার স্ত্রী উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর কাছে গিয়ে সবিস্তারে ঘটনা জানায়। উমর রা. সেই সম্প্রদায়ের লোকদেরকে এই ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তারাও এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলে, হাঁ, সে এশার নামাজ পড়তে বেরিয়ে আচমকা হারিয়ে যায়। উমর রা. সেই নারীকে চার বছর অপেক্ষা করতে বলেন। চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেই নারী এসে উমর রা. কে জানায়। উমর রা. সেই সম্প্রদায়ের লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারাও স্বীকৃতি জানায়। অনন্তর উমর রা. সেই নারীকে বিয়ে করার জন্য আদেশ দেন। এরপর সে বিয়েও করে ফেলে।

এর কিছুকাল পর তার স্বামী ফিরে এসে উমর রা. এর সাথে বিবাদে লিপ্ত হলো। উমর রা. বললেন, তোমাদের একেকজন সুদীর্ঘকাল গায়েব থাকবে আর তার পরিজন তার বেঁচে থাকার ব্যাপারে কিছুই জানবে না! তখন সে বললো, হে আমিরুল মুমিনিন, আমার ওযর ছিলো। উমর রা. বললেন, কী ওযর? সে বললো, আমি এশার সালাত আদায় করার জন্য বেরিয়েছিলাম। অনন্তর এক জিন আমাকে বন্দি করে ফেললো। আমি দীর্ঘকাল তাদের মাঝেই বাস করেছি। আমাকে বন্দি করার পর তাদের ওপর মুমিন (বর্ণনাকারী সাঈদ বলেন, শব্দটা মুমিন অথবা মুসলিম বলেছেন।) জিনেরা আক্রমণ করে। অনন্তর মুমিন জিনেরা বিজয় লাভ করে এবং তাদের অনেককেই বন্দি করে ফেলে। মুমিন জিনদের হাতে যারা বন্দি হয়েছে, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। এরপর তারা আমাকে বললো, আমরা তো দেখছি, তুমি একজন মুসলিম। তোমাকে বন্দি করা আমাদের জন্য জায়েয হবে না। তখন তারা আমাকে তাদের মাঝে থাকার বা পরিজনের কাছে ফিরে আসার এখতিয়ার দিলো। আমি পরিজনের কাছে ফিরে আসার এখতিয়ার গ্রহণ করলাম। অনন্তর তারা আমার সাথে এলো। রাতে কিছুই ঘটতো না আর দিনে এক ঝঞ্জাবায়ুকে অনুসরণ করে আমি পথ চলতাম। উমর রা. বললেন, তাদের মাঝে অবস্থানকালে তোমার খাবার কী ছিলো? সে বললো, শিম এবং আল্লাহর নাম নেয়া ছাড়া জবাইকৃত পশু। উমর রা. বললেন, তাহলে পানীয় কী ছিলো? সে বললো, জাযাফ। এরপর উমর রা. তাকে মোহর পরিশোধ করে দেয়া বা স্ত্রীকে গ্রহণ করার মাঝে এখতিয়ার দিলেন।

তেমনিভাবে হিজরতের পূর্বে নেককার জিনরা বদকার জিনদের ওপর চড়াও হতো। যারা রাসুলুল্লাহ সা. কে গালি দিতো, নেককার জিনরা তাদেরকে হত্যা করে ফেলতো। {আলইসতিকামাহঃ ১/১৯৬}

সাঈদ ইবনে ইয়াহইয়া রহ. তার মাগাযি গ্রন্থে বর্ণনা করেন, “ইবনে আব্বাস রা. বলেন, একবার এক (অদৃশ্য) চিৎকারকারী জাবালে আবু কায়সের ওপর থেকে এই কবিতা আবৃত্তি করলো—

قبَّحَ الله رأيَكُمْ آل فِهرٍ

ماأدقَّالعُقولَوالأحلام

حينَتُغضيلمنيَعيبُعليها

دينَآبائِهاالحُماةِالكرامِ

حالفَالجنّجنَّبُصرىعليكمْ

ورِجالالنَّخيلِوالآطامِ

تُوشكُالخيلُتَروهانهاراً

تقتلُالقومفيحرامِتهامِ

هلكريمٌمنكمْلهنفسُحرٍّ

ماجدُالجَدَّتينِوالأعمامِ

ضارباًضربةًتكونُنكالاً

وروَاحاً من كُربةٍ واغتنامِ

মক্কাবাসীর মধ্যে এই কবিতা ব্যাপকভাবে চর্চিত হতে থাকলো। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, এই হচ্ছে এক শয়তান, যে মূর্তির ভেতর থেকে মানুষের সাথে কথা বলে। আল্লাহ ওকে লাঞ্ছিত করবেন। তিনদিন পর পাহাড়ের ওপর থেকে সেই বেয়াদবের হত্যার সংবাদ ঘোষিত হলো—

نحنُ قتلنا في ثلاثٍ مسعرا

إذ سفَّه الحقَّ وسَنَّ المُنكرا

قَنَّعتُهُ سيفاً حُساماً مُبترا

بشَتْمِهِ نبيِّنا المُطَهرا

এরপর রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—

فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (هذا عفريت من الجن اسمه سَمحَج, آمن بي, سميته عبد الله, أخبرني أنه في طلبه منذ ثلاثة أيام) فقال علي رضي الله عنه: جزاه الله خيراً يا رسول الله”.اهـ

أخرجه الطبراني في الكبير, وأبو سعيد النقاش في فنون العجائب برقم (92), وأبو بكر الشافعي في الغيلانيات رقم 696, والشيرازي في الألقاب, والدارقطني في الأفراد, وقال الحافظ ابن كثير رحمه الله: “وقد روينا في الغيلانيات خبراً من حديث رجل منهم يقال له عبد الله بن سمحج, وفي إسناده غرابة”.اهـ [الفصول ص247].

 

৩.

উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে প্রতিভাত হলো, জিনদের মধ্যেও মুমিন-কাফির, মুসলিম-অমুসলিম রয়েছে। এখন বিষয় হলো, মুমিনদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র এবং অমুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র তথা দারুল ইসলাম এবং দারুল হারবের বিভাজন আছে কিনা— এই আলোচনা কোথাও চোখে পড়েনি। তবে বাহ্যত মনে হয়, বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের বসবাস এবং অবিশ্বাসীদের বসবাস একত্রে নয়; উপরিউক্ত সাহাবিকে বন্দিকারী অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকারীদের বর্ণনা থেকে যেমনটা অনুমিত হয়। তবে মুমিন জিনরা নাস্তিক মুরতাদ এবং গোস্তাখে রাসুলকে যে নির্দ্বিধায় হত্যা করে ফেলতো— এ কথা তো ‘আলইসতিকামা’ গ্রন্থেই উল্লেখিত হয়েছে। মুসলমানরা মক্কায় থাকাবস্থায়ই জিনেরা যুদ্ধাভিযান শুরু করেছিলো। কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী প্রথমত রাসুলুল্লাহ সা. এর অনুমতি ছাড়াই তারা এই কাজ করেছে। পরে অবশ্য রাসুলুল্লাহ সা. তাদের সেই কাজকে অনুমোদন করেছেন।

 

পুনশ্চ:

এই হলো জিন সম্প্রদায়ের জঙ্গিবাদের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত। কারো কারো সামনে হয়তো এই আলোচনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এবার জিনজাতির জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধেও একলক্ষ বা ততোধিক আলিমের স্বাক্ষরিত ফতোয়া প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। জিনদের জন্য আইনও তৈরি করা যেতে পারে। জেলখানার আলাদা একটি সেল জঙ্গি জিনদের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে। ওয়াসসালাম।

Share This